alt

উপ-সম্পাদকীয়

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

গৌতম রায়

: মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪
image

জ্যোতি বসু

শত্রুকে জয় করার একটা আশ্চর্যজনক ক্ষমতা ছিল জ্যোতিবাবুর। কখনো শত্রুকে প্যাঁচে ফেলে, তাকে নিজের দিকে নিয়ে আসাÑ এমনটা কিন্তু জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক জীবনে কখনো দেখতে পাওয়া যায়নি। রাজনীতি তিনি করতেন সোজা ছক্কা হাঁকিয়ে। ক্রিকেট খেলায় এখন যে গুগলির চল খুব জনপ্রিয় হয়েছে, রাজনীতিতে সেই গুগলি দেয়াতে বিশ্বাসী ছিলেন না জ্যোতিবাবু।

সামগ্রিকভাবে তার রাজনৈতিক জীবন যদি আমরা দেখি, তাহলে তার যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আমাদের কাছে উঠে আসবে তা হলো মার্কসীয় বীক্ষণে অজন্ম স্নাত জ্যোতিবাবু, ভারতীয় রাজনীতিতে, মার্কসবাদের চিন্তাধারার প্রয়োগের প্রশ্নে ছিলেন ভারতীয় সমাজ মনস্কতারই ধারকবাহক। জ্যোতিবাবু তার গোটা জীবনের যে রাজনৈতিক কর্মকা-, সেখানে উদাহরণ টানার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের দৃষ্টান্ত যত না উপস্থাপিত করেছেন তার থেকে অনেক বেশি তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সংস্কৃতিক, এমনকি ধর্মীয় সংকটের বিষয়গুলো।

সমাজতান্ত্রিক চিন্তার কোনোরকম কাঠামোগত অদল-বদল না করে, ভারতীয় সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কীভাবে প্রয়োগ করতে পারা যায়, এ বিষয়ে জ্যোতিবাবুর যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটা তার সমসাময়িক যুগে প্রায় দুর্লভই বলা যেতে পারে। পরবর্তীকালে বাস্তবানুগ মার্কসীয় বীক্ষণের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীতারাম ইয়েচুরি বা মোহাম্মদ সেলিম যেভাবে তাদের ভাবনা চিন্তাগুলোকে চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও প্রসারিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাতে বারবার এটাই মনে হয়, জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনের ক্ষেত্রে সীতারাম বা সেলিম যথার্থভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

জ্যোতিবাবু ব্যক্তিজীবনে ঘোরতর নাস্তিক ছিলেন। কখনো ভাবের ঘরে চুরিÑ এই জিনিসটা তার ব্যক্তি চরিত্র বা রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্য ছিল না। তা বলে তিনি কোনো রকম বাধ্যতামূলক বিষয় কারো ওপর চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও ছিলেন অত্যন্ত নিস্পৃহ। তার পতœী কমল বসু, তিনি আধ্যাত্মিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। পতœীর সেই ধর্মাচারণ ঘিরে জ্যোতিবাবুর মধ্যে কখনো কোনো রকম আপত্তি দেখতে পাওয়া যায়নি। আবার কোনো রকম উচ্ছ্বাসÑ সেটাও দেখতে পাওয়া যায়নি।

পশ্চিমবঙ্গের বহু কমিউনিস্ট নেতাকে দেখতে পাওয়া যায় বাইরে প্রচ- রকমের নাস্তিকতার কথা বলেন। সেই নাস্তিকতা তাদের এমন একটা জায়গায় খানিকটা লোক দেখানোভাবে টেনে আনে যেটা অপরের বিশ্বাসকে আঘাত করে বসে। আবার দেখতে পাওয়া যায় ওই লোকগুলোর অনেকেই বৃহস্পতিবারের স্ত্রীর লক্ষ্মী পুজোর জন্য গোপনে পূজার সামগ্রী কিনে আনছেন। তাদের কোমরের ঘুনশিতে দেখতে পাওয়া যাবে হাজারটা তাবিজ,-কবজ। হাতের বাজুতে দেখতে পাওয়া যাবে নানা রকমের পাথর। কিন্তু বাইরে তাদের আচরণ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে সাধারণ মানুষের কাছে মনে হয় কমিউনিস্টরা ধর্মহীনতাকে উৎসাহিত করছে।

যারা ধর্মজীবন পালন করে তাদের প্রতি এসব লোকগুলোর একটা ভেতরে ভেতরে বিতৃষ্ণা আছেÑ এমন ভুল ধারণাও অনেকেরই তৈরি হয়। আর এই সুযোগ নিয়েই ভারতের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি আরএসএস আর তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কিংবা সহযোগী স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসÑ এরা বারবার কমিউনিস্টদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে একটা ভুল ধারণা তৈরি করিয়ে দেয়। তারা সাধারণ মানুষকে বোঝায় কমিউনিস্টরা হলো ধর্মবিরোধী। কমিউনিস্টরা যদি শাসনক্ষমতায় আসে তাহলে কোনো মানুষ ধর্মাচারণ করতে পারবে না।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলতেন; কমিউনিস্ট মরালিটি বলে আলাদা কোনো বিষয়বস্তু আকাশ থেকে পড়ে না। সাধারণ মানব জীবনযাপন করতে যে মরালিটির প্রয়োজন হয়, সেটাই হলো কমিউনিস্টদের যাপন চিত্রের মরালিটি। কিন্তু ইলিয়াস বলতেন; কমিউনিস্টদের যেটা থাকতে হবে, সেটা হচ্ছে, একটা সুনির্দিষ্ট সামাজিক দায়বদ্ধতা। আর এই সুনির্দিষ্ট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের ক্ষেত্রে ভারতীয় রাজনীতিতেই শুধু নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে জ্যোতি বসু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন একজন কিংবদন্তি হিসেবে।

জ্যোতিবাবুর স্ত্রী আধ্যাত্মিক আকর্ষণে বেলুড় মঠ গেছেন। ভরত মহারাজের সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে কিন্তু শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের টগর বোষ্ঠমীর মতো আচরণ জ্যোতিবাবু করেননি। ভরত মহারাজ্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনিও অংশ নিয়েছেন। তবে স্বামী-স্ত্রীর আলোচনার বিষয় ভিন্ন। স্ত্রী আধ্যাত্মিক বিষয় ঘিরে আলোচনা করছেন। জ্যোতিবাবুর প্রশ্ন, ভরত মহারাজের বিপ্লবী জীবন ঘিরে। ব্রিটিশরা তার মাথার দাম ঘোষণা করেছে, এটা জেনেও সারদা দেবী কীভাবে তাকে পুত্রস্নেহে আপন করে নিয়েছিলেনÑ জ্যোতিবাবুকে বলছেন ভরত মহারাজÑ সেই স্মৃতি এই নিবন্ধকারকে এখন ও বিহ্বল করে তোলে।

স্ত্রী মন্দিরে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করতে । জ্যোতিবাবু বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছেন। বরিষ্ঠ সন্ন্যাসীরা যখন তাকে প্রসাদ ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়িত করেছেন, সু খাদ্য হিসেবে সেগুলো তিনি তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন। বরিষ্ঠ সন্ন্যাসীরা যখন তাকে শাল ইত্যাদি উপহার দিয়েছেন, তিনি অত্যন্ত সশ্রদ্ধ চিত্তে সেগুলো গ্রহণ করেছেন। সেখানে অতি বিপ্লবীয়ানা বা অতি নাটকীয়তা কখনো জ্যোতিবাবুর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়নি।

আসলে এই ‘অতি’ শব্দটা জ্যোতিবাবুর গোটা জীবনের কর্মপদ্ধতির সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই মেলে না। কখনো আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রেও জ্যোতিবাবু ‘অতি’ কোনো মাত্রা যুক্ত করেননি। আবার বিষন্নতার ক্ষেত্রেও তার মধ্যে কখনো ‘অতি’ আধিক্য তাকে ডিপ্রেশনের রোগীতেও পরিণত করেনি।

জ্যোতিবাবুর কালে কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা ভারতজুড়ে তার মতো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিক বোধহয় একমাত্র ছিলেন প-িত নেহরু, ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ ইন্দিরা গান্ধী এবং হরকিষান সিং সুরজিত।

একজন রাজনীতিকের রাজনৈতিক জীবনের সাফল্য নির্ভর করে পরিস্থিতির মূল্যায়নের প্রশ্নে তিনি কতটা বাস্তব পরিস্থিতিকে মূল্য দেন, অবস্থাকে মূল্য দেন এবং বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আগামীর পথসংকেত কীভাবে রচনা করেন তার ওপরে। জ্যোতিবাবু আপাদমস্তক বামপন্থী, মার্কসবাদী, কমিউনিস্ট। কিন্তু জ্যোতিবাবু কোনোদিনের জন্য পুঁথি সর্বস্ব কমিউনিস্ট ছিলেন না। রাজনৈতিক পদক্ষেপ বা প্রশাসনিক পদক্ষেপÑ এগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে কখনো দলের গঠনতন্ত্র ধরে ধরে একেবারে সেই রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীতে যেভাবে ঞ, চ ইত্যাদি ইত্যাদির অভিমত রয়েছে, সেভাবে নিজের রাজনৈতিক ভাবনাকে পরিচালিত করতেন না।

জ্যোতিবাবুর সাফল্য এসেছিল সমসাময়িক বহু ঘটনা পরম্পরার ফলশ্রুতিতে। বিশেষ করে খাদ্য আন্দোলন, উদ্বাস্তু সমস্যা ঘিরে কমিউনিস্টদের অবস্থান, দাঙ্গা প্রতিরোধে কেবল তাত্ত্বিকভাবে নয় মাঠে-ময়দানে দাঁড়িয়ে থেকে কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ, নারীর অধিকারের প্রশ্নে সদ্য দেশভাগের পর, সামাজিক অচল অবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়ে, নারীকে অর্থনীতির মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য কমিউনিস্টদের জীবনপণ সংগ্রামÑ এই সমস্ত কিছুই জ্যোতিবাবুর যুক্তফ্রন্টের তত্ত্বকে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করে, তাকে সফল করে তোলার জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল।

জ্যোতিবাবু রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে বিকাশ এবং একটা চরম পর্যায়ে উপনীত হওয়ার সময়কালের যে আর্থসামাজিক- রাজনৈতিক পরিকাঠামো অবিভক্ত ভারতের বা পরবর্তীকালে খ-িত ভারতে ছিল, তা আজ আর নেই। জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক সাবধান বাণী যদি আমরা অন্তর দিয়ে ধারণ করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আজ গোটা ভারতজুড়ে এভাবে উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির দাপটের মুখে দেশবাসীকে পড়তে হতো না।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

গৌতম রায়

image

জ্যোতি বসু

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

শত্রুকে জয় করার একটা আশ্চর্যজনক ক্ষমতা ছিল জ্যোতিবাবুর। কখনো শত্রুকে প্যাঁচে ফেলে, তাকে নিজের দিকে নিয়ে আসাÑ এমনটা কিন্তু জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক জীবনে কখনো দেখতে পাওয়া যায়নি। রাজনীতি তিনি করতেন সোজা ছক্কা হাঁকিয়ে। ক্রিকেট খেলায় এখন যে গুগলির চল খুব জনপ্রিয় হয়েছে, রাজনীতিতে সেই গুগলি দেয়াতে বিশ্বাসী ছিলেন না জ্যোতিবাবু।

সামগ্রিকভাবে তার রাজনৈতিক জীবন যদি আমরা দেখি, তাহলে তার যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আমাদের কাছে উঠে আসবে তা হলো মার্কসীয় বীক্ষণে অজন্ম স্নাত জ্যোতিবাবু, ভারতীয় রাজনীতিতে, মার্কসবাদের চিন্তাধারার প্রয়োগের প্রশ্নে ছিলেন ভারতীয় সমাজ মনস্কতারই ধারকবাহক। জ্যোতিবাবু তার গোটা জীবনের যে রাজনৈতিক কর্মকা-, সেখানে উদাহরণ টানার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের দৃষ্টান্ত যত না উপস্থাপিত করেছেন তার থেকে অনেক বেশি তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সংস্কৃতিক, এমনকি ধর্মীয় সংকটের বিষয়গুলো।

সমাজতান্ত্রিক চিন্তার কোনোরকম কাঠামোগত অদল-বদল না করে, ভারতীয় সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কীভাবে প্রয়োগ করতে পারা যায়, এ বিষয়ে জ্যোতিবাবুর যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটা তার সমসাময়িক যুগে প্রায় দুর্লভই বলা যেতে পারে। পরবর্তীকালে বাস্তবানুগ মার্কসীয় বীক্ষণের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীতারাম ইয়েচুরি বা মোহাম্মদ সেলিম যেভাবে তাদের ভাবনা চিন্তাগুলোকে চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও প্রসারিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাতে বারবার এটাই মনে হয়, জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনের ক্ষেত্রে সীতারাম বা সেলিম যথার্থভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

জ্যোতিবাবু ব্যক্তিজীবনে ঘোরতর নাস্তিক ছিলেন। কখনো ভাবের ঘরে চুরিÑ এই জিনিসটা তার ব্যক্তি চরিত্র বা রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্য ছিল না। তা বলে তিনি কোনো রকম বাধ্যতামূলক বিষয় কারো ওপর চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও ছিলেন অত্যন্ত নিস্পৃহ। তার পতœী কমল বসু, তিনি আধ্যাত্মিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। পতœীর সেই ধর্মাচারণ ঘিরে জ্যোতিবাবুর মধ্যে কখনো কোনো রকম আপত্তি দেখতে পাওয়া যায়নি। আবার কোনো রকম উচ্ছ্বাসÑ সেটাও দেখতে পাওয়া যায়নি।

পশ্চিমবঙ্গের বহু কমিউনিস্ট নেতাকে দেখতে পাওয়া যায় বাইরে প্রচ- রকমের নাস্তিকতার কথা বলেন। সেই নাস্তিকতা তাদের এমন একটা জায়গায় খানিকটা লোক দেখানোভাবে টেনে আনে যেটা অপরের বিশ্বাসকে আঘাত করে বসে। আবার দেখতে পাওয়া যায় ওই লোকগুলোর অনেকেই বৃহস্পতিবারের স্ত্রীর লক্ষ্মী পুজোর জন্য গোপনে পূজার সামগ্রী কিনে আনছেন। তাদের কোমরের ঘুনশিতে দেখতে পাওয়া যাবে হাজারটা তাবিজ,-কবজ। হাতের বাজুতে দেখতে পাওয়া যাবে নানা রকমের পাথর। কিন্তু বাইরে তাদের আচরণ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে সাধারণ মানুষের কাছে মনে হয় কমিউনিস্টরা ধর্মহীনতাকে উৎসাহিত করছে।

যারা ধর্মজীবন পালন করে তাদের প্রতি এসব লোকগুলোর একটা ভেতরে ভেতরে বিতৃষ্ণা আছেÑ এমন ভুল ধারণাও অনেকেরই তৈরি হয়। আর এই সুযোগ নিয়েই ভারতের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি আরএসএস আর তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কিংবা সহযোগী স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসÑ এরা বারবার কমিউনিস্টদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে একটা ভুল ধারণা তৈরি করিয়ে দেয়। তারা সাধারণ মানুষকে বোঝায় কমিউনিস্টরা হলো ধর্মবিরোধী। কমিউনিস্টরা যদি শাসনক্ষমতায় আসে তাহলে কোনো মানুষ ধর্মাচারণ করতে পারবে না।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলতেন; কমিউনিস্ট মরালিটি বলে আলাদা কোনো বিষয়বস্তু আকাশ থেকে পড়ে না। সাধারণ মানব জীবনযাপন করতে যে মরালিটির প্রয়োজন হয়, সেটাই হলো কমিউনিস্টদের যাপন চিত্রের মরালিটি। কিন্তু ইলিয়াস বলতেন; কমিউনিস্টদের যেটা থাকতে হবে, সেটা হচ্ছে, একটা সুনির্দিষ্ট সামাজিক দায়বদ্ধতা। আর এই সুনির্দিষ্ট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের ক্ষেত্রে ভারতীয় রাজনীতিতেই শুধু নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে জ্যোতি বসু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন একজন কিংবদন্তি হিসেবে।

জ্যোতিবাবুর স্ত্রী আধ্যাত্মিক আকর্ষণে বেলুড় মঠ গেছেন। ভরত মহারাজের সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে কিন্তু শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের টগর বোষ্ঠমীর মতো আচরণ জ্যোতিবাবু করেননি। ভরত মহারাজ্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনিও অংশ নিয়েছেন। তবে স্বামী-স্ত্রীর আলোচনার বিষয় ভিন্ন। স্ত্রী আধ্যাত্মিক বিষয় ঘিরে আলোচনা করছেন। জ্যোতিবাবুর প্রশ্ন, ভরত মহারাজের বিপ্লবী জীবন ঘিরে। ব্রিটিশরা তার মাথার দাম ঘোষণা করেছে, এটা জেনেও সারদা দেবী কীভাবে তাকে পুত্রস্নেহে আপন করে নিয়েছিলেনÑ জ্যোতিবাবুকে বলছেন ভরত মহারাজÑ সেই স্মৃতি এই নিবন্ধকারকে এখন ও বিহ্বল করে তোলে।

স্ত্রী মন্দিরে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করতে । জ্যোতিবাবু বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছেন। বরিষ্ঠ সন্ন্যাসীরা যখন তাকে প্রসাদ ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়িত করেছেন, সু খাদ্য হিসেবে সেগুলো তিনি তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন। বরিষ্ঠ সন্ন্যাসীরা যখন তাকে শাল ইত্যাদি উপহার দিয়েছেন, তিনি অত্যন্ত সশ্রদ্ধ চিত্তে সেগুলো গ্রহণ করেছেন। সেখানে অতি বিপ্লবীয়ানা বা অতি নাটকীয়তা কখনো জ্যোতিবাবুর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়নি।

আসলে এই ‘অতি’ শব্দটা জ্যোতিবাবুর গোটা জীবনের কর্মপদ্ধতির সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই মেলে না। কখনো আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রেও জ্যোতিবাবু ‘অতি’ কোনো মাত্রা যুক্ত করেননি। আবার বিষন্নতার ক্ষেত্রেও তার মধ্যে কখনো ‘অতি’ আধিক্য তাকে ডিপ্রেশনের রোগীতেও পরিণত করেনি।

জ্যোতিবাবুর কালে কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা ভারতজুড়ে তার মতো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিক বোধহয় একমাত্র ছিলেন প-িত নেহরু, ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ ইন্দিরা গান্ধী এবং হরকিষান সিং সুরজিত।

একজন রাজনীতিকের রাজনৈতিক জীবনের সাফল্য নির্ভর করে পরিস্থিতির মূল্যায়নের প্রশ্নে তিনি কতটা বাস্তব পরিস্থিতিকে মূল্য দেন, অবস্থাকে মূল্য দেন এবং বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আগামীর পথসংকেত কীভাবে রচনা করেন তার ওপরে। জ্যোতিবাবু আপাদমস্তক বামপন্থী, মার্কসবাদী, কমিউনিস্ট। কিন্তু জ্যোতিবাবু কোনোদিনের জন্য পুঁথি সর্বস্ব কমিউনিস্ট ছিলেন না। রাজনৈতিক পদক্ষেপ বা প্রশাসনিক পদক্ষেপÑ এগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে কখনো দলের গঠনতন্ত্র ধরে ধরে একেবারে সেই রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীতে যেভাবে ঞ, চ ইত্যাদি ইত্যাদির অভিমত রয়েছে, সেভাবে নিজের রাজনৈতিক ভাবনাকে পরিচালিত করতেন না।

জ্যোতিবাবুর সাফল্য এসেছিল সমসাময়িক বহু ঘটনা পরম্পরার ফলশ্রুতিতে। বিশেষ করে খাদ্য আন্দোলন, উদ্বাস্তু সমস্যা ঘিরে কমিউনিস্টদের অবস্থান, দাঙ্গা প্রতিরোধে কেবল তাত্ত্বিকভাবে নয় মাঠে-ময়দানে দাঁড়িয়ে থেকে কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ, নারীর অধিকারের প্রশ্নে সদ্য দেশভাগের পর, সামাজিক অচল অবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়ে, নারীকে অর্থনীতির মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য কমিউনিস্টদের জীবনপণ সংগ্রামÑ এই সমস্ত কিছুই জ্যোতিবাবুর যুক্তফ্রন্টের তত্ত্বকে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করে, তাকে সফল করে তোলার জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল।

জ্যোতিবাবু রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে বিকাশ এবং একটা চরম পর্যায়ে উপনীত হওয়ার সময়কালের যে আর্থসামাজিক- রাজনৈতিক পরিকাঠামো অবিভক্ত ভারতের বা পরবর্তীকালে খ-িত ভারতে ছিল, তা আজ আর নেই। জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক সাবধান বাণী যদি আমরা অন্তর দিয়ে ধারণ করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আজ গোটা ভারতজুড়ে এভাবে উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির দাপটের মুখে দেশবাসীকে পড়তে হতো না।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top