alt

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

: রোববার, ১৪ জুলাই ২০২৪

শিল্পবিপ্লবের শুরু মানুষের প্রয়োজনে তার নিজের ভালোর জন্য। শুরুটা কয়লা পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে ১৭৬৫ সালে। অথচ এর প্রায় ৮০ বছর আগে নিউটন তার গতির তৃতীয় সূত্রে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান প্রতিক্রিয়া আছে। মানুষ এই চিরসত্যটি বুঝতে অনেক সময় নিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই সারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি লিগ অব নেশন্স গঠিত হয়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সার্থক হয়নি। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ দুই দশকের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়া। যাই হোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে মোটামুটি একই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ১৯৪৫ এর ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রযুক্তির প্রতিক্রিয়া তাবত বিশ্বকে একসময় কী ভয়ানক পরিণতির মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে তা নিয়ে কেউ কিছু ভাবেনি। তবে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আবহাওয়াবিজ্ঞানীরা জানতেন। প্রথম দিকে বৃদ্ধির হার এতই ধীর ছিল যে বিষয়টি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকরা আমলে নিতে সময় নিয়েছেন। তখন জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি অনুন্নত দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করা।

ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালের ১৭ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিউইয়র্কে সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সংরক্ষণের চেয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সম্পদগুলো কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেই বিষয়গুলোই প্রাধান্য পায়। তারপরে ১৯৬৮ সালের ২৯ মে জাতিসংঘের ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল এগুলো বিশেষ এজেন্ডাভুক্ত করে এবং পরবর্তীতে সাধারণ পরিষদ অনুমোদিত মানুষ এবং পরিবেশ সম্পর্কিত একটি সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত সুইডেনে প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিজ্ঞানীরা মানবপরিবেশ সংরক্ষণসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে একটি কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সঙ্গে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী পদার্থসমূহ শনাক্তকরণ এবং নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও ছিল। ওই সম্মেলনে প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গ উঠে আসে। আয়োজকরা বিভিন্ন দেশের সরকারকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, তার প্রভাব এবং তার মাত্রা সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। তারা সবদেশে জলবায়ু পর্যক্ষেণের জন্য বিশেষ কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। কর্মসূচিগুলোর সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রকৃতি এবং মানুষকে কতখানি দায়ী সে বিষয়টি নির্ধারণের বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল। বিজ্ঞানীরা পরিবেশসংক্রান্ত কেনিয়ার নাইরোবিতে ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) এর অধীনে আরেকটি সামিটের আয়োজন করতে বলে। তখন প্রধান উপজীব্য ছিল পানিসম্পদ, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, নবায়নযোগ্য শক্তি, মরুকরণ, বন, পরিবেশগত কাঠামো, পরিবেশগত আইনি কাঠামোÑ এগুলো।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি তখনও প্রাধান্য পায়নি। তবে প্রথম জলবায়ু সামিটের পরবর্তী বিশ বছরে বৈশ্বিক জলবায়ু ও বায়ুম-ল সম্পর্কিত উদ্বিগ্নতা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। ইউএনইপি-এর নির্দেশে ১৯৭৯ তে দূরপাল্লার পরিবহন ব্যবস্থার কারণে বায়ুদূষণের পরিমাণ নির্ণয় সাপেক্ষে লং রেঞ্জ ট্রান্সবাউন্ডারি এয়ার পলিউশন শিরোনামে একটি কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। সেখানে ইউরোপ-আমেরিকা এবং আরও কিছু দেশসমূহের মধ্যে বায়ুদূষণ কমানোর আন্তঃদেশীয় চুক্তি হয়। ১৯৮০ সালে ইউএনইপি-এর গভর্নিং কাউন্সিল বায়ুদূষণের কারণে ওজোন স্তরের ক্ষতির বিষয়টি লক্ষ্য করে ক্লোরোফ্লুরো কার্বন-এর উৎপাদন ও ব্যবহার সীমীত করার সুপারিশ করে। ১৯৮৫ সালের ভিয়েনা কনভেনশনে ওজোন স্তর সংরক্ষণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণের বিষয়টি উঠে আসে। সিদ্ধান্ত হয় সালফার নির্গমন ৩০ শতাংশ কমাতে হবে। ইতোমধ্যে ইউরোপ এবং আমেরিকায় বায়ুদূষণের কারণে এসিড বৃষ্টি হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল বলে গণ্য করা হয়। সেজন্য ইউএনইপি এবং ডব্লিউএমও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ পরিবেশগত ইস্যুকে ১৯৮৭ সালে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে। সুস্থ পরিবেশসম্মত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নীতিনির্ধারণ ও কর্মসূচি গ্রহণসংক্রান্ত এনভায়ারনমেন্ট পার্সপেক্টিভ টু দ্য ইয়ার ২০০০ অ্যান্ড বিয়ন্ড শিরোনামে একটি ফ্রেমওয়ার্ক গঠন করে।

সেখানে পরিবেশ এবং উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ককে বিশেষ জোর দেয়া হয়। টেকসই উন্নয়ন ধারণার শুরু সেখান থেকেই। এত কিছুর পরেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখানে মুখ্য বিষয় হিসেবে জায়গা পায়নি। ১৯৮৮ সালে, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং ওজোন স্তর হালকা হয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো রাজনৈতিক ইস্যু এবং জনবিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বছরের শুরুতে টঘঊচ একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে। যাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি পরিবেশনির্ভর কিন্তু সংবেদনশীল সেক্টরগুলো শনাক্ত করা যায়। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গীরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়াদি পর্যবেক্ষণের জন্য ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) নামের একটি ফোরাম গঠিত হয় এবং তারা একই বছরের নভেম্বরে তাদের প্রথম সভা করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জলবায়ু পরিবর্তনকে সুনির্দিষ্ট এবং জরুরি বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। ডব্লিউএমও এবং ইউএনইপিকে এ বিস্তারিত রিভ্যু এবং করণীয় বিষয় তৈরি করতে বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের উচ্চতাবৃদ্ধির কারণে হুমকির মুখে থাকা মালদ্বীপের মতো দেশগুলো নিয়ে মালে-ডিক্লেরাশন আলোচনায় উঠে আসে। একই বছর ২ মে জাতিসংঘ ওজোন স্তর সংরক্ষণজনিত হেলসিঙ্কি ডিক্লেরাশেন বিবেচনায় উঠে আসে। ১৯৮৯ এর মন্ট্রিল প্রটোকল অনুযায়ী যে সমস্ত পদার্থ ওজোন স্তরের জন্য ক্ষতিকর সেগুলোর বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিফল সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে ১৯৯০ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে সাধারণ পরিষদ ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরোতে পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কে একটি ধরিত্রী সম্মেলন আহ্বান করে। এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিফল থেকে পরিত্রাণের তাগিদে বিশ্বব্যাপী একযোগে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। এখানে বায়ুম-লের সুরক্ষা, টেকসই উন্নয়ন, শক্তি সাশ্রয়, ওজোন স্তর হ্রাস সম্পর্কিত বিষয়াদি গুরুত্ব পায়। সম্মেলনের সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) কর্তৃক স্বাক্ষর কার্যক্রমের উদবোধন। ১৫৮টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছিল। এই কনভেনশনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কীভাবে মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এটা ১৯৯৪ থেকে কার্যকর হয় এবং ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের রাখার বার্লিন ম্যান্ডেট গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি সম্বলিত একটি প্রোটোকল বা অন্যান্য আইনি উপকরণের ওপর আলোচনা শুরু করে।

১৯৯৭ সালে সালের ডিসেম্বরে জাপানে ইউএনএফসিসিসি গৃহীত কিয়তো প্রোটোকলে নেয়া অঙ্গীকার ছিল ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন-ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের সামগ্রিক নির্গমন ১৯৯০ এর স্তর থেকে কমপক্ষে ৫ শতাংশ হ্রাস করা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রতি বছর কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ) সম্মেলন হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রকার অগ্রগতি নেই। ২০০৬ সালে বায়ুম-লে কার্বন-ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল ৩৮১ পিপিএম। মিথেন এবং নাইট্রাস অকসাইডের ঘনত্ব ছিল যথাক্রমে ১৭৮২ পিপিবি এবং ৩২০ পিপিএম। ২০১৯ এর হিসেবে অনুযায়ী কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনত্ব যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম, ১৮৬৬ পিপিবি এবং ৩৩২ পিপিএম। আর শিল্পবিপ্লবের শুরুতে কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল যথাক্রমে ২৮০ পিপিএম, ৭১৫ পিপিবি এবং ২৭০ পিপিএম। পরিসংখ্যান মোতাবেক বিশ্বে সাম্প্রতিককালে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির ধারা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছেই। তাহলে কী হচ্ছে? এত আয়োজন, এত কথা সবই কী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে!

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট, সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

রোববার, ১৪ জুলাই ২০২৪

শিল্পবিপ্লবের শুরু মানুষের প্রয়োজনে তার নিজের ভালোর জন্য। শুরুটা কয়লা পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে ১৭৬৫ সালে। অথচ এর প্রায় ৮০ বছর আগে নিউটন তার গতির তৃতীয় সূত্রে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান প্রতিক্রিয়া আছে। মানুষ এই চিরসত্যটি বুঝতে অনেক সময় নিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই সারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি লিগ অব নেশন্স গঠিত হয়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সার্থক হয়নি। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ দুই দশকের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়া। যাই হোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে মোটামুটি একই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ১৯৪৫ এর ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রযুক্তির প্রতিক্রিয়া তাবত বিশ্বকে একসময় কী ভয়ানক পরিণতির মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে তা নিয়ে কেউ কিছু ভাবেনি। তবে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আবহাওয়াবিজ্ঞানীরা জানতেন। প্রথম দিকে বৃদ্ধির হার এতই ধীর ছিল যে বিষয়টি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকরা আমলে নিতে সময় নিয়েছেন। তখন জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি অনুন্নত দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করা।

ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালের ১৭ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিউইয়র্কে সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সংরক্ষণের চেয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সম্পদগুলো কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেই বিষয়গুলোই প্রাধান্য পায়। তারপরে ১৯৬৮ সালের ২৯ মে জাতিসংঘের ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল এগুলো বিশেষ এজেন্ডাভুক্ত করে এবং পরবর্তীতে সাধারণ পরিষদ অনুমোদিত মানুষ এবং পরিবেশ সম্পর্কিত একটি সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত সুইডেনে প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিজ্ঞানীরা মানবপরিবেশ সংরক্ষণসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে একটি কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সঙ্গে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী পদার্থসমূহ শনাক্তকরণ এবং নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও ছিল। ওই সম্মেলনে প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গ উঠে আসে। আয়োজকরা বিভিন্ন দেশের সরকারকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, তার প্রভাব এবং তার মাত্রা সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। তারা সবদেশে জলবায়ু পর্যক্ষেণের জন্য বিশেষ কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। কর্মসূচিগুলোর সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রকৃতি এবং মানুষকে কতখানি দায়ী সে বিষয়টি নির্ধারণের বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল। বিজ্ঞানীরা পরিবেশসংক্রান্ত কেনিয়ার নাইরোবিতে ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) এর অধীনে আরেকটি সামিটের আয়োজন করতে বলে। তখন প্রধান উপজীব্য ছিল পানিসম্পদ, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, নবায়নযোগ্য শক্তি, মরুকরণ, বন, পরিবেশগত কাঠামো, পরিবেশগত আইনি কাঠামোÑ এগুলো।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি তখনও প্রাধান্য পায়নি। তবে প্রথম জলবায়ু সামিটের পরবর্তী বিশ বছরে বৈশ্বিক জলবায়ু ও বায়ুম-ল সম্পর্কিত উদ্বিগ্নতা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। ইউএনইপি-এর নির্দেশে ১৯৭৯ তে দূরপাল্লার পরিবহন ব্যবস্থার কারণে বায়ুদূষণের পরিমাণ নির্ণয় সাপেক্ষে লং রেঞ্জ ট্রান্সবাউন্ডারি এয়ার পলিউশন শিরোনামে একটি কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। সেখানে ইউরোপ-আমেরিকা এবং আরও কিছু দেশসমূহের মধ্যে বায়ুদূষণ কমানোর আন্তঃদেশীয় চুক্তি হয়। ১৯৮০ সালে ইউএনইপি-এর গভর্নিং কাউন্সিল বায়ুদূষণের কারণে ওজোন স্তরের ক্ষতির বিষয়টি লক্ষ্য করে ক্লোরোফ্লুরো কার্বন-এর উৎপাদন ও ব্যবহার সীমীত করার সুপারিশ করে। ১৯৮৫ সালের ভিয়েনা কনভেনশনে ওজোন স্তর সংরক্ষণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণের বিষয়টি উঠে আসে। সিদ্ধান্ত হয় সালফার নির্গমন ৩০ শতাংশ কমাতে হবে। ইতোমধ্যে ইউরোপ এবং আমেরিকায় বায়ুদূষণের কারণে এসিড বৃষ্টি হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল বলে গণ্য করা হয়। সেজন্য ইউএনইপি এবং ডব্লিউএমও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ পরিবেশগত ইস্যুকে ১৯৮৭ সালে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে। সুস্থ পরিবেশসম্মত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নীতিনির্ধারণ ও কর্মসূচি গ্রহণসংক্রান্ত এনভায়ারনমেন্ট পার্সপেক্টিভ টু দ্য ইয়ার ২০০০ অ্যান্ড বিয়ন্ড শিরোনামে একটি ফ্রেমওয়ার্ক গঠন করে।

সেখানে পরিবেশ এবং উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ককে বিশেষ জোর দেয়া হয়। টেকসই উন্নয়ন ধারণার শুরু সেখান থেকেই। এত কিছুর পরেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখানে মুখ্য বিষয় হিসেবে জায়গা পায়নি। ১৯৮৮ সালে, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং ওজোন স্তর হালকা হয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো রাজনৈতিক ইস্যু এবং জনবিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বছরের শুরুতে টঘঊচ একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে। যাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি পরিবেশনির্ভর কিন্তু সংবেদনশীল সেক্টরগুলো শনাক্ত করা যায়। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গীরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়াদি পর্যবেক্ষণের জন্য ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) নামের একটি ফোরাম গঠিত হয় এবং তারা একই বছরের নভেম্বরে তাদের প্রথম সভা করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জলবায়ু পরিবর্তনকে সুনির্দিষ্ট এবং জরুরি বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। ডব্লিউএমও এবং ইউএনইপিকে এ বিস্তারিত রিভ্যু এবং করণীয় বিষয় তৈরি করতে বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের উচ্চতাবৃদ্ধির কারণে হুমকির মুখে থাকা মালদ্বীপের মতো দেশগুলো নিয়ে মালে-ডিক্লেরাশন আলোচনায় উঠে আসে। একই বছর ২ মে জাতিসংঘ ওজোন স্তর সংরক্ষণজনিত হেলসিঙ্কি ডিক্লেরাশেন বিবেচনায় উঠে আসে। ১৯৮৯ এর মন্ট্রিল প্রটোকল অনুযায়ী যে সমস্ত পদার্থ ওজোন স্তরের জন্য ক্ষতিকর সেগুলোর বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিফল সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে ১৯৯০ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে সাধারণ পরিষদ ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরোতে পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কে একটি ধরিত্রী সম্মেলন আহ্বান করে। এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিফল থেকে পরিত্রাণের তাগিদে বিশ্বব্যাপী একযোগে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। এখানে বায়ুম-লের সুরক্ষা, টেকসই উন্নয়ন, শক্তি সাশ্রয়, ওজোন স্তর হ্রাস সম্পর্কিত বিষয়াদি গুরুত্ব পায়। সম্মেলনের সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) কর্তৃক স্বাক্ষর কার্যক্রমের উদবোধন। ১৫৮টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছিল। এই কনভেনশনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কীভাবে মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এটা ১৯৯৪ থেকে কার্যকর হয় এবং ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের রাখার বার্লিন ম্যান্ডেট গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি সম্বলিত একটি প্রোটোকল বা অন্যান্য আইনি উপকরণের ওপর আলোচনা শুরু করে।

১৯৯৭ সালে সালের ডিসেম্বরে জাপানে ইউএনএফসিসিসি গৃহীত কিয়তো প্রোটোকলে নেয়া অঙ্গীকার ছিল ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন-ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের সামগ্রিক নির্গমন ১৯৯০ এর স্তর থেকে কমপক্ষে ৫ শতাংশ হ্রাস করা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রতি বছর কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ) সম্মেলন হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রকার অগ্রগতি নেই। ২০০৬ সালে বায়ুম-লে কার্বন-ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল ৩৮১ পিপিএম। মিথেন এবং নাইট্রাস অকসাইডের ঘনত্ব ছিল যথাক্রমে ১৭৮২ পিপিবি এবং ৩২০ পিপিএম। ২০১৯ এর হিসেবে অনুযায়ী কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনত্ব যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম, ১৮৬৬ পিপিবি এবং ৩৩২ পিপিএম। আর শিল্পবিপ্লবের শুরুতে কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল যথাক্রমে ২৮০ পিপিএম, ৭১৫ পিপিবি এবং ২৭০ পিপিএম। পরিসংখ্যান মোতাবেক বিশ্বে সাম্প্রতিককালে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির ধারা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছেই। তাহলে কী হচ্ছে? এত আয়োজন, এত কথা সবই কী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে!

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট, সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

back to top