মাহরুফ চৌধুরী
শিক্ষা জাতির মেরুদ-, আর এই মেরুদ-কে শক্তিশালী, সুসংহত ও সুদৃঢ় রাখার প্রধান দায়িত্ব শিক্ষক সমাজের। তাই তাদের জাতি গড়ার কারিগরও বলা হয়ে থাকে। তাদের পেশাগত নিষ্ঠা, নৈতিকতা এবং দেশপ্রেমের মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা জাতির ভবিষ্যত উন্নয়নের পথে একটি বড় অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
আগের লেখায় শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে দেখানো হয়েছে যে, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পরিবর্তে দলীয় আনুগত্য ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে শিক্ষক সমাজ, যারা আদর্শের মূর্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা, তারা এখন দলীয় পরিচয়ের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে উচ্চশিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য থেকে সরে যাচ্ছেন। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব, ক্যারিয়ার এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের ওপর।
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ছাত্র-জনতার রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষার প্রেক্ষাপটে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতির নিগড় থেকে মুক্ত করা এবং শিক্ষকদের পেশাগত দায়বদ্ধতা পুনঃস্থাপনের জন্য কীভাবে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, সেই বিষয়গুলো তুলে ধরা জরুরি মনে করছি। দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করে শিক্ষকদেরকে তাদের মূল কাজ, বিশেষ করে পাঠদান, গবেষণা এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার সুযোগ করে দেওয়া এবং শিক্ষার্থীদেরকে উন্নয়নমুখী শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে সাহায্য করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষকরাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নীতিগত পরিবর্তনের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সক্রিয় প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে।
শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ। বিশেষ করে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের রাজনীতিতে না-জড়াতে সচেতন ও কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা প্রয়োজন। শিক্ষকদের নৈতিক দায়বদ্ধতা ও কর্মকান্ডের স্বচ্ছতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। তাই শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি :
১. শিক্ষকতা একটি পেশা। পেশাজীবীরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন না। পেশাগত নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ দ্বারাই চালিত হবে তাদের পেশাগত কর্মকান্ড। কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শের বা নেতার আনুগত্য তাদের পেশাগত পরিচয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা দেখেছি, দলীয় আনুগত্য ও স্বার্থপরতার কারণে শিক্ষকেরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে সরে এসে রাজনৈতিক বিভাজন এবং পক্ষপাতমূলক আচরণে লিপ্ত হচ্ছেন। তাই শিক্ষক হিসেবে পেশাদারিত্ব বজায় রাখার অঙ্গীকার নিয়েই তাদের পেশাজীবী হিসেবে নিয়োগ ও তাদের মাঝে পেশাদারিত্বের মনোভাব গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। পেশাজীবি হিসেবে শিক্ষকদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, শিক্ষাক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষাদানের পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আর তা করতে শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত মানসিক ও নৈতিক শিক্ষার আয়োজন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে শিক্ষকেরা তাদের পেশাদার দায়িত্ব ও নীতি-নৈতিকতার প্রতি সচেতন হবেন, তাদের কর্মকা-ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা মনোবৃত্তি গড়ে উঠবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হবেন।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও প্রদত্ত শিক্ষার মান গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সরাসরি শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ ও মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে যে বিভাজন তৈরি হয়, তা শিক্ষার্থীদের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, শিক্ষকরা শিক্ষাদানে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুকূল ও সমন্বিত শেখার পরিবেশ তৈরি হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো জ্ঞান অর্জন ও নৈতিকতার বিকাশের কেন্দ্র। এখানে শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যতিত দলীয় রাজনীতি বা আদর্শ স্থান পেলে, শিক্ষকেরা পক্ষপাতিত্বের শিকার হতে পারেন এবং সঠিক মূল্যায়ন ব্যাহত হতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অর্জন বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশ ও ফলাফল প্রভাবিত হয়।
৩. দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর যথাযথ সমাধান করা দরকার। বাংলাদেশে শিক্ষক রাজনীতির মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখা। দ্বিতীয় কারণ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা। অপর একটি কারণ হলো, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব মতাদর্শে শিক্ষকদের নিয়োজিত করে এবং প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করে। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও পেশিশক্তির প্রদর্শনী। দলীয় রাজনীতিকীকরণের এই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি তৈরি করে; ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
৪. দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনয়ন করা জরুরি। আর সেটা করতে হলে প্রশাসনিক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে মানসম্মত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুযোগ প্রদান করা উচিত। এতে শিক্ষকদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব বা দলীয় গ্রুপিংয়ের প্রবণতা কমবে। এটি করার জন্য মেধা ও যোগ্যতাকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করলে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত নিয়মকানুন মেনে চলা এবং নিয়োগ বোর্ডে নির্দলীয় ব্যক্তিদের স্থান দিয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে শুধু উচ্চশিক্ষার মানই উন্নত হবে না, বরং শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের ওপর জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা পুনঃস্থাপিত হবে।
৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দলীয় রাজনৈতিক দল বা নেতাদের প্রভাব কমাতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন রাখা একান্ত জরুরি। মানুষ রাজনীতি-সচেতন প্রাণী। শ্রেণী, বর্ণ, গোত্র ভেদে সব মানুষেরই রয়েছে রাজনীতি করার অধিকার। সে রাজনীতি হবে কল্যাণের রাজনীতি তথা ব্যক্তি-মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত। তাই বলে রাষ্ট্রীয় পরিধিতে জীবনের সর্বস্তরের কর্মকা-ের রাজনীতিকীরণ কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় পরিসীমায় সেবাখাতগুলোকে সর্বাবস্থায় দলীয় রাজনীতির বলয় থেকে মুক্ত রেখে মানুষের অধিকারগুলো নিশ্চত করতে হবে। তাই শিক্ষাকে একটি সেবাখাত হিসেবে বিবেচনা করে উচ্চশিক্ষাসহ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয় স্বার্থে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে মুক্ত করা অপরিহার্য। শিক্ষকেরা রাজনীতি করবেন নিজেদের, তাদের শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালমন্দ এবং দাবীদাওয়া পূরণের জন্য। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন অংশীজনের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা তৈরি করে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাইরের বা স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে সরকারেরও কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
৬. শিক্ষকদের পেশাগত দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে তাদের প্রধান মনোযোগ শিক্ষাদান, গবেষণা, এবং শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের দিকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের কর্মকা-ের নিয়মিত মূল্যায়ন এবং নজরদারির জন্যে ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষকরাজনীতি নিষিদ্ধকরণে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা ও প্রয়োজনীয় আইন-কানুন প্রণয়ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এই নীতিমালার আওতায় শিক্ষকেরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। শিক্ষকেরা শুধুমাত্র তাদের শিক্ষাদান, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন। কেউ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকেন, তাদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে করে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করা নিরুৎসাহিত হবে এবং শিক্ষকেরা শিক্ষার মূল দায়িত্বে ফিরে আসতে বাধ্য হবেন। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে।
৭. দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে শিক্ষকদের মুক্তি দিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রায়োগিক অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন অপরিহার্য। প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দলীয় হস্তক্ষেপের প্রভাব এড়িয়ে তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমাজ সাধারণে স্বীকৃত সুধীজন ও গুণীজনদের নিয়ে গঠিত হবে একটি বোর্ড যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল তৈরি করে সুপারিশ করবে এবং কর্তৃপক্ষ সেই প্যানেল থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কর্মদক্ষতা ও সক্ষমতার বিচারে যোগ্যতমকে নিয়োগ দিবেন। আর তখনই স্বায়ত্বশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যে সুফল বয়ে আনবে। স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার প্রসার এবং জীবনমুখি যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করতে পারবে।
৮. সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকেরা নৈতিক ও পেশাগত নিয়মনীতি অনুসরণের মাধ্যমে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। শিক্ষককেরা তাদের নিজেদের পেশাগত দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন ও মতাদর্শের সঠিক শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে গঠনমূলক চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষকেরা নিজেদের আচার-আচরণের মাধ্যমে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন একটি পরিবেশ গড়ে ওঠে যেখানে শিক্ষার্থীরা নৈতিকতা, মানসিক উৎকর্ষ, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং পেশাগত প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে পারে। দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচকতা সম্পর্কে অভিভাবকদের মাঝেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। অভিভাবকরা যাতে তাদের সন্তানদের শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সমষ্ঠিগতভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পারেন।
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে দেশ ও জাতিকে ধাপে ধাপে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। এটি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নেই নয়, বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতিতে এবং দায় ও দরদের সংস্কৃতির বিস্তারে বিশেষ সহায়ক হবে।
দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষকরাজনীতি বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে শিক্ষার মান ও জাতির আগামী প্রজন্মের মেধার বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য শুধু দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা নয়, বরং নৈতিক, সৃজনশীল এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সুনাগরিক ও সুশাসক গড়ে তোলা; কিন্তু লেজুড়বৃত্তির
শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব এই লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সদিচ্ছা এবং শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের সচেতনতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই শুধু এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে উচ্চশিক্ষাস্তরের শিক্ষকসমাজকে মুক্ত করার উদ্যোগ শুধু সরকার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না; এজন্য একটি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এবং সাধারণ নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন অসম্ভব।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংস্কারে ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে শিক্ষা সংস্কারের যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে একটি সমন্বিত ও সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারও জ্ঞান, মুক্তচিন্তা এবং সৃজনশীলতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একমাত্র তখনই একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল জাতি গঠনে উচ্চশিক্ষার ভূমিকা যথাযথভাবে পূর্ণতা পাবে। শিক্ষকেরা শুধু শিক্ষাদানের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করতে পারেন না; তাকে হতে হয় নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মেধাচর্চার মূর্ত প্রতীক। দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তারা যখন শুধু শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করবেন এবং শিক্ষার্থীদের সার্বিকভাবে সহায়তা করবেন, তখনই তারা প্রকৃত অর্থে জাতি গঠনের কারিগর হতে পারবেন। এটি নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত দায়বদ্ধতা যেমন জরুরি, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস এবং প্রয়োজনীয় নিয়ম-নীতি ও আইনগত পরিবর্তন অত্যাবশ্যক।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
শিক্ষা জাতির মেরুদ-, আর এই মেরুদ-কে শক্তিশালী, সুসংহত ও সুদৃঢ় রাখার প্রধান দায়িত্ব শিক্ষক সমাজের। তাই তাদের জাতি গড়ার কারিগরও বলা হয়ে থাকে। তাদের পেশাগত নিষ্ঠা, নৈতিকতা এবং দেশপ্রেমের মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা জাতির ভবিষ্যত উন্নয়নের পথে একটি বড় অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
আগের লেখায় শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে দেখানো হয়েছে যে, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পরিবর্তে দলীয় আনুগত্য ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে শিক্ষক সমাজ, যারা আদর্শের মূর্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা, তারা এখন দলীয় পরিচয়ের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে উচ্চশিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য থেকে সরে যাচ্ছেন। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব, ক্যারিয়ার এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের ওপর।
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ছাত্র-জনতার রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষার প্রেক্ষাপটে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতির নিগড় থেকে মুক্ত করা এবং শিক্ষকদের পেশাগত দায়বদ্ধতা পুনঃস্থাপনের জন্য কীভাবে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, সেই বিষয়গুলো তুলে ধরা জরুরি মনে করছি। দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করে শিক্ষকদেরকে তাদের মূল কাজ, বিশেষ করে পাঠদান, গবেষণা এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার সুযোগ করে দেওয়া এবং শিক্ষার্থীদেরকে উন্নয়নমুখী শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে সাহায্য করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষকরাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নীতিগত পরিবর্তনের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সক্রিয় প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে।
শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ। বিশেষ করে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের রাজনীতিতে না-জড়াতে সচেতন ও কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা প্রয়োজন। শিক্ষকদের নৈতিক দায়বদ্ধতা ও কর্মকান্ডের স্বচ্ছতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। তাই শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি :
১. শিক্ষকতা একটি পেশা। পেশাজীবীরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন না। পেশাগত নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ দ্বারাই চালিত হবে তাদের পেশাগত কর্মকান্ড। কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শের বা নেতার আনুগত্য তাদের পেশাগত পরিচয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা দেখেছি, দলীয় আনুগত্য ও স্বার্থপরতার কারণে শিক্ষকেরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে সরে এসে রাজনৈতিক বিভাজন এবং পক্ষপাতমূলক আচরণে লিপ্ত হচ্ছেন। তাই শিক্ষক হিসেবে পেশাদারিত্ব বজায় রাখার অঙ্গীকার নিয়েই তাদের পেশাজীবী হিসেবে নিয়োগ ও তাদের মাঝে পেশাদারিত্বের মনোভাব গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। পেশাজীবি হিসেবে শিক্ষকদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, শিক্ষাক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষাদানের পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আর তা করতে শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত মানসিক ও নৈতিক শিক্ষার আয়োজন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে শিক্ষকেরা তাদের পেশাদার দায়িত্ব ও নীতি-নৈতিকতার প্রতি সচেতন হবেন, তাদের কর্মকা-ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা মনোবৃত্তি গড়ে উঠবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হবেন।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও প্রদত্ত শিক্ষার মান গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সরাসরি শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ ও মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে যে বিভাজন তৈরি হয়, তা শিক্ষার্থীদের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, শিক্ষকরা শিক্ষাদানে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুকূল ও সমন্বিত শেখার পরিবেশ তৈরি হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো জ্ঞান অর্জন ও নৈতিকতার বিকাশের কেন্দ্র। এখানে শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যতিত দলীয় রাজনীতি বা আদর্শ স্থান পেলে, শিক্ষকেরা পক্ষপাতিত্বের শিকার হতে পারেন এবং সঠিক মূল্যায়ন ব্যাহত হতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অর্জন বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশ ও ফলাফল প্রভাবিত হয়।
৩. দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর যথাযথ সমাধান করা দরকার। বাংলাদেশে শিক্ষক রাজনীতির মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখা। দ্বিতীয় কারণ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা। অপর একটি কারণ হলো, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব মতাদর্শে শিক্ষকদের নিয়োজিত করে এবং প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করে। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও পেশিশক্তির প্রদর্শনী। দলীয় রাজনীতিকীকরণের এই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি তৈরি করে; ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
৪. দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনয়ন করা জরুরি। আর সেটা করতে হলে প্রশাসনিক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে মানসম্মত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুযোগ প্রদান করা উচিত। এতে শিক্ষকদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব বা দলীয় গ্রুপিংয়ের প্রবণতা কমবে। এটি করার জন্য মেধা ও যোগ্যতাকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করলে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত নিয়মকানুন মেনে চলা এবং নিয়োগ বোর্ডে নির্দলীয় ব্যক্তিদের স্থান দিয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে শুধু উচ্চশিক্ষার মানই উন্নত হবে না, বরং শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের ওপর জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা পুনঃস্থাপিত হবে।
৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দলীয় রাজনৈতিক দল বা নেতাদের প্রভাব কমাতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন রাখা একান্ত জরুরি। মানুষ রাজনীতি-সচেতন প্রাণী। শ্রেণী, বর্ণ, গোত্র ভেদে সব মানুষেরই রয়েছে রাজনীতি করার অধিকার। সে রাজনীতি হবে কল্যাণের রাজনীতি তথা ব্যক্তি-মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত। তাই বলে রাষ্ট্রীয় পরিধিতে জীবনের সর্বস্তরের কর্মকা-ের রাজনীতিকীরণ কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় পরিসীমায় সেবাখাতগুলোকে সর্বাবস্থায় দলীয় রাজনীতির বলয় থেকে মুক্ত রেখে মানুষের অধিকারগুলো নিশ্চত করতে হবে। তাই শিক্ষাকে একটি সেবাখাত হিসেবে বিবেচনা করে উচ্চশিক্ষাসহ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয় স্বার্থে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে মুক্ত করা অপরিহার্য। শিক্ষকেরা রাজনীতি করবেন নিজেদের, তাদের শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালমন্দ এবং দাবীদাওয়া পূরণের জন্য। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন অংশীজনের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা তৈরি করে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাইরের বা স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে সরকারেরও কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
৬. শিক্ষকদের পেশাগত দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে তাদের প্রধান মনোযোগ শিক্ষাদান, গবেষণা, এবং শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের দিকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের কর্মকা-ের নিয়মিত মূল্যায়ন এবং নজরদারির জন্যে ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষকরাজনীতি নিষিদ্ধকরণে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা ও প্রয়োজনীয় আইন-কানুন প্রণয়ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এই নীতিমালার আওতায় শিক্ষকেরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। শিক্ষকেরা শুধুমাত্র তাদের শিক্ষাদান, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন। কেউ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকেন, তাদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে করে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করা নিরুৎসাহিত হবে এবং শিক্ষকেরা শিক্ষার মূল দায়িত্বে ফিরে আসতে বাধ্য হবেন। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে।
৭. দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে শিক্ষকদের মুক্তি দিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রায়োগিক অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন অপরিহার্য। প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দলীয় হস্তক্ষেপের প্রভাব এড়িয়ে তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমাজ সাধারণে স্বীকৃত সুধীজন ও গুণীজনদের নিয়ে গঠিত হবে একটি বোর্ড যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল তৈরি করে সুপারিশ করবে এবং কর্তৃপক্ষ সেই প্যানেল থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কর্মদক্ষতা ও সক্ষমতার বিচারে যোগ্যতমকে নিয়োগ দিবেন। আর তখনই স্বায়ত্বশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যে সুফল বয়ে আনবে। স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার প্রসার এবং জীবনমুখি যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করতে পারবে।
৮. সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকেরা নৈতিক ও পেশাগত নিয়মনীতি অনুসরণের মাধ্যমে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। শিক্ষককেরা তাদের নিজেদের পেশাগত দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন ও মতাদর্শের সঠিক শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে গঠনমূলক চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষকেরা নিজেদের আচার-আচরণের মাধ্যমে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন একটি পরিবেশ গড়ে ওঠে যেখানে শিক্ষার্থীরা নৈতিকতা, মানসিক উৎকর্ষ, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং পেশাগত প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে পারে। দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচকতা সম্পর্কে অভিভাবকদের মাঝেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। অভিভাবকরা যাতে তাদের সন্তানদের শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সমষ্ঠিগতভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পারেন।
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে দেশ ও জাতিকে ধাপে ধাপে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। এটি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নেই নয়, বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতিতে এবং দায় ও দরদের সংস্কৃতির বিস্তারে বিশেষ সহায়ক হবে।
দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষকরাজনীতি বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে শিক্ষার মান ও জাতির আগামী প্রজন্মের মেধার বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য শুধু দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা নয়, বরং নৈতিক, সৃজনশীল এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সুনাগরিক ও সুশাসক গড়ে তোলা; কিন্তু লেজুড়বৃত্তির
শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব এই লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সদিচ্ছা এবং শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের সচেতনতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই শুধু এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে উচ্চশিক্ষাস্তরের শিক্ষকসমাজকে মুক্ত করার উদ্যোগ শুধু সরকার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না; এজন্য একটি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এবং সাধারণ নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন অসম্ভব।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংস্কারে ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে শিক্ষা সংস্কারের যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে একটি সমন্বিত ও সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারও জ্ঞান, মুক্তচিন্তা এবং সৃজনশীলতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একমাত্র তখনই একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল জাতি গঠনে উচ্চশিক্ষার ভূমিকা যথাযথভাবে পূর্ণতা পাবে। শিক্ষকেরা শুধু শিক্ষাদানের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করতে পারেন না; তাকে হতে হয় নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মেধাচর্চার মূর্ত প্রতীক। দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তারা যখন শুধু শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করবেন এবং শিক্ষার্থীদের সার্বিকভাবে সহায়তা করবেন, তখনই তারা প্রকৃত অর্থে জাতি গঠনের কারিগর হতে পারবেন। এটি নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত দায়বদ্ধতা যেমন জরুরি, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস এবং প্রয়োজনীয় নিয়ম-নীতি ও আইনগত পরিবর্তন অত্যাবশ্যক।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]