মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
ট্রেন শিডিউল বিপর্যয় শুধু যাত্রী ভোগান্তির গল্প নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা এবং নীতিনির্ধারণের ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রেলপথের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো একক লাইন ব্যবস্থা। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ রুট এখনো সিঙ্গেল লাইন। অর্থাৎ এক লাইনে ট্রেন দুই দিকেই চলে, একে অপরকে অতিক্রম করতে পারে না। ফলাফল, এক ট্রেন একটু দেরি করলেই পুরো রুটের শিডিউল ভেঙে পড়ে। এই একক লাইন ব্যবস্থা এখন রেলওয়ের শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
রেলওয়ের বহরে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ বছর পুরনো ইঞ্জিন। অনেক ইঞ্জিন প্রতিদিনই বিকল হচ্ছে, মাঝপথে থেমে যাচ্ছে আর কোচগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট ও দক্ষ টেকনিশিয়ান না থাকায়, পুরনো ইঞ্জিনগুলো দিন গুনছে মৃত্যুর অপেক্ষায়। বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে বর্তমানে ৩০৭টি ইঞ্জিন রয়েছে, যার মধ্যে ১৯৭টি মিটারগেজ এবং বাকিগুলো ব্রডগেজ ইঞ্জিন। অনেক সময় ইঞ্জিনের খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না, ফলে একটি ইঞ্জিন সারাতে সপ্তাহ লেগে যায়। এ অবস্থায় নতুন ট্রেন চালানোর ঘোষণাগুলো জনতার কানে আনন্দের নয়, বরং এক প্রহসন মাত্র।
আধুনিক রেলওয়ের প্রাণ হলো সিগন্যাল ও কন্ট্রোল সিস্টেম। উন্নত দেশগুলোয় ট্রেন চলাচল পুরোপুরি কম্পিউটারনির্ভর- একটি ট্রেনের অবস্থান, গতি, সিগন্যালসবকিছু সেন্ট্রাল মনিটরিং সিস্টেমে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় চলছে ম্যানুয়াল সিগন্যালিং। অর্থাৎ, স্টেশন মাস্টার হাতের পতাকা নাড়েন, বা ফোনে জানান ‘ট্রেন ছাড়তে পারে।’ এই প্রাচীন পদ্ধতিতে ভুল, বিলম্ব ও দুর্ঘটনা স্বাভাবিক।ডিজিটাল সিগন্যাল প্রকল্পের কাজ ধীর গতিতে চলছে। অনেক জায়গায় কাজ শুরু হলেও শেষ হয়নি; কোথাও কাজ শেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্ক্রিয় অবস্থায়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় সব বিভাগেই কর্মীসংকট। ট্রেনচালক, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার, সিগন্যাল অপারেটর সবখানেই লোকবল কম। আর যারা আছেন, তাদের অনেকেই বছরের পর বছর প্রশিক্ষণবিহীন অবস্থায় কাজ করছেন। অন্যদিকে, রেলওয়ে পরিচালনা ব্যবস্থাও অত্যন্ত জটিল ও আমলাতান্ত্রিক। সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে মাসের পর মাস, বাজেট অনুমোদনে রাজনীতি কাজ করে, ফলে কাজের গতি থাকে ধীর। এই দুর্বল ব্যবস্থাপনা পুরো রেলব্যবস্থার গতিকে থামিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হলো মূল সংস্কারই হয়নি। যেখানে প্রয়োজন ছিল দক্ষ মানবসম্পদ, শক্তিশালী মনিটরিং, এবং সময়নিষ্ঠ ব্যবস্থাপনা; সেখানে আমরা দেখেছি ‘প্রকল্পনির্ভর উন্নয়ন।’ অর্থাৎ, প্রকল্প শেষ হলে কাজও শেষ। কিন্তু সেবা ঠিকঠাক হয় না। অন্যদিকে, দুর্নীতি ও অদক্ষতা রেল খাতের উন্নয়নকে ধীর করে ফেলেছে। কিছু উন্নয়ন প্রকল্প কাগজে আছে, বাস্তবে নেই।
বিশ্বের উন্নত রেলব্যবস্থাগুলো এখন ডিজিটাল মনিটরিং, ট্রেন ট্র্যাকিং অ্যাপ, অটোমেটেড সিগন্যালিং সিস্টেম, এবং স্মার্ট মেইনটেন্যান্সের যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে সেই পথে হাঁটার চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু গতি খুব ধীর। ‘রেলওয়ে ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ চালুর উদ্যোগ নেয়া হলেও, এখনো তা পূর্ণ কার্যকর হয়নি। তবে আশার কথা, দেশের কিছু বড় প্রকল্প যেমন- পদ্মা রেল সংযোগ, ডাবল লাইন প্রকল্প, ডুয়েল গেজ সম্প্রসারণ বাস্তবায়িত হলে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হতে পারে।
বাংলাদেশের ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় কেবল এক দিনের দেরি নয়, এটি সময়ের সঙ্গে এক জাতির দৌড়ে পিছিয়ে পড়া। রেলপথ একটি দেশের জীবনরেখা, যার উপর নির্ভর করে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, ও সামাজিক স্থিতি। যদি আমরা সত্যিই উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, তবে রেলপথকে সময়নিষ্ঠ ও আধুনিক করা ছাড়া বিকল্প নেই। বাংলাদেশের রেলপথকে যদি নতুন করে বাঁচাতে হয়, তবে আমাদের সময়ের হিসাব রাখতে হবে। কারণ সময় হারানো মানেই ভবিষ্যৎ হারানো। মনে রাখতে হবে, ‘রেল শুধু লাইন আর ইঞ্জিন নয়, এটা সময়ের সঙ্গে চলার প্রতিশ্রুতি।’
আরিফুল ইসলাম রাফি
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
ট্রেন শিডিউল বিপর্যয় শুধু যাত্রী ভোগান্তির গল্প নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা এবং নীতিনির্ধারণের ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রেলপথের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো একক লাইন ব্যবস্থা। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ রুট এখনো সিঙ্গেল লাইন। অর্থাৎ এক লাইনে ট্রেন দুই দিকেই চলে, একে অপরকে অতিক্রম করতে পারে না। ফলাফল, এক ট্রেন একটু দেরি করলেই পুরো রুটের শিডিউল ভেঙে পড়ে। এই একক লাইন ব্যবস্থা এখন রেলওয়ের শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
রেলওয়ের বহরে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ বছর পুরনো ইঞ্জিন। অনেক ইঞ্জিন প্রতিদিনই বিকল হচ্ছে, মাঝপথে থেমে যাচ্ছে আর কোচগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট ও দক্ষ টেকনিশিয়ান না থাকায়, পুরনো ইঞ্জিনগুলো দিন গুনছে মৃত্যুর অপেক্ষায়। বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে বর্তমানে ৩০৭টি ইঞ্জিন রয়েছে, যার মধ্যে ১৯৭টি মিটারগেজ এবং বাকিগুলো ব্রডগেজ ইঞ্জিন। অনেক সময় ইঞ্জিনের খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না, ফলে একটি ইঞ্জিন সারাতে সপ্তাহ লেগে যায়। এ অবস্থায় নতুন ট্রেন চালানোর ঘোষণাগুলো জনতার কানে আনন্দের নয়, বরং এক প্রহসন মাত্র।
আধুনিক রেলওয়ের প্রাণ হলো সিগন্যাল ও কন্ট্রোল সিস্টেম। উন্নত দেশগুলোয় ট্রেন চলাচল পুরোপুরি কম্পিউটারনির্ভর- একটি ট্রেনের অবস্থান, গতি, সিগন্যালসবকিছু সেন্ট্রাল মনিটরিং সিস্টেমে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় চলছে ম্যানুয়াল সিগন্যালিং। অর্থাৎ, স্টেশন মাস্টার হাতের পতাকা নাড়েন, বা ফোনে জানান ‘ট্রেন ছাড়তে পারে।’ এই প্রাচীন পদ্ধতিতে ভুল, বিলম্ব ও দুর্ঘটনা স্বাভাবিক।ডিজিটাল সিগন্যাল প্রকল্পের কাজ ধীর গতিতে চলছে। অনেক জায়গায় কাজ শুরু হলেও শেষ হয়নি; কোথাও কাজ শেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্ক্রিয় অবস্থায়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় সব বিভাগেই কর্মীসংকট। ট্রেনচালক, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার, সিগন্যাল অপারেটর সবখানেই লোকবল কম। আর যারা আছেন, তাদের অনেকেই বছরের পর বছর প্রশিক্ষণবিহীন অবস্থায় কাজ করছেন। অন্যদিকে, রেলওয়ে পরিচালনা ব্যবস্থাও অত্যন্ত জটিল ও আমলাতান্ত্রিক। সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে মাসের পর মাস, বাজেট অনুমোদনে রাজনীতি কাজ করে, ফলে কাজের গতি থাকে ধীর। এই দুর্বল ব্যবস্থাপনা পুরো রেলব্যবস্থার গতিকে থামিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হলো মূল সংস্কারই হয়নি। যেখানে প্রয়োজন ছিল দক্ষ মানবসম্পদ, শক্তিশালী মনিটরিং, এবং সময়নিষ্ঠ ব্যবস্থাপনা; সেখানে আমরা দেখেছি ‘প্রকল্পনির্ভর উন্নয়ন।’ অর্থাৎ, প্রকল্প শেষ হলে কাজও শেষ। কিন্তু সেবা ঠিকঠাক হয় না। অন্যদিকে, দুর্নীতি ও অদক্ষতা রেল খাতের উন্নয়নকে ধীর করে ফেলেছে। কিছু উন্নয়ন প্রকল্প কাগজে আছে, বাস্তবে নেই।
বিশ্বের উন্নত রেলব্যবস্থাগুলো এখন ডিজিটাল মনিটরিং, ট্রেন ট্র্যাকিং অ্যাপ, অটোমেটেড সিগন্যালিং সিস্টেম, এবং স্মার্ট মেইনটেন্যান্সের যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে সেই পথে হাঁটার চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু গতি খুব ধীর। ‘রেলওয়ে ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ চালুর উদ্যোগ নেয়া হলেও, এখনো তা পূর্ণ কার্যকর হয়নি। তবে আশার কথা, দেশের কিছু বড় প্রকল্প যেমন- পদ্মা রেল সংযোগ, ডাবল লাইন প্রকল্প, ডুয়েল গেজ সম্প্রসারণ বাস্তবায়িত হলে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হতে পারে।
বাংলাদেশের ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় কেবল এক দিনের দেরি নয়, এটি সময়ের সঙ্গে এক জাতির দৌড়ে পিছিয়ে পড়া। রেলপথ একটি দেশের জীবনরেখা, যার উপর নির্ভর করে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, ও সামাজিক স্থিতি। যদি আমরা সত্যিই উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, তবে রেলপথকে সময়নিষ্ঠ ও আধুনিক করা ছাড়া বিকল্প নেই। বাংলাদেশের রেলপথকে যদি নতুন করে বাঁচাতে হয়, তবে আমাদের সময়ের হিসাব রাখতে হবে। কারণ সময় হারানো মানেই ভবিষ্যৎ হারানো। মনে রাখতে হবে, ‘রেল শুধু লাইন আর ইঞ্জিন নয়, এটা সময়ের সঙ্গে চলার প্রতিশ্রুতি।’
আরিফুল ইসলাম রাফি