মঈনউদ্দিন মুনশী
“যে গান কানে যায়না শোনা/ সে গান যেথায় নিত্য বাজে/প্রাণের বীণা নিয়ে যাব সেই অতলের সভা-মাঝে/চিরদিনের সুরটি বেঁধে, শেষ গানে তার কান্না কেঁদে/নীরব যিনি তাঁহার পায়ে নীরব বীণা দিব ধরি/ রূপ-সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ-রতন আশা করি”
এই যে কবি, তাঁর উন্মেষ ঊনবিংশ শতাব্দীর নব-জাগ্রত জীবনে। একদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অন্যদিকে জয়দেব এবং বৈষ্ণব পদ-লালিত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় শুরু থেকেই বাংলার প্রচলিত গীতিধারার পোষকতা করেছেন। তাঁর কাব্যে সৌন্দর্য তন্ময়তা, স্বজাতিকতা এবং আন্তর্জাতিকতা বোধ প্রথিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন “সমস্ত আদর্শের মূল থকবে স্বদেশের মৃত্তিকায় প্রথিত এবং দেশের মাটি থেকেই তা রস আহরণ করবে কিন্তু তা পত্র-পল্লব বিস্তৃত করবে সর্বদিকে।”
“আজও সময় হয়নি কি তার, কাজ কি আছে বাকি
ওগো, ওই যে সন্ধ্যা নামে সাগর তীরে।
মলিন আলোয় পাখা মেলে সিন্ধু পারের পাখি
আপন কুলায় মাঝে সবাই এল ফিরে
কখন তুমি আসবে ঘাটের পরে
বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে
অস্তরবির শেষ আলোটির মতো
তরী নিশীথ মাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।”
মানুষের জন্যে চিন্তা, কর্তব্যের নানা সঙ্কল্প তাঁর বুদ্ধি এবং কল্পনা বিশ্ব প্রকৃতি এবং মানব লোকের মধ্যে সম্পর্ক সূত্র আবিষ্কার করেছিলো।
“বসি শুধু গৃহকোণে/ লুব্ধ চিত্তে করিতেছি সদা অধ্যয়ন/দেশে দেশান্তরে কারা করেছে ভ্রমণ/কৌতূহল বশে আমি তাহাদের সনে/করিতেছি তোমারে বেষ্টন মনে মনে।”
কবি বলেছেন, দার্শনিক চেতনার উন্মেষ, প্রকৃতির সৌন্দর্য নিরীক্ষণের মধ্যে “জগতের সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়া, প্রিয়জনের মাধুর্যের মধ্যে দিয়া ভগবান আমাদিগকে টানিছেন। জগতের রূপের মধ্যেই সেই অপরূপের সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা, ইহাকে আমি মুক্তির সাধনা বলি।”
“দেহে আর মনেপ্রাণে হয়ে একাকার/একি অপরূপ লীলা এ অঙ্গে আমার/এ কি জ্যোতি এ কি ব্যোম দীপ্ত দীপ জ্বালা/দিবা আর রজনীর চির নাট্যশালা।”
তাঁর সৌন্দর্য বোধের আদর্শ হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য নিরীক্ষণের মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ নির্ধারণ এবং দার্শনিক চেতনা নিবেদিত চিত্ততায় রূপান্তর।
“কি গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,/ সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছি যতদূর/ শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর/ যেতে আমি দিব না তোমায়”
চিত্রার ‘উর্বশী’ কবিতা রবীন্দ্রনাথ-এর সৌন্দর্য বোধের একটি চমৎকার নিদর্শন। ‘উর্বশী’ সৌন্দর্যের আদর্শ, ‘সোনার তরী’তে বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অর্থ নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন।
‘নৈবেদ্য’র কবিতাগুলোয় তাঁর ব্যবহৃত শব্দগুলো নিশ্চিন্ত, স্পষ্ট, অলঙ্কারবিহীন, নির্ভাবনাময়, স্বচ্ছ, তন্ময় মুহূর্তে উচ্চারিত আড়ম্বরহীন ধ্বনির মতো “মাঝে মাঝে কতবার ভাবি, কর্মহীন/আজ নষ্ট হল বেলা, নষ্ট হল দিন/ নষ্ট হয় নাই প্রভু, সে সকল ক্ষণ/আপনি তাদের তুমি করেছ গ্রহণ।”
তাঁর কাব্য গ্রন্থাবলি নৈবেদ্য, উৎসর্গ, খেয়া, গীতাঞ্জলির কবিতা সম্পর্কে তাঁর উক্তি “আমি ভালবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে, যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদন। আমি আবাল্য অভ্যস্থ ঐকান্তিক সাহিত্য সাধনার গ-ীকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্থাৎ আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি, তাতে বাইরে থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তরের থেকে পেয়েছি প্রসাদ।”
‘গীতাঞ্জলি’ তাঁকে খ্যাতির উচ্চশিখরে পৌঁছে দিয়েছে। ‘গীতাঞ্জলি’র সহজ, সরল নিবেদনের সুর, দন্দহীন নির্ভাবনায় পরম পুরুষকে কামনা এবং নিভৃত প্রাণের প্রসন্নতা “সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর/ কত বর্ণে কত গন্ধে, কত গানে কত ছন্দে/ অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয় পুর/ আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।”
তিনি যে চৈতন্যের কথা বলেছেন, যে ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং চিত্তের ঔদার্য তাঁর কবিতায় অলৌকিক সৌন্দর্যের প্রতিফলন এনেছে তৎকালীন ইউরোপে তার নিদর্শন নেই। আইরিশ কবি ‘উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস’ ১৯১২ সালে ইংরেজিতে ‘গীতাঞ্জলি’র ভূমিকা লিখে ইউরোপের কাছে উপস্থিত করলেন। ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন। সমগ্র ইউরোপ তাঁকে উন্মুক্ত চিত্তে গ্রহণ করলো।
তিনি বলেছেন, “জীবন নিজেকে বিকশিত করে গতির মধ্যে এবং অনবরত সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্যে। মানুষের আত্মস্বরূপ গতির প্রবাহে অনবরত আপনাকে বিকশিত করছে। এই যে গতিময় সৃজনশক্তি, এটাই হোল মানুষের ধর্ম।” “শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও/ উদ্দাম উধাও/ ফিরে নাহি চাও/ যাকিছু তোমার সব দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও/ কুড়ায়ে লও না কিছু, কর না সঞ্চয়।”
১৯৩২ সালে ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে তিনি পদ্যের নিরুপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙলেন, কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রশস্ত করলেন
“দোতলার জানলা থেকে চোখে পড়ে/ পুকুরের একটি কোনা/ ভাদ্রমাসে কানায় কানায় জল/ জলে গাছের গভীর ছায়া টলটল করছে/ সবুজ রেশমের আভায়।”
এরপর গদ্য ভঙ্গিতে আরও যে কয়টি কবিতা গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে শেষ সপ্তক (১৯৩৫), শ্যামলী (১৯৩৬) এবং পত্রপুট (১৯৩৬)-
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে/ আমি চোখ মেললুম আকাশে/ জ্বলে উঠল আলো/ পুবে পশ্চিমে”
১৯৩৮ সালে অসুস্থতার পর, তিনি অনুভব করেছেন ধরিত্রীর সঙ্গে তাঁর নিবিড় বন্ধন, তাঁর কাব্যে নতুন বোধের স্তর আবিষ্কৃত হয়
“আমার মনে একটুও নেই বৈকুণ্ঠের আশা/ ঐখানে মোর বাসা/ যে মাটিতে শিউরে উঠে ঘাস/ যার পরে ঐ মন্ত্র পড়ে দক্ষিণে বাতাস।”
বাংলা নিসর্গ কাব্যের মূল ধারা রবীন্দ্রনাথে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিলো। তিনি বুঝেছিলেন প্রকৃতি ঈশ্বরের আলেখ্য এবং তা মানুষকে অহরহ মঙ্গলের দিকে পরিচালিত করেছে। তার কাব্যে প্রকৃতিবিলাস ছিল কিন্তু প্রকৃতিকে যাচাই করার কথা শোনা যায়নি। ‘কল্লোল’ যুগের কবিরা রবীন্দ্র-প্রভাবে বেড়ে উঠলেও এক সময় তারা ভাবলেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যে জীবনের সমগ্র রূপ ধরা পড়েনি। প্রকৃতি প্রেম ক্ষুণœ না করেও তারা লক্ষ করেছিলেন এই বিচিত্র ঐশ্বর্যময় প্রকৃতিতেও প্রেম নশ্বর, কাল বিনাশী এবং আকাশ আর প্রান্তর চিরহেমন্তে বিলীন।
বর্তমানের বিশুদ্ধ বাংলা কাব্যের পরম্পরা থেকে রবীন্দ্রনাথ-এর কবিতা পৃথক, কিন্তু তার বিরোধী নয়। তাঁর ‘কল্পনা প্রতিভা’, ভাবনা প্রতিভা এবং আবেগের শুদ্ধতা আজও বর্তমান কবিদের সাধনার বিষয়। আধুনিক কবির সামনে ধর্ম বা দর্শন নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও বিশ্বাসভূমি নেই, রবীন্দ্রনাথের কাছে যা ছিল সহজলভ্য। নিজের যুগের প্রাণ-পরিসর রবীন্দ্রনাথের আয়ত্তে ছিল। তাঁর কবিতায় সমাজ প্রাধান্য পেয়েছে, যেটা আধুনিক কবিরা গ্রহণ করেছে ‘কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’
বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার সংকট রবীন্দ্র-সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। আধুনিক কবিতার ভাষা অর্থ পেরিয়ে উপলব্ধির আলোয় অর্থের অনমনীয় শিবত্বে পৌঁছায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নিহিতার্থের মহিমা ছিল যা ‘নিহিত অর্থের’ বৈপরীত্যে ‘অর্থ গৌরব’ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আজও আধুনিক, তাঁর কাব্যে আছে ‘সব মানুষের নাড়ীকম্পন’ বিশেষ কালের সঙ্গে চিরকালের যে মিলন-বিন্দু তা ছুঁতে পারা যায় তাঁর কবিতায়।
রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই আধুনিক কবির, তার কারণ শুধু এই নয় যে, তাঁর প্রভাব এড়াবার সজ্ঞান প্রয়াস সত্ত্বেও অবচেতনায় তাঁরই কাব্যে তারা অনুভাবিত। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সাহায্য ও ইঙ্গিত পেয়েই বাংলায় আধুনিক কাব্যের সূচনা ঘটেছে। তাঁর কাছ থেকেই প্রাপ্ত সমাজ-ইতিহাস চেতনা এবং কল্পনা-প্রতিভার বিস্ময়কর ভাস্বরতা।
আধুনিক কবিতা রবীন্দ্রনাথকে খুব মহিমার সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাদের কাছে। অনেক আধুনিক কবিতা এমন যে ‘কোন একটা’ শব্দ না বুঝলে পঙ্ক্তিই বোঝা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ভাবটা বোঝা যায়, তাই মানে খুঁজতে হয় না। কী অদ্ভুত দক্ষতায় তিনি শব্দ ও প্রসঙ্গ ব্যবহার করেন। তাঁর গান “ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে”-এর একটা লাইন আছে “ললিত নৃত্যে বাজুক স্বণরসনা” যার আভিধানিক অর্থ ‘নারীর কটিভূষণ’ সোনার জিভ নয়। রবীন্দ্রনাথকে অনেক সময় আমরা কেমন না বুঝেই বুঝে নিই। রবীন্দ্রনাথের শিল্প সৃষ্টি, আসলে নিজেকে সৃষ্টি তিল তিল করে। কবি বুদ্ধদেব বসুর মতে, রবীন্দ্রনাথ প্রথম আধুনিক এবং আধুনিক বাংলা কাব্যের চূড়াও তাঁর কবিতা স্পর্শ করে গেছে।
ব্যাপকতা, প্রাচুর্য এবং বৈচিত্র্যের দিক থেকে তিনি নিজেই নিজের তুলনা, অন্য কেউ নয়। বাঙালির সত্তাজুড়ে রবীন্দ্রনাথের দুর্মর উপস্থিতি। বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র এখনও রবীন্দ্রনাথ। অনেক আনন্দ, আকুলতা ও ব্যথার মুহূর্তে তিনি আজও আমাদের সহচর।
মঈনউদ্দিন মুনশী
শুক্রবার, ০৬ আগস্ট ২০২১
“যে গান কানে যায়না শোনা/ সে গান যেথায় নিত্য বাজে/প্রাণের বীণা নিয়ে যাব সেই অতলের সভা-মাঝে/চিরদিনের সুরটি বেঁধে, শেষ গানে তার কান্না কেঁদে/নীরব যিনি তাঁহার পায়ে নীরব বীণা দিব ধরি/ রূপ-সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ-রতন আশা করি”
এই যে কবি, তাঁর উন্মেষ ঊনবিংশ শতাব্দীর নব-জাগ্রত জীবনে। একদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অন্যদিকে জয়দেব এবং বৈষ্ণব পদ-লালিত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় শুরু থেকেই বাংলার প্রচলিত গীতিধারার পোষকতা করেছেন। তাঁর কাব্যে সৌন্দর্য তন্ময়তা, স্বজাতিকতা এবং আন্তর্জাতিকতা বোধ প্রথিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন “সমস্ত আদর্শের মূল থকবে স্বদেশের মৃত্তিকায় প্রথিত এবং দেশের মাটি থেকেই তা রস আহরণ করবে কিন্তু তা পত্র-পল্লব বিস্তৃত করবে সর্বদিকে।”
“আজও সময় হয়নি কি তার, কাজ কি আছে বাকি
ওগো, ওই যে সন্ধ্যা নামে সাগর তীরে।
মলিন আলোয় পাখা মেলে সিন্ধু পারের পাখি
আপন কুলায় মাঝে সবাই এল ফিরে
কখন তুমি আসবে ঘাটের পরে
বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে
অস্তরবির শেষ আলোটির মতো
তরী নিশীথ মাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।”
মানুষের জন্যে চিন্তা, কর্তব্যের নানা সঙ্কল্প তাঁর বুদ্ধি এবং কল্পনা বিশ্ব প্রকৃতি এবং মানব লোকের মধ্যে সম্পর্ক সূত্র আবিষ্কার করেছিলো।
“বসি শুধু গৃহকোণে/ লুব্ধ চিত্তে করিতেছি সদা অধ্যয়ন/দেশে দেশান্তরে কারা করেছে ভ্রমণ/কৌতূহল বশে আমি তাহাদের সনে/করিতেছি তোমারে বেষ্টন মনে মনে।”
কবি বলেছেন, দার্শনিক চেতনার উন্মেষ, প্রকৃতির সৌন্দর্য নিরীক্ষণের মধ্যে “জগতের সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়া, প্রিয়জনের মাধুর্যের মধ্যে দিয়া ভগবান আমাদিগকে টানিছেন। জগতের রূপের মধ্যেই সেই অপরূপের সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা, ইহাকে আমি মুক্তির সাধনা বলি।”
“দেহে আর মনেপ্রাণে হয়ে একাকার/একি অপরূপ লীলা এ অঙ্গে আমার/এ কি জ্যোতি এ কি ব্যোম দীপ্ত দীপ জ্বালা/দিবা আর রজনীর চির নাট্যশালা।”
তাঁর সৌন্দর্য বোধের আদর্শ হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য নিরীক্ষণের মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ নির্ধারণ এবং দার্শনিক চেতনা নিবেদিত চিত্ততায় রূপান্তর।
“কি গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,/ সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছি যতদূর/ শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর/ যেতে আমি দিব না তোমায়”
চিত্রার ‘উর্বশী’ কবিতা রবীন্দ্রনাথ-এর সৌন্দর্য বোধের একটি চমৎকার নিদর্শন। ‘উর্বশী’ সৌন্দর্যের আদর্শ, ‘সোনার তরী’তে বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অর্থ নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন।
‘নৈবেদ্য’র কবিতাগুলোয় তাঁর ব্যবহৃত শব্দগুলো নিশ্চিন্ত, স্পষ্ট, অলঙ্কারবিহীন, নির্ভাবনাময়, স্বচ্ছ, তন্ময় মুহূর্তে উচ্চারিত আড়ম্বরহীন ধ্বনির মতো “মাঝে মাঝে কতবার ভাবি, কর্মহীন/আজ নষ্ট হল বেলা, নষ্ট হল দিন/ নষ্ট হয় নাই প্রভু, সে সকল ক্ষণ/আপনি তাদের তুমি করেছ গ্রহণ।”
তাঁর কাব্য গ্রন্থাবলি নৈবেদ্য, উৎসর্গ, খেয়া, গীতাঞ্জলির কবিতা সম্পর্কে তাঁর উক্তি “আমি ভালবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে, যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদন। আমি আবাল্য অভ্যস্থ ঐকান্তিক সাহিত্য সাধনার গ-ীকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্থাৎ আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি, তাতে বাইরে থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তরের থেকে পেয়েছি প্রসাদ।”
‘গীতাঞ্জলি’ তাঁকে খ্যাতির উচ্চশিখরে পৌঁছে দিয়েছে। ‘গীতাঞ্জলি’র সহজ, সরল নিবেদনের সুর, দন্দহীন নির্ভাবনায় পরম পুরুষকে কামনা এবং নিভৃত প্রাণের প্রসন্নতা “সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর/ কত বর্ণে কত গন্ধে, কত গানে কত ছন্দে/ অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয় পুর/ আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।”
তিনি যে চৈতন্যের কথা বলেছেন, যে ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং চিত্তের ঔদার্য তাঁর কবিতায় অলৌকিক সৌন্দর্যের প্রতিফলন এনেছে তৎকালীন ইউরোপে তার নিদর্শন নেই। আইরিশ কবি ‘উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস’ ১৯১২ সালে ইংরেজিতে ‘গীতাঞ্জলি’র ভূমিকা লিখে ইউরোপের কাছে উপস্থিত করলেন। ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন। সমগ্র ইউরোপ তাঁকে উন্মুক্ত চিত্তে গ্রহণ করলো।
তিনি বলেছেন, “জীবন নিজেকে বিকশিত করে গতির মধ্যে এবং অনবরত সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্যে। মানুষের আত্মস্বরূপ গতির প্রবাহে অনবরত আপনাকে বিকশিত করছে। এই যে গতিময় সৃজনশক্তি, এটাই হোল মানুষের ধর্ম।” “শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও/ উদ্দাম উধাও/ ফিরে নাহি চাও/ যাকিছু তোমার সব দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও/ কুড়ায়ে লও না কিছু, কর না সঞ্চয়।”
১৯৩২ সালে ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে তিনি পদ্যের নিরুপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙলেন, কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রশস্ত করলেন
“দোতলার জানলা থেকে চোখে পড়ে/ পুকুরের একটি কোনা/ ভাদ্রমাসে কানায় কানায় জল/ জলে গাছের গভীর ছায়া টলটল করছে/ সবুজ রেশমের আভায়।”
এরপর গদ্য ভঙ্গিতে আরও যে কয়টি কবিতা গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে শেষ সপ্তক (১৯৩৫), শ্যামলী (১৯৩৬) এবং পত্রপুট (১৯৩৬)-
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে/ আমি চোখ মেললুম আকাশে/ জ্বলে উঠল আলো/ পুবে পশ্চিমে”
১৯৩৮ সালে অসুস্থতার পর, তিনি অনুভব করেছেন ধরিত্রীর সঙ্গে তাঁর নিবিড় বন্ধন, তাঁর কাব্যে নতুন বোধের স্তর আবিষ্কৃত হয়
“আমার মনে একটুও নেই বৈকুণ্ঠের আশা/ ঐখানে মোর বাসা/ যে মাটিতে শিউরে উঠে ঘাস/ যার পরে ঐ মন্ত্র পড়ে দক্ষিণে বাতাস।”
বাংলা নিসর্গ কাব্যের মূল ধারা রবীন্দ্রনাথে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিলো। তিনি বুঝেছিলেন প্রকৃতি ঈশ্বরের আলেখ্য এবং তা মানুষকে অহরহ মঙ্গলের দিকে পরিচালিত করেছে। তার কাব্যে প্রকৃতিবিলাস ছিল কিন্তু প্রকৃতিকে যাচাই করার কথা শোনা যায়নি। ‘কল্লোল’ যুগের কবিরা রবীন্দ্র-প্রভাবে বেড়ে উঠলেও এক সময় তারা ভাবলেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যে জীবনের সমগ্র রূপ ধরা পড়েনি। প্রকৃতি প্রেম ক্ষুণœ না করেও তারা লক্ষ করেছিলেন এই বিচিত্র ঐশ্বর্যময় প্রকৃতিতেও প্রেম নশ্বর, কাল বিনাশী এবং আকাশ আর প্রান্তর চিরহেমন্তে বিলীন।
বর্তমানের বিশুদ্ধ বাংলা কাব্যের পরম্পরা থেকে রবীন্দ্রনাথ-এর কবিতা পৃথক, কিন্তু তার বিরোধী নয়। তাঁর ‘কল্পনা প্রতিভা’, ভাবনা প্রতিভা এবং আবেগের শুদ্ধতা আজও বর্তমান কবিদের সাধনার বিষয়। আধুনিক কবির সামনে ধর্ম বা দর্শন নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও বিশ্বাসভূমি নেই, রবীন্দ্রনাথের কাছে যা ছিল সহজলভ্য। নিজের যুগের প্রাণ-পরিসর রবীন্দ্রনাথের আয়ত্তে ছিল। তাঁর কবিতায় সমাজ প্রাধান্য পেয়েছে, যেটা আধুনিক কবিরা গ্রহণ করেছে ‘কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’
বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার সংকট রবীন্দ্র-সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। আধুনিক কবিতার ভাষা অর্থ পেরিয়ে উপলব্ধির আলোয় অর্থের অনমনীয় শিবত্বে পৌঁছায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নিহিতার্থের মহিমা ছিল যা ‘নিহিত অর্থের’ বৈপরীত্যে ‘অর্থ গৌরব’ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আজও আধুনিক, তাঁর কাব্যে আছে ‘সব মানুষের নাড়ীকম্পন’ বিশেষ কালের সঙ্গে চিরকালের যে মিলন-বিন্দু তা ছুঁতে পারা যায় তাঁর কবিতায়।
রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই আধুনিক কবির, তার কারণ শুধু এই নয় যে, তাঁর প্রভাব এড়াবার সজ্ঞান প্রয়াস সত্ত্বেও অবচেতনায় তাঁরই কাব্যে তারা অনুভাবিত। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সাহায্য ও ইঙ্গিত পেয়েই বাংলায় আধুনিক কাব্যের সূচনা ঘটেছে। তাঁর কাছ থেকেই প্রাপ্ত সমাজ-ইতিহাস চেতনা এবং কল্পনা-প্রতিভার বিস্ময়কর ভাস্বরতা।
আধুনিক কবিতা রবীন্দ্রনাথকে খুব মহিমার সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাদের কাছে। অনেক আধুনিক কবিতা এমন যে ‘কোন একটা’ শব্দ না বুঝলে পঙ্ক্তিই বোঝা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ভাবটা বোঝা যায়, তাই মানে খুঁজতে হয় না। কী অদ্ভুত দক্ষতায় তিনি শব্দ ও প্রসঙ্গ ব্যবহার করেন। তাঁর গান “ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে”-এর একটা লাইন আছে “ললিত নৃত্যে বাজুক স্বণরসনা” যার আভিধানিক অর্থ ‘নারীর কটিভূষণ’ সোনার জিভ নয়। রবীন্দ্রনাথকে অনেক সময় আমরা কেমন না বুঝেই বুঝে নিই। রবীন্দ্রনাথের শিল্প সৃষ্টি, আসলে নিজেকে সৃষ্টি তিল তিল করে। কবি বুদ্ধদেব বসুর মতে, রবীন্দ্রনাথ প্রথম আধুনিক এবং আধুনিক বাংলা কাব্যের চূড়াও তাঁর কবিতা স্পর্শ করে গেছে।
ব্যাপকতা, প্রাচুর্য এবং বৈচিত্র্যের দিক থেকে তিনি নিজেই নিজের তুলনা, অন্য কেউ নয়। বাঙালির সত্তাজুড়ে রবীন্দ্রনাথের দুর্মর উপস্থিতি। বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র এখনও রবীন্দ্রনাথ। অনেক আনন্দ, আকুলতা ও ব্যথার মুহূর্তে তিনি আজও আমাদের সহচর।