alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক রচনা : দুই

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

: শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১

শিল্পী : সমর মজুমদার

(পূর্ব প্রকাশের পর)

২. এক অখ্যাত কিশোর

রচনাটির নাম ‘এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ’! শিরোনাম দেখে অনেকেই চমকে উঠবেন হয়তো, বিশেষ করে যাঁরা আমাকে চেনেন। তারা হয়তো বলবেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তোমার বয়স কত ছিল হে? গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছিল তোমার নাকের নিচে? তোমার আবার মুক্তিযুদ্ধ!

আমি স্বীকার করছি যুদ্ধে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত বয়স তখন আমার হয়নি। কিন্তু যুদ্ধটা যদি আপনার গায়ে এসে গড়িয়ে পড়ে তখন আপনি করবেনটা কী ! হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন?

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স কত? নয় দশ বছর কিংবা তার কিছু বেশি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। সাত বছর বয়সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার কথা আমার। তখনকার দিনে গ্রামের ছেলেমেয়েরা একটু বেশি বয়সেই স্কুলে যেতো। তাছাড়া আমার বেলায় অন্য একটা ঘটনাও ঘটেছিল মনে হয়। সেটাকে ইংরেজিতে বলা ইঁষষুরহম. এর সহজ বাংলা হলো ভয় পাওয়া, ভয় দেখানে, উৎপীড়ন ইত্যাদি। আমার যতটুকু মনে হয় আমি উৎপীড়নের শিকার হয়ে কিছুদিন স্কুলে যাইনি। কে করেছিল আমাকে উৎপীড়ন? আমার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়ুয়া কিছু ছাত্র। তাদের এক নেতা ছিল। তার আসল নাম কী ছিল আমার মনে নেই। অনেকেই তার আসল নাম জানতো না। তার আসল নামটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল নকল নামের আড়ালে। একটা প্রাণির নামে তাকে ডাকা হতো। এমনকি ওটাই তার আসল নাম হতে পারে। সে সময় নাম রাখার কোনো সঠিক তরিকা ছিল না। যেমন শুক্রবারে জন্মালে অনেকেই ছেলে সন্তানের নাম রাখত শুক্কুর আলি, মঙ্গলবারে জন্মালে নাম রাখা হতো মঙ্গল মিয়া। আমার সেই মুখ্য উৎপীড়কের নাম ছিলে একটি প্রাণির নামের আদ্যক্ষর বে দিয়ে...। এটি এমন একটি প্রাণি যে প্রাণি মুরগির বাচ্চা আর পাখির ছানা খেতে পছন্দ করে। সাপের সাথে লড়াই করার জন্য প্রাণিটির সুখ্যাতি রয়েছে। আশা করি পাঠক নামটি উদ্ধারে করে সমর্থ হয়েছেন। কী জন্য তাকে এ নামে ডাকা হতো তার শানে নজুল আমার জানা নেই। সে ছিল মাথায় আমাদের চেয়ে বেশ বড়োসড়ো। চোখগুলো ছিল বিশাল। সে চোখের দিকে তাকালে আমাদের বুকের রক্ত হিম হওয়ার যোগাড় হতো। সেই ছেলেটি কী জন্য আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আজ আমার মনে নেই। আমি বেশ কিছুদিন স্কুলে যাইনি। সেটা সম্ভবত ছোট ওয়ানে পড়ার সময়। ফলে আমি একটু বেশি বয়স নিয়েই স্কুলে আবার ভর্তি হই।

১৯৭১ সালে আমি নূরপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। ক্লাস টুয়ের বইতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটা জীবনী ছিল। আমরা দুলে দুলে সে জীবনী পড়তাম। স্কুলে পড়ার আগে আমাদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। মক্তবটা ছিল আমাদের পাড়াতেই। স্কুলটা ছিল গ্রামের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে আমাদের পাড়া হতে প্রায় দেড় কি. মি. দূরে।

‘পাক সারজমিন সাদ বাদ,

কিশোয়ারে হাসিন শাদ বাদ’... দিয়ে আমাদের স্কুল শুরু হতো। জাতীয় সংগীত শেষে আমরা একটা ওয়াদা পাঠ করতাম। ওয়াদার কথাগুলো মনে নেই তবে এতে ভালো হয়ে চলার আর পাকিস্তানের সুখ-সমৃদ্ধির কথা বলা হতো বলে মনে হয়।

বাবুল আর কামাল দুই ভাইয়ের ছবিটা আমি এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই, যেনো ছবি নয়, জীবন্ত দুটি বালক আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়।

এ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধ করেছে এমন সাহসী বীর বালকের ভূরি ভূরি নজির মিলবে। অতএব, আমি তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো নাবালক হলেও যুদ্ধ জিনিসটা বুঝার মতো সাবালক হয়েছিলাম। আমার এ লেখা পড়ে পাঠকগণ বিভ্রান্ত হবেন না, এ নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি। আমার এ লেখা কাউকে ছোট করার জন্য নয়, বিব্রত করার জন্য নয়। আমার এলাকার কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন। ইতিহাসের পরিক্রমায় পরোক্ষভাবে তাদের ভূমিকার কথা এখানে চলে আসবে, তাতে কেউ আহত হলে আমার করার কিছু নেই।

আমার এ লেখাটি কোনো ইতিহাস নয়, তবে ইতিহাসের অংশ, পুরো দুইদিনের ইতিহাস, দুই গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তবে খণ্ডিত। এ নিয়ে আমি কোনো গবেষণা করিনি। একটি বালকের স্মৃতিতে যতটুকু মনে আছে আমি তা লিখেছি। এটি কোনো গল্প নয় তবে গল্পের অনুষঙ্গ আছে এতে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কয়েক ক’বছর আগে একটি উপন্যাস রচনা করেছি, তবে প্রকাশ করিনি।

পরে লিখেও আমার উপন্যাস ‘বেলা অবেলার গান’ প্রকাশিত হয়েছে গত বইমেলায়। এ যেন বড়বোনকে রেখে ছোটবোনের বিয়ে। অপ্রকাশিত আমার এ উপন্যাস থেকেও কিছু অংশ হয়তো আসবে যেগুলো বাস্তব।

হ্যা, যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য একটা বয়স তো লাগেই। সেটি প্রচলিত যুদ্ধের ক্ষেত্রে। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অপ্রচলিত একটা যুদ্ধ, প্রতিরোধের যুদ্ধ, বাঁচার যুদ্ধ, প্রতিবাদের যুদ্ধ, মা-বোনের ইজ্জত বাঁচানোর যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধে যোদ্ধাদের বয়স কিংবা লিঙ্গ কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। সেজন্যই বোধ হয় শাশ্বত এক বাঙালি বালিকা তারামন বিবি মাত্র তেরো বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

আপাতত বয়সের ব্যাপারটা থাক। ওটার হিসেব পরে দেবো। আসলে মানুষের জীবনে কিংবা একটা জাতীর জীবনে কিছু মহেন্দ্রক্ষণ আসে। সেই মহেন্দ্রক্ষণের অংশ হওয়া সব মানুষের কপালে জোটে না। সেদিক দিয়ে আমি এবং আমার মতো অনেকেই ভাগ্যবান। আমি এমন একটা ভাগ্যবান প্রজন্মের কথা বলছি যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছেন, যাঁরা এতে অংশ নিয়েছেন, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, শত্রুর সাথে লড়ে শহীদ হয়েছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্তরে লালন করেছেন, নীরবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রার্থনা করেছেন। আফসোস তাদের জন্য যারা এর কোনো শ্রেণিতেই পড়ে না, ঘৃণা তাদের জন্য যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তা করেছে, লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জত লুটে নিয়েছে কিংবা লুটে নিতে সহায়তা করেছে, হত্যা করেছেন লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে।

যা বলছিলাম, আমি মহেন্দ্রক্ষণের একজন ক্ষুদ্র সাক্ষী, একজন সামান্য অংশীদার। আমি চোখ বন্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের সেই দৃশ্যগুলো এখনও দেখতে পাই যা আমার নিজ গ্রাম ঘটেছিল। এপ্রিল কিংবা মে মাসে নাসিরনগর থানা আক্রমণের অংশগ্রহণের ঘটনা আমি এখনো দিব্য চেখে দেখতে পাই। আমি কান পেতে এখনও শুনতে পাই ভৈরবের পুল ভাঙার শব্দ কিংবা তেলিয়া পাড়ায় কামান দাগানোর শব্দ। হ্যাঁ, এসবই আমার সামনে দিয়ে চলচ্চিত্রের মতো ভেসে চলে যায়, কিংবা যায় না, লটকে থাকে আমার চোখের দিব্যদৃষ্টিতে। সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি দৃশ্যের মতোই এই দৃশ্যগুলি বন্দি হয়ে আছে আমার মগজে, আমার স্মৃতির প্রতিটি কোষে। মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যগুলো যা আমি দেখেছি, যা আমি শুনেছি তা ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু কিছু দৃশ্য আর স্মৃতিতে হয়তো মরিচা পড়েছে যা একটু ঘর্ষণেই আবার চকচকে হয়ে আমার স্মৃতি কোষে ধরা দিয়েছে। ঘটনাগুলো যখন আমি লিখছি তখন আমার মনে হচ্ছে এগুলি পঞ্চাশ বছর আগে নয়, যেনো এখনই ঘটছে। স্মৃতি বড়ো ধরনের কোনো প্রতারণা না করলে আমার কলমের আগা দিয়ে সত্য ঘটনাগুলোই আমি আপনাদের সামনে বয়ান করব। কিছু কিছু ঘটনার তারিখ আমার মনে নেই, থাকার কথাও নয়। আমি এগুলো কোনো ডায়েরিতে লিখে রাখি নাই। আমি কোনো ইতিহাস লিখার চেষ্টা করছি না যে আমি দিন তারিখ সঠিকভাবে উল্লেখ করব। তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি ঘটনার সময় ঠিক রাখতে। আমাদের যুদ্ধটা ছিল মাত্র নয় মাসের, আর আমি যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করছি সেগুলোর বয়স মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার। সুতরাং ঘটনার বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা এখানে খুবই কম। এগুলো মনে রাখার মতো বয়সটা তখন পর্যাপ্ত ছিল বলেই মনে হয়। ক্রমশ...

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক রচনা : দুই

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

শিল্পী : সমর মজুমদার

শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

২. এক অখ্যাত কিশোর

রচনাটির নাম ‘এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ’! শিরোনাম দেখে অনেকেই চমকে উঠবেন হয়তো, বিশেষ করে যাঁরা আমাকে চেনেন। তারা হয়তো বলবেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তোমার বয়স কত ছিল হে? গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছিল তোমার নাকের নিচে? তোমার আবার মুক্তিযুদ্ধ!

আমি স্বীকার করছি যুদ্ধে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত বয়স তখন আমার হয়নি। কিন্তু যুদ্ধটা যদি আপনার গায়ে এসে গড়িয়ে পড়ে তখন আপনি করবেনটা কী ! হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন?

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স কত? নয় দশ বছর কিংবা তার কিছু বেশি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। সাত বছর বয়সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার কথা আমার। তখনকার দিনে গ্রামের ছেলেমেয়েরা একটু বেশি বয়সেই স্কুলে যেতো। তাছাড়া আমার বেলায় অন্য একটা ঘটনাও ঘটেছিল মনে হয়। সেটাকে ইংরেজিতে বলা ইঁষষুরহম. এর সহজ বাংলা হলো ভয় পাওয়া, ভয় দেখানে, উৎপীড়ন ইত্যাদি। আমার যতটুকু মনে হয় আমি উৎপীড়নের শিকার হয়ে কিছুদিন স্কুলে যাইনি। কে করেছিল আমাকে উৎপীড়ন? আমার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়ুয়া কিছু ছাত্র। তাদের এক নেতা ছিল। তার আসল নাম কী ছিল আমার মনে নেই। অনেকেই তার আসল নাম জানতো না। তার আসল নামটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল নকল নামের আড়ালে। একটা প্রাণির নামে তাকে ডাকা হতো। এমনকি ওটাই তার আসল নাম হতে পারে। সে সময় নাম রাখার কোনো সঠিক তরিকা ছিল না। যেমন শুক্রবারে জন্মালে অনেকেই ছেলে সন্তানের নাম রাখত শুক্কুর আলি, মঙ্গলবারে জন্মালে নাম রাখা হতো মঙ্গল মিয়া। আমার সেই মুখ্য উৎপীড়কের নাম ছিলে একটি প্রাণির নামের আদ্যক্ষর বে দিয়ে...। এটি এমন একটি প্রাণি যে প্রাণি মুরগির বাচ্চা আর পাখির ছানা খেতে পছন্দ করে। সাপের সাথে লড়াই করার জন্য প্রাণিটির সুখ্যাতি রয়েছে। আশা করি পাঠক নামটি উদ্ধারে করে সমর্থ হয়েছেন। কী জন্য তাকে এ নামে ডাকা হতো তার শানে নজুল আমার জানা নেই। সে ছিল মাথায় আমাদের চেয়ে বেশ বড়োসড়ো। চোখগুলো ছিল বিশাল। সে চোখের দিকে তাকালে আমাদের বুকের রক্ত হিম হওয়ার যোগাড় হতো। সেই ছেলেটি কী জন্য আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আজ আমার মনে নেই। আমি বেশ কিছুদিন স্কুলে যাইনি। সেটা সম্ভবত ছোট ওয়ানে পড়ার সময়। ফলে আমি একটু বেশি বয়স নিয়েই স্কুলে আবার ভর্তি হই।

১৯৭১ সালে আমি নূরপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। ক্লাস টুয়ের বইতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটা জীবনী ছিল। আমরা দুলে দুলে সে জীবনী পড়তাম। স্কুলে পড়ার আগে আমাদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। মক্তবটা ছিল আমাদের পাড়াতেই। স্কুলটা ছিল গ্রামের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে আমাদের পাড়া হতে প্রায় দেড় কি. মি. দূরে।

‘পাক সারজমিন সাদ বাদ,

কিশোয়ারে হাসিন শাদ বাদ’... দিয়ে আমাদের স্কুল শুরু হতো। জাতীয় সংগীত শেষে আমরা একটা ওয়াদা পাঠ করতাম। ওয়াদার কথাগুলো মনে নেই তবে এতে ভালো হয়ে চলার আর পাকিস্তানের সুখ-সমৃদ্ধির কথা বলা হতো বলে মনে হয়।

বাবুল আর কামাল দুই ভাইয়ের ছবিটা আমি এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই, যেনো ছবি নয়, জীবন্ত দুটি বালক আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়।

এ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধ করেছে এমন সাহসী বীর বালকের ভূরি ভূরি নজির মিলবে। অতএব, আমি তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো নাবালক হলেও যুদ্ধ জিনিসটা বুঝার মতো সাবালক হয়েছিলাম। আমার এ লেখা পড়ে পাঠকগণ বিভ্রান্ত হবেন না, এ নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি। আমার এ লেখা কাউকে ছোট করার জন্য নয়, বিব্রত করার জন্য নয়। আমার এলাকার কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন। ইতিহাসের পরিক্রমায় পরোক্ষভাবে তাদের ভূমিকার কথা এখানে চলে আসবে, তাতে কেউ আহত হলে আমার করার কিছু নেই।

আমার এ লেখাটি কোনো ইতিহাস নয়, তবে ইতিহাসের অংশ, পুরো দুইদিনের ইতিহাস, দুই গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তবে খণ্ডিত। এ নিয়ে আমি কোনো গবেষণা করিনি। একটি বালকের স্মৃতিতে যতটুকু মনে আছে আমি তা লিখেছি। এটি কোনো গল্প নয় তবে গল্পের অনুষঙ্গ আছে এতে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কয়েক ক’বছর আগে একটি উপন্যাস রচনা করেছি, তবে প্রকাশ করিনি।

পরে লিখেও আমার উপন্যাস ‘বেলা অবেলার গান’ প্রকাশিত হয়েছে গত বইমেলায়। এ যেন বড়বোনকে রেখে ছোটবোনের বিয়ে। অপ্রকাশিত আমার এ উপন্যাস থেকেও কিছু অংশ হয়তো আসবে যেগুলো বাস্তব।

হ্যা, যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য একটা বয়স তো লাগেই। সেটি প্রচলিত যুদ্ধের ক্ষেত্রে। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অপ্রচলিত একটা যুদ্ধ, প্রতিরোধের যুদ্ধ, বাঁচার যুদ্ধ, প্রতিবাদের যুদ্ধ, মা-বোনের ইজ্জত বাঁচানোর যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধে যোদ্ধাদের বয়স কিংবা লিঙ্গ কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। সেজন্যই বোধ হয় শাশ্বত এক বাঙালি বালিকা তারামন বিবি মাত্র তেরো বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

আপাতত বয়সের ব্যাপারটা থাক। ওটার হিসেব পরে দেবো। আসলে মানুষের জীবনে কিংবা একটা জাতীর জীবনে কিছু মহেন্দ্রক্ষণ আসে। সেই মহেন্দ্রক্ষণের অংশ হওয়া সব মানুষের কপালে জোটে না। সেদিক দিয়ে আমি এবং আমার মতো অনেকেই ভাগ্যবান। আমি এমন একটা ভাগ্যবান প্রজন্মের কথা বলছি যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছেন, যাঁরা এতে অংশ নিয়েছেন, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, শত্রুর সাথে লড়ে শহীদ হয়েছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্তরে লালন করেছেন, নীরবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রার্থনা করেছেন। আফসোস তাদের জন্য যারা এর কোনো শ্রেণিতেই পড়ে না, ঘৃণা তাদের জন্য যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তা করেছে, লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জত লুটে নিয়েছে কিংবা লুটে নিতে সহায়তা করেছে, হত্যা করেছেন লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে।

যা বলছিলাম, আমি মহেন্দ্রক্ষণের একজন ক্ষুদ্র সাক্ষী, একজন সামান্য অংশীদার। আমি চোখ বন্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের সেই দৃশ্যগুলো এখনও দেখতে পাই যা আমার নিজ গ্রাম ঘটেছিল। এপ্রিল কিংবা মে মাসে নাসিরনগর থানা আক্রমণের অংশগ্রহণের ঘটনা আমি এখনো দিব্য চেখে দেখতে পাই। আমি কান পেতে এখনও শুনতে পাই ভৈরবের পুল ভাঙার শব্দ কিংবা তেলিয়া পাড়ায় কামান দাগানোর শব্দ। হ্যাঁ, এসবই আমার সামনে দিয়ে চলচ্চিত্রের মতো ভেসে চলে যায়, কিংবা যায় না, লটকে থাকে আমার চোখের দিব্যদৃষ্টিতে। সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি দৃশ্যের মতোই এই দৃশ্যগুলি বন্দি হয়ে আছে আমার মগজে, আমার স্মৃতির প্রতিটি কোষে। মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যগুলো যা আমি দেখেছি, যা আমি শুনেছি তা ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু কিছু দৃশ্য আর স্মৃতিতে হয়তো মরিচা পড়েছে যা একটু ঘর্ষণেই আবার চকচকে হয়ে আমার স্মৃতি কোষে ধরা দিয়েছে। ঘটনাগুলো যখন আমি লিখছি তখন আমার মনে হচ্ছে এগুলি পঞ্চাশ বছর আগে নয়, যেনো এখনই ঘটছে। স্মৃতি বড়ো ধরনের কোনো প্রতারণা না করলে আমার কলমের আগা দিয়ে সত্য ঘটনাগুলোই আমি আপনাদের সামনে বয়ান করব। কিছু কিছু ঘটনার তারিখ আমার মনে নেই, থাকার কথাও নয়। আমি এগুলো কোনো ডায়েরিতে লিখে রাখি নাই। আমি কোনো ইতিহাস লিখার চেষ্টা করছি না যে আমি দিন তারিখ সঠিকভাবে উল্লেখ করব। তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি ঘটনার সময় ঠিক রাখতে। আমাদের যুদ্ধটা ছিল মাত্র নয় মাসের, আর আমি যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করছি সেগুলোর বয়স মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার। সুতরাং ঘটনার বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা এখানে খুবই কম। এগুলো মনে রাখার মতো বয়সটা তখন পর্যাপ্ত ছিল বলেই মনে হয়। ক্রমশ...

back to top