alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

এ কে এম লুৎফর রহমান

: শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪

কথায় আছে ‘আলগা মাটিতে বিড়াল আঁচড়ায়।’ সেই লক্ষ্যে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক হাত নিতে চলমান শিক্ষক আন্দোলনকে অযৌক্তিক প্রমাণ করার অপপ্রয়াসে এখন মাঠে বিভিন্ন প্রজাতির বাগাড়ম্বর শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন আপনারা কেন এই আন্দোলনে ‘প্রত্যয়’ তো আপনাদের জন্য নয়। আপনাদের তো কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না। শিক্ষকরা সমাজের দর্পণ। তারা মনে করছেন, ঘোষিত নতুন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য

একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে মেধাবীরা শিক্ষকতাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পেশায় আসতে চাইবে না। এমনিতেই দিনে দিনে উচ্চশিক্ষার বাতিঘর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধার সংকট দেখা দিচ্ছে।

মেধাবীরা দেশের বাইরে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করে আর ফিরতে চাইছে না। এই পেশার আর্থিক সুরক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদা তরুণদেকে আকর্ষণ করতে পারছে না। এর মধ্যে যদি এই ‘প্রত্যয়’ পেনশন ব্যবস্থা চালু হয় তাহলে ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাশূন্য হয়ে পরবে এবং দেশ এক অন্ধকার অমানিশায় নিমজ্জিত হবে। কাজেই এই পেনশন ব্যবস্থায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষতি নয়, উচ্চশিক্ষা তথা দেশ এক অপুরনীয় ক্ষতির মধ্যে পড়বে। সমাজের বিবেক হয়ে সকলের কাছে বিষয়গুলো তুলে ধরা শিক্ষকদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ থেকে কয়েকটি বিষয় আপনাদের সদয় অবগতির জন্য তুলে ধরছিÑ শিক্ষকদের মর্যাদা পৃথিবীর সকল উন্নত দেশেই আছে। জার্মানিতে শিক্ষকদের বেতন অন্য পেশা থেকে বেশি। এ নিয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্যরা জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের কাছে দাবি জানিয়েছিলো তাদের বেতনও যেন শিক্ষকদের সমান করা হয়। উত্তরে চ্যান্সেলর তা নাকচ করে দেন। আমি জাপানেও দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মন্ত্রণালযয়ে প্রবেশ করলে সকল কর্মকর্তা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কুর্নিশ করে তাকে সম্মান জানান। সেখানে শিক্ষকদের বেতনও অন্যান্য অনেক পেশার তুলনায় বেশি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা এবং শিক্ষকদের অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শিক্ষা খাতের বিনিয়োগকে তিনি উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এজন্য দেশের প্রথম বাজেটে শিক্ষা খাতে তিনি সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখেছিলেন। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি অনুরাগ থেকেই ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শিক্ষার মান উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কমিশনের রিপোর্টে দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৫-৬% শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করার প্রস্তাব করা হয়। সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. আব্দুল মতিন চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অপদস্থ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, সুযোগ পেলে তার মর্যাদা ফিরিয়ে দিবেন। কথা রেখেছিলেন জাতির পিতা, ১৯৭৩ সালের ১৩ এপ্রিল এই মহান শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। শিক্ষকদের মর্যাদার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও যতœবান ছিলেন। ফলে স্বাধীনতার পরে ক্ষমতায় বসেই ১৯৭২ সালের ১ অক্টোবর প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. এ আর মল্লিককে (আজিজুর রহমান মল্লিক) শিক্ষাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি শিক্ষকদের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন বলেই ১৯৭৪ সালে নোয়াখালী জেলায় সার্কিট হাউসে অবস্থানরত অবস্থায় একজন প্রবীণ শিক্ষক পরিচয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি নিজেই দেখা করেন এবং রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা, কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় (জুন ২০২৪ পর্যন্ত) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সকল পর্যায়ের সরকারি চাকুরীজীবীরা যে আনুতোষিক পাবেন অপ্রতুল হলেও তা দিয়ে অবসরের পর পরিবার পরিজন নিয়ে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করবেন। আর মাসিক যে ভাতা পাবেন তা এবং এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে যদি কোন সঞ্চয় থাকে এসব নিয়ে দুই বেলা দুমুঠো খেয়ে-জীবন ধারণ করবেন। আর এসবের মাধ্যমে সংবিধানের উপরোল্লিখিত মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডে কিছু জমা থাকলে সেটা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। এর বাইরেও ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-শাদী তো থাকছেই। কাজেই এসব কিছু মিটানোর জন্য জুন ২০২৪ পর্যন্ত চলমান পেনশন ব্যবস্থাই একজন চাকরিজীবীর একমাত্র আশা-ভরসা। আর যদি এই আশাটুকুই না থাকে তবে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে কেন আসবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের একজন বিভাগীয় প্রধান সব প্রশাসনিক দপ্তরের (বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি, মন্ত্রণালয়) চাহিদা অনুযায়ী বিভাগের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। একাডেমিক কমিটি, প্ল্যানিং কমিটি, একাডেমিক প্ল্যান, ল্যাব উন্নয়ন, বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে মালামাল ক্রয় ও সমন্বয় এবং সহ-শিক্ষা পাঠক্রমসহ হাজারো কাজ। একাডেমিক পড়ালেখা, পাঠ পরিকল্পনা, পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, টেবুলেশন, ফলাফল তৈরি এবং গবেষণাসহ অন্যান্য কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত এই দায়িত্বপালন করার জন্য তাকে মাসে চার হাজার পাঁচশত টাকা সম্মানী প্রদান করা হলে সরকারের নিরীক্ষা দপ্তর থেকে এর জন্য অডিট আপত্তি দেয়া হয়। অডিট বিভাগ বলছে এক হাজার পাঁচশত টাকার বেশি দেয়া যাবে না। একই কথা একজন হল প্রভোস্টের ক্ষেত্রেও বলা হয়। আপনি ভাবেন তো একজন প্রভোষ্টকে একটা হলের কত সমস্যা ও কত চাপ নিতে হয়? একটু এদিক সেদিক হলেই তোপের মুখে পড়তে হয়। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন দপ্তরের পরিচালক বা দপ্তর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সামান্য সম্মানীর জন্য অডিট আপত্তি খেতে হচ্ছে। তাহলে এখানে সাংবিধানিকভাবে কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরির অঙ্গীকার রক্ষা হচ্ছে কি?

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বই কেনার জন্য বছরে চার হাজার টাকা ভাতা হিসেবে দেয়া হয়। এই টাকায় কোন কোন ক্ষেত্রে একটি বইও কেনা যায় না। এর উপরেও অডিট আপত্তি দেয়া হয়। বলা হচ্ছে বারোশত (১২০০) টাকার উপর বই ভাতা দেয়া যাবে না।

অথচ বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে দেখা যায়, প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় যা ধরা হয় পরবর্তীতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়িয়ে ও মূল্যস্ফীতির কথা বলে তিনগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে সুদবিহীন গাড়ির লোন (ত্রিশ লাখ টাকা) সঙ্গে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকা, মোবাইল ক্রয় বাবদ অর্থ, কুক এলাউন্স ষোলো হাজার টাকা, সিকিউরিটি এলাউন্স ষোলো হাজার টাকা ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে। কোন সমস্যা নেই, কেউ এটার বিরোধিতাও করছে না। সঙ্গতি থাকলে দিতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা তখনই হচ্ছে যখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে বছরে চার হাজার টাকা বই ভাতা দেয়া হচ্ছে। যে রাজ্যে বছরে চার হাজার টাকার বই ভাতার জন্য অডিট আপত্তি খেতে হয়, সেখানে শিক্ষার গুণগতমান, বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং আশা করা বিলাসিতা নয় কি? অনেকে বলছেন, ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমনকি একেবারেই অস্থিতিশীল পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে আছে। আমরা নাই কেন? আপনি জেনে অবাক হবেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের একজন অধ্যাপকের বেতন স্কেল বাংলাদেশের বেতন কাঠামো থেকে তিন-চার গুণ বেশি। এমনকি ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যেও ২০২০ সালে শ্রীলংকা শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতন কাঠামো প্রদান করে। এভাবে দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজের মর্যাদা এবং অর্থিক সুরক্ষা কোনটাই আশাব্যঞ্জক নয়। শুধু তাই নয়, উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণায় বিনিয়োগেও আমরা পেছনে।

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি, সম্ভবত ২০১৯ সালের শুরুর দিকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে কথোপকথনে জানতে পারলাম, সে বছর ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে একশত কোটি রুপি অনুদান পেয়েছেন এবং তারা বললেন রসায়ন গবেষণার জন্য সব ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। তাহলে বলেন বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে কে যাবে?

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রতি মাসে মোবাইল ভাতা হিসেবে মাত্র আটশত টাকা দেয়া হয়। শোনা যাচ্ছে এর ওপরও অডিট আপত্তি আছে এবং পেনশনের সময় সব টাকা কেটে রেখে দেয়া হবে। শিক্ষককে মাসে আটশত টাকা দেয়ার কারণে অডিট আপত্তি দিবেন, আবার ভাববেন বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং এর কথা? অন্যান্য কিছু পেশায় কর্মরত ৫ম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা (বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ ক্যাডার, বাংলাদেশ আর্মি ইত্যাদি) রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় (ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্স) অবস্থান থাকলেও চতুর্থ গ্রেডের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপকের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অবস্থান নাই। আর সেজন্যই হয়তো রংপুর জেলায় একজন নির্বাহী কর্মকর্তাকে (পঞ্চম গ্রেড) স্যার না বলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপককে (চতুর্থ গ্রেড) অশোভন আচরণের শিকার হতে হয়েছিল (প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০২৩)। জেলা পর্যায়ে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষরা (৩য় গ্রেড) জেলার শিক্ষা সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এসবের কারণ কখনই আমরা খুঁজিনি। আমরা সস্তা কথায় পরিস্থিতি গরম করে নিজেকে হিরো বানাতে খুব পারদর্শী। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বলা হচ্ছে, শিক্ষকরা তেমন কাজ করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। শিক্ষকরা যদি কাজ নাই করেন তবে তো শিক্ষা ব্যবস্থা মুখথুবড়ে পড়ে যেত। শিক্ষকদের সহায়তা না পেলে আপনি কিভাবে মানবসম্পদে পরিণত হয়ে চাকরি পেলেন? শিক্ষকদের মর্যাদার ব্যাপারে আমাদের সামাজিক কার্পণ্যতার ব্যাধি অনেক পুরোনো। তারা পাজামা-পাঞ্জাবি পরবে, হাতে বাঁকা হাতলের একটি ছাতা থাকবে। প্যান্ট-শার্ট তাদের মানায় না। শিক্ষকদের গাড়ি-বাড়ির প্রয়োজন নাই। তারা হেঁটে অথবা সাইকেলে চড়ে যাবে। শিক্ষকরা সমাজের বাইরে নয়। পরিবার পরিজন নিয়ে মান ইজ্জতের সঙ্গে সমাজে বসবাসের অধিকার তাদের আছে।

অন্যান্য প্রায় সকল সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন মিটিংয়ের জন্য নির্ধারিত এলাউন্স থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা একাডেমিক কমিটির মিটিং, প্লানিং কমিটির মিটিং, পাঠ্যক্রম কমিটির মিটিংসহ কোথাও কোন সিটিং এলাউন্স পান না। শিক্ষকরা এ নিয়ে কখনো তেমন অভিযোগও করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পাশের ভবনটি হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম-কমিশন। এখানে ১০০ (একশত) নম্বরের একটি খাতা মূল্যায়ন করলে ৩০০ (তিনশত) টাকা সম্মানী দেয়া হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ (একশত) নম্বরের একটি খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকরা বর্তমানে পান ১৬৫ (একশত পঁয়ষট্টি) টাকা। একই দেশে একই মানের কাজের মূল্যায়নে বৈষম্য নিয়েও তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তেমন উচ্চবাচ্য করেনি এবং এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোন দায় আছে বলে মনে হয় না।

২০১৫ সালে বেতন স্কেল আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ৩ ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছিল পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক হস্তক্ষেপে সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও কাক্সিক্ষত সুপার গ্রেড থেকে বঞ্চিত থেকেই যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সে বছর নতুন পে-স্কেলে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য অতিরিক্ত ৩টি ইনক্রিমেন্ট প্রদান বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সেটি ২০১৫ থেকে কার্যকরী হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায় ২০২২ সাল থেকেই বহাল থাকে তা নিয়ে শিক্ষকরা বিভিন্ন ফোরামে কথা বললেও আন্দোলনে মাঠে নামেনি। নেমেছেন নিজেদের জন্য নয়, পরবর্তী প্রজন্মের মেধাবী শিক্ষকদের জন্য, শিক্ষাকে বাঁচানোর জন্য। নেমেছেন তখন, যখন দেখছেন অবসরের পর যে আর্থিক নিশ্চয়তাটুকু থাকার কথা তাতে টান ড়েছে (অবশ্য এই অনিশ্চয়তায় আরো অনেকেই পড়েছেন)। বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় (জুন ২০২৪ পর্যন্ত) শিক্ষকরা পেনশন ভোগরত অবস্থায় মারা গেলে তার পরিবার আজীবন পেনশন পান। কিন্তু নতুন পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনার ৭৫ বছর পর মারা গেলে তার স্ত্রী কোন পেনশন পাবেন না। তাহলে তিনি (স্ত্রী) কার কাছে গিয়ে হাত পাতবে, এই দুশ্চিন্তায় মাঠে নেমেছেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবসরের পর যাতে সম্মানজনকভাবে পরিবার নিয়ে চলতে পারে এই নিশ্চয়তাটুকু চায়। শিক্ষকরা কারো সঙ্গে তুলনা করতে চায় না। শিক্ষকরা চায় তাদের পরবর্তী প্রজন্মের আর্থ-সামাজিক সুরক্ষা, চায় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র উচ্চতর বেতন কাঠামো, চায় যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের নিয়ে স্বাধীন শিক্ষা কমিশন, চায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মানজনক অবস্থান। আমরা আশাবাদী জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু শিক্ষক প্রতিনিধিদের নিয়ে একান্তে বসবেন, তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো ধৈর্যসহকারে শুনবেন এবং একটা সম্মানজনক সমাধান দিয়ে পাঠদান ও গবেষণায় ফিরিয়ে আনবেন।

[লেখক : অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

এ কে এম লুৎফর রহমান

শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪

কথায় আছে ‘আলগা মাটিতে বিড়াল আঁচড়ায়।’ সেই লক্ষ্যে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক হাত নিতে চলমান শিক্ষক আন্দোলনকে অযৌক্তিক প্রমাণ করার অপপ্রয়াসে এখন মাঠে বিভিন্ন প্রজাতির বাগাড়ম্বর শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন আপনারা কেন এই আন্দোলনে ‘প্রত্যয়’ তো আপনাদের জন্য নয়। আপনাদের তো কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না। শিক্ষকরা সমাজের দর্পণ। তারা মনে করছেন, ঘোষিত নতুন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য

একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে মেধাবীরা শিক্ষকতাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পেশায় আসতে চাইবে না। এমনিতেই দিনে দিনে উচ্চশিক্ষার বাতিঘর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধার সংকট দেখা দিচ্ছে।

মেধাবীরা দেশের বাইরে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করে আর ফিরতে চাইছে না। এই পেশার আর্থিক সুরক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদা তরুণদেকে আকর্ষণ করতে পারছে না। এর মধ্যে যদি এই ‘প্রত্যয়’ পেনশন ব্যবস্থা চালু হয় তাহলে ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাশূন্য হয়ে পরবে এবং দেশ এক অন্ধকার অমানিশায় নিমজ্জিত হবে। কাজেই এই পেনশন ব্যবস্থায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষতি নয়, উচ্চশিক্ষা তথা দেশ এক অপুরনীয় ক্ষতির মধ্যে পড়বে। সমাজের বিবেক হয়ে সকলের কাছে বিষয়গুলো তুলে ধরা শিক্ষকদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ থেকে কয়েকটি বিষয় আপনাদের সদয় অবগতির জন্য তুলে ধরছিÑ শিক্ষকদের মর্যাদা পৃথিবীর সকল উন্নত দেশেই আছে। জার্মানিতে শিক্ষকদের বেতন অন্য পেশা থেকে বেশি। এ নিয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্যরা জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের কাছে দাবি জানিয়েছিলো তাদের বেতনও যেন শিক্ষকদের সমান করা হয়। উত্তরে চ্যান্সেলর তা নাকচ করে দেন। আমি জাপানেও দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মন্ত্রণালযয়ে প্রবেশ করলে সকল কর্মকর্তা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কুর্নিশ করে তাকে সম্মান জানান। সেখানে শিক্ষকদের বেতনও অন্যান্য অনেক পেশার তুলনায় বেশি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা এবং শিক্ষকদের অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শিক্ষা খাতের বিনিয়োগকে তিনি উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এজন্য দেশের প্রথম বাজেটে শিক্ষা খাতে তিনি সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখেছিলেন। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি অনুরাগ থেকেই ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শিক্ষার মান উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কমিশনের রিপোর্টে দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৫-৬% শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করার প্রস্তাব করা হয়। সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. আব্দুল মতিন চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অপদস্থ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, সুযোগ পেলে তার মর্যাদা ফিরিয়ে দিবেন। কথা রেখেছিলেন জাতির পিতা, ১৯৭৩ সালের ১৩ এপ্রিল এই মহান শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। শিক্ষকদের মর্যাদার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও যতœবান ছিলেন। ফলে স্বাধীনতার পরে ক্ষমতায় বসেই ১৯৭২ সালের ১ অক্টোবর প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. এ আর মল্লিককে (আজিজুর রহমান মল্লিক) শিক্ষাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি শিক্ষকদের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন বলেই ১৯৭৪ সালে নোয়াখালী জেলায় সার্কিট হাউসে অবস্থানরত অবস্থায় একজন প্রবীণ শিক্ষক পরিচয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি নিজেই দেখা করেন এবং রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা, কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় (জুন ২০২৪ পর্যন্ত) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সকল পর্যায়ের সরকারি চাকুরীজীবীরা যে আনুতোষিক পাবেন অপ্রতুল হলেও তা দিয়ে অবসরের পর পরিবার পরিজন নিয়ে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করবেন। আর মাসিক যে ভাতা পাবেন তা এবং এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে যদি কোন সঞ্চয় থাকে এসব নিয়ে দুই বেলা দুমুঠো খেয়ে-জীবন ধারণ করবেন। আর এসবের মাধ্যমে সংবিধানের উপরোল্লিখিত মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডে কিছু জমা থাকলে সেটা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। এর বাইরেও ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-শাদী তো থাকছেই। কাজেই এসব কিছু মিটানোর জন্য জুন ২০২৪ পর্যন্ত চলমান পেনশন ব্যবস্থাই একজন চাকরিজীবীর একমাত্র আশা-ভরসা। আর যদি এই আশাটুকুই না থাকে তবে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে কেন আসবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের একজন বিভাগীয় প্রধান সব প্রশাসনিক দপ্তরের (বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি, মন্ত্রণালয়) চাহিদা অনুযায়ী বিভাগের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। একাডেমিক কমিটি, প্ল্যানিং কমিটি, একাডেমিক প্ল্যান, ল্যাব উন্নয়ন, বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে মালামাল ক্রয় ও সমন্বয় এবং সহ-শিক্ষা পাঠক্রমসহ হাজারো কাজ। একাডেমিক পড়ালেখা, পাঠ পরিকল্পনা, পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, টেবুলেশন, ফলাফল তৈরি এবং গবেষণাসহ অন্যান্য কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত এই দায়িত্বপালন করার জন্য তাকে মাসে চার হাজার পাঁচশত টাকা সম্মানী প্রদান করা হলে সরকারের নিরীক্ষা দপ্তর থেকে এর জন্য অডিট আপত্তি দেয়া হয়। অডিট বিভাগ বলছে এক হাজার পাঁচশত টাকার বেশি দেয়া যাবে না। একই কথা একজন হল প্রভোস্টের ক্ষেত্রেও বলা হয়। আপনি ভাবেন তো একজন প্রভোষ্টকে একটা হলের কত সমস্যা ও কত চাপ নিতে হয়? একটু এদিক সেদিক হলেই তোপের মুখে পড়তে হয়। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন দপ্তরের পরিচালক বা দপ্তর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সামান্য সম্মানীর জন্য অডিট আপত্তি খেতে হচ্ছে। তাহলে এখানে সাংবিধানিকভাবে কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরির অঙ্গীকার রক্ষা হচ্ছে কি?

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বই কেনার জন্য বছরে চার হাজার টাকা ভাতা হিসেবে দেয়া হয়। এই টাকায় কোন কোন ক্ষেত্রে একটি বইও কেনা যায় না। এর উপরেও অডিট আপত্তি দেয়া হয়। বলা হচ্ছে বারোশত (১২০০) টাকার উপর বই ভাতা দেয়া যাবে না।

অথচ বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে দেখা যায়, প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় যা ধরা হয় পরবর্তীতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়িয়ে ও মূল্যস্ফীতির কথা বলে তিনগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে সুদবিহীন গাড়ির লোন (ত্রিশ লাখ টাকা) সঙ্গে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকা, মোবাইল ক্রয় বাবদ অর্থ, কুক এলাউন্স ষোলো হাজার টাকা, সিকিউরিটি এলাউন্স ষোলো হাজার টাকা ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে। কোন সমস্যা নেই, কেউ এটার বিরোধিতাও করছে না। সঙ্গতি থাকলে দিতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা তখনই হচ্ছে যখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে বছরে চার হাজার টাকা বই ভাতা দেয়া হচ্ছে। যে রাজ্যে বছরে চার হাজার টাকার বই ভাতার জন্য অডিট আপত্তি খেতে হয়, সেখানে শিক্ষার গুণগতমান, বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং আশা করা বিলাসিতা নয় কি? অনেকে বলছেন, ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমনকি একেবারেই অস্থিতিশীল পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে আছে। আমরা নাই কেন? আপনি জেনে অবাক হবেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের একজন অধ্যাপকের বেতন স্কেল বাংলাদেশের বেতন কাঠামো থেকে তিন-চার গুণ বেশি। এমনকি ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যেও ২০২০ সালে শ্রীলংকা শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতন কাঠামো প্রদান করে। এভাবে দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজের মর্যাদা এবং অর্থিক সুরক্ষা কোনটাই আশাব্যঞ্জক নয়। শুধু তাই নয়, উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণায় বিনিয়োগেও আমরা পেছনে।

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি, সম্ভবত ২০১৯ সালের শুরুর দিকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে কথোপকথনে জানতে পারলাম, সে বছর ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে একশত কোটি রুপি অনুদান পেয়েছেন এবং তারা বললেন রসায়ন গবেষণার জন্য সব ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। তাহলে বলেন বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে কে যাবে?

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রতি মাসে মোবাইল ভাতা হিসেবে মাত্র আটশত টাকা দেয়া হয়। শোনা যাচ্ছে এর ওপরও অডিট আপত্তি আছে এবং পেনশনের সময় সব টাকা কেটে রেখে দেয়া হবে। শিক্ষককে মাসে আটশত টাকা দেয়ার কারণে অডিট আপত্তি দিবেন, আবার ভাববেন বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং এর কথা? অন্যান্য কিছু পেশায় কর্মরত ৫ম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা (বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ ক্যাডার, বাংলাদেশ আর্মি ইত্যাদি) রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় (ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্স) অবস্থান থাকলেও চতুর্থ গ্রেডের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপকের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অবস্থান নাই। আর সেজন্যই হয়তো রংপুর জেলায় একজন নির্বাহী কর্মকর্তাকে (পঞ্চম গ্রেড) স্যার না বলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপককে (চতুর্থ গ্রেড) অশোভন আচরণের শিকার হতে হয়েছিল (প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০২৩)। জেলা পর্যায়ে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষরা (৩য় গ্রেড) জেলার শিক্ষা সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এসবের কারণ কখনই আমরা খুঁজিনি। আমরা সস্তা কথায় পরিস্থিতি গরম করে নিজেকে হিরো বানাতে খুব পারদর্শী। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বলা হচ্ছে, শিক্ষকরা তেমন কাজ করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। শিক্ষকরা যদি কাজ নাই করেন তবে তো শিক্ষা ব্যবস্থা মুখথুবড়ে পড়ে যেত। শিক্ষকদের সহায়তা না পেলে আপনি কিভাবে মানবসম্পদে পরিণত হয়ে চাকরি পেলেন? শিক্ষকদের মর্যাদার ব্যাপারে আমাদের সামাজিক কার্পণ্যতার ব্যাধি অনেক পুরোনো। তারা পাজামা-পাঞ্জাবি পরবে, হাতে বাঁকা হাতলের একটি ছাতা থাকবে। প্যান্ট-শার্ট তাদের মানায় না। শিক্ষকদের গাড়ি-বাড়ির প্রয়োজন নাই। তারা হেঁটে অথবা সাইকেলে চড়ে যাবে। শিক্ষকরা সমাজের বাইরে নয়। পরিবার পরিজন নিয়ে মান ইজ্জতের সঙ্গে সমাজে বসবাসের অধিকার তাদের আছে।

অন্যান্য প্রায় সকল সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন মিটিংয়ের জন্য নির্ধারিত এলাউন্স থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা একাডেমিক কমিটির মিটিং, প্লানিং কমিটির মিটিং, পাঠ্যক্রম কমিটির মিটিংসহ কোথাও কোন সিটিং এলাউন্স পান না। শিক্ষকরা এ নিয়ে কখনো তেমন অভিযোগও করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পাশের ভবনটি হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম-কমিশন। এখানে ১০০ (একশত) নম্বরের একটি খাতা মূল্যায়ন করলে ৩০০ (তিনশত) টাকা সম্মানী দেয়া হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ (একশত) নম্বরের একটি খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকরা বর্তমানে পান ১৬৫ (একশত পঁয়ষট্টি) টাকা। একই দেশে একই মানের কাজের মূল্যায়নে বৈষম্য নিয়েও তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তেমন উচ্চবাচ্য করেনি এবং এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোন দায় আছে বলে মনে হয় না।

২০১৫ সালে বেতন স্কেল আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ৩ ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছিল পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক হস্তক্ষেপে সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও কাক্সিক্ষত সুপার গ্রেড থেকে বঞ্চিত থেকেই যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সে বছর নতুন পে-স্কেলে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য অতিরিক্ত ৩টি ইনক্রিমেন্ট প্রদান বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সেটি ২০১৫ থেকে কার্যকরী হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায় ২০২২ সাল থেকেই বহাল থাকে তা নিয়ে শিক্ষকরা বিভিন্ন ফোরামে কথা বললেও আন্দোলনে মাঠে নামেনি। নেমেছেন নিজেদের জন্য নয়, পরবর্তী প্রজন্মের মেধাবী শিক্ষকদের জন্য, শিক্ষাকে বাঁচানোর জন্য। নেমেছেন তখন, যখন দেখছেন অবসরের পর যে আর্থিক নিশ্চয়তাটুকু থাকার কথা তাতে টান ড়েছে (অবশ্য এই অনিশ্চয়তায় আরো অনেকেই পড়েছেন)। বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় (জুন ২০২৪ পর্যন্ত) শিক্ষকরা পেনশন ভোগরত অবস্থায় মারা গেলে তার পরিবার আজীবন পেনশন পান। কিন্তু নতুন পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনার ৭৫ বছর পর মারা গেলে তার স্ত্রী কোন পেনশন পাবেন না। তাহলে তিনি (স্ত্রী) কার কাছে গিয়ে হাত পাতবে, এই দুশ্চিন্তায় মাঠে নেমেছেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবসরের পর যাতে সম্মানজনকভাবে পরিবার নিয়ে চলতে পারে এই নিশ্চয়তাটুকু চায়। শিক্ষকরা কারো সঙ্গে তুলনা করতে চায় না। শিক্ষকরা চায় তাদের পরবর্তী প্রজন্মের আর্থ-সামাজিক সুরক্ষা, চায় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র উচ্চতর বেতন কাঠামো, চায় যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের নিয়ে স্বাধীন শিক্ষা কমিশন, চায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মানজনক অবস্থান। আমরা আশাবাদী জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু শিক্ষক প্রতিনিধিদের নিয়ে একান্তে বসবেন, তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো ধৈর্যসহকারে শুনবেন এবং একটা সম্মানজনক সমাধান দিয়ে পাঠদান ও গবেষণায় ফিরিয়ে আনবেন।

[লেখক : অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]

back to top