সানজিদা হক মিশু
ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়ের সহমরণ প্রথা ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। নারীর স্বামী ছাড়াও সংসারে টিকে থাকার অধিকার আছে তা একটা সময়ে ভারতবর্ষের মানুষরা ভুলেই গিয়েছিলো। রাজা রামমোহন রায় ১৮১২ সালে বৃটিশ শাসকদের সহায়তায় সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। বিধবাদের সহমরণে নয়, সংসারে বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ে তখন কাজ শুরু করেন ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঊনবিংশ শতাব্দি থেকে ধীরে ধীরে নারীর শিক্ষা আর অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়। এ শতাব্দির শেষ দিকে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী নারী শিক্ষার নিমিত্তে কুমিল্লায় একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু হয় নারীর স্বাধিকার লাভের সংগ্রাম। ঊনবিংশ শতাব্দির একজন খ্যাতিমান নারীশিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক বেগম রোকেয়া,যিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে নারীর শিক্ষা ও সচেতনতার আলো জ¦ালাতে কাজ করেছেন আজীবন।
নারী স্বাধীনতার কথা বহু পূর্ব থেকে প্রচলিত হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক অন্দোলনে এর উত্থান ১৮৩০ সালে। নারীবাদের পরিসরে ১৯২০ সালে জায়গা পায় নারী শিক্ষার বিষয়টি। ভারতবর্ষের মুসলিম নারীদের জন্য যেটি রোকেয়া চালু করেন ক্ষুদ্র পরিসরে। ১৯৩০ সালে এসে ‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি আধুনিকতার বহুমাত্রিকতা লাভ করে। ফ্রান্সের নারী দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ারের ল্যদ্যজিয়ম সেক্স (ফরাসি), ইংরেজিতে দ্য সেকেন্ড সেক্স এবং বাংলায় দ্বিতীয় লিঙ্গ নারীবাদী আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে এবং রাখছে। সভ্যতাব্যাপী নারীর নানান ধরনের অবস্থান, বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সমাজে নারীকে কীভাবে দ্বিতীয় লিঙ্গে পরিণত হতে হয়েছে তার প্রমাণ রয়েছে এ গ্রন্থে। জীববৈজ্ঞানিক, মনোবৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কীভাবে ‘নারী’ সম্প্রদায়কে সেকেন্ড সেক্সে পরিণত করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ বোভেয়ার তাঁর এ বইয়ে রেখেছেন। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য-
‘ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে যে পুরুষেরা সব সময় নিজেদের হাতে ধরে রেখেছে সব বস্তুগত ক্ষমতা; পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদিকাল থেকে তারা নারীকে পরনির্ভর অবস্থায় রাখাকেই মনে করেছে সবচেয়ে ভালো; তাদের আইনগত বিধিবিধান তৈরি হয়েছে নারীর বিরুদ্ধে; এবং এভাবে তাকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অপরূপে।’
১৯৬৩ সালে আমেরিকান নারীনেত্রী ফ্রিজান তাঁর দি ফেমিনাইন মিসটিকা গ্রন্থে বয়ঁধষরঃু ভবসরহরংস-এর কথা বলেছেন। সমানাধিকারমূলক চিন্তার জগতকে বিভিন্ন ধাপে এ গ্রন্থে লেখক তুলে এনেছেন। তারপর ১৯৭৮ সালে আরেক আমেরিকান নারীবাদী লেখক মেরি ডলি মুহ/বপড়ষড়মু গ্রন্থে ধর্ম, আইন ও বিজ্ঞানকে পুরুষপ্রধান বলে অভিহিত করেছেন, কেননা এগুলোতে নারীর স্বাধিকারকে নানাভাবে খর্ব করা হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দিতে যখন নারীর অধিকার নিয়ে অন্যান্য ধর্মে তোলপাড় শুরু হয়েছে তখন মুসলিম নারীদের জাগাতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে মিশরীয় মুসলিম আইনবিদ ক্কাসিম আমিনের তাহরির-আল-মার’আ (ডড়সবহ’ং খরনধৎধঃরড়হ) গ্রন্থটি। দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, লাঞ্ছনা আর অধিকারবোধে নারীকে সোচ্চার করানোই ছিলো রোকেয়ার মূল কাজ। নারী সম্পর্কে ধারণার নমুনাস্বরূপ প্রণিধানযোগ্য-
ধর্ম বলে : নারী থেকেই পাপের জন্ম, ধর্মাচরণে সে পুরুষের সহকারিণী মাত্র।
আইন বলে : মা তার সন্তানের অভিভাবক নয়, ধাত্রী মাত্র। সন্তান পিতার।
শিল্প বলে : নারী সুন্দরী, যৌন উত্তেজনা সঞ্চারিনী, প্রেরণাদাত্রী। শিল্পসৃষ্টি তার কাজ নয়।
বিজ্ঞাপন বলে : নারী মা, নারী গৃহিণী, নারী এক অতিসুন্দরী অলীক মানবী।
সাহিত্য বলে : নারী প্রেরণা, নারী উর্বশী অর্থাৎ যৌনতার প্রতীক, নারী গৃহলক্ষ্মী। যে নারী সাহিত্য সৃষ্টি করে সে পুরুষের জগতে অনুপ্রবেশকারী ‘মহিলা কবি’ জাতীয়।
দর্শন বলে : মাতৃত্ব আর স্বামীসেবাই নারীর আসল দায়িত্ব যা তাকে মহীয়সী করে।
সমাজ বলে : নারী শ্রীমতি অমুক পুরুষ বা মিসেস তমুক পুরুষ, তার নিজস্ব কোনো পরিচিতি নাই। নারী অনা¤œী, অনুগত, অন্তঃপুরচারিণী।
অর্থনীতি বলে : সাবধান এখানে নয়, কাজের জগতটা পুরুষের। পুরুষ ভর্তা, নারীর ভরণপোষণের দায় তার। নারী নির্ভরশীল।
সুতরাং, উপার্জন-উৎপাদন থেকে নির্বাসন এবং যৌনতা-মাতৃত্ব-গৃহিণীপনায় সাফল্যের ওপর গড়ে ওঠে নারীত্বের সংজ্ঞা।
রোকেয়ার নারী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো নারীর সার্বিক মুক্তি। নারীর সার্বিক মুক্তির পথ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন শিক্ষাকে। নাগরিক অধিকারবোধসম্পন্ন শিক্ষা যাতে নারীরও প্রাপ্য হয়- এ নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন। নারীশিক্ষাবিদ রোকেয়া নারী শিক্ষার জন্য তৈরি স্কুল পরিচালনা করেছেন। নারীর হিতার্থ কামনা, ধর্মান্ধ আর সমাজের বন্দিশালা থেকে উন্মুক্ত মাঠে নারীকে হাজির করা-ই ছিলো রোকেয়ার কাজ। এ সম্পর্কে তাঁর লেখনী-‘আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে;...শিক্ষা মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই।’
নারীবাদী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে যখন কেটি মিলে¯œতের ংবীঁধষ ঢ়ড়ষরঃরপং (১৯৬৯), ডালি স্পেন্ডারের গড়ঃযবৎং ড়ভ ঃযবহড়াবষ (১৯৮৬), জেন স্পেন্সারের ঞযব ৎরংব ড়ভ ঃযব ডড়সবহ হড়াবষরংঃংপ্রভৃতি গ্রন্থগুলো গণ্য করা হচ্ছে তারও অনেক পূর্বে। রোকেয়া নারীবাদের ছাপ রেখেছেন তাঁর রচিত সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর ও অন্যান্য গ্রন্থে। রোকেয়া তাঁর সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গীয় মুসলিম নারী সমাজের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতাকে দেখিয়েছেন। জাতিকে শিক্ষিত হতে হলে নারীকে শিক্ষিত হতে হবে। পুরুষপ্রধান সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে ঘরে বসিয়ে রাখা হচ্ছে তার শারীরিক নানা জটিলতার দোহাই দিয়ে। প্রকৃত সুশিক্ষার অভাবেই নারী হয়ে ওঠে সংকীর্ণমনা ও ভীতু। রোকেয়া নারীদের সাহসী করার প্রয়াসে হাতে নিয়েছিলেন আলোকবর্তিকা, যেখানে ছিলো জ্ঞানের আলো। তাঁর ধারণা, সমাজকে অগ্রসর করতে হলে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে নারীকে।
লেখক অকুণ্ঠভাবে তৎকালীন নারীর সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থার বিষয় তাঁর মতিচুর (১ম খ-) প্রবন্ধগ্রন্থে আলোচনা করেছেন। অশিক্ষা, কুসংস্কার, অজ্ঞানতা, পর্দাপ্রথা নারীকে কীভাবে অথর্ব করেছে তার প্রমাণ মেলে এ প্রবন্ধগ্রন্থে। পৃথিবী থেকে দাসত্ব ব্যবস্থা দূর হলেও নারীর দাসত্ব প্রথা এখনো বলবৎ। সমাজের অসহযোগিতা নারীকে সকল কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। নারীর দেহ ও মন উভয়ই তাই পরিণত হয়েছে দাসীতে। স্বাবলম্বন, সাহস আর মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলো অনুশীলনের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।
তৎকালীন ভারতবর্ষে নারীর কোনো অবস্থান-ই ছিলো না। নারী কেবল পুরুষের তৈরি পুতুলের মতো সেজে থাকতো। শরীর আর মন উভয়কে জড়পি- করে রাখা-ই ছিলো তাদের কাজ। শিক্ষা যেখানে উন্নতির প্রধান ধাপ সেখানে মুসলিম নারী ছিলো শিক্ষা থেকে উপেক্ষিত। সমাজ তাদের জন্য উপযুক্ত কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা ভাবেনি। রোকেয়াকে এ উপেক্ষা কষ্ট দিয়েছিলো। তাই তিনি মুসলিম নারীকে শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেন। নারীর মনোকক্ষে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করে চলেন। তাই রোকেয়া একজন নারীশিক্ষাবিদ। স্ত্রীশিক্ষা তথা নারীশিক্ষা নিয়ে সেসময়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত ছিলো যে, নারী (স্ত্রী) শিক্ষিত হলে স্বামীর প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা কমে যাবে; ধর্মে অনাস্থা তৈরি হবে, অকল্যাণের বাসা বাঁধবে পরিবারে। এ বিষয়ে রোকেয়ার আক্ষেপ বাণী-
‘স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে অধিকাংশ লোকের কেমন একটি কুসংস্কার আছে যে তাঁহারা ‘স্ত্রীশিক্ষা’ শব্দ শুনিলেই ‘শিক্ষার কুফলের’ একটা ভাবী বিভীষিকা দেখিয়া শিহরিয়া ওঠেন। অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের শত দোষ সমাজ অম্লান বদনে ক্ষমা করিয়া থাকে, কিন্তু সামান্য শিক্ষাপ্রাপ্ত মহিলা দোষ না করিলেও সমাজ কোনো কল্পিত দোষ বাড়াইয়া সে বেচারীর ঐ ‘শিক্ষা’ ঘাড়ে চাপাইয়া দেয় এবং শত কণ্ঠে সমস্বরে বলিয়া থাকে স্ত্রীশিক্ষাকে নমস্কার।’
রোকেয়া তাঁর লেখনীতে নারীকে ঘরের অচলায়তন থেকে বের হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর বিশাল কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে নারীরও অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ^কে নারী শিক্ষার পক্ষে উদ্যোগী হতে হবে, তাহলেই কেবল বিশ^ উন্নত হবে। নারী শিক্ষার প্রসার ও নারী জাগরণে রোকেয়া সবাইকে এক হওয়ার কথা বলেছেন। রোকেয়ার ভাবনার জগৎ ছিলো নারীর স্বাধিকারকে কেন্দ্র করে। নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শুধুমাত্র সুশিক্ষার অভাবে। লেখনী ও স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রোকেয়া ভারতবর্ষে নারীর স্বাধিকার আদায়ের পক্ষে কাজ করেছেন। সামাজিক নানা জটিল প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও ধর্মীয় গোঁড়ামি যা নারীর জন্য ছিলো- তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতকের ভারতবর্ষে হিন্দু নারীদের বাঁচাতে যখন রামমোহন রায় ও ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘পুরুষ’ জাতি অভিহিত হয়ে সংগ্রাম করেছেন সেখানে ‘নারী’ অভিহিত হয়ে রোকেয়া ভারতবর্ষের মুসলমান নারীর স্বাধিকার নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
‘ঊনবিংশ শতাব্দিতে বাংলার রেনেসাঁস যুগে হিন্দু সমাজের নারীদের হীনাবস্থা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মহান পুরুষ শাস্ত্রাকারদের অনুশাসনকে হাতিয়ার করেই হিন্দু নারীদের ধর্মের দোহাই দিয়ে যে অধঃপতিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল তা থেকে তাদের উন্নত করার সফল প্রয়াস করেছিলেন। সেরূপ বিংশ শতাব্দির প্রথম দশক হতে আমৃত্যু মুক্তমনা মানবতাবাদী বেগম রোকেয়া ইসলামি অনুশাসন ঐতিহ্যকে ব্যাখা করে মুসলিম সমাজ যে প্রকৃতপক্ষে তাদের নারীদের ইসলাম প্রদত্ত সকল অধিকার হতে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে চলেছেন এ অমোঘ সত্য নির্ভীকচিত্তে জনসম্মুখে উপস্থাপিত করে বাঙালি মুসলিম, নারী ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা করিছেলেন।’
মতিচুর (প্রথম খ-)-এর অধিকাংশ প্রবন্ধই নারীর আর্তনাদ, নারীর পিছিয়ে পড়া আর এ থেকে উত্তরণের উপায়কে কেন্দ্র করে। নারীকে অগ্রসর হতে হলে যে শিক্ষিত হতে হবে এটাই এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। রোকেয়া তাঁর লেখনীতে নারীবাদের স্পষ্ট ছাপ রেখে গেছেন। পুরুষতন্ত্র সম্পর্কে রোকেয়া দর্শন নারীবাদী মেরির চেয়েও কট্টর ছিলো। রোকেয়া ঘুমন্ত নারীজীবনকে নিজের স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত হতে বলেছেন। নারীশিক্ষার যে মূলমন্ত্র তিনি প্রচার করে গেছেন তা বিদ্যমান থাকবে সবসময়। সমাজ ও পরিবারে নারী পুরুষের ভূমিকায় তিনি স্বচ্ছতা রেখেছেন। পুরুষের যেমন জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের জন্য শিক্ষা দরকার, নারীরও দরকার। যা কিছু প্রয়োজন তা উভয়ের জন্য প্রয়োজন। রোকেয়ার নারীবাদের স্বরূপ সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন-
‘রোকেয়ার সমগ্র রচনাবলি ভরে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ঘৃণা; ‘পুরুষ’ ধারণাটিই ছিলো তাঁর কাছে আপত্তিকর। পুরুষদের তিনি যে সামান্য করুণা করেছেন তা সম্ভবত ভাই ও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। রোকেয়া রচনাবলির প্রধান বৈশিষ্ট্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; পশ্চিমের প্রথম নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্টের মধ্যেও এতখানি পুরুষবিদ্বেষ ও দ্রোহিতা দেখা যায় না।’
নারীকে যদি স্বাধীকার লাভ করতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই সচেতন, দায়িত্ববান ও মানসিকভাবে দক্ষ হতে হবে। আর এ তিনটি গুণ অর্জনের জন্য দরকার সুশিক্ষা। ভারতবর্ষে নারীর সুশিক্ষা লাভের জন্য রোকেয়ার সংগ্রাম অনস্বীকার্য। রোকেয়া নারীজাতির মুক্তির উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালান। শিক্ষাব্রতী, সমাজকর্মী রোকেয়া সকলকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন নারীশিক্ষায় ব্রতী হওয়ার। রোকেয়া সাহিত্য সাধনার বড় অংশ জুড়ে নারী সমাজের জাগরণের বাণী বিধৃত হয়েছে। মূলত রোকেয়ার হাত ধরে ভারতবর্ষে নারীমুক্তির যে হাওয়া লেগেছিলো তা সফল করতে হলে আজকের নারীকে হয়ে ওঠতে হবে মানুষে, প্রকৃত মানুষে; মেধায়-মননে। সমাজকে দরকার হলে সামাজিক সম্পর্কের রূপ পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে আধুনিকতার চরমে পৌঁছে হয়তো নারী থেকে যাবে ভোগী হয়ে; রাস্তায়, জঙ্গলে, নদীতে, সমুদ্রে, পাহাড়ে কিংবা আপন গৃহে।
সানজিদা হক মিশু
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়ের সহমরণ প্রথা ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। নারীর স্বামী ছাড়াও সংসারে টিকে থাকার অধিকার আছে তা একটা সময়ে ভারতবর্ষের মানুষরা ভুলেই গিয়েছিলো। রাজা রামমোহন রায় ১৮১২ সালে বৃটিশ শাসকদের সহায়তায় সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। বিধবাদের সহমরণে নয়, সংসারে বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ে তখন কাজ শুরু করেন ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঊনবিংশ শতাব্দি থেকে ধীরে ধীরে নারীর শিক্ষা আর অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়। এ শতাব্দির শেষ দিকে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী নারী শিক্ষার নিমিত্তে কুমিল্লায় একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু হয় নারীর স্বাধিকার লাভের সংগ্রাম। ঊনবিংশ শতাব্দির একজন খ্যাতিমান নারীশিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক বেগম রোকেয়া,যিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে নারীর শিক্ষা ও সচেতনতার আলো জ¦ালাতে কাজ করেছেন আজীবন।
নারী স্বাধীনতার কথা বহু পূর্ব থেকে প্রচলিত হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক অন্দোলনে এর উত্থান ১৮৩০ সালে। নারীবাদের পরিসরে ১৯২০ সালে জায়গা পায় নারী শিক্ষার বিষয়টি। ভারতবর্ষের মুসলিম নারীদের জন্য যেটি রোকেয়া চালু করেন ক্ষুদ্র পরিসরে। ১৯৩০ সালে এসে ‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি আধুনিকতার বহুমাত্রিকতা লাভ করে। ফ্রান্সের নারী দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ারের ল্যদ্যজিয়ম সেক্স (ফরাসি), ইংরেজিতে দ্য সেকেন্ড সেক্স এবং বাংলায় দ্বিতীয় লিঙ্গ নারীবাদী আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে এবং রাখছে। সভ্যতাব্যাপী নারীর নানান ধরনের অবস্থান, বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সমাজে নারীকে কীভাবে দ্বিতীয় লিঙ্গে পরিণত হতে হয়েছে তার প্রমাণ রয়েছে এ গ্রন্থে। জীববৈজ্ঞানিক, মনোবৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কীভাবে ‘নারী’ সম্প্রদায়কে সেকেন্ড সেক্সে পরিণত করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ বোভেয়ার তাঁর এ বইয়ে রেখেছেন। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য-
‘ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে যে পুরুষেরা সব সময় নিজেদের হাতে ধরে রেখেছে সব বস্তুগত ক্ষমতা; পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদিকাল থেকে তারা নারীকে পরনির্ভর অবস্থায় রাখাকেই মনে করেছে সবচেয়ে ভালো; তাদের আইনগত বিধিবিধান তৈরি হয়েছে নারীর বিরুদ্ধে; এবং এভাবে তাকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অপরূপে।’
১৯৬৩ সালে আমেরিকান নারীনেত্রী ফ্রিজান তাঁর দি ফেমিনাইন মিসটিকা গ্রন্থে বয়ঁধষরঃু ভবসরহরংস-এর কথা বলেছেন। সমানাধিকারমূলক চিন্তার জগতকে বিভিন্ন ধাপে এ গ্রন্থে লেখক তুলে এনেছেন। তারপর ১৯৭৮ সালে আরেক আমেরিকান নারীবাদী লেখক মেরি ডলি মুহ/বপড়ষড়মু গ্রন্থে ধর্ম, আইন ও বিজ্ঞানকে পুরুষপ্রধান বলে অভিহিত করেছেন, কেননা এগুলোতে নারীর স্বাধিকারকে নানাভাবে খর্ব করা হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দিতে যখন নারীর অধিকার নিয়ে অন্যান্য ধর্মে তোলপাড় শুরু হয়েছে তখন মুসলিম নারীদের জাগাতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে মিশরীয় মুসলিম আইনবিদ ক্কাসিম আমিনের তাহরির-আল-মার’আ (ডড়সবহ’ং খরনধৎধঃরড়হ) গ্রন্থটি। দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, লাঞ্ছনা আর অধিকারবোধে নারীকে সোচ্চার করানোই ছিলো রোকেয়ার মূল কাজ। নারী সম্পর্কে ধারণার নমুনাস্বরূপ প্রণিধানযোগ্য-
ধর্ম বলে : নারী থেকেই পাপের জন্ম, ধর্মাচরণে সে পুরুষের সহকারিণী মাত্র।
আইন বলে : মা তার সন্তানের অভিভাবক নয়, ধাত্রী মাত্র। সন্তান পিতার।
শিল্প বলে : নারী সুন্দরী, যৌন উত্তেজনা সঞ্চারিনী, প্রেরণাদাত্রী। শিল্পসৃষ্টি তার কাজ নয়।
বিজ্ঞাপন বলে : নারী মা, নারী গৃহিণী, নারী এক অতিসুন্দরী অলীক মানবী।
সাহিত্য বলে : নারী প্রেরণা, নারী উর্বশী অর্থাৎ যৌনতার প্রতীক, নারী গৃহলক্ষ্মী। যে নারী সাহিত্য সৃষ্টি করে সে পুরুষের জগতে অনুপ্রবেশকারী ‘মহিলা কবি’ জাতীয়।
দর্শন বলে : মাতৃত্ব আর স্বামীসেবাই নারীর আসল দায়িত্ব যা তাকে মহীয়সী করে।
সমাজ বলে : নারী শ্রীমতি অমুক পুরুষ বা মিসেস তমুক পুরুষ, তার নিজস্ব কোনো পরিচিতি নাই। নারী অনা¤œী, অনুগত, অন্তঃপুরচারিণী।
অর্থনীতি বলে : সাবধান এখানে নয়, কাজের জগতটা পুরুষের। পুরুষ ভর্তা, নারীর ভরণপোষণের দায় তার। নারী নির্ভরশীল।
সুতরাং, উপার্জন-উৎপাদন থেকে নির্বাসন এবং যৌনতা-মাতৃত্ব-গৃহিণীপনায় সাফল্যের ওপর গড়ে ওঠে নারীত্বের সংজ্ঞা।
রোকেয়ার নারী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো নারীর সার্বিক মুক্তি। নারীর সার্বিক মুক্তির পথ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন শিক্ষাকে। নাগরিক অধিকারবোধসম্পন্ন শিক্ষা যাতে নারীরও প্রাপ্য হয়- এ নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন। নারীশিক্ষাবিদ রোকেয়া নারী শিক্ষার জন্য তৈরি স্কুল পরিচালনা করেছেন। নারীর হিতার্থ কামনা, ধর্মান্ধ আর সমাজের বন্দিশালা থেকে উন্মুক্ত মাঠে নারীকে হাজির করা-ই ছিলো রোকেয়ার কাজ। এ সম্পর্কে তাঁর লেখনী-‘আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে;...শিক্ষা মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই।’
নারীবাদী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে যখন কেটি মিলে¯œতের ংবীঁধষ ঢ়ড়ষরঃরপং (১৯৬৯), ডালি স্পেন্ডারের গড়ঃযবৎং ড়ভ ঃযবহড়াবষ (১৯৮৬), জেন স্পেন্সারের ঞযব ৎরংব ড়ভ ঃযব ডড়সবহ হড়াবষরংঃংপ্রভৃতি গ্রন্থগুলো গণ্য করা হচ্ছে তারও অনেক পূর্বে। রোকেয়া নারীবাদের ছাপ রেখেছেন তাঁর রচিত সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর ও অন্যান্য গ্রন্থে। রোকেয়া তাঁর সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গীয় মুসলিম নারী সমাজের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতাকে দেখিয়েছেন। জাতিকে শিক্ষিত হতে হলে নারীকে শিক্ষিত হতে হবে। পুরুষপ্রধান সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে ঘরে বসিয়ে রাখা হচ্ছে তার শারীরিক নানা জটিলতার দোহাই দিয়ে। প্রকৃত সুশিক্ষার অভাবেই নারী হয়ে ওঠে সংকীর্ণমনা ও ভীতু। রোকেয়া নারীদের সাহসী করার প্রয়াসে হাতে নিয়েছিলেন আলোকবর্তিকা, যেখানে ছিলো জ্ঞানের আলো। তাঁর ধারণা, সমাজকে অগ্রসর করতে হলে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে নারীকে।
লেখক অকুণ্ঠভাবে তৎকালীন নারীর সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থার বিষয় তাঁর মতিচুর (১ম খ-) প্রবন্ধগ্রন্থে আলোচনা করেছেন। অশিক্ষা, কুসংস্কার, অজ্ঞানতা, পর্দাপ্রথা নারীকে কীভাবে অথর্ব করেছে তার প্রমাণ মেলে এ প্রবন্ধগ্রন্থে। পৃথিবী থেকে দাসত্ব ব্যবস্থা দূর হলেও নারীর দাসত্ব প্রথা এখনো বলবৎ। সমাজের অসহযোগিতা নারীকে সকল কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। নারীর দেহ ও মন উভয়ই তাই পরিণত হয়েছে দাসীতে। স্বাবলম্বন, সাহস আর মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলো অনুশীলনের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।
তৎকালীন ভারতবর্ষে নারীর কোনো অবস্থান-ই ছিলো না। নারী কেবল পুরুষের তৈরি পুতুলের মতো সেজে থাকতো। শরীর আর মন উভয়কে জড়পি- করে রাখা-ই ছিলো তাদের কাজ। শিক্ষা যেখানে উন্নতির প্রধান ধাপ সেখানে মুসলিম নারী ছিলো শিক্ষা থেকে উপেক্ষিত। সমাজ তাদের জন্য উপযুক্ত কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা ভাবেনি। রোকেয়াকে এ উপেক্ষা কষ্ট দিয়েছিলো। তাই তিনি মুসলিম নারীকে শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেন। নারীর মনোকক্ষে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করে চলেন। তাই রোকেয়া একজন নারীশিক্ষাবিদ। স্ত্রীশিক্ষা তথা নারীশিক্ষা নিয়ে সেসময়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত ছিলো যে, নারী (স্ত্রী) শিক্ষিত হলে স্বামীর প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা কমে যাবে; ধর্মে অনাস্থা তৈরি হবে, অকল্যাণের বাসা বাঁধবে পরিবারে। এ বিষয়ে রোকেয়ার আক্ষেপ বাণী-
‘স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে অধিকাংশ লোকের কেমন একটি কুসংস্কার আছে যে তাঁহারা ‘স্ত্রীশিক্ষা’ শব্দ শুনিলেই ‘শিক্ষার কুফলের’ একটা ভাবী বিভীষিকা দেখিয়া শিহরিয়া ওঠেন। অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের শত দোষ সমাজ অম্লান বদনে ক্ষমা করিয়া থাকে, কিন্তু সামান্য শিক্ষাপ্রাপ্ত মহিলা দোষ না করিলেও সমাজ কোনো কল্পিত দোষ বাড়াইয়া সে বেচারীর ঐ ‘শিক্ষা’ ঘাড়ে চাপাইয়া দেয় এবং শত কণ্ঠে সমস্বরে বলিয়া থাকে স্ত্রীশিক্ষাকে নমস্কার।’
রোকেয়া তাঁর লেখনীতে নারীকে ঘরের অচলায়তন থেকে বের হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর বিশাল কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে নারীরও অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ^কে নারী শিক্ষার পক্ষে উদ্যোগী হতে হবে, তাহলেই কেবল বিশ^ উন্নত হবে। নারী শিক্ষার প্রসার ও নারী জাগরণে রোকেয়া সবাইকে এক হওয়ার কথা বলেছেন। রোকেয়ার ভাবনার জগৎ ছিলো নারীর স্বাধিকারকে কেন্দ্র করে। নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শুধুমাত্র সুশিক্ষার অভাবে। লেখনী ও স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রোকেয়া ভারতবর্ষে নারীর স্বাধিকার আদায়ের পক্ষে কাজ করেছেন। সামাজিক নানা জটিল প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও ধর্মীয় গোঁড়ামি যা নারীর জন্য ছিলো- তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতকের ভারতবর্ষে হিন্দু নারীদের বাঁচাতে যখন রামমোহন রায় ও ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘পুরুষ’ জাতি অভিহিত হয়ে সংগ্রাম করেছেন সেখানে ‘নারী’ অভিহিত হয়ে রোকেয়া ভারতবর্ষের মুসলমান নারীর স্বাধিকার নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
‘ঊনবিংশ শতাব্দিতে বাংলার রেনেসাঁস যুগে হিন্দু সমাজের নারীদের হীনাবস্থা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মহান পুরুষ শাস্ত্রাকারদের অনুশাসনকে হাতিয়ার করেই হিন্দু নারীদের ধর্মের দোহাই দিয়ে যে অধঃপতিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল তা থেকে তাদের উন্নত করার সফল প্রয়াস করেছিলেন। সেরূপ বিংশ শতাব্দির প্রথম দশক হতে আমৃত্যু মুক্তমনা মানবতাবাদী বেগম রোকেয়া ইসলামি অনুশাসন ঐতিহ্যকে ব্যাখা করে মুসলিম সমাজ যে প্রকৃতপক্ষে তাদের নারীদের ইসলাম প্রদত্ত সকল অধিকার হতে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে চলেছেন এ অমোঘ সত্য নির্ভীকচিত্তে জনসম্মুখে উপস্থাপিত করে বাঙালি মুসলিম, নারী ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা করিছেলেন।’
মতিচুর (প্রথম খ-)-এর অধিকাংশ প্রবন্ধই নারীর আর্তনাদ, নারীর পিছিয়ে পড়া আর এ থেকে উত্তরণের উপায়কে কেন্দ্র করে। নারীকে অগ্রসর হতে হলে যে শিক্ষিত হতে হবে এটাই এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। রোকেয়া তাঁর লেখনীতে নারীবাদের স্পষ্ট ছাপ রেখে গেছেন। পুরুষতন্ত্র সম্পর্কে রোকেয়া দর্শন নারীবাদী মেরির চেয়েও কট্টর ছিলো। রোকেয়া ঘুমন্ত নারীজীবনকে নিজের স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত হতে বলেছেন। নারীশিক্ষার যে মূলমন্ত্র তিনি প্রচার করে গেছেন তা বিদ্যমান থাকবে সবসময়। সমাজ ও পরিবারে নারী পুরুষের ভূমিকায় তিনি স্বচ্ছতা রেখেছেন। পুরুষের যেমন জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের জন্য শিক্ষা দরকার, নারীরও দরকার। যা কিছু প্রয়োজন তা উভয়ের জন্য প্রয়োজন। রোকেয়ার নারীবাদের স্বরূপ সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন-
‘রোকেয়ার সমগ্র রচনাবলি ভরে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ঘৃণা; ‘পুরুষ’ ধারণাটিই ছিলো তাঁর কাছে আপত্তিকর। পুরুষদের তিনি যে সামান্য করুণা করেছেন তা সম্ভবত ভাই ও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। রোকেয়া রচনাবলির প্রধান বৈশিষ্ট্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; পশ্চিমের প্রথম নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্টের মধ্যেও এতখানি পুরুষবিদ্বেষ ও দ্রোহিতা দেখা যায় না।’
নারীকে যদি স্বাধীকার লাভ করতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই সচেতন, দায়িত্ববান ও মানসিকভাবে দক্ষ হতে হবে। আর এ তিনটি গুণ অর্জনের জন্য দরকার সুশিক্ষা। ভারতবর্ষে নারীর সুশিক্ষা লাভের জন্য রোকেয়ার সংগ্রাম অনস্বীকার্য। রোকেয়া নারীজাতির মুক্তির উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালান। শিক্ষাব্রতী, সমাজকর্মী রোকেয়া সকলকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন নারীশিক্ষায় ব্রতী হওয়ার। রোকেয়া সাহিত্য সাধনার বড় অংশ জুড়ে নারী সমাজের জাগরণের বাণী বিধৃত হয়েছে। মূলত রোকেয়ার হাত ধরে ভারতবর্ষে নারীমুক্তির যে হাওয়া লেগেছিলো তা সফল করতে হলে আজকের নারীকে হয়ে ওঠতে হবে মানুষে, প্রকৃত মানুষে; মেধায়-মননে। সমাজকে দরকার হলে সামাজিক সম্পর্কের রূপ পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে আধুনিকতার চরমে পৌঁছে হয়তো নারী থেকে যাবে ভোগী হয়ে; রাস্তায়, জঙ্গলে, নদীতে, সমুদ্রে, পাহাড়ে কিংবা আপন গৃহে।