alt

উপ-সম্পাদকীয়

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

রেজাউল করিম খোকন

: রোববার, ১৪ জুলাই ২০২৪

বাসযোগ্যতার সূচকে দেখা গেছে, বিশ্বে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। আগের বছর ১৬৬তম অবস্থানে থাকলেও এবার ১৬৮ নম্বরে নেমে এসেছে। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামোর মতো সূচকের আলোকে বিশ্বের ১৭৩টি শহর নিয়ে এই জরিপ করা হয়।

ঢাকায় নাগরিক সুবিধা ও জনঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার অবাসযোগ্যতা ও অস্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কর্মকা- সারাদেশের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ও অন্যান্য আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। ঢাকায় যেসব অবকাঠামো গড়া হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পনার মানদ-ে যথেষ্ট না, বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৪৩। এর মধ্যে অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ ১০০-তে পেয়েছে ২৬ দশমিক ৮।

২০১৯ সালেও বাংলাদেশ অবকাঠামো খাতে ২৬ দশমিক ৮ পেয়েছিল। অন্যান্য সূচকে কিছুটা কমবেশি হলেও অবকাঠামো সূচকে ধারাবাহিকভাবে একই নম্বর পাচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের করাচি অবকাঠামো সূচকে পেয়েছে ৫১ দশমিক ৮ পয়েন্ট। ঢাকায় সেবা দেয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহি দুর্বল। ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে। বিশেষ করে গত এক দশকে অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশ এক জায়গায় আটকে আছে। আগামী সময়েও বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অগ্রগতির সম্ভাবনা কম। ঢাকায় সেবা দেয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না।

বাসযোগ্য শহরে গণপরিবহন অপরিহার্য। সরকার অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব দিলেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। সরকার বাসমালিকদের কাছে জিম্মি। এই শহরকে বাঁচাতে হলে উন্নতমানের বাস চালু করতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মেগা প্রকল্পে আগ্রহ বেশি। ফলে ঢাকায় টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। ঢাকায় সেবা দেয়ার সঙ্গে যেসব সংস্থা জড়িত, তাদের দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। ঢাকা কেন পিছিয়ে যাচ্ছে, সেটার জবাব কেউ দেয় না। অবকাঠামো খাতে চরমভাবে খারাপ করছে বাংলাদেশ। শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, বাসগুলো যাত্রীর জন্য মারামারি করে এটাকে গণপরিবহন বলা যায় না। যে পরিস্থিতি তাতে ভবিষ্যতেও বাসযোগ্যতায় খুব বেশি উন্নতি হবে না। ঢাকায় ব্যয়বহুল বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও বাসযোগ্যতায় অগ্রগতি হচ্ছে না, যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো করা হচ্ছে, সেগুলো পরিকল্পিত ও টেকসই হচ্ছে না।

এ বছরও ভারি বৃষ্টিপাত হলেই জলজট হওয়ার আশঙ্কাটা রয়ে গেছে। ফুটপাত পথচারীবান্ধব করার ঘোষণা দিয়েছিলেন দুই মেয়রই। কিন্তু এখনও ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। শহরের অধিকাংশ ফুটপাত দখল করে আছে দোকানপাট। শুধু তাই নয় যখন তখন যে কেউই তাদের ইচ্ছামাফিক শহরের ফুটপাতে দোকান তুলছেন, পসরা সাজাচ্ছেন। এই দখল প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়নি। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই উচ্ছেদের জায়গাগুলো আবার দখল হয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো, হকারদের পুনর্বাসন ছাড়া ফুটপাত পথচারীবান্ধব করা যাবে না।

এই শহরে সারি সারি ভবন আর রাস্তাঘাটের বিস্তৃতি ঘটছে, কিছু কিছু এলাকার চাকচিক্য সৌন্দর্য বাড়ছে তবে সেই তুলনায় বস্তির কোনো উন্নয়ন হয়নি। সুযোগ-সুবিধাও বাড়েনি। খেলার মাঠগুলোর বেহাল অবস্থা খুব সহজেই চোখে পড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মাঠগুলোর নজরদারি করার কেউ নেই। খেলার মাঠে নেই খেলাধুলার পরিবেশ। ধানমন্ডি এলাকায় একটা খেলার মাঠকে নিয়ে দারুণ তোলপাড় হয়েছে। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে খেলার মাঠটি আবার শিশুদের খেলাধুলার জন্য ফিরে এসেছে তাদের কাছে।

ঢাকা নগরীর বিভিন্ন জায়গায় এরকম বহু খেলার মাঠ হারিয়ে গেছে কিংবা বেদখল হয়ে গেছে। শিশু-কিশোররা খেলার মাঠের অভাবে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে। তাদের যথার্থ মানসিক, শারীরিক গঠন এবং বিকাশ ঘটছে না। যে কারণে কিশোরদের গ্যাং কালচারের দৌরাত্ম্যে চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা শহরে খেলার মাঠের অভাব দূর করতে হবে। আসলে যানজট, জলজট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষ ওই বিষয়টির দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারছে না। ওষুধ ছিটানোর পরও ঢাকার মশার উপদ্রব কমেনি। মশার উপদ্রবের কথা দুই মেয়রই স্বীকার করেছেন। মশার যন্ত্রণা ঢাকা শহরবাসীর জীবনে চরম অস্বস্তি হয়ে আছে এখনও।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর এখন একটি দর্শনহীন, ভিশনহীন ও সমন্বয়হীন দূষিত নগরে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট নগর দর্শন, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এ শহর নিয়ে আমাদের সামনে স্পষ্ট কোন ভিশনও নেই। নগরীতে পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কার করে, দূষণমুক্ত পরিবেশ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, ড্রেনেজ সমস্যার সমাধানসহ নাগরিক ভোগান্তি দূর করতে হিমশিম খাচ্ছে সিটি করপোরেশনগুলো। যত্রতত্র গড়ে উঠছে শপিং সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বাণিজিক কার্যালয়।

আবাসিক এলাকাগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ঝুলন্ত তারের নগরীতে পরিণত হচ্ছে শহরগুলো। মাস্টারপ্ল্যানের বাহিরে মার্কেটগুলোতে অনঅনুমোদিত দোকান-পাট তুলে অরাজকতা তৈরি করছে কিছু অসাধু চক্র। অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাচ্ছে, পানিবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। কী বৃষ্টি, কী বর্ষাকালÑ যে সংস্থার যখন খুশি রাস্তা কাটাছেঁড়া করছে। জলবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নাকি ওয়াসা তা নিয়ে চলে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। সাধারণত উন্নয়ন কর্মকা-গুলো প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে পারে না সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্মে নিয়োজিত এজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আমরা সব সময়েই প্রত্যক্ষ করে আসছি। এটাকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। দুই সিটি করপোরেশনের কাজকর্মে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতার অবসান ঘটাতে ঢাকার দুই মেয়েরই তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং দক্ষতার প্রয়োগ করছেন। এই শহরে আমরা যারা বাস করছি, তাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে শহরটিকে সুন্দর আকর্ষণীয় করে তোলার ব্যাপারে। এ শহরকে নিজ বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো ভালোবাসতে হবে। তাহলেই একে পরিচ্ছন্ন, বসবাস উপযোগী সুন্দর নগরীতে পরিণত করা সম্ভব হবে। পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর ঢাকা গড়তে নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতাই সফলতার শক্তি।

এই নগরীকে স্বপ্নের মতো সুন্দর, বাসযোগ্য এবং আরামদায়ক করতে প্রত্যেক নগরবাসীর নিজস্ব কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যে যার অবস্থান থেকে সেই দায়িত্বগুলো পালন করে গেলে আমাদের এই প্রিয় শহর কোনোভাবে পিছিয়ে থাকতে পারে না, বিশে^র বাসের অযোগ্য শহরের কিংবা দুর্ভোগের শহরের তালিকায় ঠাঁই পেতে পারে না। দুঃস্বপ্নের বোঝা আর অনাগত বিপদের শঙ্কা বুকে বয়ে আমরা আমাদের প্রতিটি দিন পার করতে চাই না আর। অনেক সম্ভাবনা এবং সুন্দরের হাতছানি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের প্রিয় এই রাজধানী ঢাকা শহর দুঃস্বপ্ন কিংবা দুর্ভোগের শহর হিসেবে বিবেচিত হোক আমরা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। আমরা মনেপ্রাণে চাই, একটি চমৎকার বাসযোগ্য স্বস্তিকর জীবনের শান্ত সুনিবিড় আন্তর্জাতিক মানের শহর হিসেবে গণ্য হোক বিশ^জুড়ে।

এখন বিশ্বের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহর, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শহর, বিশে^র বাসের অযোগ্য শহর কিংবা দুর্ভোগের শহর, যানজটের শহর, ব্যয়বহুল জীবনযাপনের শহর প্রভৃতি তকমায় ভূষিত হয় আমাদের সবার প্রাণের শহর ঢাকাকে। এর চেয়ে কষ্টের অনুভূতি আর কী হতে পারে?

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

রেজাউল করিম খোকন

রোববার, ১৪ জুলাই ২০২৪

বাসযোগ্যতার সূচকে দেখা গেছে, বিশ্বে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। আগের বছর ১৬৬তম অবস্থানে থাকলেও এবার ১৬৮ নম্বরে নেমে এসেছে। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামোর মতো সূচকের আলোকে বিশ্বের ১৭৩টি শহর নিয়ে এই জরিপ করা হয়।

ঢাকায় নাগরিক সুবিধা ও জনঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার অবাসযোগ্যতা ও অস্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কর্মকা- সারাদেশের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ও অন্যান্য আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। ঢাকায় যেসব অবকাঠামো গড়া হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পনার মানদ-ে যথেষ্ট না, বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৪৩। এর মধ্যে অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ ১০০-তে পেয়েছে ২৬ দশমিক ৮।

২০১৯ সালেও বাংলাদেশ অবকাঠামো খাতে ২৬ দশমিক ৮ পেয়েছিল। অন্যান্য সূচকে কিছুটা কমবেশি হলেও অবকাঠামো সূচকে ধারাবাহিকভাবে একই নম্বর পাচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের করাচি অবকাঠামো সূচকে পেয়েছে ৫১ দশমিক ৮ পয়েন্ট। ঢাকায় সেবা দেয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহি দুর্বল। ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে। বিশেষ করে গত এক দশকে অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশ এক জায়গায় আটকে আছে। আগামী সময়েও বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অগ্রগতির সম্ভাবনা কম। ঢাকায় সেবা দেয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না।

বাসযোগ্য শহরে গণপরিবহন অপরিহার্য। সরকার অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব দিলেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। সরকার বাসমালিকদের কাছে জিম্মি। এই শহরকে বাঁচাতে হলে উন্নতমানের বাস চালু করতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মেগা প্রকল্পে আগ্রহ বেশি। ফলে ঢাকায় টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। ঢাকায় সেবা দেয়ার সঙ্গে যেসব সংস্থা জড়িত, তাদের দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। ঢাকা কেন পিছিয়ে যাচ্ছে, সেটার জবাব কেউ দেয় না। অবকাঠামো খাতে চরমভাবে খারাপ করছে বাংলাদেশ। শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, বাসগুলো যাত্রীর জন্য মারামারি করে এটাকে গণপরিবহন বলা যায় না। যে পরিস্থিতি তাতে ভবিষ্যতেও বাসযোগ্যতায় খুব বেশি উন্নতি হবে না। ঢাকায় ব্যয়বহুল বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও বাসযোগ্যতায় অগ্রগতি হচ্ছে না, যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো করা হচ্ছে, সেগুলো পরিকল্পিত ও টেকসই হচ্ছে না।

এ বছরও ভারি বৃষ্টিপাত হলেই জলজট হওয়ার আশঙ্কাটা রয়ে গেছে। ফুটপাত পথচারীবান্ধব করার ঘোষণা দিয়েছিলেন দুই মেয়রই। কিন্তু এখনও ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। শহরের অধিকাংশ ফুটপাত দখল করে আছে দোকানপাট। শুধু তাই নয় যখন তখন যে কেউই তাদের ইচ্ছামাফিক শহরের ফুটপাতে দোকান তুলছেন, পসরা সাজাচ্ছেন। এই দখল প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়নি। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই উচ্ছেদের জায়গাগুলো আবার দখল হয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো, হকারদের পুনর্বাসন ছাড়া ফুটপাত পথচারীবান্ধব করা যাবে না।

এই শহরে সারি সারি ভবন আর রাস্তাঘাটের বিস্তৃতি ঘটছে, কিছু কিছু এলাকার চাকচিক্য সৌন্দর্য বাড়ছে তবে সেই তুলনায় বস্তির কোনো উন্নয়ন হয়নি। সুযোগ-সুবিধাও বাড়েনি। খেলার মাঠগুলোর বেহাল অবস্থা খুব সহজেই চোখে পড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মাঠগুলোর নজরদারি করার কেউ নেই। খেলার মাঠে নেই খেলাধুলার পরিবেশ। ধানমন্ডি এলাকায় একটা খেলার মাঠকে নিয়ে দারুণ তোলপাড় হয়েছে। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে খেলার মাঠটি আবার শিশুদের খেলাধুলার জন্য ফিরে এসেছে তাদের কাছে।

ঢাকা নগরীর বিভিন্ন জায়গায় এরকম বহু খেলার মাঠ হারিয়ে গেছে কিংবা বেদখল হয়ে গেছে। শিশু-কিশোররা খেলার মাঠের অভাবে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে। তাদের যথার্থ মানসিক, শারীরিক গঠন এবং বিকাশ ঘটছে না। যে কারণে কিশোরদের গ্যাং কালচারের দৌরাত্ম্যে চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা শহরে খেলার মাঠের অভাব দূর করতে হবে। আসলে যানজট, জলজট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষ ওই বিষয়টির দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারছে না। ওষুধ ছিটানোর পরও ঢাকার মশার উপদ্রব কমেনি। মশার উপদ্রবের কথা দুই মেয়রই স্বীকার করেছেন। মশার যন্ত্রণা ঢাকা শহরবাসীর জীবনে চরম অস্বস্তি হয়ে আছে এখনও।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর এখন একটি দর্শনহীন, ভিশনহীন ও সমন্বয়হীন দূষিত নগরে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট নগর দর্শন, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এ শহর নিয়ে আমাদের সামনে স্পষ্ট কোন ভিশনও নেই। নগরীতে পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কার করে, দূষণমুক্ত পরিবেশ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, ড্রেনেজ সমস্যার সমাধানসহ নাগরিক ভোগান্তি দূর করতে হিমশিম খাচ্ছে সিটি করপোরেশনগুলো। যত্রতত্র গড়ে উঠছে শপিং সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বাণিজিক কার্যালয়।

আবাসিক এলাকাগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ঝুলন্ত তারের নগরীতে পরিণত হচ্ছে শহরগুলো। মাস্টারপ্ল্যানের বাহিরে মার্কেটগুলোতে অনঅনুমোদিত দোকান-পাট তুলে অরাজকতা তৈরি করছে কিছু অসাধু চক্র। অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাচ্ছে, পানিবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। কী বৃষ্টি, কী বর্ষাকালÑ যে সংস্থার যখন খুশি রাস্তা কাটাছেঁড়া করছে। জলবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নাকি ওয়াসা তা নিয়ে চলে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। সাধারণত উন্নয়ন কর্মকা-গুলো প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে পারে না সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্মে নিয়োজিত এজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আমরা সব সময়েই প্রত্যক্ষ করে আসছি। এটাকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। দুই সিটি করপোরেশনের কাজকর্মে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতার অবসান ঘটাতে ঢাকার দুই মেয়েরই তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং দক্ষতার প্রয়োগ করছেন। এই শহরে আমরা যারা বাস করছি, তাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে শহরটিকে সুন্দর আকর্ষণীয় করে তোলার ব্যাপারে। এ শহরকে নিজ বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো ভালোবাসতে হবে। তাহলেই একে পরিচ্ছন্ন, বসবাস উপযোগী সুন্দর নগরীতে পরিণত করা সম্ভব হবে। পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর ঢাকা গড়তে নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতাই সফলতার শক্তি।

এই নগরীকে স্বপ্নের মতো সুন্দর, বাসযোগ্য এবং আরামদায়ক করতে প্রত্যেক নগরবাসীর নিজস্ব কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যে যার অবস্থান থেকে সেই দায়িত্বগুলো পালন করে গেলে আমাদের এই প্রিয় শহর কোনোভাবে পিছিয়ে থাকতে পারে না, বিশে^র বাসের অযোগ্য শহরের কিংবা দুর্ভোগের শহরের তালিকায় ঠাঁই পেতে পারে না। দুঃস্বপ্নের বোঝা আর অনাগত বিপদের শঙ্কা বুকে বয়ে আমরা আমাদের প্রতিটি দিন পার করতে চাই না আর। অনেক সম্ভাবনা এবং সুন্দরের হাতছানি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের প্রিয় এই রাজধানী ঢাকা শহর দুঃস্বপ্ন কিংবা দুর্ভোগের শহর হিসেবে বিবেচিত হোক আমরা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। আমরা মনেপ্রাণে চাই, একটি চমৎকার বাসযোগ্য স্বস্তিকর জীবনের শান্ত সুনিবিড় আন্তর্জাতিক মানের শহর হিসেবে গণ্য হোক বিশ^জুড়ে।

এখন বিশ্বের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহর, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শহর, বিশে^র বাসের অযোগ্য শহর কিংবা দুর্ভোগের শহর, যানজটের শহর, ব্যয়বহুল জীবনযাপনের শহর প্রভৃতি তকমায় ভূষিত হয় আমাদের সবার প্রাণের শহর ঢাকাকে। এর চেয়ে কষ্টের অনুভূতি আর কী হতে পারে?

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top