ইউ টার্ন
ইউ টার্ন শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয় পলিটিক্সে। মোগল আমলে মীর জাফর আলী খান বোধহয় সর্বপ্রথম ইউ টার্ন নিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধে তার নেওয়া ইউ টার্ন আদতে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছে।
সাধারণত ইউ টার্ন বলতে আমি বুঝি, সোজা রাস্তায় চলা কোনও যানবাহন বাঁক বদল করে আবার সেই দিকেই ফিরে আসাকো। মানুষও এমনটি করে থাকে। মানুষের বেলায় ইউ টার্ন না বলে বলা হয়, পল্টি লওয়া বা পল্টিবাজি।
রুকিয়ার সঙ্গে দেখা না হলে পল্টিবাজি সম্পর্কে আমার ধারণা অসম্পূর্ণ থাকতো।
শীতের ছুটিতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আমি কক্সবাজার বেড়াতে এসেছি আর রুকিয়া এসেছে তার স্বামীকে নিয়ে। সী গাল হোটেলের ডিলাক্স হিল সাইডের একটা রুমে আমরা উঠেছি। তবে এমন বিলাসবহুল রুমে মাঝ রাতে এসে শুধু ঘুমানোর সময়টা ছাড়া বেশিক্ষণ অবস্থান করা হয় না। গত চারদিন ধরে পুরো কক্সবাজার চষে বেড়াচ্ছি আমরা। অফিস থেকে পাঁচদিন ছুটি নিয়েছিলাম। চারদিন শেষ। আগামিকালই ফিরত হবে অফিসে। সকালে দোলা মনে করিয়ে দিল, ‘সমুদ্র দেখতে এসে সূর্যাস্ত না দেখেই চলে যাবা?’
‘আরে তাই তো!’ যেন হঠাৎ মনে পড়ল আমার।
ঠিক করলাম, আজ বিকেলে অন্য কোথাও যাব না। সোজা সৈকতে চলে যাব। আবিরের রঙে যখন রাঙা হয়ে উঠবে পশ্চিম দিগন্ত তখন সূর্যটা কীভাবে তার গহ্বরে হারিয়ে যায় তা দেখব।
দোলা শাড়ি পরেছে। মেরুন রঙের। আমি পরেছি পাঞ্জাবি। আমার পাঞ্জাবি কফি রঙের। দোলার শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে পাঞ্জাবি পাওয়া যায়নি। তাই দুজনের পোশাকের রং ম্যাচিং হয়নি। তবে মেরুন রঙের সঙ্গে কফি রংয়ের কিছুটা মিল আছে। তা-ই পরে সৈকতে চলে এলাম। এখানে এসে বালির ওপর দাঁড়িয়ে দিগন্তের গহ্বরে ডুবতে থাকা সূর্যটাকে দেখে মনে হলো, আবির রঙা দিগন্তের বিশাল ক্যানভাসে কোনও শিল্পী একটা লাল বৃত্ত এঁকে রেখেছে।
পায়ের নিচে বালি, মাঝখানে বিশাল সমুদ্র, নীল জলরাশি, ঊর্মিমালা, সমুদ্র ও দিগন্তের মিলনরেখায় লাল সূর্য- আহা! কী চমৎকার দৃশ্য! মুঠোফোনের ক্যামেরায় দৃশ্যটা ধারণ করার পরও মন তুষ্ট হল না। ভ্যান গগের মতো শিল্পী হলে এখনই একটা ছবি আঁকতে বসে যেতাম। কিছু দৃশ্য আছে ক্যামেরায় ধারণ করে রাখার পরও মন তুষ্ট হয় না। মজাদার কোনও খাবার খাওয়ার পর যেমন জিভে স্বাদসুধা লেগে থাকে, তেমনই।
সমুদ্রের ঊর্মিমালার গর্জন, হিম শীতল হাওয়া, রক্তিম সূর্যের নিমীলন আর বালির ওপরে হেঁটে চলার পর ফুটে ওঠা পায়ের রেখা- এসব দৃশ্য যদি অমর করে রাখা যেত! এ কথা ভাবতে ভাবতে আমি এদিক-ওদিক হাঁটছিলাম। অন্য প্রান্তে, দোলা স্থির দাঁড়িয়ে মুঠোফোনের ক্যামেরা অন করে নিবিষ্ট মনে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। সূর্যাস্তের দৃশ্য ধারণ করতে চায়। এজন্য একবারও অন্যদিকে চোখ সরায় না সে।
‘আরে বাদল! কবে এলে এখানে?’
হঠাৎ কোনও মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম। দেখলাম রুকিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে সমুদ্রের নীল জলের মতো নীল রঙের শাড়ি আর কপালে ডুবতে থাকা সূর্যের মতো লাল টিপ। আমি একবার সমুদ্রের ওপাড়ের লাল সূর্যটা দেখি আরেকবার দেখি রুকিয়ার কপালের টিপ। কোনটা সূর্য পার্থক্য করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো।
দোলা অনতি দূরে দাঁড়িয়ে সূর্য, সমুদ্র ও সৈকতের মনোরম দৃশ্যগুলো তার মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত। সূর্যটা তখনও দিগন্তের গহ্বরে ডুব দেয়নি। একবার দোলাকে দেখে নিয়ে আবার রুকিয়ার দিকে চোখ ফেরালাম তখন আমার মনের গ্রামোফোনে রবীন্দ্র সংগীত বেজে চলেছে- ‘আবার দেখা যদি হলো সখা, প্রাণের মাঝে আয়...!’
কপালে সূর্যের মতো লাল টিপ আর রসুনের খোসার মতো পাতলা ও ফর্সা পায়ের নখ- রুকিয়ার আপাদমস্তক অবলোকন করে একটু চমকে উঠলাম। এ তবে রুকিয়া! মাথার চুল দুই ভাগ করে কলাবেণী বেঁধে শাদা ইউনিফর্ম পরে ক্লাসে আসত যে মেয়েটা, যার হাতে থাকত হ্যান্ডনোট লেখার ডায়েরি, সেই মেয়ের হাত ধরে এখন দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি ছোট্ট অথচ ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে। মেয়েটা দেখতে অবিকল রুকিয়ার মতো। বিকেলের শেষ আলো এসে যখন মেয়েটার মুখে পড়ল তখন মনে হলো, রুকিয়ার মুখটাই যেন তার মুখের ওপরে বসানো। মেয়েটা যে রুকিয়ারই সন্তান চেহারার মিল দেখে বুঝতে বাকি রইল না।
মেয়ের মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার তাকালাম মায়ের মুখের দিকে। সাত আট বছর আগের রুকিয়ার সাথে বিস্তর ব্যবধান পেলাম। রুকিয়ার মাঝে কৈশোর অনুত্তীর্ণ সেই চঞ্চলতা নেই। এক রকম গুরু-গম্ভীর ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ভুলটা আমারই হয়েছে। আমি তো পড়ে আছি সাত-আট বছর আগের রুকিয়াকে নিয়ে। ঝর্না যেমন নদী হয়, রুকিয়াও যে মেয়ে থেকে নারী হয়ে গেছে, সেটা আমার বোধে ছিল না। তবে নারী হয়ে ওঠার পর রুকিয়া আরও সুন্দর হয়েছে।
রুকিয়ার পরনে নীল রঙের শাড়ি আর কপালে লাল টিপ, ম্যাচিং হয়নি। রুকিয়া এমনই। কখনও ম্যাচ করে পোশাক পরে না। তার শরীরের যে কোনও পোশাক ম্যাচিং হয়ে যায়। সে কখনও আয়োজন করে সাজে না। তার সাজ বলতে বড়জোর চোখে একরত্তি কাজল পরে, কলেজে পড়ার সময় দেখেছি। কাজল পরলে তার চোখের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। একবার তাকে বলেছিলামও এ কথা। এরপর তাকে আর কখনও কাজল পরতে দেখিনি।
‘...বরং পায়ে আলতা পরলে তোমাকে বেশ লাগে।’
এ কথাটাও বলেছিলাম।
এরপর পায়ে নিয়মিত আলতা পরত রুকিয়া। নূপুরের নিক্বণধ্বনিসমেত রক্তরঙা আলতা পায়ে যখন সে কলেজের সবুজ তৃণের গালিচা বিছানো পথে হাঁটত- আমার মাঝে এক ধরনের দোল তৈরি হতো। সেই দোলের দোলায় দোলায়মান থাকতাম আমি অনিমেষ, অনিমিখ।
নীল শাড়ির সঙ্গে লাল টিপ যায় না। কিন্তু রুকিয়াকে মন্দ লাগছে না। আজ চোখে কাজল পরেছে। সেকি স্বামীর পছন্দে কাজল পরা শুরু করেছে? আর কী কী পছন্দ করে তার স্বামী? পায়ে আলতা পরা পছন্দ করে কি? শাড়ির নিচের পাড়ে ঢেকে আছে রুকিয়ার পা। তাই তার পায়ে আলতা পরেছে কিনা দেখতে পেলাম না। রুকিয়ার চোখজোড়া অবিরাম আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে বারবার পায়ের দিকে তাকাতে অস্বস্তি লাগছে। তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।
রুকিয়া করমর্দনের জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু আমি তার হাতটা ধরতে একটু ইতস্তত করলাম। ইতস্তত করার নেপথ্যে একটা কারণ আছে। দোলা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে একজন মেয়ের সঙ্গে স্বামীকে করমর্দন করতে দেখে কোনও স্ত্রী খুশি হবে না। খুশি হওয়ার কথাও না। তাই রুকিয়ার সঙ্গে আমি করমর্দনও করলাম না।
রুকিয়া আগের চেয়ে একটু মোটা হয়েছে। তার শরীর বদলে যাওয়া, পোশাক-আশাক, কানে, গলায়, হাতে দামি অলংকারের চাকচিক্য দেখে বুঝতে পারলাম তার স্বামী বেশ ধনাঢ্য ব্যক্তি। রুকিয়া তাহলে সুখেই আছে? আমি তার সুখে থাকার কথা ভাবছিলাম যখন ঠিক তখন সে আমার কুশল জানতে চাইল, ‘কেমন আছো তুমি?’
আমি মৃদ কণ্ঠে জবাব দিলাম, ‘ভালো আছি।’
‘কবে এসেছ এখানে? সঙ্গে আর কে এসেছে? বউ নিয়ে এসেছ বুঝি?’
‘হ্যা, আমার সঙ্গে বউ এসেছে। তোমার বর আসেনি?’
‘এসেছে তো।’ বলেই একটু দুরে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্বামীকে হাতের ইশারায় আমাদের কাছে ডাকল। সমুদ্র সৈকতের শাদা ফেনিল জলরাশি আর দূরের আবছা আলোয় তার স্বামীকে অস্পষ্ট দেখতে পেলাম। পুরো চেহারা বুঝতে না পারলেও রুকিয়ার ইশারার জবাবে সম্মতি জানিয়ে সে যে আমাদের দিকে আসতে লাগল সেটা বুঝতে পারলাম।
রুকিয়ার স্বামী আসার আগের এ সময়টুকুতে সিনেমার ফ্লাশব্যাক দৃশ্যের মতো কল্পনায় আমাদের ফেলে আসা দিনগুলো থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
তখন আমি কলেজে পড়তাম। একই কলেজে রুকিয়াও পড়ত। দুজনেরই গ্রুপ ছিল সায়েন্স। প্রতিদিন রুকিয়ার সঙ্গে দেখা হতো। দেখতে দেখতে তার প্রতি ভালো লাগা অনুভব করতে থাকি। কিন্তু রুকিয়াকে ঘুণাক্ষরেও তা বলিনি।
রুকিয়াকে ভালো লাগলেও তার নামটা ভালো লাগত না। কেন জানি মনে হতো, রুকিয়া, সালেহা, আবিদা কিংবা আছিয়া- মেয়েদের এসব নাম নানি-দাদিদের আমলের। তাই একটু সম্পাদনা করে রুকিয়াকে আমি ডাকতাম রুবা। তার আর আমার নামের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলাম নামটা।
রুবার গায়ের রং ধব্ধবে ফর্সা। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, দুধের মতন শাদা নারী। অবশ্য রুবা তখনও নারী হয়ে ওঠেনি। তখনও মাথার চুল দুই ভাগ করে কলাবেণী বেঁধে কৈশোরের চাঞ্চল্য নিয়ে ক্লাসে আসত সে। তো নারী না হয়ে ওঠা সেই কিশোরী রুবার একদিন ভীষণ মন খারাপ। প্রথম ক্লাসের পর ক্যান্টিনের দিকে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম, মাঠের দক্ষিণ দিকের মেহগনিগাছগুলোর নিচে চারজন বান্ধবী তার চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। রুবা বেশ উদ্বিগ্ন, তার চোখের কোণে বেদনার অশ্রু টলমল করছে।
এ রকম একজন মেয়েকে এ অবস্থায় দেখে কিছুটা কষ্ট লাগল আমার। ফর্সা শরীরের মেয়েদের চোখের মণি বেশ কালো হয়। একটু কান্নাতেই জল গড়িয়ে পড়ে। কালো চোখ লাল হয়ে যায়। কালো চোখের মেয়েদের অশ্রুতে বেশ দুঃখী লাগে। কারও দুঃখী মুখ দেখতে আমার ভালো লাগে না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে? কোনও সমস্যা?’
রুবা আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা চারজনের মধ্য থেকে একজন জবাব দিল, ‘রুকিয়ার ভীষণ বিপদ!’
রুকিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই এ এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা আরিফুল হকের ছেলে শাওন তাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। শাওনের বয়স পঁচিশ। শারীরিক গঠন লম্বাটে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল ভেড়ার লোমের মতো। একজন বখাটে ছেলের যে সব গুণাবলি থাকতে হয়, শাওনের সবই আছে।
রুকিয়া সেদিন কলেজে আসার সময় শাওন তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পথরোধ করে দাঁড়ায়। তাকে প্রেম করার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি না হলে অপমান করার হুমকি দেয়। রুকিয়ার একটাই অপরাধ, সে বেশ সুন্দরী। সুন্দরী হওয়ার অপরাধে শাওনের হাত থেকে বাঁচতে রুকিয়া একটু দূরে চায়ের দোকানে কয়েকজন মানুষ দেখে সেখানে ছুটে যায়। চায়ের দোকানের মানুষদের দেখে দলবল নিয়ে কেটে পড়ে শাওন। এমনটা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। নিরুপায় হয়ে রুকিয়া বিকল্প পথ ব্যবহার করে কলেজে আসা-যাওয়া করে। কিন্তু সব পথই তারা দখল করে রাখে। এমনকি পথ মাড়িয়ে কলেজের গেটে পর্যন্ত চলে আসে। তাকে দেখলেই আজেবাজে মন্তব্য করতে থাকে। তুলে নেওয়ারও হুমকি দেয়। পরিস্থিতি একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে রুকিয়া কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। রুকিয়া কলেজে আসে না বলে বান্ধবীরা তার খোঁজ নেয়। তারা বিষয়টা অবগত হয়ে রুকিয়াকে মায়ের কাছে শেয়ার করার পরামর্শ দেয়। রুকিয়া তা-ই করে। সব জেনে মা একটা পথ বের করে। সংসারের কাজ ফেলে মেয়ের সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করতে থাকে। রুকিয়ার সঙ্গে মাকে দেখে শাওন আর পথ রোধ করে দাঁড়ায় না। কিছুদিন নিজেকে আড়াল করে রাখে। রুকিয়া ভাবে, ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে সে। একটানা দুই মাস মা রুকিয়ার সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে ভেবে মা তার সঙ্গে কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। মা সঙ্গে আসে না বলে শাওন আবার কোথা থেকে যেন এসে হাজির হয়। এবার বেশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। সরাসরি তুলে নেওয়ার হুমকি দেয়।
রুকিয়ার বাবা-মা আর বসে থাকেনি। নিজেদের সম্মান ক্ষুণœ হওয়ার ভয়ে এতদিন নীরবে সব সয়ে গিয়েছিল। এবার আর সম্মান ক্ষুণেœর চিন্তার করলে চলবে না। অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ জানিয়ে রুকিয়ার বাবা থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়। কিন্তু পুলিশ সেই অভিযোগ মামলা হিশেবে গ্রহণ করেনি। তাদের পক্ষে কিছুই করার নেই বলে জানায়। কারণ প্রতি বছর শাওনের জন্মদিনে এলাকার চেয়ারম্যান কেক কাটে। শাওনের বাবা আরিফুল হক একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। প্রভাবশালী এক নেতাদের সঙ্গে তার ‘ভাই-ব্রাদার’ সম্পর্ক। তাই পুলিশ আরিফুল হককে বিষয়টা ফয়সালা করার অনুরোধ করে। অপর দিকে, রুকিয়ার বাবা থানায় কোনও সাহায্য না পেয়ে সরাসরি আদালতে অভিযোগ করে। আদালত থেকে থানায় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলে পুলিশ শাওনকে ধরে আনে। শাওনের বাবা আরিফুল হককেও ডেকে আনে। আরিফুল হকের এবার টনক নড়ে। উপায়ন্তর না দেখে সিনিয়র নেতাদের কাছে ছুটে যায়। নেতাদের পরামর্শে ছেলেকে বাঁচাতে তাকে মানসিক রোগীর বলে পরিচয় দেয়। পুলিশ আরিফুল হকের কাছ থেকে মুচলেকা নেয় এবং তার ছেলে আর মেয়েটাকে উত্ত্যক্ত করবে না বলে লিখিত অঙ্গীকার দেয়। রুকিয়ার মা-বাবাও বিষয়টা স্বাভাবিক হয়ে গেছে ভেবে মেয়েকে একা একা কলেজে যেতে দেয়। কয়েকটা দিন সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু এর কিছুদিন পর শাওন আবার বেরিয়ে আসে। সেদিন রুকিয়ার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের গেট পর্যন্ত চলে আসে। আসার সময়টাতে তাকে শ্লীল ও অশ্লীল অনেক কথাই বলে। রুকিয়া কোনও কথায় কর্তপাত না করে সোজা কলেজের গেট পেরিয়ে ক্লাসে চলে আসে। এখানে তার সহপাঠীরা অবস্থান করছিল। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বান্ধবীকে ডেকে বাইরে নিয়ে এসে মেহগনিগাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের এ চরম দুর্দশার কথা জানায় এবং জানতে চায়, এখন এর থেকে বাঁচার উপায় কী?
শাওন আগে শুধু পথে উত্ত্যক্ত করত। আদালতে অভিযোগ করার পর বাসায় এসে হুমকি দিয়ে গেছে। তাই নিজের বাসায় থাকা নিরাপদ নয় বলে রুকিয়া একেক দিন একেক আত্মীয়ের বাসায় রাত্রিযাপন করতে থাকে। ঘটনাটা জানার পর রুকিয়ার ক্লাসমেট হিশেবে আমরা ক’জন বন্ধু তাকে এহেন দুর্দশা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলাম। প্রথমে ভাবলাম, শাওনের সঙ্গে কথা বলব। তাকে বোঝাব। সে যদি বোঝে, তো ভালো। না হলে প্রয়োজনে মারামারি করতেও প্রস্তুত আছি। আমার এমন তেজদীপ্ততার নেপথ্যে একটা কারণ আছে। রুকিয়াকে যে আমার ভালো লাগে। অবশ্য সেটা আর শুধু ভালোলাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভালোবাসা পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে।
ভালোবাসা সব পারে, পাথরে ফোটাতে পারে ফুল
জোয়ারের জলে ভাসাতে পারে মরা নদীর দুই কূল।
ভালোবাসা সব পারে, চৈত্রে আনতে পারে বসন্ত
ফুলে ফুলে সাজাতে পারে জীবনের আদ্যোপান্ত।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নবীনবরণ অনুষ্ঠানে রুকিয়ার কিন্নর কণ্ঠে যেদিন এ কবিতাটা আবৃত্তি শুনেছিলাম সেদিন থেকেই তার প্রতি আমার ভালোলাগা ও ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। এখন ভালোবাসার পরিণতি হিশেবে তাকে জীবনসঙ্গী করে পেতে অপেক্ষায় আছি। রুকিয়ার মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী করে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার ভাগ্য কেমন আমি জানি না। রুকিয়াকে জীবনসঙ্গী করে পেতে দরকার হলে ভাগ্য বদল করে নেব। পৃথিবীতে অনেকেই নিজের ভাগ্য নিজে তৈরি করেছে। আমিও না হয় তা-ই করব।
রুকিয়াকে পেতে ভাগ্য বদল করার প্রথম ধাপ হিশেবে আমি শাওনকে তার পেছন থেকে সরানোর মিশনে নেমে পড়ি। এ ক্ষেত্রে আমাকে একাই শাওনের মুখোমুখি হতে হয়। আমার বন্ধুরা কেউ তার সামনে যাওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু আমি দৈব বলে কোথা থেকে যেন সাহস পেয়েছি। শাওনকে খুঁজে বের করে তাকে অনুরোধ করি রুকিয়ার পেছন থেকে সরে যেতে। উলটো শাওন আমাকে বলে, ‘আমি তো রুকিয়ার পেছনে নই, সামনে আছি। তুমি বরং রুকিয়ার পেছন থেকে সরে যাও।’
তার কথায় আমার পৌরুষে আঘাত লাগে। ইচ্ছে হয়, তাকে তখনই খুন করি। কিন্তু খুন করা আমার কাজ না। আমার কাজ ভালোবাসা।
‘রুকিয়াকে আমি ভালোবাসি।’
এ কথাটা আচমকা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। আর তাতেই শাওন তেলে-বেগুনে জ¦লে ওঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে একটা কল করতেই মিনিট দশেকের মধ্যে তার সব সাঙ্গপাঙ্গ এসে হাজির হয়। প্রত্যেকের হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্প ও ব্যাট। তার পর? তার পর তারা স্ট্যাম্প ও ব্যাট দিয়ে আমার ওপর আঘাত করতে থাকে। আমার মাথা ফেঁটে রক্ত ঝরে পড়ার আগে তাদের আঘাত থামেনি।
তিন ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পর হাসপাতালে নিজেকে আবিষ্কার করি মাথায় ও হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায়। এরপর প্রায় পনের দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরি। বাসায় বেডরেস্টে কেটে যায় আরও সপ্তাহ খানেক সময়। এক মাস পর কলেজে এসে রুকিয়াকে আর খুঁজে পাইনি। তার বান্ধবীদের কাছে জানতে পারি, গত সপ্তায় রুকিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।
আসলে রুকিয়ার বিয়ে হয়নি। রুকিয়াকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাওনের হাত থেকে বাঁচাতে বাবা-মা রুকিয়াকে বিয়ে দিয়েছে।
রুকিয়ার স্বামী আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম, এতটাই চমকে উঠলাম যে, সমুদ্রের শান্ত জলে আচমকা ঘূর্ণিঝড়ের গর্জন শুনতে পেলাম। এ কাকে দেখছি! রুকিয়া বিয়ে করেছে শাওনকে! শাওন এখন রুকিয়ার স্বামী! আমার সঙ্গে এত বড় পল্টি নিল সে!
পরাজিত সৈনিকের মতো আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাওন আমার কাছে এগিয়ে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। এবার আর ইতস্তত করার কোনও সুযোগ নেই। তাই আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। করমর্দন করতে করতে শাওনের দিকে তাকিয়ে আরও অবাক হলাম। তার মাথায় সেই ভেড়ার লোমের মতো চুল নেই। এখন কদমছাট চুল। মুখে খোচা কোচা দাড়ি নেই, এখন একেবারে ক্লিন সেভ। হাঁটুর সামনে খামচি দিয়ে ছিঁড়ে রাখার মতো ছেঁড়া জিন্স প্যান্টের বদলে পরে আছে কালো রঙের গ্যাভাডিন প্যান্ট আর ফুলহাতা শাদা শার্ট। আশ্চর্য! শাওন এতটা ফরমাল হলো কীভাবে?
ভালোবাসা সব পারে, পাথরে ফোটাতে পারে ফুল
জোয়ারের জলে ভাসাতে পারে মরা নদীর দুই কূল।
ভালোবাসা সব পারে...
আমাদের কাছ থেকে কখন যে সরে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল রুকিয়া। শাওন আমার সঙ্গে আর কথা না বলে তার স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে এলাম আমার স্ত্রীর কাছে। দোলা মুঠোফোনের ক্যামেরায় এখনও ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে সেলফি তুলতে লাগল। আমি, দোলা আর সমুদ্রের ওপারের অস্তগামী লাল সূর্যটা সেলফির একটি ফ্রেমে বন্দি হলাম।
ইউ টার্ন
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
ইউ টার্ন শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয় পলিটিক্সে। মোগল আমলে মীর জাফর আলী খান বোধহয় সর্বপ্রথম ইউ টার্ন নিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধে তার নেওয়া ইউ টার্ন আদতে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছে।
সাধারণত ইউ টার্ন বলতে আমি বুঝি, সোজা রাস্তায় চলা কোনও যানবাহন বাঁক বদল করে আবার সেই দিকেই ফিরে আসাকো। মানুষও এমনটি করে থাকে। মানুষের বেলায় ইউ টার্ন না বলে বলা হয়, পল্টি লওয়া বা পল্টিবাজি।
রুকিয়ার সঙ্গে দেখা না হলে পল্টিবাজি সম্পর্কে আমার ধারণা অসম্পূর্ণ থাকতো।
শীতের ছুটিতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আমি কক্সবাজার বেড়াতে এসেছি আর রুকিয়া এসেছে তার স্বামীকে নিয়ে। সী গাল হোটেলের ডিলাক্স হিল সাইডের একটা রুমে আমরা উঠেছি। তবে এমন বিলাসবহুল রুমে মাঝ রাতে এসে শুধু ঘুমানোর সময়টা ছাড়া বেশিক্ষণ অবস্থান করা হয় না। গত চারদিন ধরে পুরো কক্সবাজার চষে বেড়াচ্ছি আমরা। অফিস থেকে পাঁচদিন ছুটি নিয়েছিলাম। চারদিন শেষ। আগামিকালই ফিরত হবে অফিসে। সকালে দোলা মনে করিয়ে দিল, ‘সমুদ্র দেখতে এসে সূর্যাস্ত না দেখেই চলে যাবা?’
‘আরে তাই তো!’ যেন হঠাৎ মনে পড়ল আমার।
ঠিক করলাম, আজ বিকেলে অন্য কোথাও যাব না। সোজা সৈকতে চলে যাব। আবিরের রঙে যখন রাঙা হয়ে উঠবে পশ্চিম দিগন্ত তখন সূর্যটা কীভাবে তার গহ্বরে হারিয়ে যায় তা দেখব।
দোলা শাড়ি পরেছে। মেরুন রঙের। আমি পরেছি পাঞ্জাবি। আমার পাঞ্জাবি কফি রঙের। দোলার শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে পাঞ্জাবি পাওয়া যায়নি। তাই দুজনের পোশাকের রং ম্যাচিং হয়নি। তবে মেরুন রঙের সঙ্গে কফি রংয়ের কিছুটা মিল আছে। তা-ই পরে সৈকতে চলে এলাম। এখানে এসে বালির ওপর দাঁড়িয়ে দিগন্তের গহ্বরে ডুবতে থাকা সূর্যটাকে দেখে মনে হলো, আবির রঙা দিগন্তের বিশাল ক্যানভাসে কোনও শিল্পী একটা লাল বৃত্ত এঁকে রেখেছে।
পায়ের নিচে বালি, মাঝখানে বিশাল সমুদ্র, নীল জলরাশি, ঊর্মিমালা, সমুদ্র ও দিগন্তের মিলনরেখায় লাল সূর্য- আহা! কী চমৎকার দৃশ্য! মুঠোফোনের ক্যামেরায় দৃশ্যটা ধারণ করার পরও মন তুষ্ট হল না। ভ্যান গগের মতো শিল্পী হলে এখনই একটা ছবি আঁকতে বসে যেতাম। কিছু দৃশ্য আছে ক্যামেরায় ধারণ করে রাখার পরও মন তুষ্ট হয় না। মজাদার কোনও খাবার খাওয়ার পর যেমন জিভে স্বাদসুধা লেগে থাকে, তেমনই।
সমুদ্রের ঊর্মিমালার গর্জন, হিম শীতল হাওয়া, রক্তিম সূর্যের নিমীলন আর বালির ওপরে হেঁটে চলার পর ফুটে ওঠা পায়ের রেখা- এসব দৃশ্য যদি অমর করে রাখা যেত! এ কথা ভাবতে ভাবতে আমি এদিক-ওদিক হাঁটছিলাম। অন্য প্রান্তে, দোলা স্থির দাঁড়িয়ে মুঠোফোনের ক্যামেরা অন করে নিবিষ্ট মনে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। সূর্যাস্তের দৃশ্য ধারণ করতে চায়। এজন্য একবারও অন্যদিকে চোখ সরায় না সে।
‘আরে বাদল! কবে এলে এখানে?’
হঠাৎ কোনও মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম। দেখলাম রুকিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে সমুদ্রের নীল জলের মতো নীল রঙের শাড়ি আর কপালে ডুবতে থাকা সূর্যের মতো লাল টিপ। আমি একবার সমুদ্রের ওপাড়ের লাল সূর্যটা দেখি আরেকবার দেখি রুকিয়ার কপালের টিপ। কোনটা সূর্য পার্থক্য করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো।
দোলা অনতি দূরে দাঁড়িয়ে সূর্য, সমুদ্র ও সৈকতের মনোরম দৃশ্যগুলো তার মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত। সূর্যটা তখনও দিগন্তের গহ্বরে ডুব দেয়নি। একবার দোলাকে দেখে নিয়ে আবার রুকিয়ার দিকে চোখ ফেরালাম তখন আমার মনের গ্রামোফোনে রবীন্দ্র সংগীত বেজে চলেছে- ‘আবার দেখা যদি হলো সখা, প্রাণের মাঝে আয়...!’
কপালে সূর্যের মতো লাল টিপ আর রসুনের খোসার মতো পাতলা ও ফর্সা পায়ের নখ- রুকিয়ার আপাদমস্তক অবলোকন করে একটু চমকে উঠলাম। এ তবে রুকিয়া! মাথার চুল দুই ভাগ করে কলাবেণী বেঁধে শাদা ইউনিফর্ম পরে ক্লাসে আসত যে মেয়েটা, যার হাতে থাকত হ্যান্ডনোট লেখার ডায়েরি, সেই মেয়ের হাত ধরে এখন দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি ছোট্ট অথচ ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে। মেয়েটা দেখতে অবিকল রুকিয়ার মতো। বিকেলের শেষ আলো এসে যখন মেয়েটার মুখে পড়ল তখন মনে হলো, রুকিয়ার মুখটাই যেন তার মুখের ওপরে বসানো। মেয়েটা যে রুকিয়ারই সন্তান চেহারার মিল দেখে বুঝতে বাকি রইল না।
মেয়ের মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার তাকালাম মায়ের মুখের দিকে। সাত আট বছর আগের রুকিয়ার সাথে বিস্তর ব্যবধান পেলাম। রুকিয়ার মাঝে কৈশোর অনুত্তীর্ণ সেই চঞ্চলতা নেই। এক রকম গুরু-গম্ভীর ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ভুলটা আমারই হয়েছে। আমি তো পড়ে আছি সাত-আট বছর আগের রুকিয়াকে নিয়ে। ঝর্না যেমন নদী হয়, রুকিয়াও যে মেয়ে থেকে নারী হয়ে গেছে, সেটা আমার বোধে ছিল না। তবে নারী হয়ে ওঠার পর রুকিয়া আরও সুন্দর হয়েছে।
রুকিয়ার পরনে নীল রঙের শাড়ি আর কপালে লাল টিপ, ম্যাচিং হয়নি। রুকিয়া এমনই। কখনও ম্যাচ করে পোশাক পরে না। তার শরীরের যে কোনও পোশাক ম্যাচিং হয়ে যায়। সে কখনও আয়োজন করে সাজে না। তার সাজ বলতে বড়জোর চোখে একরত্তি কাজল পরে, কলেজে পড়ার সময় দেখেছি। কাজল পরলে তার চোখের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। একবার তাকে বলেছিলামও এ কথা। এরপর তাকে আর কখনও কাজল পরতে দেখিনি।
‘...বরং পায়ে আলতা পরলে তোমাকে বেশ লাগে।’
এ কথাটাও বলেছিলাম।
এরপর পায়ে নিয়মিত আলতা পরত রুকিয়া। নূপুরের নিক্বণধ্বনিসমেত রক্তরঙা আলতা পায়ে যখন সে কলেজের সবুজ তৃণের গালিচা বিছানো পথে হাঁটত- আমার মাঝে এক ধরনের দোল তৈরি হতো। সেই দোলের দোলায় দোলায়মান থাকতাম আমি অনিমেষ, অনিমিখ।
নীল শাড়ির সঙ্গে লাল টিপ যায় না। কিন্তু রুকিয়াকে মন্দ লাগছে না। আজ চোখে কাজল পরেছে। সেকি স্বামীর পছন্দে কাজল পরা শুরু করেছে? আর কী কী পছন্দ করে তার স্বামী? পায়ে আলতা পরা পছন্দ করে কি? শাড়ির নিচের পাড়ে ঢেকে আছে রুকিয়ার পা। তাই তার পায়ে আলতা পরেছে কিনা দেখতে পেলাম না। রুকিয়ার চোখজোড়া অবিরাম আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে বারবার পায়ের দিকে তাকাতে অস্বস্তি লাগছে। তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।
রুকিয়া করমর্দনের জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু আমি তার হাতটা ধরতে একটু ইতস্তত করলাম। ইতস্তত করার নেপথ্যে একটা কারণ আছে। দোলা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে একজন মেয়ের সঙ্গে স্বামীকে করমর্দন করতে দেখে কোনও স্ত্রী খুশি হবে না। খুশি হওয়ার কথাও না। তাই রুকিয়ার সঙ্গে আমি করমর্দনও করলাম না।
রুকিয়া আগের চেয়ে একটু মোটা হয়েছে। তার শরীর বদলে যাওয়া, পোশাক-আশাক, কানে, গলায়, হাতে দামি অলংকারের চাকচিক্য দেখে বুঝতে পারলাম তার স্বামী বেশ ধনাঢ্য ব্যক্তি। রুকিয়া তাহলে সুখেই আছে? আমি তার সুখে থাকার কথা ভাবছিলাম যখন ঠিক তখন সে আমার কুশল জানতে চাইল, ‘কেমন আছো তুমি?’
আমি মৃদ কণ্ঠে জবাব দিলাম, ‘ভালো আছি।’
‘কবে এসেছ এখানে? সঙ্গে আর কে এসেছে? বউ নিয়ে এসেছ বুঝি?’
‘হ্যা, আমার সঙ্গে বউ এসেছে। তোমার বর আসেনি?’
‘এসেছে তো।’ বলেই একটু দুরে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্বামীকে হাতের ইশারায় আমাদের কাছে ডাকল। সমুদ্র সৈকতের শাদা ফেনিল জলরাশি আর দূরের আবছা আলোয় তার স্বামীকে অস্পষ্ট দেখতে পেলাম। পুরো চেহারা বুঝতে না পারলেও রুকিয়ার ইশারার জবাবে সম্মতি জানিয়ে সে যে আমাদের দিকে আসতে লাগল সেটা বুঝতে পারলাম।
রুকিয়ার স্বামী আসার আগের এ সময়টুকুতে সিনেমার ফ্লাশব্যাক দৃশ্যের মতো কল্পনায় আমাদের ফেলে আসা দিনগুলো থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
তখন আমি কলেজে পড়তাম। একই কলেজে রুকিয়াও পড়ত। দুজনেরই গ্রুপ ছিল সায়েন্স। প্রতিদিন রুকিয়ার সঙ্গে দেখা হতো। দেখতে দেখতে তার প্রতি ভালো লাগা অনুভব করতে থাকি। কিন্তু রুকিয়াকে ঘুণাক্ষরেও তা বলিনি।
রুকিয়াকে ভালো লাগলেও তার নামটা ভালো লাগত না। কেন জানি মনে হতো, রুকিয়া, সালেহা, আবিদা কিংবা আছিয়া- মেয়েদের এসব নাম নানি-দাদিদের আমলের। তাই একটু সম্পাদনা করে রুকিয়াকে আমি ডাকতাম রুবা। তার আর আমার নামের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলাম নামটা।
রুবার গায়ের রং ধব্ধবে ফর্সা। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, দুধের মতন শাদা নারী। অবশ্য রুবা তখনও নারী হয়ে ওঠেনি। তখনও মাথার চুল দুই ভাগ করে কলাবেণী বেঁধে কৈশোরের চাঞ্চল্য নিয়ে ক্লাসে আসত সে। তো নারী না হয়ে ওঠা সেই কিশোরী রুবার একদিন ভীষণ মন খারাপ। প্রথম ক্লাসের পর ক্যান্টিনের দিকে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম, মাঠের দক্ষিণ দিকের মেহগনিগাছগুলোর নিচে চারজন বান্ধবী তার চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। রুবা বেশ উদ্বিগ্ন, তার চোখের কোণে বেদনার অশ্রু টলমল করছে।
এ রকম একজন মেয়েকে এ অবস্থায় দেখে কিছুটা কষ্ট লাগল আমার। ফর্সা শরীরের মেয়েদের চোখের মণি বেশ কালো হয়। একটু কান্নাতেই জল গড়িয়ে পড়ে। কালো চোখ লাল হয়ে যায়। কালো চোখের মেয়েদের অশ্রুতে বেশ দুঃখী লাগে। কারও দুঃখী মুখ দেখতে আমার ভালো লাগে না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে? কোনও সমস্যা?’
রুবা আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা চারজনের মধ্য থেকে একজন জবাব দিল, ‘রুকিয়ার ভীষণ বিপদ!’
রুকিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই এ এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা আরিফুল হকের ছেলে শাওন তাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। শাওনের বয়স পঁচিশ। শারীরিক গঠন লম্বাটে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল ভেড়ার লোমের মতো। একজন বখাটে ছেলের যে সব গুণাবলি থাকতে হয়, শাওনের সবই আছে।
রুকিয়া সেদিন কলেজে আসার সময় শাওন তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পথরোধ করে দাঁড়ায়। তাকে প্রেম করার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি না হলে অপমান করার হুমকি দেয়। রুকিয়ার একটাই অপরাধ, সে বেশ সুন্দরী। সুন্দরী হওয়ার অপরাধে শাওনের হাত থেকে বাঁচতে রুকিয়া একটু দূরে চায়ের দোকানে কয়েকজন মানুষ দেখে সেখানে ছুটে যায়। চায়ের দোকানের মানুষদের দেখে দলবল নিয়ে কেটে পড়ে শাওন। এমনটা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। নিরুপায় হয়ে রুকিয়া বিকল্প পথ ব্যবহার করে কলেজে আসা-যাওয়া করে। কিন্তু সব পথই তারা দখল করে রাখে। এমনকি পথ মাড়িয়ে কলেজের গেটে পর্যন্ত চলে আসে। তাকে দেখলেই আজেবাজে মন্তব্য করতে থাকে। তুলে নেওয়ারও হুমকি দেয়। পরিস্থিতি একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে রুকিয়া কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। রুকিয়া কলেজে আসে না বলে বান্ধবীরা তার খোঁজ নেয়। তারা বিষয়টা অবগত হয়ে রুকিয়াকে মায়ের কাছে শেয়ার করার পরামর্শ দেয়। রুকিয়া তা-ই করে। সব জেনে মা একটা পথ বের করে। সংসারের কাজ ফেলে মেয়ের সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করতে থাকে। রুকিয়ার সঙ্গে মাকে দেখে শাওন আর পথ রোধ করে দাঁড়ায় না। কিছুদিন নিজেকে আড়াল করে রাখে। রুকিয়া ভাবে, ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে সে। একটানা দুই মাস মা রুকিয়ার সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে ভেবে মা তার সঙ্গে কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। মা সঙ্গে আসে না বলে শাওন আবার কোথা থেকে যেন এসে হাজির হয়। এবার বেশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। সরাসরি তুলে নেওয়ার হুমকি দেয়।
রুকিয়ার বাবা-মা আর বসে থাকেনি। নিজেদের সম্মান ক্ষুণœ হওয়ার ভয়ে এতদিন নীরবে সব সয়ে গিয়েছিল। এবার আর সম্মান ক্ষুণেœর চিন্তার করলে চলবে না। অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ জানিয়ে রুকিয়ার বাবা থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়। কিন্তু পুলিশ সেই অভিযোগ মামলা হিশেবে গ্রহণ করেনি। তাদের পক্ষে কিছুই করার নেই বলে জানায়। কারণ প্রতি বছর শাওনের জন্মদিনে এলাকার চেয়ারম্যান কেক কাটে। শাওনের বাবা আরিফুল হক একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। প্রভাবশালী এক নেতাদের সঙ্গে তার ‘ভাই-ব্রাদার’ সম্পর্ক। তাই পুলিশ আরিফুল হককে বিষয়টা ফয়সালা করার অনুরোধ করে। অপর দিকে, রুকিয়ার বাবা থানায় কোনও সাহায্য না পেয়ে সরাসরি আদালতে অভিযোগ করে। আদালত থেকে থানায় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলে পুলিশ শাওনকে ধরে আনে। শাওনের বাবা আরিফুল হককেও ডেকে আনে। আরিফুল হকের এবার টনক নড়ে। উপায়ন্তর না দেখে সিনিয়র নেতাদের কাছে ছুটে যায়। নেতাদের পরামর্শে ছেলেকে বাঁচাতে তাকে মানসিক রোগীর বলে পরিচয় দেয়। পুলিশ আরিফুল হকের কাছ থেকে মুচলেকা নেয় এবং তার ছেলে আর মেয়েটাকে উত্ত্যক্ত করবে না বলে লিখিত অঙ্গীকার দেয়। রুকিয়ার মা-বাবাও বিষয়টা স্বাভাবিক হয়ে গেছে ভেবে মেয়েকে একা একা কলেজে যেতে দেয়। কয়েকটা দিন সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু এর কিছুদিন পর শাওন আবার বেরিয়ে আসে। সেদিন রুকিয়ার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের গেট পর্যন্ত চলে আসে। আসার সময়টাতে তাকে শ্লীল ও অশ্লীল অনেক কথাই বলে। রুকিয়া কোনও কথায় কর্তপাত না করে সোজা কলেজের গেট পেরিয়ে ক্লাসে চলে আসে। এখানে তার সহপাঠীরা অবস্থান করছিল। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বান্ধবীকে ডেকে বাইরে নিয়ে এসে মেহগনিগাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের এ চরম দুর্দশার কথা জানায় এবং জানতে চায়, এখন এর থেকে বাঁচার উপায় কী?
শাওন আগে শুধু পথে উত্ত্যক্ত করত। আদালতে অভিযোগ করার পর বাসায় এসে হুমকি দিয়ে গেছে। তাই নিজের বাসায় থাকা নিরাপদ নয় বলে রুকিয়া একেক দিন একেক আত্মীয়ের বাসায় রাত্রিযাপন করতে থাকে। ঘটনাটা জানার পর রুকিয়ার ক্লাসমেট হিশেবে আমরা ক’জন বন্ধু তাকে এহেন দুর্দশা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলাম। প্রথমে ভাবলাম, শাওনের সঙ্গে কথা বলব। তাকে বোঝাব। সে যদি বোঝে, তো ভালো। না হলে প্রয়োজনে মারামারি করতেও প্রস্তুত আছি। আমার এমন তেজদীপ্ততার নেপথ্যে একটা কারণ আছে। রুকিয়াকে যে আমার ভালো লাগে। অবশ্য সেটা আর শুধু ভালোলাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভালোবাসা পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে।
ভালোবাসা সব পারে, পাথরে ফোটাতে পারে ফুল
জোয়ারের জলে ভাসাতে পারে মরা নদীর দুই কূল।
ভালোবাসা সব পারে, চৈত্রে আনতে পারে বসন্ত
ফুলে ফুলে সাজাতে পারে জীবনের আদ্যোপান্ত।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নবীনবরণ অনুষ্ঠানে রুকিয়ার কিন্নর কণ্ঠে যেদিন এ কবিতাটা আবৃত্তি শুনেছিলাম সেদিন থেকেই তার প্রতি আমার ভালোলাগা ও ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। এখন ভালোবাসার পরিণতি হিশেবে তাকে জীবনসঙ্গী করে পেতে অপেক্ষায় আছি। রুকিয়ার মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী করে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার ভাগ্য কেমন আমি জানি না। রুকিয়াকে জীবনসঙ্গী করে পেতে দরকার হলে ভাগ্য বদল করে নেব। পৃথিবীতে অনেকেই নিজের ভাগ্য নিজে তৈরি করেছে। আমিও না হয় তা-ই করব।
রুকিয়াকে পেতে ভাগ্য বদল করার প্রথম ধাপ হিশেবে আমি শাওনকে তার পেছন থেকে সরানোর মিশনে নেমে পড়ি। এ ক্ষেত্রে আমাকে একাই শাওনের মুখোমুখি হতে হয়। আমার বন্ধুরা কেউ তার সামনে যাওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু আমি দৈব বলে কোথা থেকে যেন সাহস পেয়েছি। শাওনকে খুঁজে বের করে তাকে অনুরোধ করি রুকিয়ার পেছন থেকে সরে যেতে। উলটো শাওন আমাকে বলে, ‘আমি তো রুকিয়ার পেছনে নই, সামনে আছি। তুমি বরং রুকিয়ার পেছন থেকে সরে যাও।’
তার কথায় আমার পৌরুষে আঘাত লাগে। ইচ্ছে হয়, তাকে তখনই খুন করি। কিন্তু খুন করা আমার কাজ না। আমার কাজ ভালোবাসা।
‘রুকিয়াকে আমি ভালোবাসি।’
এ কথাটা আচমকা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। আর তাতেই শাওন তেলে-বেগুনে জ¦লে ওঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে একটা কল করতেই মিনিট দশেকের মধ্যে তার সব সাঙ্গপাঙ্গ এসে হাজির হয়। প্রত্যেকের হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্প ও ব্যাট। তার পর? তার পর তারা স্ট্যাম্প ও ব্যাট দিয়ে আমার ওপর আঘাত করতে থাকে। আমার মাথা ফেঁটে রক্ত ঝরে পড়ার আগে তাদের আঘাত থামেনি।
তিন ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পর হাসপাতালে নিজেকে আবিষ্কার করি মাথায় ও হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায়। এরপর প্রায় পনের দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরি। বাসায় বেডরেস্টে কেটে যায় আরও সপ্তাহ খানেক সময়। এক মাস পর কলেজে এসে রুকিয়াকে আর খুঁজে পাইনি। তার বান্ধবীদের কাছে জানতে পারি, গত সপ্তায় রুকিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।
আসলে রুকিয়ার বিয়ে হয়নি। রুকিয়াকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাওনের হাত থেকে বাঁচাতে বাবা-মা রুকিয়াকে বিয়ে দিয়েছে।
রুকিয়ার স্বামী আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম, এতটাই চমকে উঠলাম যে, সমুদ্রের শান্ত জলে আচমকা ঘূর্ণিঝড়ের গর্জন শুনতে পেলাম। এ কাকে দেখছি! রুকিয়া বিয়ে করেছে শাওনকে! শাওন এখন রুকিয়ার স্বামী! আমার সঙ্গে এত বড় পল্টি নিল সে!
পরাজিত সৈনিকের মতো আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাওন আমার কাছে এগিয়ে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। এবার আর ইতস্তত করার কোনও সুযোগ নেই। তাই আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। করমর্দন করতে করতে শাওনের দিকে তাকিয়ে আরও অবাক হলাম। তার মাথায় সেই ভেড়ার লোমের মতো চুল নেই। এখন কদমছাট চুল। মুখে খোচা কোচা দাড়ি নেই, এখন একেবারে ক্লিন সেভ। হাঁটুর সামনে খামচি দিয়ে ছিঁড়ে রাখার মতো ছেঁড়া জিন্স প্যান্টের বদলে পরে আছে কালো রঙের গ্যাভাডিন প্যান্ট আর ফুলহাতা শাদা শার্ট। আশ্চর্য! শাওন এতটা ফরমাল হলো কীভাবে?
ভালোবাসা সব পারে, পাথরে ফোটাতে পারে ফুল
জোয়ারের জলে ভাসাতে পারে মরা নদীর দুই কূল।
ভালোবাসা সব পারে...
আমাদের কাছ থেকে কখন যে সরে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল রুকিয়া। শাওন আমার সঙ্গে আর কথা না বলে তার স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে এলাম আমার স্ত্রীর কাছে। দোলা মুঠোফোনের ক্যামেরায় এখনও ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে সেলফি তুলতে লাগল। আমি, দোলা আর সমুদ্রের ওপারের অস্তগামী লাল সূর্যটা সেলফির একটি ফ্রেমে বন্দি হলাম।