alt

উপ-সম্পাদকীয়

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ

: শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪

আমরা দাবি করি, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত। সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সবচেয়ে সুন্দর। মানুষের জ্ঞান আছে, প্রজ্ঞা আছে, শক্তি আছে। মানুষ কথা বলে, কথা শোনে, দৃষ্টিশক্তি আছে। মানুষ কৌশল অবলম্বন করতে পারে। অর্থাৎ মানুষ অসাধারণ সব গুণের অধিকারী, যা অন্যদের নেই। তাই সৃষ্টির বাকিরা আতরাফ বা নিকৃষ্ট। একটু লক্ষ্য করে দেখুন, সেই মানুষই কিনা কত হাজার বছর ধরে তার সবাই ক্ষমতা নিকৃষ্ট জড় পদার্থের ওপর অর্পণ করে তার পেছনে নিরন্তর হন্যে হয়ে ছুটছে। যে কথা বলতে পারে না, চলতে পারে না। জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, শারীরিক শক্তি, সামর্থ্য কিছুই নেই তার। অথচ তাকে নিয়ে মানুষ গর্ব করে, মর্যাদাবান হয়, অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়। মানুষকে অধীন করে। আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস সবকিছুই তার কল্যাণে। বুঝতেই পারছেন সেই মহাশক্তিধর বস্তুটি আর কিছুই নয়- অর্থ। যাকে আমরা বলি ‘টাকা’। সে কারণেই হয়তো কবি বলেছেন- টাকা আমার পরম বন্ধু, টাকাই আমার সব/ পার হওয়া যায় মহাসিন্ধু, দারুণ অনুভব।

পৃথিবীর সব দেশেই অনিবার্যরূপে অর্থের ব্যবহার এবং কদর রয়েছে। ১৯৫টি দেশে ১৮০টি মুদ্রার প্রচলন তার যথার্থ প্রমাণ। সর্বত্র কাগুজে মুদ্রাই প্রধান। বর্তমানে মানুষকে শাসন করা পরাক্রমশালী কাগুজে মুদ্রার গর্বিত পূর্বপুরুষ কারা, এর প্রচলনই বা কখন এবং এর উত্তরপুরুষ হিসেবে কারা আসছে সেটিতে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। কাগুজে মুদ্রার বৈপ্লবিক সূচনা হয় চীনে, ট্যাঙ বংশের রাজত্বকালে (৬১৮-৯০৭ সাল)। কারও কারও মতে, আনুমানিক ১০২৩ খ্রিষ্টাব্দে চীনে সুং সাম্রাজ্যের সম্রাট চেং দুর শাসনামলে প্রথম কাগুজে মুদ্রা চালু হয়। সুইডেন ১৬৬১ সালে ইউরোপে প্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন করে। প্রাচীনকালে মানুষ যখন আস্তে আস্তে সভ্যতার আলো পেতে শুরু করলো তখন প্রয়োজনের নিরিখে বিভিন্ন পণ্যের আদান-প্রদান শুরু হলো। যাকে আমরা পণ্য বিনিময় প্রথা বা বার্টার সিস্টেম বলে থাকি। সময়টা তখন আনুমানিক ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। উভয় পক্ষের মতৈক্যের ভিত্তিতে পণ্যের একটা মূল্য নির্ধারণ করে এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের বিনিময় সম্পন্ন হতো। তখন গোমহিষাদি, গম, কাপড়চোপড়, লবণ ইত্যাদি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যাকে কমোডিটি মানিও বলা হয়ে থাকে। তখন থেকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবে হালআমলের কাগুজে মুদ্রা। মাঝে দীর্ঘ সময় এ স্থান দখল করে নেয় ধাতব মুদ্রা।

ধাতব মুদ্রা ঠিক কবে থেকে তার শাসন শুরু করে তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কারও কারও মতে, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সুমেরিয়রা প্রথম ধাতব ম্দ্রুা ব্যবহার করে। আবার কারও কারও মতে, ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনের পশ্চিম চৌ রাজবংশ প্রথম ধাতব মুদ্রার ব্যবহার শুরু করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ৬৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লিডিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) রাজা আলিয়াত্তেস প্রথম পশ্চিমা বিশ্বের ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেন। সে যাই হোক ধাতব মুদ্রা হিসেবে প্রথমে তামা, তারপর রুপা, সোনা এবং একপর্যায়ে ব্রোঞ্জও ব্যবহৃত হতো। এগুলো বিভিন্ন মানের এবং স্তরের মুদ্রা ছিল। কাগুজে মুদ্রার পাশাপাশি এখনো ধাতব মুদ্রার প্রচলন রয়েছে। তবে অ-মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি বিধায় সেগুলোর নিহিত মূল্য কম। মুদ্রামানও অনেক কম। ধাতব মুদ্রা প্রচলনের পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূল্য ভান্ডার হিসেবে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহৃত হতো। আফ্রিকাতে পুঁতি, ইঙ্গট, হাতির দাঁত, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, পশুসম্পদ, ম্যানিলা মুদ্রা, শেল মানি, গেরুয়া এবং অন্যান্য আর্থ অক্সাইডসহ অনেক ধরনের মূল্য ভান্ডার ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যায়।

বর্তমানে সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিকভাবে কোন একক মুদ্রা বা বৈশ্বিক মুদ্রা নেই। তবে আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য প্রত্যেক দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু মুদ্রা সংরক্ষণ বা রিজার্ভ রাখে যাকে রিজার্ভ মানি বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধ অর্থনীতি এবং তাদের আধিপত্যের কারণে সারা পৃথিবীতে ইউএস ডলার খুবই আকাক্সিক্ষত এবং সমাদৃত মুদ্রা। সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভ মানি হিসেবে প্রায় ৬০ ভাগ ইউএস ডলার সংরক্ষণ করে। এছাড়া ইউরো এবং জাপানি ইয়েনও রিজার্ভ মানি হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এক সময় প্রত্যেক দেশের কাগুজে মুদ্রা সোনার মূল্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যত মুদ্রা ছাপানো হতো তার বিপরীতে সোনা সংরক্ষণ করা হতো। দেশে অথবা বিদেশে সহজেই প্রতিটি মুদ্রার ইউনিট নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনায় পরিবর্তনযোগ্য ছিল। একে সোনার মান্যতা বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বলা হয়। ১৯৭১ সালের আগস্টে “স্বর্ণ বা অন্যান্য রিজার্ভ সম্পদে ডলারের রূপান্তরযোগ্যতা সাময়িকভাবে স্থগিত করবেন” মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম. নিক্সনের এরূপ ঘোষণায় মূলত ব্রেটন উডস সিস্টেমের সমাপ্তি ঘটে। তখন থেকে কোন দেশের মুদ্রাই আর সোনার দ্বারা সমর্থিত নয়। এখন সবাই দেশের মুদ্রা সরকার কর্তৃক জারি করা একটি লিগ্যাল টেন্ডার বা আইনি দরপত্র, যাকে ফিয়াট মানি বলা হয়। ইউএস ডলার, বাংলাদেশি টাকা, ভারতীয় রুপি, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড সবই ফিয়াট মানি। তার নিহিত মূল্য নেই, কাগজের ওপর লিখিত মূল্যই তার মূল্য।

ধরুন বাংলাদেশের কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে কোন জনমানব নেই ভবিষ্যতেও থাকবে না এরকম জায়গায় অনেক পরিমাণ ডলার রেখে দেয়া হলো। তাহলে সেই মহামূল্যবান ডলারের নিশ্চয়ই কোন মূল্য থাকবে না। কারণ কেউ সেগুলো ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে না। আবার ধরুন, বাংলাদেশের কোন এক অজ পাড়াগাঁয়ে যেখানে মানুষজন বাংলাদেশি টাকা ছাড়া অন্য কোন বিদেশি মুদ্রা চেনে না বা জানে না তাদেরকে অনেক অনেক ডলার দেয়া হলো। তারা নিশ্চয়ই সে ডলার নিবে না কারণ তাদের কাছে ডলারের কোন উপযোগিতা নেই। অর্থাৎ যে কোন মুদ্রা তখনই মূল্যবান যখন মানুষ তাকে গ্রহণ করবে, মূল্য হিসেবে সংরক্ষণ করবে, বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবে। অন্যথায় এটি শুধুই এক টুকরো কাগজ। এতে সুস্পষ্ট যে, দেশে দেশে মানুষই তার প্রয়োজনে এক টুকরো কাগজকে মহামূল্যবান করে তুলেছেন।

কত কাল, আর কত কাল! কাগুজে মুদ্রার রাজত্বে ইতোমধ্যে হানা দিয়েছে অনেকেই। ক্রেডিট মানি হিসেবে চেকের ব্যবহারও তার কৌলীন্য নষ্ট করেনি। অন্তত তাকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। কড়কড়ে নোটের গন্ধে আমিত্বের সুখ অনুভব করা যায়। কিন্তু ছন্দপাতের সূচনা ১৯৫০-১৯৬৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুগপরিবর্তনীয় প্লাস্টিক মানি হিসেবে ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড চালুর মাধ্যমে। আজ প্রায় সারা বিশ্বে এর দোর্দ- প্রতাপ। ২০০৯ সালে চালু হয় নতুন ধারণার রহস্যময় বিট কয়েন। ইলেকট্রনিক মানি, ক্রিপ্টোকারেন্সি, ডিজিটাল মুদ্রা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা এবং চূড়ান্তভাবে স্মার্ট ক্যাশলেস সোসাইটি। অর্থাৎ অর্থের সবাই ধরনের হাতবদল হবে নগদ অর্থের পরিবর্তে শুধু ডিজিটাল পদ্ধতিতে। এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু অনুভবে অনুখন। এরাই শাসন করবে মুদ্রা নামক মহাশক্তিকে। মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আজ অনেক দূর এগিয়ে। ইতিহাসের কী পরিহাস, ইউরোপে প্রথম কাগুজে মুদ্রা প্রচলনকারী সেই সুইডেনই কাগুজে মুদ্রার শব দাহ্য করে ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ থেকে বিশ্বের প্রথম ক্যাশলেস সোসাইটিতে সমাসীন।

এটি সত্যি মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন উদ্ভাবনে নিজেদের নানা অলংকারে স্মার্ট করে তুলছে। জীবনযাত্রায় প্রতিনিয়ত নতুন কিছুর সংযোজন মানেই জীবনকে মহিমান্বিত করার বাসনায় বর্তমানকে পিছনে ফেলে নতুনত্বে নিজেদের আবদ্ধ করা। নিঃসন্দেহে ক্যাশলেস অর্থনীতির সুবিধা অনেক, তাই মানুষ এ ব্যবস্থায় ঝুঁকছে। এ প্রক্রিয়ায় যেকোন সময় যেকোন জায়গা থেকে সহজে অর্থ স্থানান্তর বা পরিশোধ করা যায়। ফলে মূল্যবান সময় বাঁচবে এবং নগদ অর্থ বহন করার ঝুঁকি নেই। ব্যাংক ডাকাতি বা চুরির সুযোগ নেই। এতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বাড়বে। দুর্নীতি কমবে। কালো টাকার প্রবাহ কমবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে। নগদ অর্থ ছাপানো এবং এর ব্যবস্থাপনা ব্যয় দরকার হবে না। কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কমে যাবে। ফলে উল্লেখযোগ্য হারে আর্থিক অপরাধ কমে আসবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। এটি আধুনিক অর্থনীতির নতুন অধ্যায়।

এত সুবিধা সত্ত্বেও বিজ্ঞজনেরা কিছু আশঙ্কার কথা বলেন। ক্যাশলেস অর্থনীতি পুরোপুরি ডিজিটাল পদ্ধতির জটিল নেটওয়ার্ক-নির্ভর একটি প্রক্রিয়া, তাই এটি সাইবার অপরাধ সংবেদনশীল। এতে মানুষের আর্থিক লেনদেনের গোপনীয়তা নষ্ট হতে পারে। হ্যাকারদের কবলে পড়ার ঝুঁকি বাড়বে। টেকনোলজি সমস্যার কারণে সময়মতো পরিশোধ কার্যক্রম সম্পন্নে বিঘœ সৃষ্টি হতে পারে। কোন কারণে চার্জ বা ফি আরোপ করা হলে এ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। ওয়ারেন বাফেট বলেছেন, “সাইবার ক্রাইম হলো মানবজাতির এক নম্বর সমস্যা এবং এটি মানবজাতির জন্য প্রকৃত ঝুঁকি।” ভাবনার বিষয়, আমরা কি খুব বেশি মাত্রায় অস্পৃশ্য প্রযুক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে ফেলছি?

[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক ]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ

শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪

আমরা দাবি করি, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত। সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সবচেয়ে সুন্দর। মানুষের জ্ঞান আছে, প্রজ্ঞা আছে, শক্তি আছে। মানুষ কথা বলে, কথা শোনে, দৃষ্টিশক্তি আছে। মানুষ কৌশল অবলম্বন করতে পারে। অর্থাৎ মানুষ অসাধারণ সব গুণের অধিকারী, যা অন্যদের নেই। তাই সৃষ্টির বাকিরা আতরাফ বা নিকৃষ্ট। একটু লক্ষ্য করে দেখুন, সেই মানুষই কিনা কত হাজার বছর ধরে তার সবাই ক্ষমতা নিকৃষ্ট জড় পদার্থের ওপর অর্পণ করে তার পেছনে নিরন্তর হন্যে হয়ে ছুটছে। যে কথা বলতে পারে না, চলতে পারে না। জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, শারীরিক শক্তি, সামর্থ্য কিছুই নেই তার। অথচ তাকে নিয়ে মানুষ গর্ব করে, মর্যাদাবান হয়, অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়। মানুষকে অধীন করে। আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস সবকিছুই তার কল্যাণে। বুঝতেই পারছেন সেই মহাশক্তিধর বস্তুটি আর কিছুই নয়- অর্থ। যাকে আমরা বলি ‘টাকা’। সে কারণেই হয়তো কবি বলেছেন- টাকা আমার পরম বন্ধু, টাকাই আমার সব/ পার হওয়া যায় মহাসিন্ধু, দারুণ অনুভব।

পৃথিবীর সব দেশেই অনিবার্যরূপে অর্থের ব্যবহার এবং কদর রয়েছে। ১৯৫টি দেশে ১৮০টি মুদ্রার প্রচলন তার যথার্থ প্রমাণ। সর্বত্র কাগুজে মুদ্রাই প্রধান। বর্তমানে মানুষকে শাসন করা পরাক্রমশালী কাগুজে মুদ্রার গর্বিত পূর্বপুরুষ কারা, এর প্রচলনই বা কখন এবং এর উত্তরপুরুষ হিসেবে কারা আসছে সেটিতে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। কাগুজে মুদ্রার বৈপ্লবিক সূচনা হয় চীনে, ট্যাঙ বংশের রাজত্বকালে (৬১৮-৯০৭ সাল)। কারও কারও মতে, আনুমানিক ১০২৩ খ্রিষ্টাব্দে চীনে সুং সাম্রাজ্যের সম্রাট চেং দুর শাসনামলে প্রথম কাগুজে মুদ্রা চালু হয়। সুইডেন ১৬৬১ সালে ইউরোপে প্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন করে। প্রাচীনকালে মানুষ যখন আস্তে আস্তে সভ্যতার আলো পেতে শুরু করলো তখন প্রয়োজনের নিরিখে বিভিন্ন পণ্যের আদান-প্রদান শুরু হলো। যাকে আমরা পণ্য বিনিময় প্রথা বা বার্টার সিস্টেম বলে থাকি। সময়টা তখন আনুমানিক ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। উভয় পক্ষের মতৈক্যের ভিত্তিতে পণ্যের একটা মূল্য নির্ধারণ করে এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের বিনিময় সম্পন্ন হতো। তখন গোমহিষাদি, গম, কাপড়চোপড়, লবণ ইত্যাদি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যাকে কমোডিটি মানিও বলা হয়ে থাকে। তখন থেকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবে হালআমলের কাগুজে মুদ্রা। মাঝে দীর্ঘ সময় এ স্থান দখল করে নেয় ধাতব মুদ্রা।

ধাতব মুদ্রা ঠিক কবে থেকে তার শাসন শুরু করে তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কারও কারও মতে, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সুমেরিয়রা প্রথম ধাতব ম্দ্রুা ব্যবহার করে। আবার কারও কারও মতে, ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনের পশ্চিম চৌ রাজবংশ প্রথম ধাতব মুদ্রার ব্যবহার শুরু করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ৬৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লিডিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) রাজা আলিয়াত্তেস প্রথম পশ্চিমা বিশ্বের ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেন। সে যাই হোক ধাতব মুদ্রা হিসেবে প্রথমে তামা, তারপর রুপা, সোনা এবং একপর্যায়ে ব্রোঞ্জও ব্যবহৃত হতো। এগুলো বিভিন্ন মানের এবং স্তরের মুদ্রা ছিল। কাগুজে মুদ্রার পাশাপাশি এখনো ধাতব মুদ্রার প্রচলন রয়েছে। তবে অ-মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি বিধায় সেগুলোর নিহিত মূল্য কম। মুদ্রামানও অনেক কম। ধাতব মুদ্রা প্রচলনের পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূল্য ভান্ডার হিসেবে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহৃত হতো। আফ্রিকাতে পুঁতি, ইঙ্গট, হাতির দাঁত, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, পশুসম্পদ, ম্যানিলা মুদ্রা, শেল মানি, গেরুয়া এবং অন্যান্য আর্থ অক্সাইডসহ অনেক ধরনের মূল্য ভান্ডার ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যায়।

বর্তমানে সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিকভাবে কোন একক মুদ্রা বা বৈশ্বিক মুদ্রা নেই। তবে আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য প্রত্যেক দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু মুদ্রা সংরক্ষণ বা রিজার্ভ রাখে যাকে রিজার্ভ মানি বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধ অর্থনীতি এবং তাদের আধিপত্যের কারণে সারা পৃথিবীতে ইউএস ডলার খুবই আকাক্সিক্ষত এবং সমাদৃত মুদ্রা। সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভ মানি হিসেবে প্রায় ৬০ ভাগ ইউএস ডলার সংরক্ষণ করে। এছাড়া ইউরো এবং জাপানি ইয়েনও রিজার্ভ মানি হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এক সময় প্রত্যেক দেশের কাগুজে মুদ্রা সোনার মূল্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যত মুদ্রা ছাপানো হতো তার বিপরীতে সোনা সংরক্ষণ করা হতো। দেশে অথবা বিদেশে সহজেই প্রতিটি মুদ্রার ইউনিট নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনায় পরিবর্তনযোগ্য ছিল। একে সোনার মান্যতা বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বলা হয়। ১৯৭১ সালের আগস্টে “স্বর্ণ বা অন্যান্য রিজার্ভ সম্পদে ডলারের রূপান্তরযোগ্যতা সাময়িকভাবে স্থগিত করবেন” মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম. নিক্সনের এরূপ ঘোষণায় মূলত ব্রেটন উডস সিস্টেমের সমাপ্তি ঘটে। তখন থেকে কোন দেশের মুদ্রাই আর সোনার দ্বারা সমর্থিত নয়। এখন সবাই দেশের মুদ্রা সরকার কর্তৃক জারি করা একটি লিগ্যাল টেন্ডার বা আইনি দরপত্র, যাকে ফিয়াট মানি বলা হয়। ইউএস ডলার, বাংলাদেশি টাকা, ভারতীয় রুপি, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড সবই ফিয়াট মানি। তার নিহিত মূল্য নেই, কাগজের ওপর লিখিত মূল্যই তার মূল্য।

ধরুন বাংলাদেশের কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে কোন জনমানব নেই ভবিষ্যতেও থাকবে না এরকম জায়গায় অনেক পরিমাণ ডলার রেখে দেয়া হলো। তাহলে সেই মহামূল্যবান ডলারের নিশ্চয়ই কোন মূল্য থাকবে না। কারণ কেউ সেগুলো ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে না। আবার ধরুন, বাংলাদেশের কোন এক অজ পাড়াগাঁয়ে যেখানে মানুষজন বাংলাদেশি টাকা ছাড়া অন্য কোন বিদেশি মুদ্রা চেনে না বা জানে না তাদেরকে অনেক অনেক ডলার দেয়া হলো। তারা নিশ্চয়ই সে ডলার নিবে না কারণ তাদের কাছে ডলারের কোন উপযোগিতা নেই। অর্থাৎ যে কোন মুদ্রা তখনই মূল্যবান যখন মানুষ তাকে গ্রহণ করবে, মূল্য হিসেবে সংরক্ষণ করবে, বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবে। অন্যথায় এটি শুধুই এক টুকরো কাগজ। এতে সুস্পষ্ট যে, দেশে দেশে মানুষই তার প্রয়োজনে এক টুকরো কাগজকে মহামূল্যবান করে তুলেছেন।

কত কাল, আর কত কাল! কাগুজে মুদ্রার রাজত্বে ইতোমধ্যে হানা দিয়েছে অনেকেই। ক্রেডিট মানি হিসেবে চেকের ব্যবহারও তার কৌলীন্য নষ্ট করেনি। অন্তত তাকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। কড়কড়ে নোটের গন্ধে আমিত্বের সুখ অনুভব করা যায়। কিন্তু ছন্দপাতের সূচনা ১৯৫০-১৯৬৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুগপরিবর্তনীয় প্লাস্টিক মানি হিসেবে ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড চালুর মাধ্যমে। আজ প্রায় সারা বিশ্বে এর দোর্দ- প্রতাপ। ২০০৯ সালে চালু হয় নতুন ধারণার রহস্যময় বিট কয়েন। ইলেকট্রনিক মানি, ক্রিপ্টোকারেন্সি, ডিজিটাল মুদ্রা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা এবং চূড়ান্তভাবে স্মার্ট ক্যাশলেস সোসাইটি। অর্থাৎ অর্থের সবাই ধরনের হাতবদল হবে নগদ অর্থের পরিবর্তে শুধু ডিজিটাল পদ্ধতিতে। এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু অনুভবে অনুখন। এরাই শাসন করবে মুদ্রা নামক মহাশক্তিকে। মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আজ অনেক দূর এগিয়ে। ইতিহাসের কী পরিহাস, ইউরোপে প্রথম কাগুজে মুদ্রা প্রচলনকারী সেই সুইডেনই কাগুজে মুদ্রার শব দাহ্য করে ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ থেকে বিশ্বের প্রথম ক্যাশলেস সোসাইটিতে সমাসীন।

এটি সত্যি মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন উদ্ভাবনে নিজেদের নানা অলংকারে স্মার্ট করে তুলছে। জীবনযাত্রায় প্রতিনিয়ত নতুন কিছুর সংযোজন মানেই জীবনকে মহিমান্বিত করার বাসনায় বর্তমানকে পিছনে ফেলে নতুনত্বে নিজেদের আবদ্ধ করা। নিঃসন্দেহে ক্যাশলেস অর্থনীতির সুবিধা অনেক, তাই মানুষ এ ব্যবস্থায় ঝুঁকছে। এ প্রক্রিয়ায় যেকোন সময় যেকোন জায়গা থেকে সহজে অর্থ স্থানান্তর বা পরিশোধ করা যায়। ফলে মূল্যবান সময় বাঁচবে এবং নগদ অর্থ বহন করার ঝুঁকি নেই। ব্যাংক ডাকাতি বা চুরির সুযোগ নেই। এতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বাড়বে। দুর্নীতি কমবে। কালো টাকার প্রবাহ কমবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে। নগদ অর্থ ছাপানো এবং এর ব্যবস্থাপনা ব্যয় দরকার হবে না। কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কমে যাবে। ফলে উল্লেখযোগ্য হারে আর্থিক অপরাধ কমে আসবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। এটি আধুনিক অর্থনীতির নতুন অধ্যায়।

এত সুবিধা সত্ত্বেও বিজ্ঞজনেরা কিছু আশঙ্কার কথা বলেন। ক্যাশলেস অর্থনীতি পুরোপুরি ডিজিটাল পদ্ধতির জটিল নেটওয়ার্ক-নির্ভর একটি প্রক্রিয়া, তাই এটি সাইবার অপরাধ সংবেদনশীল। এতে মানুষের আর্থিক লেনদেনের গোপনীয়তা নষ্ট হতে পারে। হ্যাকারদের কবলে পড়ার ঝুঁকি বাড়বে। টেকনোলজি সমস্যার কারণে সময়মতো পরিশোধ কার্যক্রম সম্পন্নে বিঘœ সৃষ্টি হতে পারে। কোন কারণে চার্জ বা ফি আরোপ করা হলে এ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। ওয়ারেন বাফেট বলেছেন, “সাইবার ক্রাইম হলো মানবজাতির এক নম্বর সমস্যা এবং এটি মানবজাতির জন্য প্রকৃত ঝুঁকি।” ভাবনার বিষয়, আমরা কি খুব বেশি মাত্রায় অস্পৃশ্য প্রযুক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে ফেলছি?

[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক ]

back to top