alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪

সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্ম সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। সরকারি কর্মচারীদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষত রেখে সাধারণ মানুষের সেবা করা। সরকারি কর্মচারীদের সেবক-সেবিকার মনোবৃত্তিতে জনগণ ও জাতিকে সেবা দেয়া আজ জনগণের অপরিহার্য দাবি। যে কয়েকটি বিষয়কে মাথায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয় তা আজ সবারই জানা; কিন্তু এসব বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের আমলাতন্ত্র কতটা সবল পেশাদারিত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত? প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কতটা সেবক ও কতটা প্রভু? আমলানির্ভর সরকার রাষ্ট্রের উন্নয়নে কতটা সহায়ক বা প্রতিবন্ধক? এ প্রশ্নগুলো জনগণকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য অভিধায়ে আখ্যায়িত করা যায়। বিদ্যমান আমলাতন্ত্রে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতায় জাতীয় রাষ্ট্রের রাজনীতি শূন্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমলাদের স্বার্থপরতা আর তোষণ নীতিতে সরকারের নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নষ্ট হচ্ছে। বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কারণে বিচার বিভাগ পর্যন্ত আজ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমলারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে অপব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে মন্ত্রী এমপি পর্যন্ত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে অনেক সময় নতজানু নীতি অবলম্বন করে থাকে অথবা ভাগাভাগি চুক্তির মাধ্যমে সুবিধাভোগীর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষ আমলাদের দ্বারা বিভিন্নভাবে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকারে পরিণত হন। সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে আমাদের আমলাতন্ত্রের আশু সংস্কারে মনোযোগ নিবদ্ধ হতে হবে।

পুলিশ একটি রাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা ছাড়াও সমাজের অনেক সেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে হয় পুলিশকে। এছাড়া দেশের অনেক দুর্যোগ-দুর্ভোগ মোকাবিলায় পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে যোগ্য ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেয়া হবেÑ এটাই প্রত্যাশা। বেনজীরের পুলিশের মহাপরিদর্শকের পদ অলঙ্কৃত করার মতো যোগ্যতা ছিল তার। তবে তাকে নিয়োগ দেয়ার সময় শুধু পেশাগত যোগ্যতাই কি বিবেচনা করা হয়েছিল?

বেনজীর আহমেদের প্রায় ৩৫ বছরের চাকরি জীবনে তিনি পাঁচবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল’ লাভ করেন। এ পদকগুলো তিনি ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পেয়েছেন। এছাড়া তার কৃতিত্বের মধ্যে রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদকও আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২০-২০২১ সালে তাকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২০২১ সালে বেনজীরকে সেরা করদাতা নির্বাচিত করে। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন তার মন্ত্রণালয় থেকে ২০২০-২০২১ সালে বেনজীরকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দিয়েছে, সে সময় দুদকের তথ্য অনুযায়ী, বেনজীর ও তার পরিবার প্রায় ৮৭ একরেরও বেশি জমি ক্রয় করেছেন। ২০২১ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যখন বেনজীরকে সেরা করদাতা নির্বাচিত করে, ওই সময়ে বেনজীর ও তার পরিবার ১৩৮ একরেরও বেশি জমির মালিক ছিলেন। সরকারের উচ্চমহল কি এখন অস্বীকার করতে চায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনজীরের এত অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার কোনো তথ্যই তাদের জানা ছিল না? রাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী দুটি গোয়েন্দা সংস্থা তাহলে কী করেছে? অন্যান্য দায়িত্ব পালন ছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কখন কী করেন, সেই খবর সরকারপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেয়াও এ দুটি গোয়েন্দা সংস্থার কাজ।

এখন যে বুদ্ধি ও বিবেচনায়েই সরকার বেনজীরকে পরিত্যাগ করুক না কেন, তার অপরাধের দায়ভার তারা এড়াতে পারেন না; কিন্তু সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে মনে হয়, তারা এখন বেনজীরের অপরাধের বোঝা আর টানতে চান না। সরকারের সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য শুনে তাই মনে হয়। তিনি বেনজীরের দুর্নীতির খবর তার পদে থাকাকালীন গণমাধ্যমে প্রকাশ না পাওয়ায় সাংবাদিকদের সৎসাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী, বেনজীর র‌্যাবের ডিজি ও পুলিশের মহাপরিদর্শক থাকা অবস্থায়ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চান, সরকার এখন কেন সে দায় নেবে না? ওবায়দুল কাদের এভাবে সাংবাদিকদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়ভার থেকে কতটুকু মুক্ত হতে পারবেন। সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সর্বোচ্চ পদে থেকে বেনজীর যেভাবে দুষ্কর্ম করে গেছেন, ওবায়দুল কাদেরের কথায়, তা জানতে না পারাও যে সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা, তা তিনি অস্বীকার করবেন কী করে?

তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, সরকারের প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্যকে বেনজীর ব্যক্তিগত ফায়দা বা সুবিধা লুটার জন্য বেশি ব্যবহার করেছেন, যা স্বার্থপরতার নামান্তর। এখানে তার যোগ্যতার বিষয়টিকে তেমনটা মুখ্য বিবেচিত হয়েছে বলে আমার মনে হয়না। একজন যোগ্য পেশাদারিত্বের পক্ষে এমন দুর্নীতিতে জড়িত হওয়া মোটেও গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তার কর্তৃত্ববাদী আচরণে তিনি একজন রাষ্ট্রের নাগরিক অথবা একজন দায়িত্বশীল বাহিনীর প্রধান সে কথাও তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি এতটাই কর্তৃত্ববাদী মানুষে পরিণত হয়েছিলেন যে, ধরাকে সরাজ্ঞান করার অবকাশ ছিল না।

অর্থাৎ তিনি একজন অবিসংবাদিত কর্তৃত্বপরায়ণ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে চিন্তা করেছিলেন। সরকার বা রাষ্ট্রের কাছে তার জবাবদিহিতা আছে সেটাকে তিনি গৌণ হিসেবে দেখেছেন। তিনি কোন জবাবদিহিতার ধার ধারতেন না। তিনি নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসেবে জেনেছিলেন। তিনি ছিলেন সব প্রশ্ন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। অবস্থাটা এমন যে, ইংল্যান্ডের রাজাকে যেমন কোন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয় না, তিনি কোন ভুল করেন না এবং ইংল্যান্ডের রাজা বা রানি যা করেন তা সঠিকভাবে করেন। আজকের বেনজীর ইস্যুতে তাই মনে হচ্ছে। তবে এই ক্ষমতার অপব্যবহার কোন ন্যায় নীতির মাপকাঠিতে বিচার্যÑ তা আমার উপলব্ধিতে আসে না।

সরকারি আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ও সরকারের নজরদারির অভাবে বেনজীর সাহেব অপরিমেয় কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠান প্রধান হয়েছিলেন অথবা তাকে সেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অথবা তিনি সেভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। বিনিময়ে বেনজীর সাহেব নিজের স্বার্থসিদ্ধির পথকে প্রশস্ততর করে নামে বেনামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ও শিষ্টাচারের অপব্যবহার করেছেন। এই কথা জেনারেল আজিজ আহমেদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

একজন প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন এমন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান অথবা অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন? এটা জাতির জন্য এক মারাত্মক দুর্ভাগ্য ও খারাপ দৃষ্টান্তের শামিল। সমাজ বা রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে যা বুমেরাং হয়ে ওঠে এমনটা কখনোই সভ্য রাষ্ট্রের বা সরকারের জন্য কাক্সিক্ষত নয়। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ তার কার্যক্রমকে এড়িয়ে গেছেনÑ যার ফলে এই বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি। এতে বদনাম, দুর্নাম যা হওয়ার সে দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্র এবং সরকারকেই নিতে হবে। কোন কর্তা ব্যক্তির এহেন আচরণে প্রকারান্তরে রাষ্ট্রকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে হয়। আর এর পরিণতিতে রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের যে অশান্তি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়Ñ তার জন্য রাষ্ট্রকেই ভুগতে হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান আইন-কানুন নীতিমালায় সাধারণ মানুষের কাছে মূল্যহীন আবর্জনা স্তূপে পরিণত হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা ও নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। প্রকারান্তরে রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হতে থাকে।

একজন বাহিনী প্রধানকে কী কারণে এমন মাফিয়া হিসেবে গণ্য হতে হয় অথবা তিনি নিজেকে মাফিয়া বলে দাবি করেন তা যে কোন সুস্থ মানুষকেই হতবাক করে দেয়। এটা তো দেশের সব নাগরিক সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা বা হঠকারিতা বা দেশদ্রোহিতার সামিল। সরকারের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার কোন ম্যাজিক কোন পুলিশ প্রধান বা সেনাপ্রধানের থাকে না। সেই ম্যাজিকের মালিক দেশের জনগণ। এক্ষেত্রে যদি কোন বাহিনী প্রধান ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেনÑ তার দায় একদিকে যেমন তার নিজের ওপরে বর্তায় তেমনিভাবে তা সরকারের ওপরেও বর্তায়। এমন কুদৃষ্টান্ত রাষ্ট্র বা জাতির জন্য কোনভাবেই শোভনীয় নয়। এই জাতীয় পরিস্থিতি উন্নয়নধারাকে বাধাগ্রস্ত করে।

এদিকে এমপি আনার হত্যাকা-ে জাতি আজ বিষ্মিত হয়েছে। একদিকে ডিবিপ্রধানের একরকম বক্তব্য, অন্যদিকে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় জাতি আজ দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ রকমটা কোন সুস্থ জাতির পক্ষেই কাম্য নয়।

আমাদের বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য ২০৪১ সালকে যেভাবে টার্গেট করে অগ্রযাত্রার কথা ভাবা হয়েছে, সে অগ্রযাত্রা ও সম্ভাবনা এক বড় চ্যলেঞ্জের মুখোমুখি হবে। অশান্তি আর গোলযোগের আগুন দেশময় দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে। বাহিনীর ওপর তার এক প্রচ- রকমের ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। ক্রমশই বাহিনীর সম্মান ও মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হবে। তবে বেনজীর-আজিজই শুধু নয়Ñ ভেতরে ভেতরে এরকম আরও অনেক মাফিয়া ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে। তাদের বিচারের কাঠগড়ায় আনতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪

সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্ম সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। সরকারি কর্মচারীদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষত রেখে সাধারণ মানুষের সেবা করা। সরকারি কর্মচারীদের সেবক-সেবিকার মনোবৃত্তিতে জনগণ ও জাতিকে সেবা দেয়া আজ জনগণের অপরিহার্য দাবি। যে কয়েকটি বিষয়কে মাথায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয় তা আজ সবারই জানা; কিন্তু এসব বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের আমলাতন্ত্র কতটা সবল পেশাদারিত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত? প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কতটা সেবক ও কতটা প্রভু? আমলানির্ভর সরকার রাষ্ট্রের উন্নয়নে কতটা সহায়ক বা প্রতিবন্ধক? এ প্রশ্নগুলো জনগণকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য অভিধায়ে আখ্যায়িত করা যায়। বিদ্যমান আমলাতন্ত্রে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতায় জাতীয় রাষ্ট্রের রাজনীতি শূন্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমলাদের স্বার্থপরতা আর তোষণ নীতিতে সরকারের নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নষ্ট হচ্ছে। বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কারণে বিচার বিভাগ পর্যন্ত আজ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমলারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে অপব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে মন্ত্রী এমপি পর্যন্ত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে অনেক সময় নতজানু নীতি অবলম্বন করে থাকে অথবা ভাগাভাগি চুক্তির মাধ্যমে সুবিধাভোগীর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষ আমলাদের দ্বারা বিভিন্নভাবে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকারে পরিণত হন। সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে আমাদের আমলাতন্ত্রের আশু সংস্কারে মনোযোগ নিবদ্ধ হতে হবে।

পুলিশ একটি রাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা ছাড়াও সমাজের অনেক সেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে হয় পুলিশকে। এছাড়া দেশের অনেক দুর্যোগ-দুর্ভোগ মোকাবিলায় পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে যোগ্য ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেয়া হবেÑ এটাই প্রত্যাশা। বেনজীরের পুলিশের মহাপরিদর্শকের পদ অলঙ্কৃত করার মতো যোগ্যতা ছিল তার। তবে তাকে নিয়োগ দেয়ার সময় শুধু পেশাগত যোগ্যতাই কি বিবেচনা করা হয়েছিল?

বেনজীর আহমেদের প্রায় ৩৫ বছরের চাকরি জীবনে তিনি পাঁচবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল’ লাভ করেন। এ পদকগুলো তিনি ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পেয়েছেন। এছাড়া তার কৃতিত্বের মধ্যে রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদকও আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২০-২০২১ সালে তাকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২০২১ সালে বেনজীরকে সেরা করদাতা নির্বাচিত করে। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন তার মন্ত্রণালয় থেকে ২০২০-২০২১ সালে বেনজীরকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দিয়েছে, সে সময় দুদকের তথ্য অনুযায়ী, বেনজীর ও তার পরিবার প্রায় ৮৭ একরেরও বেশি জমি ক্রয় করেছেন। ২০২১ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যখন বেনজীরকে সেরা করদাতা নির্বাচিত করে, ওই সময়ে বেনজীর ও তার পরিবার ১৩৮ একরেরও বেশি জমির মালিক ছিলেন। সরকারের উচ্চমহল কি এখন অস্বীকার করতে চায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনজীরের এত অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার কোনো তথ্যই তাদের জানা ছিল না? রাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী দুটি গোয়েন্দা সংস্থা তাহলে কী করেছে? অন্যান্য দায়িত্ব পালন ছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কখন কী করেন, সেই খবর সরকারপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেয়াও এ দুটি গোয়েন্দা সংস্থার কাজ।

এখন যে বুদ্ধি ও বিবেচনায়েই সরকার বেনজীরকে পরিত্যাগ করুক না কেন, তার অপরাধের দায়ভার তারা এড়াতে পারেন না; কিন্তু সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে মনে হয়, তারা এখন বেনজীরের অপরাধের বোঝা আর টানতে চান না। সরকারের সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য শুনে তাই মনে হয়। তিনি বেনজীরের দুর্নীতির খবর তার পদে থাকাকালীন গণমাধ্যমে প্রকাশ না পাওয়ায় সাংবাদিকদের সৎসাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী, বেনজীর র‌্যাবের ডিজি ও পুলিশের মহাপরিদর্শক থাকা অবস্থায়ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চান, সরকার এখন কেন সে দায় নেবে না? ওবায়দুল কাদের এভাবে সাংবাদিকদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়ভার থেকে কতটুকু মুক্ত হতে পারবেন। সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সর্বোচ্চ পদে থেকে বেনজীর যেভাবে দুষ্কর্ম করে গেছেন, ওবায়দুল কাদেরের কথায়, তা জানতে না পারাও যে সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা, তা তিনি অস্বীকার করবেন কী করে?

তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, সরকারের প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্যকে বেনজীর ব্যক্তিগত ফায়দা বা সুবিধা লুটার জন্য বেশি ব্যবহার করেছেন, যা স্বার্থপরতার নামান্তর। এখানে তার যোগ্যতার বিষয়টিকে তেমনটা মুখ্য বিবেচিত হয়েছে বলে আমার মনে হয়না। একজন যোগ্য পেশাদারিত্বের পক্ষে এমন দুর্নীতিতে জড়িত হওয়া মোটেও গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তার কর্তৃত্ববাদী আচরণে তিনি একজন রাষ্ট্রের নাগরিক অথবা একজন দায়িত্বশীল বাহিনীর প্রধান সে কথাও তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি এতটাই কর্তৃত্ববাদী মানুষে পরিণত হয়েছিলেন যে, ধরাকে সরাজ্ঞান করার অবকাশ ছিল না।

অর্থাৎ তিনি একজন অবিসংবাদিত কর্তৃত্বপরায়ণ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে চিন্তা করেছিলেন। সরকার বা রাষ্ট্রের কাছে তার জবাবদিহিতা আছে সেটাকে তিনি গৌণ হিসেবে দেখেছেন। তিনি কোন জবাবদিহিতার ধার ধারতেন না। তিনি নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসেবে জেনেছিলেন। তিনি ছিলেন সব প্রশ্ন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। অবস্থাটা এমন যে, ইংল্যান্ডের রাজাকে যেমন কোন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয় না, তিনি কোন ভুল করেন না এবং ইংল্যান্ডের রাজা বা রানি যা করেন তা সঠিকভাবে করেন। আজকের বেনজীর ইস্যুতে তাই মনে হচ্ছে। তবে এই ক্ষমতার অপব্যবহার কোন ন্যায় নীতির মাপকাঠিতে বিচার্যÑ তা আমার উপলব্ধিতে আসে না।

সরকারি আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ও সরকারের নজরদারির অভাবে বেনজীর সাহেব অপরিমেয় কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠান প্রধান হয়েছিলেন অথবা তাকে সেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অথবা তিনি সেভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। বিনিময়ে বেনজীর সাহেব নিজের স্বার্থসিদ্ধির পথকে প্রশস্ততর করে নামে বেনামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ও শিষ্টাচারের অপব্যবহার করেছেন। এই কথা জেনারেল আজিজ আহমেদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

একজন প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন এমন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান অথবা অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন? এটা জাতির জন্য এক মারাত্মক দুর্ভাগ্য ও খারাপ দৃষ্টান্তের শামিল। সমাজ বা রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে যা বুমেরাং হয়ে ওঠে এমনটা কখনোই সভ্য রাষ্ট্রের বা সরকারের জন্য কাক্সিক্ষত নয়। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ তার কার্যক্রমকে এড়িয়ে গেছেনÑ যার ফলে এই বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি। এতে বদনাম, দুর্নাম যা হওয়ার সে দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্র এবং সরকারকেই নিতে হবে। কোন কর্তা ব্যক্তির এহেন আচরণে প্রকারান্তরে রাষ্ট্রকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে হয়। আর এর পরিণতিতে রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের যে অশান্তি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়Ñ তার জন্য রাষ্ট্রকেই ভুগতে হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান আইন-কানুন নীতিমালায় সাধারণ মানুষের কাছে মূল্যহীন আবর্জনা স্তূপে পরিণত হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা ও নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। প্রকারান্তরে রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হতে থাকে।

একজন বাহিনী প্রধানকে কী কারণে এমন মাফিয়া হিসেবে গণ্য হতে হয় অথবা তিনি নিজেকে মাফিয়া বলে দাবি করেন তা যে কোন সুস্থ মানুষকেই হতবাক করে দেয়। এটা তো দেশের সব নাগরিক সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা বা হঠকারিতা বা দেশদ্রোহিতার সামিল। সরকারের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার কোন ম্যাজিক কোন পুলিশ প্রধান বা সেনাপ্রধানের থাকে না। সেই ম্যাজিকের মালিক দেশের জনগণ। এক্ষেত্রে যদি কোন বাহিনী প্রধান ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেনÑ তার দায় একদিকে যেমন তার নিজের ওপরে বর্তায় তেমনিভাবে তা সরকারের ওপরেও বর্তায়। এমন কুদৃষ্টান্ত রাষ্ট্র বা জাতির জন্য কোনভাবেই শোভনীয় নয়। এই জাতীয় পরিস্থিতি উন্নয়নধারাকে বাধাগ্রস্ত করে।

এদিকে এমপি আনার হত্যাকা-ে জাতি আজ বিষ্মিত হয়েছে। একদিকে ডিবিপ্রধানের একরকম বক্তব্য, অন্যদিকে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় জাতি আজ দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ রকমটা কোন সুস্থ জাতির পক্ষেই কাম্য নয়।

আমাদের বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য ২০৪১ সালকে যেভাবে টার্গেট করে অগ্রযাত্রার কথা ভাবা হয়েছে, সে অগ্রযাত্রা ও সম্ভাবনা এক বড় চ্যলেঞ্জের মুখোমুখি হবে। অশান্তি আর গোলযোগের আগুন দেশময় দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে। বাহিনীর ওপর তার এক প্রচ- রকমের ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। ক্রমশই বাহিনীর সম্মান ও মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হবে। তবে বেনজীর-আজিজই শুধু নয়Ñ ভেতরে ভেতরে এরকম আরও অনেক মাফিয়া ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে। তাদের বিচারের কাঠগড়ায় আনতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top