গৌতম বসুর জন্য
কালীকৃষ্ণ গুহ
তুমি একদিন ভাষা খুঁজে পেয়েছিলে, গৌতম।
অনেক সন্তাপ আর নীরবতা পার হয়ে, ঝড়বৃষ্টি পার হয়ে
ভাষা খুঁজে পেয়েছিলে তুমি। খুঁজে পেয়েছিলে
ধুলোয় ঢাকা মানুষের জন্মজন্মান্তরের সংসার
ব্যক্তি-মানুষের জীবনে ভাষার জন্ম কীভাবে হয়
এ নিয়ে অনেক ভেবেছি।
ভাবনার মধ্যে কাক ডেকে উঠেছে বারবার। একদিন
সহযাত্রীকে বলেছি, ‘ভাষাও অন্ধকার হয়ে এল।’
আজ তোমার জয়ধ্বনি উঠছে, শুনতে পাই, গৌতম...
অঝোরে দিনরাত
শিহাব সরকার
বর্ষায় কত বাহারি ছাতা হাতে হাতে
ফুল লতাপাতা-ছাপা, হলদে-গোলাপি
দ্যাখো রঙ-উৎসব, কালো ছাতা আছে ইতিউতি
বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে দিনরাত।
থৈথৈ জল শহরের রাস্তায় ও ফুটপাতে,
জলডুব জীবনের চাকা বসে গেছে
হাঁটুজল ভেঙে তুমি সাবধানে
হেঁটে এসো রেইনকোটে ঝুম বৃষ্টিতে,
দেখা হবে না জলে হারানো লেকপাড়ে?
ঝরছে বৃষ্টি অঝোরে দিনরাত।
রেইনকোটে নারী এ নগরী দেখেনি বহুদিন
ব্রিকলেনে উইন্টারে ছিলো অন্য কোনো বর্ষাতি
রাণী হয়ে সেইদিন আলো ফুটেছিলে মেঘলায়
এ শহরে ফুটবে না কেন আজ রাতারাতি...
জলজট রাস্তায়। গাড়িগুলি যায় ভূতগাঁও,
দেখি সাদা জ্যোৎস্নায় ভেনিসের কত কত নাও।
ধূলিলিপি
আবদুর রাজ্জাক
পৃথিবীর সর্বত্র সন্ধ্যার রং একই, সেইসব সন্ধ্যা একভাবে
গেয়ে যায় গোধূলি,
সেসব সন্ধ্যার বিমূর্ত নীল কখনও থাকে, কখনও হারিয়ে যায়।
কখনও কখনও কাউকে ভেবে বহুবার কেঁদেছি, তারপর দেখেছি
বিশুদ্ধ ক্রন্দন কখনই আসেনি।
এমন এমনতর দিনে খুব বরষা নামে, তখন তোমার শ্রাবণী মেঘ
ভিজ্যুয়াল ভাবনায় অনুবাদ করে ধূলিলিপি সময়।
সবচেয়ে কঠিন সত্য মানুষ লুকিয়ে রাখে- কেউ ফেরে,
কেউ ফেরে না, এই না-ফেরার ব্যাখা অব্যাখাতই থেকে যায়।
সংজ্ঞায়িত ব্যাপারের অনেক দিক থাকে,
কী অদ্ভুত তোমাকে হারানোর কারণ কখোনই খুঁজিনি, তোমার
নড়বড়ে আকাশ ক্রমশ পার হয়ে এসেছি।
পাগলা! যাকে তুমি আজীবন ভেবেছো,
তাকে ভুল করে ভেবেছো।
ছোটো এই জীবন, কারও জন্য কিছু করতে না-পারার ব্যর্থতা
খুব কষ্ট দেয়, আমাকে। সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রেখে
তোমাকে সান্ত¡না দিয়েছি, ঢেউভাঙা শব্দে, না, প্রতিবাদ করোনি।
অনুভূতিগুলো
সরকার মাসুদ
কখনো মনে হয় অনুভূতিগুলো ছাড়াছাড়া
ভোরের নির্মল বাতাসে কিন্তু মনে হয়
সন্ধ্যার ভাবঘন মগ্নতার ভেতর মনে হয়
প্রতিটি অনুভব খুব চিকন সুতা দিয়ে গাঁথা
দুঃখের আনন্দের বিষাদের উল্লাসের
অন্তঃপুরে পাতা আছে টলটলে পাতকুয়া
অনুভূতিগুলো সব এসে জড়ো হয় ওইখানে
তারা সরলরেখা হয়ে আসে, বাতাসের ধাক্কায়
তারা বক্ররেখা হয়ে ভেসে যায় প্রশ্নাতুর!
অনুভূতিগুলো যতক্ষণ হাওয়ায় ভাসবে
তুমি তাকে কল্পনা করবে, কোনো আকার পাবে না
কোন কিছুর সাথে সংঘর্ষ না-হওয়া অবধি
তুমি তাকে শব্দে-রঙ্গে-সুরে ধরতে পারবে না জীবনেও।
ব্যাগভর্তি রোদ নিয়ে ঘরে ফিরছি
অশোক কর
ব্যাগভর্তি রোদ নিয়ে ঘরে ফিরছি সন্ধ্যাবেলা
রুচির সাথে বাজার সওদায় এসেছে বৈচিত্র্য!
এখন জলের প্রতিবিম্বে দেখি সরল প্রতিহিংসা
সে জলেই সাঁতরে খুঁজি শান্ত সুমুদ্দুর!
চোখের জলে লুকানো সেই সরল হিংসাগুলি
হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসিয়ে দিই সুগন্ধী বকুল!
তখন আমার আকাশ সবার চেয়ে বড়
তুমি চাইলেই বিলিয়ে দিই বুক ভরানো আলো!
নক্ষত্র আলোয় চোখের তারায় আকাশ খুঁজি
যে জল-প্রতিবিম্বে পেয়েছিলে খুঁজে ধ্রুবতারা!
স্বপ্নের সন্ধান
হাইকেল হাশমী
ধূসর সকাল দিগন্ত থেকে ধীরগতিতে নামছে
এই শহরের ব্যস্ত রাস্তায়, বাজারে আর গলিতে
জ্বলন্ত সূর্য মাথার উপর রেখে
ঘুরবো সারাদিন উদ্দেশ্যহীনভাবে
এই রাজপথ, এই চেনা পথ হয়ে একেবারে পথহীন।
দুপুরের তাপ জীর্ণ শরীরে শুষে নিয়ে
জলশূন্য তৃষ্ণার্ত আকাশের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে
ছাইমাখা সন্ধ্যার দিকে হেঁটে যাবো।
ওই সন্ধ্যার সুড়ঙ্গ পার করলেই রাত্রির উপত্যকা
যে করছে অপেক্ষা ক্লান্ত বিনিদ্র চোখের।
রাত্রির কালো অন্ধকারে
চোখ দুটি ঘুরবে ঘুমের দ্বারে দ্বারে
কড়া নাড়বে রুদ্ধ কপাটের
আর অবশেষে হতাশার চিহ্ন চোখে ভরে
ফিরে আসবে বিনিদ্র জগতে।
জানি চোখ আজো পাবে না স্বপ্নের সন্ধান
ঘুমের মাটি হয়েছে অনুর্বর
আর ওখানে ফলবে না স্বপ্নের সোনালি ফসল!
সেই মেঘ সিঁদুরে শঙ্কায়
জিললুর রহমান
মেঘের পাহাড় ছাড়া আর কোনো পাহাড় হাঁটছে না
গজগামিনীর ঢঙে সার সার ঐরাবত যথা
যারা বড় বড় মেঘ- যারা ঘন শাদা ডাইনোসরবেশী
আমাদের মাথার উপরে উড়ে উড়ে
নিত্যদিন প্রকৃতির প্রাণের দোসর
বাধা বন্ধনের ধার ধারে না, মানে না
সীমন্তের কোনো তার- কোনো কাঁটা
দখিনের সমুদ্রের হাওয়া ঠেলে দেয় সে মেঘ উত্তরে
পাহাড়ের ঘাড়ে তারা শীতল পরশ ঢেলে যায়
অজানা গন্তব্যে ছোটে বুনো হরিণীর গতি
আরো উত্তরের বরফের দুধশাদা ঠোঁটে
সাগরের নিমক ও উষ্ণতা হয়তো পায় একচোট
বুকে করে নিয়ে যায় সে আর্দ্রতা মানুষের ঘরে
প্রাণিদের- উদ্ভিদের প্রাণের ভেতর
নতুন শস্যের ঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে
নতুন জীবন চিত্রে ভরেছে আকাশ-
মেঘে মেঘে বেলা হয় বর্ষণের আনন্দের ঢঙে
মাথার ওপরে কড়া ঝলমলে রোদ্দুরের ফাঁকে
নির্বিকার গ্রাস করে করে ওড়ে সুদূর অলক্ষে
সেই মেঘ, সিঁদুরে শঙ্কায় কম্পমান আকাশ গঙ্গায়
বর্ষায় ভেজা কবিতা
হাসান কল্লোল
বৃষ্টি পড়ছে আর কবিতার ছত্রে ছত্রে জল।
সারা কবিতার চোখ, চুল, পায়ের আঙুল ভিজছে এবং কর্দমাক্ত প্রতিমা হয়ে উঠছে।
বাউলের জলমগ্ন প্রেমে
জোৎস্না উঠলে জাগে পূর্ণিমার ঘোর অমাবস্যায়- তার গায়ে কেতকী ফুলের ঘ্রাণ!
অসহায় পৃথিবীতে যখন বন্যায় ভাসে ফসলী জমি, ভূকম্পনে দুলে ওঠে
দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো সেতার-
অতিমারির শ্বাসকষ্টে ভুগছে এদিকে বয়সী ভাই
তখন এইসব জল পড়ার দিনে
ভেজাপাতার বাঁশি- কে বাজায়,
কী সে বাজায়!
এই পৃথিবীতে তবু শিশিরে ভেজা বটের শেকড়,
শিশুর জলমগ্ন স্কুলের সোঁদা গন্ধ,
পুকুরে জলপোকার খেলায় মত্ত দুপুর;
রেলস্টেশনের স্যাঁতসেঁতে হুইসেল
বৃষ্টিতে নেচে ওঠা কাশবনের জলছবি,
বিকেলের বারান্দায় শৈশবের
মেয়েটির মায়া আর
নদীর ওপারে রেখে আসা কদমের শাদা শাদা রেণু,
তবুও তোমাদের কবিতার ভেজা নদীতে সাঁতরায়
আহা জীবনের অবুঝ বিরহী কোরক!
বর্ষায় কবিতা
সর্বনাশা সময় বোঝে না।
মফস্বলের কবিতা
মুজিব ইরম
যে শহরে নদী বয় সকাল বিকাল...
আর কিছু নয়
ছোট এ শহরে আমি
সুর হতে চেয়েছি সে বারিষা বেলায়...
আমি তো দূরের লোক
কাদাপানি মেখে
গ্রাম থেকে এসে
দেখতে চেয়েছি সেই সুরেলা দুপুর...
আছি আমি
রাত্রি হয়ে ছোট এ শহরে
তোমারই কণ্ঠে ডাকা মফস্বলী লোক...
প্রত্যেক জীবনে নাই বৃষ্টিবিলাসের গল্প
ইকবাল হোসেন বুলবুল
যার আছে একটি কেবল জামা; তার থেকে ভালো করে আঁকতে পারে না কেউ
ঘর, ছাতা, আকাশের ছবি। আঁকতে পারে না কেউ জলের দহন দাগ, বৃষ্টির আগুন।
জলের শরীরেও থাকে আলাদা আলাদা ভাষা; তারে ছাড়া তর্জমায় কে বসাবে
সঠিক বয়ান? কে জানাতে পারে বলো, কী সে জ্বালা বৃষ্টির চুম্বনে?
উড়ন্ত মেঘের ঠোঁটে কখন যে মধু ফলে কখন যে ফলে বিষ; সে-ই তো বুঝতে পারে
সবার অধিক। সে-ই তো বলতে পারে বৃষ্টিঝরা বৃষ্টিখেলা কান্না আঁকে কতো!
যার আছে একটি কেবল জামা; তারে ছাড়া বলতে পারে না কেউ প্রত্যেক জীবনে নাই
বৃষ্টিবিলাসের গল্প।
একটি রবাহূত বর্ষাকবিতা
মাহফুজ আল-হোসেন
বৃষ্টিবিলাসী নীলাম্বরী মেঘেদের সাময় কি সান্দ্রতার স্বয়ংবরা মেহফিলে যোগ দিয়েছে কেতাদুরস্ত নাগরিক চাঁদ;
রিমঝিম বৃষ্টিদিনে নান্দনিক দায়ভাগের যক্ষপ্রিয়া পদাবলি আমার,
অপহৃত মিতক্ষরা শৈশবের বিবশ কাল থেকেই তো তুমি অভিমানী মেঘবালিকা ভেবে এসেছো নিজেকে;
পরাবাস্তব এ গান্ধর্ব গোধূলিতে রবাহুত বর্ষাকবিতায় হুটহাট ঢুকে পড়ে হয়তো তোমার মন্দাক্রান্তা
স্বপ্নসাধ উজিয়ে উঠতে পারে- আর সে কারণেই বুঝি বিনা আমন্ত্রণে তুমি যোগ দিতে চাও মধ্যরাতের সুরাবৃষ্টিতে জলমগ্ন বোটক্লাবের অতিনাটকীয় নৃত্য- গীতোৎসবে!
অথচ, সাংসারিক প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের সপ্তব্যঞ্জন আর তার নিরর্থক নৈমিত্তিক অসহনীয় আয়োজন স্পষ্টত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে- দিগন্তস্পর্শী গণমৃত্যুর ক্রন্দনরোল থেকে তোমার উন্নাসিক উৎপ্রেক্ষার ঝাপসা দৃষ্টিকে অন্যত্র দূরে সরিয়ে রাখতে;
শেষাবধি উপায়ান্তর না দেখে এ উপদ্রুত মৃত্যুউপত্যকায় আসন্ন? উৎসবের বেআক্কেলে বাঁকা চাঁদ তার সলাজ রুপোলি মুখ লুকাচ্ছে স্বেচ্ছামৃত্যুর দ-াদেশপ্রাপ্ত আইবুড়ো মেঘবালিকার বৃষ্টিভেজা নীলাম্বরীর আলুথালু আঁচলে...
বই কিনি, পড়বো একদিন
ভাগ্যধন বড়ুয়া
আশা, একদিন পড়বো এইসব কেনা বই
আমার বউ বলে বই দিয়ে শ্মশানে পোড়াবো তোমায়!
তবুও বই কিনি, যথারীতি দৈর্ঘ্যে বাড়ে ভাঁজ,
ধুলো জমে, উইয়ের গোপন বসত
নড়াচড়া হয় সপ্তা-মাসে কিংবা বছরে
পড়া আর হয় না বেশি!
আরও কেনা হয় আরও বাড়ে ক্রম;
বিছানায় বই দেখে বউ রাগে শোয় দেয়াল পেরিয়ে
আশা, আমি আর বই মুখোমুখি হবো অনাগত অপরাহ্ণে...
বর্ষার নন্দনতত্ত্ব
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
একমাথা মেঘে যে ছিল বসে ধূসর আঁধার নিয়ে
মেঘে নয় বর্ষা তার চোখেই পেয়েছিল বর্ষণের বর
ফাগুন-দিনে বিরহের বর্ষা যাকে ভেজাতো লোনাজলে
আষাঢ়-শ্রাবণ আজ তার কাছে চির অজানা অচিন।
অথচ কদমেই ছিল কোনো এক প্রগলভ দুপুরের হাসি
চৈত্রের খরতাপে চৌচির হওয়া মৃত্তিকার বুকে
সেদিন যারা এঁকেছিল জীবনের কাক্সিক্ষত ফল্গুধারা
আজ তারা মেঘহীন মরুময় আকাশের পরিযায়ী প্রাণ।
বর্ষার বেগবতী নদী যে নারী দু’পায়ে তৈরি করে ঘূর্ণি
আজ তার হাসিতে ফোটে না পদ্ম, চন্দ্রাহারী অমাবস্যা
অন্ধকারে উল্লসিত হয়ে ওঠে গুহার প্রথম প্রদোষে
বর্ষণপীড়িত মন বৃষ্টির সেতারে খোঁজে না নন্দনতত্ত্ব।
বৃষ্টিমুখরিতা
চয়ন শায়েরী
সে খোঁজে কদম, তার চাই অন্ত্যমিল- পদ্মবিল- টিনের চালের ছন্দমুখরতা- মেঘবউ হতে চায় বৃষ্টিমুখরিতা; ওই অন্ত্যমিল ভেঙে গেছে সেই কবে- ছন্দপতনের ধারা অবিরল আছে- সবখানে সব কাজে গদ্যের হাতুড়ি- ছন্দের চাতুরি; বাউয়া ব্যাঙের আনন্দের ডাকে বৃষ্টি ঝরে- ব্যাঙের পায়ের ছন্দে কুনজর পড়ে- বন্যার চোখের জলের বন্যায়- ভাঙনে ভাঙনে গদ্য টের পায়; মেঘ ভাঙে নদী ভাঙে- কখনো-বা মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে- মেঘবউ কাঁদে- কদমফুলের মতো করো না-স্পাইক- এক একটা কাইক দিতে, ঘরের বাইরে যেতে দ্বিধা ভর করে- বৃষ্টিমুখরিতা নাচে- নাচের মুদ্রায় টুংটাং বেজে ওঠে মন- সারাক্ষণ- যতক্ষণ বৃষ্টি ঝরে- যে গেছে হারায়ে, সেই বৃষ্টিপুরুষের কথা মনে পড়ে- ভাঙনের পরে।
মাটির সারিন্দায় বৃষ্টির সুর
মাহফুজ রিপন
বৃষ্টি তোমার অপেক্ষায় আছে পুব-পাড়ার ইবাদুল কিসান। তার বউ জহুরা খাতুন। অপেক্ষায় থাকে খলটের আবাতি পোলাপান। পাউগাড়ায় পালিয়ে থাকা ধুড়া সাপ। তোমার অপেক্ষায় থাকে দোয়ালের লম্বা মোচওয়ালা আজদাহা বোয়াল। দেওয়া তোমার অপেক্ষায় থাকে গ্রামের পর গ্রাম। প্রতীক্ষায় চাষের জমি ফেটে চৌচির। গড়িয়ে যায় আম কাঁঠালের বতোর। আড়ষ্ঠ, রুক্ষ এবং গোঁয়াড়-গোবিন্দ হয়ে যায় পুবের পাথার। মাটির সারিন্দায় সুর তুলে তোমারে বোলায় নীলকণ্ঠ বাউল। কারও ডাক তুমি শোন না! কিসের এতো মান- অভিমান? গুস্যা কার লগে। ঐ শোন বেঁধে গেছে জোড় ঢাকের লড়াই। এবার মুচকি হাসো। একবার বিদ্যুৎ চমকাও। শুনছি বিলেতের আকাশ প্লেনের দখলে- পাউডার ছিটায়া দিলে তোমার রফাদফা ফুরায়। আমাগো পাউডার জমিনের পলি। আগারির জলে ভিজাইয়া দেই যদি! আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ধরে মেঘারানির গান; দেখি তুমি কেমনে না নাইম্যা পারো...!
সুমি
ফরিদা ইয়াসমিন সুমি
কঠোর লকডাউনের সন্ধেগুলো আরো বেশি প্রশান্ত হয়ে নামলে
সৌন্দর্যে ডুবে যেতে যেতে দেখি,
ছাদে উঠছ, সেলফি তুলছো, লকডাউনের চেয়েও নিঃসঙ্গ সুন্দরতায়!
সমুদ্রিত হই ভাবালুতায়...
বাতাসের তোড়ে বেসামাল দিঘল-চুল নির্লজ্জ স্তনাগ্রে হুমড়ি খেয়ে
ছায়াঘেরা ত্রিভুজে হানা দেয়!
সমুদ্রকন্যা কাঁপে লকডাউনের মতো কঠোর নির্জনতায়!
আকাশে, হৃদয়ে লকডাউন নেই, কঠোরতা নেই, আছে উন্মুক্ত কোমলতা।
বাংলাদেশের হাওয়াগুলো তাই আমার শহরে আসে।
মেঘেরাও আসে, আসে পাখিসহ সুন্দরতম সুন্দরতাও!
না এসে পারে না, আসতেই হয়; কেননা
এখানে পাহাড় আছে,
নদী আছে,
সাগর আছে
আর আছে ‘সুমি’!
সমুদ্রিত হতে হতে ভাবি- কবে আসবে ‘তুমি’?
সিদ্ধান্ত
রাহমান ওয়াহিদ
গন্ধম ইচ্ছেগুলোকে ঝুলিয়ে রেখেছি জামরুলের ডালে
খোলা অক্সিজেনে ইচ্ছেমতো ভিজুক অবিরাম
স্বল্পায়ু স্বপ্নগুলোর ছুটি জমা আছে অফুরান
অনিঃশেষ আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছি তাই তাদের দু’হাত খুলে।
পরিযায়ী পাখিদের বলেছি- তোমাদের মুখবন্ধনি নেই
বিধিটিধিও জানো না তেমন, তাই
অযথা আর ওড়াউড়ি ক্যানো।
আকাশ তার প্রাচীন রঙটা বদলাক
ততকাল তোমাদের ক্লান্ত ডানাগুলো বিশ্রামে থাক।
অবারিত সবুজের কামিজে মুখ লুকোবো আপাতত
এভাবে কথা হবে কথাদের সাথে, তাহাদের সাথেও।
মেঘমেয়েদের বলেছি- পারলে একটু ভিজিয়ে দিয়ো
আমাদের শাদা শবদেহ, নয়তো ঢেকে দিয়ো জলজ উষ্ণতায়।
ঈশ্বরের সাথে কথা হলে বলবো- আমাদের বয়স বেড়েছে,
পারলে সৃষ্টির উৎসে ফিরিয়ে দিয়ো, নয়তো
বানিয়ে দিয়ো নতুন গ্রহের শুঁয়োপোকা প্রজাতি কোনো।
আর ভালোবাসা? প্লিজ কুয়াশা হাত ছাড়ো
পাঁজরের বাহুল্য ঢাকনা খুলে দাঁড়াও
অনভিজ্ঞ তোমাকে এখন একাকীই হেঁটে যেতে হবে
পরাবাস্তবতার আড়ালে কোথাও, কোনো ঘন স্পর্শ ছাড়াই।
আপাতত এরকমই সিদ্ধান্ত।
বিমূর্ত মুখ
জয়নাল আবেদীন শিবু
কোনো এক আষাঢ় মাস- অবিশ্রান্ত বর্ষণে থৈ থৈ জলসমুদ্র
পৃথিবীর স্বেতসবুজ ফেনিল ঢেউ- দুরন্ত বাতাসে
আছড়ে পড়ছে সাপের মতন-
ভাসছে মানব-মানবীর লাশ- দাঁড়াবার এক ইঞ্চি
জায়গা নাই কোথাও- আশ্রয় না পেয়ে
অনন্ত আকাশের দিকে ছুটছে পাখিদল...
বানের জলে পুণ্যবান পুরুষ-নারীর প্রার্থনারত নূহ নবীর নৌকা
ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছুটলে- এলোমেলো মৃতদেহগুলো
ঢেউয়ের দুলুনিতে তড়পায়- নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়
এর কোনো কোনোটি...
পাশাপাশি মেঘ ও সূর্যালোকের মাঝে কেউ একজন
ছদ্মবেশে দেখে যায় পৃথিবীর সৌন্দর্য!
স্বপ্ন খুঁজি
নারদ হালদার
একদিন এই সীমানা ঘেরা প্রাচীর ছেড়ে
নিশ্চিত খোলা আকাশের নিচে
শ্মশান ঘাটে গিয়ে বসবো-
চিরচেনা আমার ‘চন্দনা’ নদীর ভরা জলে,
গলা অব্দি ডুবিয়ে দিয়ে, এই বুড়িয়ে যাওয়া রাতের
মরা জোছনার, ভেঙে যাওয়া পূর্ণিমার চাঁদটাকে
গপগপ গিলে খাবো।
তারপর টুপ করে ডুবে যাবো
নিঃসীম আঁধারের বুকে।
আমি স্বপ্নের খোঁজে
হাঁটি দুঃস্বপ্নের ভেতর!
আমি স্বপ্নের খোঁজে হেঁটে হেঁটে
দুঃস্বপ্নের কাছে, ছুটে ছুটে যাই!
আমি স্বপ্ন খুঁজে বেড়াই!
আমি জীবন খুঁজে বেড়াই!
[নারদ হালদারের বয়স ২৫ বছর। যার দুটো লাংই নষ্ট। হাসপাতালে প্রতি দুই দিনে তাকে এক সিলিন্ডার অক্সিজেন দিতে হয়। তার দ্রুত সুস্থতা প্রত্যাশা।]
বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১
গৌতম বসুর জন্য
কালীকৃষ্ণ গুহ
তুমি একদিন ভাষা খুঁজে পেয়েছিলে, গৌতম।
অনেক সন্তাপ আর নীরবতা পার হয়ে, ঝড়বৃষ্টি পার হয়ে
ভাষা খুঁজে পেয়েছিলে তুমি। খুঁজে পেয়েছিলে
ধুলোয় ঢাকা মানুষের জন্মজন্মান্তরের সংসার
ব্যক্তি-মানুষের জীবনে ভাষার জন্ম কীভাবে হয়
এ নিয়ে অনেক ভেবেছি।
ভাবনার মধ্যে কাক ডেকে উঠেছে বারবার। একদিন
সহযাত্রীকে বলেছি, ‘ভাষাও অন্ধকার হয়ে এল।’
আজ তোমার জয়ধ্বনি উঠছে, শুনতে পাই, গৌতম...
অঝোরে দিনরাত
শিহাব সরকার
বর্ষায় কত বাহারি ছাতা হাতে হাতে
ফুল লতাপাতা-ছাপা, হলদে-গোলাপি
দ্যাখো রঙ-উৎসব, কালো ছাতা আছে ইতিউতি
বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে দিনরাত।
থৈথৈ জল শহরের রাস্তায় ও ফুটপাতে,
জলডুব জীবনের চাকা বসে গেছে
হাঁটুজল ভেঙে তুমি সাবধানে
হেঁটে এসো রেইনকোটে ঝুম বৃষ্টিতে,
দেখা হবে না জলে হারানো লেকপাড়ে?
ঝরছে বৃষ্টি অঝোরে দিনরাত।
রেইনকোটে নারী এ নগরী দেখেনি বহুদিন
ব্রিকলেনে উইন্টারে ছিলো অন্য কোনো বর্ষাতি
রাণী হয়ে সেইদিন আলো ফুটেছিলে মেঘলায়
এ শহরে ফুটবে না কেন আজ রাতারাতি...
জলজট রাস্তায়। গাড়িগুলি যায় ভূতগাঁও,
দেখি সাদা জ্যোৎস্নায় ভেনিসের কত কত নাও।
ধূলিলিপি
আবদুর রাজ্জাক
পৃথিবীর সর্বত্র সন্ধ্যার রং একই, সেইসব সন্ধ্যা একভাবে
গেয়ে যায় গোধূলি,
সেসব সন্ধ্যার বিমূর্ত নীল কখনও থাকে, কখনও হারিয়ে যায়।
কখনও কখনও কাউকে ভেবে বহুবার কেঁদেছি, তারপর দেখেছি
বিশুদ্ধ ক্রন্দন কখনই আসেনি।
এমন এমনতর দিনে খুব বরষা নামে, তখন তোমার শ্রাবণী মেঘ
ভিজ্যুয়াল ভাবনায় অনুবাদ করে ধূলিলিপি সময়।
সবচেয়ে কঠিন সত্য মানুষ লুকিয়ে রাখে- কেউ ফেরে,
কেউ ফেরে না, এই না-ফেরার ব্যাখা অব্যাখাতই থেকে যায়।
সংজ্ঞায়িত ব্যাপারের অনেক দিক থাকে,
কী অদ্ভুত তোমাকে হারানোর কারণ কখোনই খুঁজিনি, তোমার
নড়বড়ে আকাশ ক্রমশ পার হয়ে এসেছি।
পাগলা! যাকে তুমি আজীবন ভেবেছো,
তাকে ভুল করে ভেবেছো।
ছোটো এই জীবন, কারও জন্য কিছু করতে না-পারার ব্যর্থতা
খুব কষ্ট দেয়, আমাকে। সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রেখে
তোমাকে সান্ত¡না দিয়েছি, ঢেউভাঙা শব্দে, না, প্রতিবাদ করোনি।
অনুভূতিগুলো
সরকার মাসুদ
কখনো মনে হয় অনুভূতিগুলো ছাড়াছাড়া
ভোরের নির্মল বাতাসে কিন্তু মনে হয়
সন্ধ্যার ভাবঘন মগ্নতার ভেতর মনে হয়
প্রতিটি অনুভব খুব চিকন সুতা দিয়ে গাঁথা
দুঃখের আনন্দের বিষাদের উল্লাসের
অন্তঃপুরে পাতা আছে টলটলে পাতকুয়া
অনুভূতিগুলো সব এসে জড়ো হয় ওইখানে
তারা সরলরেখা হয়ে আসে, বাতাসের ধাক্কায়
তারা বক্ররেখা হয়ে ভেসে যায় প্রশ্নাতুর!
অনুভূতিগুলো যতক্ষণ হাওয়ায় ভাসবে
তুমি তাকে কল্পনা করবে, কোনো আকার পাবে না
কোন কিছুর সাথে সংঘর্ষ না-হওয়া অবধি
তুমি তাকে শব্দে-রঙ্গে-সুরে ধরতে পারবে না জীবনেও।
ব্যাগভর্তি রোদ নিয়ে ঘরে ফিরছি
অশোক কর
ব্যাগভর্তি রোদ নিয়ে ঘরে ফিরছি সন্ধ্যাবেলা
রুচির সাথে বাজার সওদায় এসেছে বৈচিত্র্য!
এখন জলের প্রতিবিম্বে দেখি সরল প্রতিহিংসা
সে জলেই সাঁতরে খুঁজি শান্ত সুমুদ্দুর!
চোখের জলে লুকানো সেই সরল হিংসাগুলি
হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসিয়ে দিই সুগন্ধী বকুল!
তখন আমার আকাশ সবার চেয়ে বড়
তুমি চাইলেই বিলিয়ে দিই বুক ভরানো আলো!
নক্ষত্র আলোয় চোখের তারায় আকাশ খুঁজি
যে জল-প্রতিবিম্বে পেয়েছিলে খুঁজে ধ্রুবতারা!
স্বপ্নের সন্ধান
হাইকেল হাশমী
ধূসর সকাল দিগন্ত থেকে ধীরগতিতে নামছে
এই শহরের ব্যস্ত রাস্তায়, বাজারে আর গলিতে
জ্বলন্ত সূর্য মাথার উপর রেখে
ঘুরবো সারাদিন উদ্দেশ্যহীনভাবে
এই রাজপথ, এই চেনা পথ হয়ে একেবারে পথহীন।
দুপুরের তাপ জীর্ণ শরীরে শুষে নিয়ে
জলশূন্য তৃষ্ণার্ত আকাশের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে
ছাইমাখা সন্ধ্যার দিকে হেঁটে যাবো।
ওই সন্ধ্যার সুড়ঙ্গ পার করলেই রাত্রির উপত্যকা
যে করছে অপেক্ষা ক্লান্ত বিনিদ্র চোখের।
রাত্রির কালো অন্ধকারে
চোখ দুটি ঘুরবে ঘুমের দ্বারে দ্বারে
কড়া নাড়বে রুদ্ধ কপাটের
আর অবশেষে হতাশার চিহ্ন চোখে ভরে
ফিরে আসবে বিনিদ্র জগতে।
জানি চোখ আজো পাবে না স্বপ্নের সন্ধান
ঘুমের মাটি হয়েছে অনুর্বর
আর ওখানে ফলবে না স্বপ্নের সোনালি ফসল!
সেই মেঘ সিঁদুরে শঙ্কায়
জিললুর রহমান
মেঘের পাহাড় ছাড়া আর কোনো পাহাড় হাঁটছে না
গজগামিনীর ঢঙে সার সার ঐরাবত যথা
যারা বড় বড় মেঘ- যারা ঘন শাদা ডাইনোসরবেশী
আমাদের মাথার উপরে উড়ে উড়ে
নিত্যদিন প্রকৃতির প্রাণের দোসর
বাধা বন্ধনের ধার ধারে না, মানে না
সীমন্তের কোনো তার- কোনো কাঁটা
দখিনের সমুদ্রের হাওয়া ঠেলে দেয় সে মেঘ উত্তরে
পাহাড়ের ঘাড়ে তারা শীতল পরশ ঢেলে যায়
অজানা গন্তব্যে ছোটে বুনো হরিণীর গতি
আরো উত্তরের বরফের দুধশাদা ঠোঁটে
সাগরের নিমক ও উষ্ণতা হয়তো পায় একচোট
বুকে করে নিয়ে যায় সে আর্দ্রতা মানুষের ঘরে
প্রাণিদের- উদ্ভিদের প্রাণের ভেতর
নতুন শস্যের ঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে
নতুন জীবন চিত্রে ভরেছে আকাশ-
মেঘে মেঘে বেলা হয় বর্ষণের আনন্দের ঢঙে
মাথার ওপরে কড়া ঝলমলে রোদ্দুরের ফাঁকে
নির্বিকার গ্রাস করে করে ওড়ে সুদূর অলক্ষে
সেই মেঘ, সিঁদুরে শঙ্কায় কম্পমান আকাশ গঙ্গায়
বর্ষায় ভেজা কবিতা
হাসান কল্লোল
বৃষ্টি পড়ছে আর কবিতার ছত্রে ছত্রে জল।
সারা কবিতার চোখ, চুল, পায়ের আঙুল ভিজছে এবং কর্দমাক্ত প্রতিমা হয়ে উঠছে।
বাউলের জলমগ্ন প্রেমে
জোৎস্না উঠলে জাগে পূর্ণিমার ঘোর অমাবস্যায়- তার গায়ে কেতকী ফুলের ঘ্রাণ!
অসহায় পৃথিবীতে যখন বন্যায় ভাসে ফসলী জমি, ভূকম্পনে দুলে ওঠে
দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো সেতার-
অতিমারির শ্বাসকষ্টে ভুগছে এদিকে বয়সী ভাই
তখন এইসব জল পড়ার দিনে
ভেজাপাতার বাঁশি- কে বাজায়,
কী সে বাজায়!
এই পৃথিবীতে তবু শিশিরে ভেজা বটের শেকড়,
শিশুর জলমগ্ন স্কুলের সোঁদা গন্ধ,
পুকুরে জলপোকার খেলায় মত্ত দুপুর;
রেলস্টেশনের স্যাঁতসেঁতে হুইসেল
বৃষ্টিতে নেচে ওঠা কাশবনের জলছবি,
বিকেলের বারান্দায় শৈশবের
মেয়েটির মায়া আর
নদীর ওপারে রেখে আসা কদমের শাদা শাদা রেণু,
তবুও তোমাদের কবিতার ভেজা নদীতে সাঁতরায়
আহা জীবনের অবুঝ বিরহী কোরক!
বর্ষায় কবিতা
সর্বনাশা সময় বোঝে না।
মফস্বলের কবিতা
মুজিব ইরম
যে শহরে নদী বয় সকাল বিকাল...
আর কিছু নয়
ছোট এ শহরে আমি
সুর হতে চেয়েছি সে বারিষা বেলায়...
আমি তো দূরের লোক
কাদাপানি মেখে
গ্রাম থেকে এসে
দেখতে চেয়েছি সেই সুরেলা দুপুর...
আছি আমি
রাত্রি হয়ে ছোট এ শহরে
তোমারই কণ্ঠে ডাকা মফস্বলী লোক...
প্রত্যেক জীবনে নাই বৃষ্টিবিলাসের গল্প
ইকবাল হোসেন বুলবুল
যার আছে একটি কেবল জামা; তার থেকে ভালো করে আঁকতে পারে না কেউ
ঘর, ছাতা, আকাশের ছবি। আঁকতে পারে না কেউ জলের দহন দাগ, বৃষ্টির আগুন।
জলের শরীরেও থাকে আলাদা আলাদা ভাষা; তারে ছাড়া তর্জমায় কে বসাবে
সঠিক বয়ান? কে জানাতে পারে বলো, কী সে জ্বালা বৃষ্টির চুম্বনে?
উড়ন্ত মেঘের ঠোঁটে কখন যে মধু ফলে কখন যে ফলে বিষ; সে-ই তো বুঝতে পারে
সবার অধিক। সে-ই তো বলতে পারে বৃষ্টিঝরা বৃষ্টিখেলা কান্না আঁকে কতো!
যার আছে একটি কেবল জামা; তারে ছাড়া বলতে পারে না কেউ প্রত্যেক জীবনে নাই
বৃষ্টিবিলাসের গল্প।
একটি রবাহূত বর্ষাকবিতা
মাহফুজ আল-হোসেন
বৃষ্টিবিলাসী নীলাম্বরী মেঘেদের সাময় কি সান্দ্রতার স্বয়ংবরা মেহফিলে যোগ দিয়েছে কেতাদুরস্ত নাগরিক চাঁদ;
রিমঝিম বৃষ্টিদিনে নান্দনিক দায়ভাগের যক্ষপ্রিয়া পদাবলি আমার,
অপহৃত মিতক্ষরা শৈশবের বিবশ কাল থেকেই তো তুমি অভিমানী মেঘবালিকা ভেবে এসেছো নিজেকে;
পরাবাস্তব এ গান্ধর্ব গোধূলিতে রবাহুত বর্ষাকবিতায় হুটহাট ঢুকে পড়ে হয়তো তোমার মন্দাক্রান্তা
স্বপ্নসাধ উজিয়ে উঠতে পারে- আর সে কারণেই বুঝি বিনা আমন্ত্রণে তুমি যোগ দিতে চাও মধ্যরাতের সুরাবৃষ্টিতে জলমগ্ন বোটক্লাবের অতিনাটকীয় নৃত্য- গীতোৎসবে!
অথচ, সাংসারিক প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের সপ্তব্যঞ্জন আর তার নিরর্থক নৈমিত্তিক অসহনীয় আয়োজন স্পষ্টত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে- দিগন্তস্পর্শী গণমৃত্যুর ক্রন্দনরোল থেকে তোমার উন্নাসিক উৎপ্রেক্ষার ঝাপসা দৃষ্টিকে অন্যত্র দূরে সরিয়ে রাখতে;
শেষাবধি উপায়ান্তর না দেখে এ উপদ্রুত মৃত্যুউপত্যকায় আসন্ন? উৎসবের বেআক্কেলে বাঁকা চাঁদ তার সলাজ রুপোলি মুখ লুকাচ্ছে স্বেচ্ছামৃত্যুর দ-াদেশপ্রাপ্ত আইবুড়ো মেঘবালিকার বৃষ্টিভেজা নীলাম্বরীর আলুথালু আঁচলে...
বই কিনি, পড়বো একদিন
ভাগ্যধন বড়ুয়া
আশা, একদিন পড়বো এইসব কেনা বই
আমার বউ বলে বই দিয়ে শ্মশানে পোড়াবো তোমায়!
তবুও বই কিনি, যথারীতি দৈর্ঘ্যে বাড়ে ভাঁজ,
ধুলো জমে, উইয়ের গোপন বসত
নড়াচড়া হয় সপ্তা-মাসে কিংবা বছরে
পড়া আর হয় না বেশি!
আরও কেনা হয় আরও বাড়ে ক্রম;
বিছানায় বই দেখে বউ রাগে শোয় দেয়াল পেরিয়ে
আশা, আমি আর বই মুখোমুখি হবো অনাগত অপরাহ্ণে...
বর্ষার নন্দনতত্ত্ব
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
একমাথা মেঘে যে ছিল বসে ধূসর আঁধার নিয়ে
মেঘে নয় বর্ষা তার চোখেই পেয়েছিল বর্ষণের বর
ফাগুন-দিনে বিরহের বর্ষা যাকে ভেজাতো লোনাজলে
আষাঢ়-শ্রাবণ আজ তার কাছে চির অজানা অচিন।
অথচ কদমেই ছিল কোনো এক প্রগলভ দুপুরের হাসি
চৈত্রের খরতাপে চৌচির হওয়া মৃত্তিকার বুকে
সেদিন যারা এঁকেছিল জীবনের কাক্সিক্ষত ফল্গুধারা
আজ তারা মেঘহীন মরুময় আকাশের পরিযায়ী প্রাণ।
বর্ষার বেগবতী নদী যে নারী দু’পায়ে তৈরি করে ঘূর্ণি
আজ তার হাসিতে ফোটে না পদ্ম, চন্দ্রাহারী অমাবস্যা
অন্ধকারে উল্লসিত হয়ে ওঠে গুহার প্রথম প্রদোষে
বর্ষণপীড়িত মন বৃষ্টির সেতারে খোঁজে না নন্দনতত্ত্ব।
বৃষ্টিমুখরিতা
চয়ন শায়েরী
সে খোঁজে কদম, তার চাই অন্ত্যমিল- পদ্মবিল- টিনের চালের ছন্দমুখরতা- মেঘবউ হতে চায় বৃষ্টিমুখরিতা; ওই অন্ত্যমিল ভেঙে গেছে সেই কবে- ছন্দপতনের ধারা অবিরল আছে- সবখানে সব কাজে গদ্যের হাতুড়ি- ছন্দের চাতুরি; বাউয়া ব্যাঙের আনন্দের ডাকে বৃষ্টি ঝরে- ব্যাঙের পায়ের ছন্দে কুনজর পড়ে- বন্যার চোখের জলের বন্যায়- ভাঙনে ভাঙনে গদ্য টের পায়; মেঘ ভাঙে নদী ভাঙে- কখনো-বা মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে- মেঘবউ কাঁদে- কদমফুলের মতো করো না-স্পাইক- এক একটা কাইক দিতে, ঘরের বাইরে যেতে দ্বিধা ভর করে- বৃষ্টিমুখরিতা নাচে- নাচের মুদ্রায় টুংটাং বেজে ওঠে মন- সারাক্ষণ- যতক্ষণ বৃষ্টি ঝরে- যে গেছে হারায়ে, সেই বৃষ্টিপুরুষের কথা মনে পড়ে- ভাঙনের পরে।
মাটির সারিন্দায় বৃষ্টির সুর
মাহফুজ রিপন
বৃষ্টি তোমার অপেক্ষায় আছে পুব-পাড়ার ইবাদুল কিসান। তার বউ জহুরা খাতুন। অপেক্ষায় থাকে খলটের আবাতি পোলাপান। পাউগাড়ায় পালিয়ে থাকা ধুড়া সাপ। তোমার অপেক্ষায় থাকে দোয়ালের লম্বা মোচওয়ালা আজদাহা বোয়াল। দেওয়া তোমার অপেক্ষায় থাকে গ্রামের পর গ্রাম। প্রতীক্ষায় চাষের জমি ফেটে চৌচির। গড়িয়ে যায় আম কাঁঠালের বতোর। আড়ষ্ঠ, রুক্ষ এবং গোঁয়াড়-গোবিন্দ হয়ে যায় পুবের পাথার। মাটির সারিন্দায় সুর তুলে তোমারে বোলায় নীলকণ্ঠ বাউল। কারও ডাক তুমি শোন না! কিসের এতো মান- অভিমান? গুস্যা কার লগে। ঐ শোন বেঁধে গেছে জোড় ঢাকের লড়াই। এবার মুচকি হাসো। একবার বিদ্যুৎ চমকাও। শুনছি বিলেতের আকাশ প্লেনের দখলে- পাউডার ছিটায়া দিলে তোমার রফাদফা ফুরায়। আমাগো পাউডার জমিনের পলি। আগারির জলে ভিজাইয়া দেই যদি! আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ধরে মেঘারানির গান; দেখি তুমি কেমনে না নাইম্যা পারো...!
সুমি
ফরিদা ইয়াসমিন সুমি
কঠোর লকডাউনের সন্ধেগুলো আরো বেশি প্রশান্ত হয়ে নামলে
সৌন্দর্যে ডুবে যেতে যেতে দেখি,
ছাদে উঠছ, সেলফি তুলছো, লকডাউনের চেয়েও নিঃসঙ্গ সুন্দরতায়!
সমুদ্রিত হই ভাবালুতায়...
বাতাসের তোড়ে বেসামাল দিঘল-চুল নির্লজ্জ স্তনাগ্রে হুমড়ি খেয়ে
ছায়াঘেরা ত্রিভুজে হানা দেয়!
সমুদ্রকন্যা কাঁপে লকডাউনের মতো কঠোর নির্জনতায়!
আকাশে, হৃদয়ে লকডাউন নেই, কঠোরতা নেই, আছে উন্মুক্ত কোমলতা।
বাংলাদেশের হাওয়াগুলো তাই আমার শহরে আসে।
মেঘেরাও আসে, আসে পাখিসহ সুন্দরতম সুন্দরতাও!
না এসে পারে না, আসতেই হয়; কেননা
এখানে পাহাড় আছে,
নদী আছে,
সাগর আছে
আর আছে ‘সুমি’!
সমুদ্রিত হতে হতে ভাবি- কবে আসবে ‘তুমি’?
সিদ্ধান্ত
রাহমান ওয়াহিদ
গন্ধম ইচ্ছেগুলোকে ঝুলিয়ে রেখেছি জামরুলের ডালে
খোলা অক্সিজেনে ইচ্ছেমতো ভিজুক অবিরাম
স্বল্পায়ু স্বপ্নগুলোর ছুটি জমা আছে অফুরান
অনিঃশেষ আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছি তাই তাদের দু’হাত খুলে।
পরিযায়ী পাখিদের বলেছি- তোমাদের মুখবন্ধনি নেই
বিধিটিধিও জানো না তেমন, তাই
অযথা আর ওড়াউড়ি ক্যানো।
আকাশ তার প্রাচীন রঙটা বদলাক
ততকাল তোমাদের ক্লান্ত ডানাগুলো বিশ্রামে থাক।
অবারিত সবুজের কামিজে মুখ লুকোবো আপাতত
এভাবে কথা হবে কথাদের সাথে, তাহাদের সাথেও।
মেঘমেয়েদের বলেছি- পারলে একটু ভিজিয়ে দিয়ো
আমাদের শাদা শবদেহ, নয়তো ঢেকে দিয়ো জলজ উষ্ণতায়।
ঈশ্বরের সাথে কথা হলে বলবো- আমাদের বয়স বেড়েছে,
পারলে সৃষ্টির উৎসে ফিরিয়ে দিয়ো, নয়তো
বানিয়ে দিয়ো নতুন গ্রহের শুঁয়োপোকা প্রজাতি কোনো।
আর ভালোবাসা? প্লিজ কুয়াশা হাত ছাড়ো
পাঁজরের বাহুল্য ঢাকনা খুলে দাঁড়াও
অনভিজ্ঞ তোমাকে এখন একাকীই হেঁটে যেতে হবে
পরাবাস্তবতার আড়ালে কোথাও, কোনো ঘন স্পর্শ ছাড়াই।
আপাতত এরকমই সিদ্ধান্ত।
বিমূর্ত মুখ
জয়নাল আবেদীন শিবু
কোনো এক আষাঢ় মাস- অবিশ্রান্ত বর্ষণে থৈ থৈ জলসমুদ্র
পৃথিবীর স্বেতসবুজ ফেনিল ঢেউ- দুরন্ত বাতাসে
আছড়ে পড়ছে সাপের মতন-
ভাসছে মানব-মানবীর লাশ- দাঁড়াবার এক ইঞ্চি
জায়গা নাই কোথাও- আশ্রয় না পেয়ে
অনন্ত আকাশের দিকে ছুটছে পাখিদল...
বানের জলে পুণ্যবান পুরুষ-নারীর প্রার্থনারত নূহ নবীর নৌকা
ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছুটলে- এলোমেলো মৃতদেহগুলো
ঢেউয়ের দুলুনিতে তড়পায়- নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়
এর কোনো কোনোটি...
পাশাপাশি মেঘ ও সূর্যালোকের মাঝে কেউ একজন
ছদ্মবেশে দেখে যায় পৃথিবীর সৌন্দর্য!
স্বপ্ন খুঁজি
নারদ হালদার
একদিন এই সীমানা ঘেরা প্রাচীর ছেড়ে
নিশ্চিত খোলা আকাশের নিচে
শ্মশান ঘাটে গিয়ে বসবো-
চিরচেনা আমার ‘চন্দনা’ নদীর ভরা জলে,
গলা অব্দি ডুবিয়ে দিয়ে, এই বুড়িয়ে যাওয়া রাতের
মরা জোছনার, ভেঙে যাওয়া পূর্ণিমার চাঁদটাকে
গপগপ গিলে খাবো।
তারপর টুপ করে ডুবে যাবো
নিঃসীম আঁধারের বুকে।
আমি স্বপ্নের খোঁজে
হাঁটি দুঃস্বপ্নের ভেতর!
আমি স্বপ্নের খোঁজে হেঁটে হেঁটে
দুঃস্বপ্নের কাছে, ছুটে ছুটে যাই!
আমি স্বপ্ন খুঁজে বেড়াই!
আমি জীবন খুঁজে বেড়াই!
[নারদ হালদারের বয়স ২৫ বছর। যার দুটো লাংই নষ্ট। হাসপাতালে প্রতি দুই দিনে তাকে এক সিলিন্ডার অক্সিজেন দিতে হয়। তার দ্রুত সুস্থতা প্রত্যাশা।]