alt

অপরাধ ও দুর্নীতি

দুদকের নামে নোটিশ করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে চক্র

ব্যবসায়ী-শিল্পপতি চাকরিজীবী টার্গেট

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : শনিবার, ২৪ জুন ২০২৩

দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি দমন কমিশনের ভেতরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপের সহযোগিতায় টার্গেট করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে নোটিশ পাঠাচ্ছেন। কর্মকর্তাদের নামে সাক্ষর করে ওইসব নোটিশে চাওয়া হচ্ছে সম্পদের হিসেব। এজন্য ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের টার্গেট করে এসব নোটিশ পাঠিয়ে পক্ষান্তরে মামলার ভয় দেখানো হয়। নোটিশ পাঠানোর পর আবার তা সমাধন করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এসব নোটিশ করে চক্রটি প্রতারণা করে আসলেও রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একই প্রক্রিয়ায় এক ব্যবসায়ী নোটিশ পাঠিয়ে মামলা ঠেকাতে ৩ কোটি টাকার চুক্তি করা হয়। এরপর ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা আনতে গেলে দুদকের গোয়েন্দা টিম ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির যৌথ অভিযানে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার মধ্যে দুদকের মানিলন্ডারিং শাখার মহাপরিচালক (ডিজির) অফিস সহকারী এবং একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাও ছিল।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পিএ গৌতম ভট্টাচার্য (৪২), পুলিশের চাকরিচ্যুত কনস্টেবল মো. এসকেন আলী খান (৫৭) এবং হাবিবুর রহমান (৪২) ও পরিতোষ মন্ডল (৬৩)। তাদের কাছ থেকে মিষ্টির ৪টি প্যাকেট, নগদ দেড় লাখ টাকা, ৪টি মোবাইল ফোন, দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের একটি খাম ও দুদকের একটি নোটিশ জব্দ করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার গৌতম ভট্টাচার্য দুদকের ডিজি মানি লন্ডারিংয়ের পিএ হিসেবে কর্মরত। তার বাড়ি মৌলভীবাজার। এসকেন আলী খান চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ। অন্য দুইজন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা, তারা পেশাগতভাবে দালাল ও প্রতারক।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, গত ২০ জুন রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকার ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামানের উত্তরার বাসায় দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের খামে একটি নোটিশ নিয়ে যায় কথিত একজন দুদক অফিসার। চিঠিতে আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা হয় ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণের চোরাচালান ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগ। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে, এমন ভয়ানক অভিযোগ শুনে ঘাবড়ে যান আশিকুজ্জামান। মামলা থেকে বাঁচতে তার কাছে প্রথমে ৫ কোটি ও পরে ১ কোটি টাকা দাবি করে কথিত দুদক অফিসার। বিনিময়ে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা দেয়া হয়। কথা অনুযায়ী গত শুক্রবার ভিকটিমকে ২০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। বাকি টাকা রোববার (আজ) ব্যাংকের মাধ্যমে চক্রটি দেয়ার জন্য ভিকটিমকে বলা হয়। সমঝোতা অনুসারে ভিকটিম আশিকুজ্জামান চক্রের শেখানো কৌশল হিসেবে চারটি মিষ্টির প্যাকেটে দেড় লাখ টাকা নিয়ে হোটেল হিরাঝিলে যান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে সংরক্ষিত টাকা গ্রহণের সময় পাশে অবস্থান নেয়া ডিবি পুলিশ তাদেরকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে।

ডিবি জানায়, দুদক কর্মচারী গৌতম ভট্টাচার্য কর্ম সূত্রে জানে দুর্নীতি সংক্রান্তে কীভাবে মানুষকে নোটিশ পাঠাতে হয়। এই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তার সহযোগীদেরকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও চাকরিজীবীকে টার্গেট করত। তাদের ব্যক্তিগত নানা তথ্য সংগ্রহ করে দুদকের চিঠির খাম ও প্যাড/ফরমেট ব্যবহার করে অভিযোগের নোটিশ পাঠাত। পরে কখনো মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে, কখনো শিল্পকলা একাডেমির ভেতরে বসে, কখনো আশপাশের বিভিন্ন হোটেলে টার্গেটের টাকায় খেতে খেতে তাদেরকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি দান/সমঝোতার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতো।

ডিবি জানিয়েছে, কথিত দুদক অফিসার ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামানকে বলে, আপনি মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যান। আপনাকে ডিবি, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা গ্রেপ্তারের জন্য খোঁজছে। নোটিশ বহনকারী ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের একজন কথিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আশিকুজ্জামানকে কথা বলিয়ে দেয়। হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের ওই কর্মকর্তা মোবাইলে কথা বলা সমীচীন নয় বলে বিস্তারিত জানার জন্য তাকে দুদক অফিসে সশরীরে হাজির হতে বলে। দুদকের নোটিশে বিভিন্ন অভিযোগের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়, ‘শূন্য থেকে তিনি আজ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাকে দুদকের জিম্মায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমতাবস্থায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন’। কারণ দর্শানোসহ ব্যক্তিগত শুনানির জন্য আগামি ১০ জুলাই তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

ডিবি জানিয়েছে, ঘাবড়ে যাওয়া আশিকুজ্জামানকে দফায় দফায় ফোন দেয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপে। ভয় দেখানো হয় সম্পত্তি ক্রোক, যাবজ্জীবন কারাদন্ড, মিডিয়ার মাধ্যমে বেইজ্জতি করাসহ সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনএসআই, ডিবি পুলিশ এবং দুদক দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে কঠোর শাস্তির। একপর্যায়ে আশিকুজ্জামানকে মতিঝিলের হিরাঝিল হোটেলের দ্বিতীয় তলায় এসে সমঝোতার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। বিষয়টি ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামান লালবাগ বিভাগের গোয়েন্দা পুলিশকে অবহিত করেন। অভিযোগ পেয়ে ডিএমপির লালবাগ বিভাগ দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং দুদকের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলামসহ হোটেল হিরাঝিলের আশপাশে অবস্থান নেয়। সমঝোতা অনুসারে ভিকটিম আশিকুজ্জামান চারটি মিষ্টির প্যাকেটে দেড় লাখ টাকা ভরে হোটেল হিরাঝিলে যান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে সংরক্ষিত টাকা গ্রহণ করার সময় আশপাশে অবস্থান নেয়া গোয়েন্দা পুলিশ চার জনের ওই চক্রকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে।

ডিবি প্রধান জানায়, গৌতম ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে দুদকের বিভিন্ন মহাপরিচালকদের পিএ হিসেবে কাজ করে আসছে। সে কখনো দুদকের ডিজি (তদন্ত), ডিজি (অ্যাডমিন), ডিজি (প্রসিকিউশন), ডিজি (মানি লন্ডারিং) এর অফিসের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (পিএ) হিসেবে কাজ করছে। গৌতম ও এসকেন ছাড়া বাকি দুজন দালাল। তাদেরকে হেল্প করত গৌতম ভট্টাচার্য ও চাকরিচ্যুত পুলিশ কনস্টেবল এসকেন আলী খান। এই দুজন জানে একটা মানুষকে কীভাবে ডাকতে হবে এবং ডাকার পর তার কাছে কীভাবে টাকা চাওয়া যায়। এই চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় রয়েছে। তাদের টার্গেট ছিল ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও যারা হঠাৎ বড় লোক হয়েছে। তারা দুদকের নামে বেনামি চিঠি দেয়, ভিকটিমদের নামে দুদকের সিল দিয়ে।

এই ঘটনার সঙ্গে দুদকের ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তা বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে কি-না এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মাধ্যমে এ পর্যন্ত কতজন মানুষ প্রতারিত হয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এই বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। আসামিদের রিমান্ডে নিলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করব।

দুদকের গোয়েন্দা শাখার প্রধান জানান, দুদকের কর্মচারীসহ একটি চক্র ভুয়া নোটিশ পাঠিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এমন অভিযোগ তারা পান। এ নিয়ে তারা গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করে। ব্যবসায়ী আশিকুর রহমানকে নোটিশ পাঠিয়ে তার কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছেন এমন তথ্য পাওয়ার পর তারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহযোগিতা নেন চক্রটিকে ধরতে। যৌথভাবে অভিযানে দুদকের টিম ঘটনাস্থলে সিভিল পোশাকে আগ থেকেই অবস্থান নেয়। এরপর অর্থ লেনদেনের সময় ডিবির টিম প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তার করে। দুদক গোয়েন্দা শাখা থেকে এ বিষয়ে আরও তদন্ত করা হচ্ছে।

৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

গতকাল তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক রুহুল আমীন। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবীর তাদের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ব্যবসার আড়ালে অনলাইনে প্রতারণার অভিযোগ

ছবি

ঢাকা বাড্ডায় এক হত্যা মামলায় তিন আসামির যাবজ্জীবন

ছবি

সাগর-রুনি হত্যা: মামলার প্রতিবেদন জমা আবারও পেছালো

ছবি

আদালতের সময় নষ্ট করায় সেলিম প্রধানকে জরিমানা

খুলনা ও মৌলভীবাজারে চার জনের মৃত্যুদণ্ড

ছবি

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেড় বছরে ৮০ জন হত্যা

ছবি

উড়োজাহাজ লিজে অনিয়ম: বিমানের সাবেক এমডিসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

চাকরি দেওয়ার কথা বলে অর্থ আত্মসাৎ, বরখাস্ত অফিস সহায়কের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

ছবি

সার আত্মসাৎ মামলায় সাবেক এমপি পোটনসহ ৫ জন কারাগারে

ছবি

বিমানবন্দর ও টঙ্গী থেকে ৭ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার

ছবি

ইন্স্যুরেন্স চাকরির আড়ালে জঙ্গি সংগঠনের রিক্রুটার : ডিবি

ছবি

স্বামী-স্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

গোবিন্দগঞ্জে নির্যাতন করে গৃহবধূর মাথার চুল কেটে দিয়েছে প্রতিপক্ষ, ৩জন গ্রেফতার

লাখে ১১ হাজার লাভ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৬৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ

ছবি

ধর্ম অবমাননায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জবি শিক্ষার্থীর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড

ভারতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কিডনি হাতিয়ে নিতো চক্রটি

ছবি

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য গ্রেপ্তার

ছবি

ডিজিটাল ডিভাইসে জানানো হতো উত্তর,১০মিনিটে পরীক্ষা শেষ

সংবাদের সার্কুলেশন ম্যানেজারকে প্রাণনাশের হুমকি

ছবি

নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও দুইজনের যাবজ্জীবন, খালাস ৬

মাদকের তথ্য দেয়ায় হাতের রগ কর্তন, আসামীর পরিবর্তে ভুক্তভোগীকেই আটক, পরে ৫০ হাজার টাকায় মুক্তি

সাবেক এসপি সুব্রত কুমার হালদারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট

ছবি

‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন : ডিবি প্রধান

ছবি

এবার মানবপাচার মামলায় মিল্টন সমাদ্দারের ৪ দিনের রিমান্ড

ছবি

ডিবি কার্যালয়ে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী, চলছে জিজ্ঞাসাবাদ

রাবির ক্যান্টিন পরিচালকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ

ছবি

মিল্টন সমাদ্দার ৩ দিনের রিমান্ডে

ছবি

তিন দিন রিমান্ডে মিল্টন সমাদ্দার

ছবি

আলোচিত মিল্টন সমাদ্দারকে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : ছাত্রলীগ নেতাকে চাঁদা না দেয়ায় ব্যবসায়ীকে মারধরের অভিযোগ

ছবি

নিঃসঙ্গ নারীদের টার্গেট, আমেরিকায় নেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণা

আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফসহ ৩৩ আসামি অভিযুক্ত

ছবি

ফরিদপুরে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যায় জড়িতরা অচিরেই গ্রেফতার

ফরিদগঞ্জে মাকে জবাই করে হত্যা করলো ছেলে

সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলেসহ কারাগারে ৩

প্রগতির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

tab

অপরাধ ও দুর্নীতি

দুদকের নামে নোটিশ করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে চক্র

ব্যবসায়ী-শিল্পপতি চাকরিজীবী টার্গেট

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

শনিবার, ২৪ জুন ২০২৩

দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি দমন কমিশনের ভেতরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপের সহযোগিতায় টার্গেট করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে নোটিশ পাঠাচ্ছেন। কর্মকর্তাদের নামে সাক্ষর করে ওইসব নোটিশে চাওয়া হচ্ছে সম্পদের হিসেব। এজন্য ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের টার্গেট করে এসব নোটিশ পাঠিয়ে পক্ষান্তরে মামলার ভয় দেখানো হয়। নোটিশ পাঠানোর পর আবার তা সমাধন করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এসব নোটিশ করে চক্রটি প্রতারণা করে আসলেও রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একই প্রক্রিয়ায় এক ব্যবসায়ী নোটিশ পাঠিয়ে মামলা ঠেকাতে ৩ কোটি টাকার চুক্তি করা হয়। এরপর ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা আনতে গেলে দুদকের গোয়েন্দা টিম ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির যৌথ অভিযানে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার মধ্যে দুদকের মানিলন্ডারিং শাখার মহাপরিচালক (ডিজির) অফিস সহকারী এবং একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাও ছিল।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পিএ গৌতম ভট্টাচার্য (৪২), পুলিশের চাকরিচ্যুত কনস্টেবল মো. এসকেন আলী খান (৫৭) এবং হাবিবুর রহমান (৪২) ও পরিতোষ মন্ডল (৬৩)। তাদের কাছ থেকে মিষ্টির ৪টি প্যাকেট, নগদ দেড় লাখ টাকা, ৪টি মোবাইল ফোন, দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের একটি খাম ও দুদকের একটি নোটিশ জব্দ করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার গৌতম ভট্টাচার্য দুদকের ডিজি মানি লন্ডারিংয়ের পিএ হিসেবে কর্মরত। তার বাড়ি মৌলভীবাজার। এসকেন আলী খান চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ। অন্য দুইজন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা, তারা পেশাগতভাবে দালাল ও প্রতারক।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, গত ২০ জুন রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকার ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামানের উত্তরার বাসায় দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের খামে একটি নোটিশ নিয়ে যায় কথিত একজন দুদক অফিসার। চিঠিতে আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা হয় ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণের চোরাচালান ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগ। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে, এমন ভয়ানক অভিযোগ শুনে ঘাবড়ে যান আশিকুজ্জামান। মামলা থেকে বাঁচতে তার কাছে প্রথমে ৫ কোটি ও পরে ১ কোটি টাকা দাবি করে কথিত দুদক অফিসার। বিনিময়ে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা দেয়া হয়। কথা অনুযায়ী গত শুক্রবার ভিকটিমকে ২০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। বাকি টাকা রোববার (আজ) ব্যাংকের মাধ্যমে চক্রটি দেয়ার জন্য ভিকটিমকে বলা হয়। সমঝোতা অনুসারে ভিকটিম আশিকুজ্জামান চক্রের শেখানো কৌশল হিসেবে চারটি মিষ্টির প্যাকেটে দেড় লাখ টাকা নিয়ে হোটেল হিরাঝিলে যান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে সংরক্ষিত টাকা গ্রহণের সময় পাশে অবস্থান নেয়া ডিবি পুলিশ তাদেরকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে।

ডিবি জানায়, দুদক কর্মচারী গৌতম ভট্টাচার্য কর্ম সূত্রে জানে দুর্নীতি সংক্রান্তে কীভাবে মানুষকে নোটিশ পাঠাতে হয়। এই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তার সহযোগীদেরকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও চাকরিজীবীকে টার্গেট করত। তাদের ব্যক্তিগত নানা তথ্য সংগ্রহ করে দুদকের চিঠির খাম ও প্যাড/ফরমেট ব্যবহার করে অভিযোগের নোটিশ পাঠাত। পরে কখনো মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে, কখনো শিল্পকলা একাডেমির ভেতরে বসে, কখনো আশপাশের বিভিন্ন হোটেলে টার্গেটের টাকায় খেতে খেতে তাদেরকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি দান/সমঝোতার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতো।

ডিবি জানিয়েছে, কথিত দুদক অফিসার ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামানকে বলে, আপনি মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যান। আপনাকে ডিবি, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা গ্রেপ্তারের জন্য খোঁজছে। নোটিশ বহনকারী ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের একজন কথিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আশিকুজ্জামানকে কথা বলিয়ে দেয়। হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের ওই কর্মকর্তা মোবাইলে কথা বলা সমীচীন নয় বলে বিস্তারিত জানার জন্য তাকে দুদক অফিসে সশরীরে হাজির হতে বলে। দুদকের নোটিশে বিভিন্ন অভিযোগের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়, ‘শূন্য থেকে তিনি আজ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাকে দুদকের জিম্মায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমতাবস্থায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন’। কারণ দর্শানোসহ ব্যক্তিগত শুনানির জন্য আগামি ১০ জুলাই তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

ডিবি জানিয়েছে, ঘাবড়ে যাওয়া আশিকুজ্জামানকে দফায় দফায় ফোন দেয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপে। ভয় দেখানো হয় সম্পত্তি ক্রোক, যাবজ্জীবন কারাদন্ড, মিডিয়ার মাধ্যমে বেইজ্জতি করাসহ সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনএসআই, ডিবি পুলিশ এবং দুদক দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে কঠোর শাস্তির। একপর্যায়ে আশিকুজ্জামানকে মতিঝিলের হিরাঝিল হোটেলের দ্বিতীয় তলায় এসে সমঝোতার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। বিষয়টি ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামান লালবাগ বিভাগের গোয়েন্দা পুলিশকে অবহিত করেন। অভিযোগ পেয়ে ডিএমপির লালবাগ বিভাগ দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং দুদকের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলামসহ হোটেল হিরাঝিলের আশপাশে অবস্থান নেয়। সমঝোতা অনুসারে ভিকটিম আশিকুজ্জামান চারটি মিষ্টির প্যাকেটে দেড় লাখ টাকা ভরে হোটেল হিরাঝিলে যান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে সংরক্ষিত টাকা গ্রহণ করার সময় আশপাশে অবস্থান নেয়া গোয়েন্দা পুলিশ চার জনের ওই চক্রকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে।

ডিবি প্রধান জানায়, গৌতম ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে দুদকের বিভিন্ন মহাপরিচালকদের পিএ হিসেবে কাজ করে আসছে। সে কখনো দুদকের ডিজি (তদন্ত), ডিজি (অ্যাডমিন), ডিজি (প্রসিকিউশন), ডিজি (মানি লন্ডারিং) এর অফিসের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (পিএ) হিসেবে কাজ করছে। গৌতম ও এসকেন ছাড়া বাকি দুজন দালাল। তাদেরকে হেল্প করত গৌতম ভট্টাচার্য ও চাকরিচ্যুত পুলিশ কনস্টেবল এসকেন আলী খান। এই দুজন জানে একটা মানুষকে কীভাবে ডাকতে হবে এবং ডাকার পর তার কাছে কীভাবে টাকা চাওয়া যায়। এই চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় রয়েছে। তাদের টার্গেট ছিল ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও যারা হঠাৎ বড় লোক হয়েছে। তারা দুদকের নামে বেনামি চিঠি দেয়, ভিকটিমদের নামে দুদকের সিল দিয়ে।

এই ঘটনার সঙ্গে দুদকের ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তা বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে কি-না এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মাধ্যমে এ পর্যন্ত কতজন মানুষ প্রতারিত হয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এই বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। আসামিদের রিমান্ডে নিলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করব।

দুদকের গোয়েন্দা শাখার প্রধান জানান, দুদকের কর্মচারীসহ একটি চক্র ভুয়া নোটিশ পাঠিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এমন অভিযোগ তারা পান। এ নিয়ে তারা গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করে। ব্যবসায়ী আশিকুর রহমানকে নোটিশ পাঠিয়ে তার কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছেন এমন তথ্য পাওয়ার পর তারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহযোগিতা নেন চক্রটিকে ধরতে। যৌথভাবে অভিযানে দুদকের টিম ঘটনাস্থলে সিভিল পোশাকে আগ থেকেই অবস্থান নেয়। এরপর অর্থ লেনদেনের সময় ডিবির টিম প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তার করে। দুদক গোয়েন্দা শাখা থেকে এ বিষয়ে আরও তদন্ত করা হচ্ছে।

৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

গতকাল তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক রুহুল আমীন। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবীর তাদের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

back to top