আনোয়ারুল হক
দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক ও শরীরচর্চা শিক্ষক পদ বাতিল করা হয়েছে। জামায়াত-হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার এই শিক্ষা ও শিশু স্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মানসিক, শারীরিক ও সৃজনশীল বিকাশে শিশু বয়স থেকে ছড়া, কবিতা, গান, ছবি আঁকা, শরীরচর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুর জন্মলগ্ন থেকেই, অনেকে বলেন জন্মের আগে থেকেই সঙ্গীত শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সংগীত চর্চা শিশুর স্মৃতিশক্তি ও একাগ্রতা বৃদ্ধি করে, ভাষা ও শব্দভাণ্ডার উন্নত করে, এবং মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়তা করে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশে শরীরচর্চাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শিশুর হাড় ও পেশি মজবুত করে, হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, মানসিক চাপ কমায়, মনোযোগ ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
নারী কমিশনের রিপোর্টকে ফ্রিজে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেনো পাঠানো হলো? কারণ সেখানে নারী পুরুষের সমতা বিধান করার কথা বলা হয়েছে। নারী সংস্কার কমিশনের সাথে কোনোরকম আলোচনা এমনকি প্রস্তাবগুলো নিয়ে কোনো একাডেমিক আলোচনাও হয়নি। আলোচনা করে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারতো। জামাত-হেফাজত-চরমোনাই- ইনকিলাব মঞ্চের হুমকিতে নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে সরকারের আর কোনো কথা নাই। এমনকি কমিশনের সদস্যরা হয়রানি ও হুমকির মধ্যে পড়েছেন। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার তার নিজ কমিশনের সদস্যদের পাশে দাঁড়ায়নি। নারী সংস্কার ইস্যুতে সরকারের ভূমিকায় নারী সমাজ প্রতারিত বোধ করেছেন
এ সব কথা তো দুনিয়া জুড়েই স্বীকৃত। শুধু জানতে ইচ্ছে করে প্রধান উপদেষ্টা বা সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টাগণ কি শৈশবে কখনো শরীরচর্চা, খেলাধুলা বা পিটি প্যারেড করেননি? তারা কি শৈশবে কখনো গান শোনেননি বা গান করেননি? তাদের কি স্কুলে ড্রইং ক্লাস করতে হতো না? এসব কিছুই কি ধর্মবিরোধী, না ধর্মের নামে যারা এসব কুপমন্ডুকতা করছেন সরকার শুধুই তাদের খুশি রাখতে আগ্রহী? অন্তর্বর্তী সরকার দেশ ও দশের সংস্কারের জন্য এতো কমিশন গঠন করলেন, কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাবনার জন্য কোনো কমিশন হলো না। মন্ত্রনালয় বা শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ফরমান জারিী করে তুঘলকি সব কা- ঘটানো হচ্ছে। শিশুরাও বৈষম্যের শিকার হলো।
অন্যদিকে জামায়াত ইসলামের আমীর ঘোষণা করেছেন যদি তারা কখনো রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারেন, তখন নারীরা যাতে বাসাবাড়িতে অধিক সময় থেকে ‘সন্তানের হক’ আদায় করতে পারেন সেজন্য নারীদের অফিস-আদালতে কাজের সময় আট ঘণ্টা থেকে কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করে ফেলবেন। কর্মজীবী নারীদের গর্ভাবস্থায় দাপ্তরিক ছুটির সময় বাড়ানো, অফিস-আদালতে মায়েদের জন্য ‘ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার’সহ দিবাকালীন শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, পুরুষও যাতে সন্তান পালনে ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য পিতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি করা ইত্যাদি সার্বজনীন দাবী এড়িয়ে জামাত আমীরের পাঁচ কর্মঘণ্টার ঘোষণা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
নারীদের কাজ শুধুমাত্র ঘর সামলানো আর সন্তান প্রতিপালন করা-আরো অনেক আগে থেকেই দুনিয়া সেই বিশ্বাসে নেই। বাংলাদেশও নেই। সেই বৃটিশ-ভারত যুগে বেগম রোকেয়া নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের মাধ্যমে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেছিলেন। সেই লড়াইয়ের ধারায় আজ আমাদের সমাজে এমন কোনো ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নেই। ন্যূনতম কর্মসহায়ক পরিবেশ, নিরাপত্তা ও সমমজুরি ছাড়াই পোশাক শিল্পের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে ৮০ শতাংশ নারী তাদের শ্রম বিক্রি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করছে। বিদেশের শ্রমবাজারেও নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানেও নারী শোষিত এবং নির্যাতিত। কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই দেশের কৃষি অর্থনীতিতে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ নারীর সর্বোচ্চ শ্রম। শহুরে জীবনেও কোন খাতে নেই নারীর অংশগ্রহণ?
মাত্র ১৫ মাস আগের জুলাই আন্দোলনেও নারীর বিশেষত ছাত্রী ও তরুণীদের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ আন্দোলনের বাঁক পরিবর্তন করে তাকে বিজয় অভিমুখে নিয়ে যায়। আন্দোলন-সংগ্রামই বলেন, শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণই বলেন আর স্ব-স্ব পেশাগত কাজই হোক - এর মধ্য দিয়ে নারী পুরুষ সকলেই জগতের সৌন্দর্যকেও উপভোগ করে। জগতের এই শোভা থেকে বঞ্চিত করে নারীদের গৃহ অনুরাগী বা আবার ঘরে ঢোকানোর এক প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে জামায়াত আমীরের পাঁচ ঘন্টা তত্ত্ব। অনেকে এটা সরলীকরণ মনে করতে পারেন। তবে দলের উদ্দেশ্য যখন ‘রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা’ এবং ‘শরিয়াহ আইন’ বাস্তবায়ন, তখন নারীকে গৃহ অনুরাগী করাটা প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করাটা অযৌক্তিক নয়।
২০২৪ - এর ৫ আগষ্টের মাস দুই/তিন পরে জামায়াত আমীরের একটি টকশো ইউটিউবে দেখেছিলাম। প্রশ্নকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, জামায়াত ক্ষমতায় আসলে কি নারীদের জন্য পর্দা প্রথা বাধ্যতামূলক করা হবে। তিনি খুব কৌশলী উত্তর দিলেন। বললেন, অবশ্যই না। বাংলাদেশে তো ভিন্ন ধর্মালম্বী নারীরাও আছেন। তাদের জন্য তো পর্দাপ্রথা বাধ্যতামূলক করতে পারি না। পাঠকের কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কাদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে! এরপরে আর কখনো এভাবে বলেছেন বলে শুনিনি। কারণ জামায়াত কৌশলে আরো পরিবর্তন এনেছে। তারা দেশজুড়ে একটি লিবারেল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তারা ‘ছাত্র শিবির দলীয়’ নামে প্যানেল না দিয়ে ভিন্ন নামে প্যানেল দিয়ে এবং প্রচারনায় দ্বীনের বা শিবিরের মতাদর্শিক প্রচার না করে ছাত্রকল্যাণমুলক কর্মসূচী প্রচার করে সার্বজনীন একটা চেহারা আনার চেষ্টা করেছে এবং তাতে সফলও হয়েছে। শিবির নেতৃবৃন্দ যেভাবে (তাদের প্রকৃত বিশ্বাস অনুযায়ী) বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বেপর্দা নারীদের’ সাথে চোখে চোখ রেখে হাসাহাসি করে কথা বলছেন, সেলফি তুলছেন সেটা কতটা ‘শরিয়াহ সম্মত’ তার ব্যখ্যা তারা বা তাদের নতুন সহযোগী হেফাজত বা চরমোনাইর নেতারা ভালো বলতে পারবেন। এই কৌশলে মুগ্ধ হয়ে জুলাই আন্দোলনে শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহসী এবং লড়াকু ভূমিকা রাখা ‘মোনামী ম্যডামরা’ আধুনিক সাজে এমনকি শাড়ির আঁচল মাথার উপর না দিয়েও যেভাবে গদ গদ হয়ে শিবিরের সব কর্মসূচিতে হাজির হচ্ছেন তা কিন্তু সাময়িক। সামনের দিনগুলোতে হয় ইসলামী ছাত্র শিবির আর ইসলামী হিসাবে থাকবে না অথবা মোনামী ম্যাডামদের মুখের হাসি বা আধুনিক পোশাক পরিহিত যে ছাত্রীরা হাসিমুখে ‘শিবির ভাইয়ার’ সাথে সেলফি তুলছেন সেই হাসি মুখ থাকবে না। থাকলেও পর্দায় ঢেকে রাখতে হবে।
এ পরিস্থিতির জন্য অন্যান্য ছাত্র সংগঠনও দায়ী। প্রথমত ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের কার্যক্রম এবং হলের সিট, ডাইনিং, ক্যান্টিন এবং হল প্রশাসনের উপর কতৃত্ব ফলানোর কার্যক্রম তাদেরকে সাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেই রেখেছিল। ছাত্রলীগের একাধিপত্যের মধ্যেও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের যে সীমিত উপস্থিতি ছিলো, তাদের নেতা কর্মীরা ‘অ্যাক্টিভিজম’ (মিছিল- মিটিং- সভা- সমাবেশ) নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে ছাত্রীদের সাথে কোনো সংযোগ বা আলোচনা ছিলো না। আবার কেউ কেউ কথাবার্তায়, আচরণে, পোশাকে ওভার স্মার্ট। আবার কারো কারো জীবনাচরণের ক্ষেত্রে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি এক ধরনের উন্নাসিকতা কাজ করতো। সাধারণ মধ্যবিত্ত রক্ষনশীল পরিবার থেকে আসা ছাত্রীরা এই ‘অ্যাক্টিভিজমে ব্যস্ত এবং ওভার স্মার্টদের অপেক্ষা শিবির পরিচয় লুকানো, সাধারণ ছাত্রী হিসেবে চলা এবং যে কোনো প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে দাতব্য সহযোগিতা পাওয়া ঐ লুক্কায়িত শিবিরকেই নিকটজন মনে করেছে। এ বিষয়টি সম্ভবত অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ইতোপূর্বে ভেবে দেখেনি।
জামায়াত চেষ্টা করছে শিবিরের মত একই ধরনের কৌশল নিতে। তবে জামাতের ‘হিন্দু শাখা’ কৌশল কাজে লাগবে বলে মনে হয় না। ৫ আগস্টের পরে নানা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে এক ধরনের অসহায়ত্ব সৃষ্টি হয়। ইসলামী হুকুমত কায়েম হলে তারা এ দেশে থাকতে পারবেন কিনা, তারা না হয় ‘লাথিগুতো’ অপমান সহ্য করে থেকে গেলেন, কিন্তু তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কী হবে- এ ধরনের অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তাভাব অধিকাংশ পরিবারে। প্রতিবেশী দেশের মোদী-যোগী মিডিয়ার রংচং দেওয়া অপপ্রচার এবং ভারতের শাসক দল বিজেপির আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী প্রচার এ দেশের ইসলামী মৌলবাদীদের বাড়তি অক্সিজেন যোগাচ্ছে। একই সাথে সংখ্যালঘুদের অসহায়ত্ব আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে যেখানে যেখানে জামায়াতের শক্তিশালী সংগঠন আছে সেখানে ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনকে দিয়ে ‘হিন্দু জামায়াত’ তৈরি করা হচ্ছে যা হিন্দু সম্প্রদায়ের মনোজগতে বিভাজনের ক্ষতকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায় তো ভুলে যায়নি এই জামায়াত ও রাজাকার বাহিনীর কারণে ১৯৭১- এ এক কোটি হিন্দুকে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিলো, মা বোনদের ইজ্জত লুন্ঠিত হয়েছিল, কাউকে কাউকে প্রাণ বাঁচাতে ধর্মান্তরিত পর্যন্ত হতে হয়েছিলো। ‘হিন্দু জামাত’ গঠন করায় তারা আরো ভীত হয়ে পড়ছে। আবার তাদের নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেও কিছু লোক আছে যারা এলাকায় ফাও মাতব্বরি, খবরদারি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু কামানোর ধান্দায় হিন্দু জামাত সেজেছে। তারাই জামাতের লিবারেল সাজগোজ ও মেকআপের বারোটা বাজিয়ে দেবে।
কথা হচ্ছিল নারীকে কর্মমুখী করার বদলে গৃহমুখী করার জামাতী পরিকল্পনা নিয়ে। চলে গেলাম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে। লেখালেখির অভ্যাস না থাকলে যা হয়। যাক সে কথা। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে একটি ছিলো নারী সংস্কার কমিশন। সকল কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হলো, সুপারিশগুলোর আলোকে যোজন বিয়োজন করে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কিন্তু নারী কমিশনের রিপোর্টকে ফ্রিজে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেনো পাঠানো হলো? কারণ সেখানে নারী পুরুষের সমতা বিধান করার কথা বলা হয়েছে। নারী সংস্কার কমিশনের সাথে কোনোরকম আলোচনা এমনকি প্রস্তাবগুলো নিয়ে কোনো একাডেমিক আলোচনাও হয়নি। আলোচনা করে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারতো। জামাত-হেফাজত-চরমোনাই- ইনকিলাব মঞ্চের হুমকিতে নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে সরকারের আর কোনো কথা নাই। এমনকি কমিশনের সদস্যরা হয়রানি ও হুমকির মধ্যে পড়েছেন। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার তার নিজ কমিশনের সদস্যদের পাশে দাঁড়ায়নি। নারী সংস্কার ইস্যুতে সরকারের ভূমিকায় নারী সমাজ প্রতারিত বোধ করেছেন।
কিন্তু নারী সংস্কার নিয়ে শূন্যতা থাকবে কেন? শূন্যতা পূরণে জামায়াত আমীর পাঁচঘন্টা তত্ত্ব হাজির করেছেন। জামায়াত আমীর এ প্রস্তাব দিয়ে বাজিমাত করতে চাইলেও সমতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া নারী সমাজের জামায়েত ইসলামের উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি। নারী সমাজ স্পষ্টভাবেই বলছেন, নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণেই তার প্রকৃত সম্মান অর্জিত হতে পারে। নারীর অংশগ্রহণকে সীমিত করে দয়া বা সহানুভূতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সমতা অর্জিত হবে না। বরং নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক পেশা থেকে ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। আর বলা হবে গৃহে অবস্থান করে ‘সন্তানের হক’ আদায় আর ‘স্বামী সেবায়’ মনোনিবেশ করতে। নারীকে নতুন এক বৈষম্যের কাঠামোয় আবদ্ধ করার সুকৌশলী পাঁচঘন্টা তত্ত্ব হাজির করা হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী অভ্যুত্থানের পরে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, নারী সমাজ এমন কি শিশুদের যে ভাবে এক নতুন বৈষম্যের কাঠামোয় আবদ্ধ করার ‘সংস্কার’ প্রক্রিয়া চালু হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে বিএনপিও নীরব। ক্ষমতায় যাওয়ার নানা হিসাব নিকাশ করে বিএনপি তাদেরই ভাষায় ‘উত্থিত উগ্র দক্ষিণ পন্থার’ নানা অংশের সাথে আপোষের পন্থা অনুসরণ করছে। নির্বাচন, সাংসদ আসন নিয়ে পর্দার অন্তরালে চলছে নানা খেলা। এরই মাঝে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের উগ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে দুই নারী চরিত্র নলিনী ও কুমুদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে রচিত বেগম রোকেয়ার কবিতার নলিনীর শেষ উচ্চারণেই কি সমাধান নিহিত রয়েছে? “হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে? দেখি, পাই কি না শান্তি-বারিকণা ডুবিলে এ সরোবরে”!!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
আনোয়ারুল হক
শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক ও শরীরচর্চা শিক্ষক পদ বাতিল করা হয়েছে। জামায়াত-হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার এই শিক্ষা ও শিশু স্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মানসিক, শারীরিক ও সৃজনশীল বিকাশে শিশু বয়স থেকে ছড়া, কবিতা, গান, ছবি আঁকা, শরীরচর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুর জন্মলগ্ন থেকেই, অনেকে বলেন জন্মের আগে থেকেই সঙ্গীত শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সংগীত চর্চা শিশুর স্মৃতিশক্তি ও একাগ্রতা বৃদ্ধি করে, ভাষা ও শব্দভাণ্ডার উন্নত করে, এবং মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়তা করে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশে শরীরচর্চাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শিশুর হাড় ও পেশি মজবুত করে, হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, মানসিক চাপ কমায়, মনোযোগ ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
নারী কমিশনের রিপোর্টকে ফ্রিজে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেনো পাঠানো হলো? কারণ সেখানে নারী পুরুষের সমতা বিধান করার কথা বলা হয়েছে। নারী সংস্কার কমিশনের সাথে কোনোরকম আলোচনা এমনকি প্রস্তাবগুলো নিয়ে কোনো একাডেমিক আলোচনাও হয়নি। আলোচনা করে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারতো। জামাত-হেফাজত-চরমোনাই- ইনকিলাব মঞ্চের হুমকিতে নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে সরকারের আর কোনো কথা নাই। এমনকি কমিশনের সদস্যরা হয়রানি ও হুমকির মধ্যে পড়েছেন। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার তার নিজ কমিশনের সদস্যদের পাশে দাঁড়ায়নি। নারী সংস্কার ইস্যুতে সরকারের ভূমিকায় নারী সমাজ প্রতারিত বোধ করেছেন
এ সব কথা তো দুনিয়া জুড়েই স্বীকৃত। শুধু জানতে ইচ্ছে করে প্রধান উপদেষ্টা বা সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টাগণ কি শৈশবে কখনো শরীরচর্চা, খেলাধুলা বা পিটি প্যারেড করেননি? তারা কি শৈশবে কখনো গান শোনেননি বা গান করেননি? তাদের কি স্কুলে ড্রইং ক্লাস করতে হতো না? এসব কিছুই কি ধর্মবিরোধী, না ধর্মের নামে যারা এসব কুপমন্ডুকতা করছেন সরকার শুধুই তাদের খুশি রাখতে আগ্রহী? অন্তর্বর্তী সরকার দেশ ও দশের সংস্কারের জন্য এতো কমিশন গঠন করলেন, কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাবনার জন্য কোনো কমিশন হলো না। মন্ত্রনালয় বা শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ফরমান জারিী করে তুঘলকি সব কা- ঘটানো হচ্ছে। শিশুরাও বৈষম্যের শিকার হলো।
অন্যদিকে জামায়াত ইসলামের আমীর ঘোষণা করেছেন যদি তারা কখনো রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারেন, তখন নারীরা যাতে বাসাবাড়িতে অধিক সময় থেকে ‘সন্তানের হক’ আদায় করতে পারেন সেজন্য নারীদের অফিস-আদালতে কাজের সময় আট ঘণ্টা থেকে কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করে ফেলবেন। কর্মজীবী নারীদের গর্ভাবস্থায় দাপ্তরিক ছুটির সময় বাড়ানো, অফিস-আদালতে মায়েদের জন্য ‘ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার’সহ দিবাকালীন শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, পুরুষও যাতে সন্তান পালনে ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য পিতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি করা ইত্যাদি সার্বজনীন দাবী এড়িয়ে জামাত আমীরের পাঁচ কর্মঘণ্টার ঘোষণা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
নারীদের কাজ শুধুমাত্র ঘর সামলানো আর সন্তান প্রতিপালন করা-আরো অনেক আগে থেকেই দুনিয়া সেই বিশ্বাসে নেই। বাংলাদেশও নেই। সেই বৃটিশ-ভারত যুগে বেগম রোকেয়া নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের মাধ্যমে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেছিলেন। সেই লড়াইয়ের ধারায় আজ আমাদের সমাজে এমন কোনো ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নেই। ন্যূনতম কর্মসহায়ক পরিবেশ, নিরাপত্তা ও সমমজুরি ছাড়াই পোশাক শিল্পের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে ৮০ শতাংশ নারী তাদের শ্রম বিক্রি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করছে। বিদেশের শ্রমবাজারেও নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানেও নারী শোষিত এবং নির্যাতিত। কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই দেশের কৃষি অর্থনীতিতে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ নারীর সর্বোচ্চ শ্রম। শহুরে জীবনেও কোন খাতে নেই নারীর অংশগ্রহণ?
মাত্র ১৫ মাস আগের জুলাই আন্দোলনেও নারীর বিশেষত ছাত্রী ও তরুণীদের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ আন্দোলনের বাঁক পরিবর্তন করে তাকে বিজয় অভিমুখে নিয়ে যায়। আন্দোলন-সংগ্রামই বলেন, শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণই বলেন আর স্ব-স্ব পেশাগত কাজই হোক - এর মধ্য দিয়ে নারী পুরুষ সকলেই জগতের সৌন্দর্যকেও উপভোগ করে। জগতের এই শোভা থেকে বঞ্চিত করে নারীদের গৃহ অনুরাগী বা আবার ঘরে ঢোকানোর এক প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে জামায়াত আমীরের পাঁচ ঘন্টা তত্ত্ব। অনেকে এটা সরলীকরণ মনে করতে পারেন। তবে দলের উদ্দেশ্য যখন ‘রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা’ এবং ‘শরিয়াহ আইন’ বাস্তবায়ন, তখন নারীকে গৃহ অনুরাগী করাটা প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করাটা অযৌক্তিক নয়।
২০২৪ - এর ৫ আগষ্টের মাস দুই/তিন পরে জামায়াত আমীরের একটি টকশো ইউটিউবে দেখেছিলাম। প্রশ্নকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, জামায়াত ক্ষমতায় আসলে কি নারীদের জন্য পর্দা প্রথা বাধ্যতামূলক করা হবে। তিনি খুব কৌশলী উত্তর দিলেন। বললেন, অবশ্যই না। বাংলাদেশে তো ভিন্ন ধর্মালম্বী নারীরাও আছেন। তাদের জন্য তো পর্দাপ্রথা বাধ্যতামূলক করতে পারি না। পাঠকের কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কাদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে! এরপরে আর কখনো এভাবে বলেছেন বলে শুনিনি। কারণ জামায়াত কৌশলে আরো পরিবর্তন এনেছে। তারা দেশজুড়ে একটি লিবারেল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তারা ‘ছাত্র শিবির দলীয়’ নামে প্যানেল না দিয়ে ভিন্ন নামে প্যানেল দিয়ে এবং প্রচারনায় দ্বীনের বা শিবিরের মতাদর্শিক প্রচার না করে ছাত্রকল্যাণমুলক কর্মসূচী প্রচার করে সার্বজনীন একটা চেহারা আনার চেষ্টা করেছে এবং তাতে সফলও হয়েছে। শিবির নেতৃবৃন্দ যেভাবে (তাদের প্রকৃত বিশ্বাস অনুযায়ী) বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বেপর্দা নারীদের’ সাথে চোখে চোখ রেখে হাসাহাসি করে কথা বলছেন, সেলফি তুলছেন সেটা কতটা ‘শরিয়াহ সম্মত’ তার ব্যখ্যা তারা বা তাদের নতুন সহযোগী হেফাজত বা চরমোনাইর নেতারা ভালো বলতে পারবেন। এই কৌশলে মুগ্ধ হয়ে জুলাই আন্দোলনে শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহসী এবং লড়াকু ভূমিকা রাখা ‘মোনামী ম্যডামরা’ আধুনিক সাজে এমনকি শাড়ির আঁচল মাথার উপর না দিয়েও যেভাবে গদ গদ হয়ে শিবিরের সব কর্মসূচিতে হাজির হচ্ছেন তা কিন্তু সাময়িক। সামনের দিনগুলোতে হয় ইসলামী ছাত্র শিবির আর ইসলামী হিসাবে থাকবে না অথবা মোনামী ম্যাডামদের মুখের হাসি বা আধুনিক পোশাক পরিহিত যে ছাত্রীরা হাসিমুখে ‘শিবির ভাইয়ার’ সাথে সেলফি তুলছেন সেই হাসি মুখ থাকবে না। থাকলেও পর্দায় ঢেকে রাখতে হবে।
এ পরিস্থিতির জন্য অন্যান্য ছাত্র সংগঠনও দায়ী। প্রথমত ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের কার্যক্রম এবং হলের সিট, ডাইনিং, ক্যান্টিন এবং হল প্রশাসনের উপর কতৃত্ব ফলানোর কার্যক্রম তাদেরকে সাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেই রেখেছিল। ছাত্রলীগের একাধিপত্যের মধ্যেও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের যে সীমিত উপস্থিতি ছিলো, তাদের নেতা কর্মীরা ‘অ্যাক্টিভিজম’ (মিছিল- মিটিং- সভা- সমাবেশ) নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে ছাত্রীদের সাথে কোনো সংযোগ বা আলোচনা ছিলো না। আবার কেউ কেউ কথাবার্তায়, আচরণে, পোশাকে ওভার স্মার্ট। আবার কারো কারো জীবনাচরণের ক্ষেত্রে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি এক ধরনের উন্নাসিকতা কাজ করতো। সাধারণ মধ্যবিত্ত রক্ষনশীল পরিবার থেকে আসা ছাত্রীরা এই ‘অ্যাক্টিভিজমে ব্যস্ত এবং ওভার স্মার্টদের অপেক্ষা শিবির পরিচয় লুকানো, সাধারণ ছাত্রী হিসেবে চলা এবং যে কোনো প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে দাতব্য সহযোগিতা পাওয়া ঐ লুক্কায়িত শিবিরকেই নিকটজন মনে করেছে। এ বিষয়টি সম্ভবত অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ইতোপূর্বে ভেবে দেখেনি।
জামায়াত চেষ্টা করছে শিবিরের মত একই ধরনের কৌশল নিতে। তবে জামাতের ‘হিন্দু শাখা’ কৌশল কাজে লাগবে বলে মনে হয় না। ৫ আগস্টের পরে নানা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে এক ধরনের অসহায়ত্ব সৃষ্টি হয়। ইসলামী হুকুমত কায়েম হলে তারা এ দেশে থাকতে পারবেন কিনা, তারা না হয় ‘লাথিগুতো’ অপমান সহ্য করে থেকে গেলেন, কিন্তু তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কী হবে- এ ধরনের অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তাভাব অধিকাংশ পরিবারে। প্রতিবেশী দেশের মোদী-যোগী মিডিয়ার রংচং দেওয়া অপপ্রচার এবং ভারতের শাসক দল বিজেপির আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী প্রচার এ দেশের ইসলামী মৌলবাদীদের বাড়তি অক্সিজেন যোগাচ্ছে। একই সাথে সংখ্যালঘুদের অসহায়ত্ব আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে যেখানে যেখানে জামায়াতের শক্তিশালী সংগঠন আছে সেখানে ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনকে দিয়ে ‘হিন্দু জামায়াত’ তৈরি করা হচ্ছে যা হিন্দু সম্প্রদায়ের মনোজগতে বিভাজনের ক্ষতকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায় তো ভুলে যায়নি এই জামায়াত ও রাজাকার বাহিনীর কারণে ১৯৭১- এ এক কোটি হিন্দুকে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিলো, মা বোনদের ইজ্জত লুন্ঠিত হয়েছিল, কাউকে কাউকে প্রাণ বাঁচাতে ধর্মান্তরিত পর্যন্ত হতে হয়েছিলো। ‘হিন্দু জামাত’ গঠন করায় তারা আরো ভীত হয়ে পড়ছে। আবার তাদের নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেও কিছু লোক আছে যারা এলাকায় ফাও মাতব্বরি, খবরদারি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু কামানোর ধান্দায় হিন্দু জামাত সেজেছে। তারাই জামাতের লিবারেল সাজগোজ ও মেকআপের বারোটা বাজিয়ে দেবে।
কথা হচ্ছিল নারীকে কর্মমুখী করার বদলে গৃহমুখী করার জামাতী পরিকল্পনা নিয়ে। চলে গেলাম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে। লেখালেখির অভ্যাস না থাকলে যা হয়। যাক সে কথা। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে একটি ছিলো নারী সংস্কার কমিশন। সকল কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হলো, সুপারিশগুলোর আলোকে যোজন বিয়োজন করে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কিন্তু নারী কমিশনের রিপোর্টকে ফ্রিজে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেনো পাঠানো হলো? কারণ সেখানে নারী পুরুষের সমতা বিধান করার কথা বলা হয়েছে। নারী সংস্কার কমিশনের সাথে কোনোরকম আলোচনা এমনকি প্রস্তাবগুলো নিয়ে কোনো একাডেমিক আলোচনাও হয়নি। আলোচনা করে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারতো। জামাত-হেফাজত-চরমোনাই- ইনকিলাব মঞ্চের হুমকিতে নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে সরকারের আর কোনো কথা নাই। এমনকি কমিশনের সদস্যরা হয়রানি ও হুমকির মধ্যে পড়েছেন। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার তার নিজ কমিশনের সদস্যদের পাশে দাঁড়ায়নি। নারী সংস্কার ইস্যুতে সরকারের ভূমিকায় নারী সমাজ প্রতারিত বোধ করেছেন।
কিন্তু নারী সংস্কার নিয়ে শূন্যতা থাকবে কেন? শূন্যতা পূরণে জামায়াত আমীর পাঁচঘন্টা তত্ত্ব হাজির করেছেন। জামায়াত আমীর এ প্রস্তাব দিয়ে বাজিমাত করতে চাইলেও সমতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া নারী সমাজের জামায়েত ইসলামের উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি। নারী সমাজ স্পষ্টভাবেই বলছেন, নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণেই তার প্রকৃত সম্মান অর্জিত হতে পারে। নারীর অংশগ্রহণকে সীমিত করে দয়া বা সহানুভূতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সমতা অর্জিত হবে না। বরং নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক পেশা থেকে ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। আর বলা হবে গৃহে অবস্থান করে ‘সন্তানের হক’ আদায় আর ‘স্বামী সেবায়’ মনোনিবেশ করতে। নারীকে নতুন এক বৈষম্যের কাঠামোয় আবদ্ধ করার সুকৌশলী পাঁচঘন্টা তত্ত্ব হাজির করা হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী অভ্যুত্থানের পরে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, নারী সমাজ এমন কি শিশুদের যে ভাবে এক নতুন বৈষম্যের কাঠামোয় আবদ্ধ করার ‘সংস্কার’ প্রক্রিয়া চালু হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে বিএনপিও নীরব। ক্ষমতায় যাওয়ার নানা হিসাব নিকাশ করে বিএনপি তাদেরই ভাষায় ‘উত্থিত উগ্র দক্ষিণ পন্থার’ নানা অংশের সাথে আপোষের পন্থা অনুসরণ করছে। নির্বাচন, সাংসদ আসন নিয়ে পর্দার অন্তরালে চলছে নানা খেলা। এরই মাঝে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের উগ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে দুই নারী চরিত্র নলিনী ও কুমুদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে রচিত বেগম রোকেয়ার কবিতার নলিনীর শেষ উচ্চারণেই কি সমাধান নিহিত রয়েছে? “হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে? দেখি, পাই কি না শান্তি-বারিকণা ডুবিলে এ সরোবরে”!!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]