alt

উপ-সম্পাদকীয়

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

নেছার আহমদ

: রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

শহর নগর বন্দরে বর্তমানে সড়কের প্রশস্ততা বেড়েছে, বেড়েছে সড়কের সংখ্যাও। কিন্তু সংকীর্ণ সড়কে যে দীর্ঘ যানজট ছিল তা থেকে মুক্তি মেলেনি এখনও। চট্টগ্রাম মহানগরের কথাই ধরি মুরাদপুরের মোড় শহর এলাকার বাস, রিকশা, টেক্সি রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে প্যাসেঞ্জারের জন্য, ফলে পেছনে শুরু হয় দীর্ঘ যানজট। ষোলশহর ২ নম্বর গেইট, জিইসি মোড়, টাইগারপাস, পাঁচলাইশ থানার মোড়, চকবাজার ওলি খাঁ মসজিদের মোড়, প্রবর্তক ও গোলপাহাড়ের মোড় এবং পুরনো গুলজারের মোড়, আন্দরকিল্লা চেরাগি পাহাড়, আগ্রাবাদ, হালিশহর, বন্দর, ইপিজেড মোড় সর্বত্র যানজটে নাকাল নগরবাসী। যত্রতত্র হাসপাতাল ক্লিনিক এবং আবাসিক এলাকায় স্কুলের কারণে যত্রতত্র পাকিং নগরে যানজটের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাফিক বিভাগের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষ চালক, আইন না মানার প্রবণতা শহরে যানজট সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। নিয়মিত পত্র-পত্রিকায় যানজট এবং এর প্রতিকারে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তে পারেনি।

যানজট নিরসনে অনেক সভা সেমিনার এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত সভা বা পরামর্শ থাকলেও তা কোন সময়েই বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান আধুনিক বিশে^ যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে সেখানে শুধু আমাদের দেশেই চোখে পড়ে সেই মান্ধাতা আমলের ট্রাফিক ব্যবস্থা। ট্রাফিক পুলিশ হাত উঠিয়ে সিগন্যাল দিয়ে গাড়ি চলাচল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। বিভিন্ন সময়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক সিগন্যাল সিস্টেম চালু করা হলেও তা বর্তমানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সেগুলোর কার্যকারিতা কোথাও নেই বললেই চলে। আজ হতে ৩০-৪০ বছর আগেও আমরা দেখেছি নিয়মিত ট্রাফিক সপ্তাহ পালিত হতো। সে সময়ে গাড়ির চালক ও পথচারীদের সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হতো। আমরা আধুনিক হয়েছি ঠিকই কিন্তু পুরনো জরজীর্ণ ব্যবস্থাকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। দিন দিন তা খারাপের দিকেই যাচ্ছে। প্রথমেই বলেছি, রাস্তার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু বর্ধিত রাস্তা এবং ফুটপাতের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।

যানজটের কারণে মৌলিক কিছু সমস্যার মুখে আমরা। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এ সমস্যার প্রতিকার ও উপায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। যানজটের কারণে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জ¦ালানি খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল-কলেজে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুল শেষে বিনোদন ও খেলাধুলার সময়টা যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে। বায়ু দূর্ষিত হচ্ছে। গাড়ির মধ্যে বসে থাকার কারণে হাঁটু, কোমর ও মেরুদ-ের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। যানজটের কারণে প্রজন্মের মধ্যে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। যেসব স্থানে যানজট প্রচন্ড চতুর্থমুখী রাস্তাগুলোতে ইউলুপ নির্মাণ করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী মহানগরে ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন।

প্রসাশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় যুবকদের সমন্বয়ে কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থা চালু এবং সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দায়িত্ব দিয়ে এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে ট্রাফিক বিভাগ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে পুলিশের জনবল সংকটের অজুহাত হতে জনগণ মুক্ত হবে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যৌথভাবে দায়িত্ব দেয়া হলে সামাজিক দায়বদ্ধতায় যার যার এলাকা সে সে যানজট মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

যানজটের সমস্যার বাইরে দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার দিকে নজর দিলেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর বিভৎষতা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পরিত্রাণের জন্য এবং নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য যেসব দপ্তরে দায়িত্ব রয়েছে তারাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তেমন তৎপর নয়। ফলে প্রতি বছরই সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণহানির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছরও দিবসটি মহাসমারোহে পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের যে প্রতিপাদ্য তা মূলত পথচারী, যাত্রী এবং সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ কীভাবে সড়ক পারাপার হবে ও যাত্রীদের আচরণ কী হওয়া উচিতÑ এটিই মূল বিষয় ছিল। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মসূচি শোভাযাত্রা ও পথচারীদের সচেতনতা সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ ছিল।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবমতে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ২১ হাজার ৬৬২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সড়কে ২ হাজার ২২২ এবং সর্বশেষ গত বছর ৩ হাজার ৭৭৬ জনের প্রাণ গেছে। অর্থাৎ প্রতি বছর দুর্ঘটনায় ও প্রাণহানি বাড়ছে।

বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ৭ থেকে ৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও মানুষের আয়স্কুল-সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লাইফ এক্সপেটেন্সি বিশ^ব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা, কোভিড-১৯, নানা রোগসহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুর তাৎক্ষণিক (রিয়েল টাইম) তথ্য প্রকাশ করে। তাদের হিসাবে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১৬.৭৪ জন মারা যান। ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮তম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৬তম।

সরকার টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে (এসডিজি) আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিত কোনো কর্মসূচি বাস্তবে পরিলক্ষিত হয়নি। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এসডিজির লক্ষ্য পূরণের পথে দুর্ঘটনা কমার কোন লক্ষণ নেই।

গত বছর নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত অর্থায়নের জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে বিশ^ব্যাংক। এ সময় সংস্থাটি বাংলাদেশ সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত নানা বিশ্লেষণ তুলে ধরে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বিশ্লেষণ করে বিশ^ব্যাংক বলেছে, এ সময় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশ দরিদ্র ও নি¤œআয়ের মানুষ। তাদের প্রায় অর্ধেক আবার পথচারী। এসডিজিতে আগামী এক দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য প্রায় ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে বলে জানায় বিশ^ব্যাংক। অথচ সরকার চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ ছাড়া আর কোন পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয়নি।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসের চাপায় নিহত হওয়ার পর ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। একপর্যায়ে তা ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে যানবাহনের কাগজপত্র চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করে, সংকেত মেনে যানবাহন চলাচল ও শৃঙ্খলায় রক্ষায় তৎপরতা দেখায়। সে সময় সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা বলেছিলেন, ‘শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, বিবেককে জাগ্রত করেছে।’

ওই বছর তড়িঘড়ি করে তৈরি করা হয় সড়ক পরিবহন আইন। আইন অমান্যের শাস্তি কঠোর করা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ধাক্কা খায় সরকার। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের নেতৃত্বাধীন পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘট ডেকে বসে। সরকার তাদের দাবি মেনে এই দুটি অপরাধের শাস্তি স্থগিত করে। আইনের প্রয়োগ শিথিল করে দেয়।

এর ফলে সড়ক পরিবহন আইনে লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির যে বিধান আছে, এর প্রয়োগ বন্ধ হয়ে যায়।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে দূরপাল্লার পথে চলাচলকারী যানের চালকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করার আশ^াস দিয়েছিল সরকার; তা বাস্তবায়ন হয়নি। মহাসড়কে উল্টো পথে যান চলাচল এবং মহাসড়কে রিকশা, থ্রি হুইলার এবং নসিমন করিমনের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে পারেনি। মহাসড়কে এ যানগুলো এবং উল্টোপথে যানচলাচল দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের জন্ম ১৯৯৫ সালে। কাউন্সিলের অধীনে ১৯৯৭ সালে থেকে দুুবছর মেয়াদি নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত কৌশলগত পরিকল্পনা করে আসছে সরকার। ২০১৭ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে। প্রতিবারই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অর্ধেক কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে কীভাবে দুর্ঘটনা কমানো হবে-এর কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক কোনো পদ্ধতি দাঁড় করাতে পারেনি সরকার। দুর্ঘটনা কমাতে সারা বছর ধরে যে কর্মসূচি থাকার কথা, এরও কোনো উল্লেখ নেই পরিকল্পনায়। নামকাওয়াস্তে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে কী কাজ করবে, এর ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হলেও নিরাপদ সড়কসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মনোযোগ নেই তাদের, বরং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর চার লেন সড়ক, উড়ালসড়ক, মেট্রোরেলসহ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপর। সড়ক আইন বাস্তবায়ন, পথচারী পারাপার নিশ্চিত করা, চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিত করা, যানবাহনের গতিনিয়ন্ত্রণÑ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।

২০১১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। উদ্দেশ্য ছিল সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে করণীয় ঠিক করা। কমিটি ৮৬ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল। এর বেশির ভাগই চালক, যানবাহন ও সড়ক-সংশ্লিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব ছিল। ওই প্রতিবেদন এখন বিআরটিএতে পড়ে আছে।

২০১৫ সালে গাড়িতে ‘স্পিড গভর্নর’ নামের একটি যন্ত্র বসিয়ে মহাসড়কে সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচল নিশ্চিতের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৬ সালে কাউন্সিল জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। তাও বাস্তাবয়ন হয়নি।

বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), বাংলাদেশ পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে রোড সেফটি উইং (নিরাপদ সড়কসংক্রান্ত শাখা) আছে। কিন্তু এসব দপ্তর সড়ক দুর্ঘটনার ওপর পূর্ণাঙ্গ কোনো গবেষণা করেনি। পুলিশ শুধু সড়ক দুঘটনায় যেসব মামলা হয়, এর নথি ধরে হতাহতের একটা হিসাব দেয়। সেটা ধরেই বেশির ভাগ বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি গবেষণা করে থাকে।

যান চলাচলের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বড় অংশীদার বিআরটিএ। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যসচিব ও সংস্থাটির চেয়ারম্যান। কিন্তু নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে সারা বছর তাদের তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। প্রতি বছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসকে কেন্দ্র করে কিছু পোস্টার-লিফলেট বিতরণ, সভা সেমিনার করে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে কিছু চালকের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের রোড সেফটি উইংয়ের বাজেটই বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। এর একটা অংশ চলে যায় বৈঠক আপ্যায়নে। বাকিটা পোস্টার ছাপিয়ে ব্যয় করা হয়।

সওজ ও এলজিইডি দেশের প্রায় সব সড়কের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। দুটি সংস্থারই রোড সেফটি ঊইং আছে। তবে তাদের দৃশ্যমান কোনো কর্মকা- চোখে পড়ে না। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে সংস্থাটি সচেতনতামূলক কিছু কর্মসূচি পালন করে। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এর বাইরে জনসচেতনতা ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নজরে পড়ে না।

উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সড়ক চওড়া হয়েছে, যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে কিন্তু সড়ক ও যানবাহনের ত্রুটি রয়েই গেছে। সড়কে প্রতিনিয়ত মৃত্যু যেন ওতপেতে রয়েছে। ফলে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি বাড়ছে।

সড়ক ও মহাসড়ক চওড়া করার পর গাড়ি, দূরপাল্লার বাস ও ট্রাকের গতি বেড়েছে। কিন্তু একই সড়কে ধীরগতির ব্যাটারি রিকশা, অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হয়নি। মহাসড়কের উপর হতে বাজার এবং দোকানপাট বন্ধ করা হয়নি। মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে দেখা যায় অভিযান চালিয়ে মহাসড়কের উপর স্থাপিত দোকান উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু দুয়েকদিন পর অদৃশ্য হস্তক্ষেপে তা আবার নির্মাণ হয়ে যায়।

বর্তমান সময়ে উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ। দেশের আকাশ ছোঁয়া উন্নয়ন বিশে^র নিকট বিস্ময়। অভ্যান্তরীণ শহর, নগর ও মহানগরীতে ট্রাফিক অব্যবস্থায় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিথর দাঁড়িয়ে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রম ও সময়ের অপচয় দেশের বিস্ময়কর উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বর্ণিত বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময়োপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এবং জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্ট করে যদি আধুনিক চিন্তা চেতনায় এবং দেশীয় স্থানীয় পরিবেশ ও অবস্থানকে মাথায় রেখে কাজ করলে অচিরেই দেশ যানজট হতে মুক্তি ও সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।

[লেখক : সম্পাদক, শিল্প শৈলী]

জেগে উঠুক সুকুমার বৃত্তি

প্রসঙ্গ : লোকসভা নির্বাচন

ছবি

বারবার পুড়ছে বাংলাদেশের ফুসফুস

শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

বিসিএস জ্বরে পুড়ছে তারুণ্য

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

নমিনির অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির গচ্ছিত টাকা পাবে কে

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

যদি শুধু বিনোদন সংস্কৃতি হয় তাহলে বাকি সব কী?

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা

বন্ধ হোক প্রশ্ন ফাঁস

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

নেছার আহমদ

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

শহর নগর বন্দরে বর্তমানে সড়কের প্রশস্ততা বেড়েছে, বেড়েছে সড়কের সংখ্যাও। কিন্তু সংকীর্ণ সড়কে যে দীর্ঘ যানজট ছিল তা থেকে মুক্তি মেলেনি এখনও। চট্টগ্রাম মহানগরের কথাই ধরি মুরাদপুরের মোড় শহর এলাকার বাস, রিকশা, টেক্সি রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে প্যাসেঞ্জারের জন্য, ফলে পেছনে শুরু হয় দীর্ঘ যানজট। ষোলশহর ২ নম্বর গেইট, জিইসি মোড়, টাইগারপাস, পাঁচলাইশ থানার মোড়, চকবাজার ওলি খাঁ মসজিদের মোড়, প্রবর্তক ও গোলপাহাড়ের মোড় এবং পুরনো গুলজারের মোড়, আন্দরকিল্লা চেরাগি পাহাড়, আগ্রাবাদ, হালিশহর, বন্দর, ইপিজেড মোড় সর্বত্র যানজটে নাকাল নগরবাসী। যত্রতত্র হাসপাতাল ক্লিনিক এবং আবাসিক এলাকায় স্কুলের কারণে যত্রতত্র পাকিং নগরে যানজটের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাফিক বিভাগের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষ চালক, আইন না মানার প্রবণতা শহরে যানজট সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। নিয়মিত পত্র-পত্রিকায় যানজট এবং এর প্রতিকারে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তে পারেনি।

যানজট নিরসনে অনেক সভা সেমিনার এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত সভা বা পরামর্শ থাকলেও তা কোন সময়েই বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান আধুনিক বিশে^ যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে সেখানে শুধু আমাদের দেশেই চোখে পড়ে সেই মান্ধাতা আমলের ট্রাফিক ব্যবস্থা। ট্রাফিক পুলিশ হাত উঠিয়ে সিগন্যাল দিয়ে গাড়ি চলাচল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। বিভিন্ন সময়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক সিগন্যাল সিস্টেম চালু করা হলেও তা বর্তমানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সেগুলোর কার্যকারিতা কোথাও নেই বললেই চলে। আজ হতে ৩০-৪০ বছর আগেও আমরা দেখেছি নিয়মিত ট্রাফিক সপ্তাহ পালিত হতো। সে সময়ে গাড়ির চালক ও পথচারীদের সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হতো। আমরা আধুনিক হয়েছি ঠিকই কিন্তু পুরনো জরজীর্ণ ব্যবস্থাকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। দিন দিন তা খারাপের দিকেই যাচ্ছে। প্রথমেই বলেছি, রাস্তার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু বর্ধিত রাস্তা এবং ফুটপাতের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।

যানজটের কারণে মৌলিক কিছু সমস্যার মুখে আমরা। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এ সমস্যার প্রতিকার ও উপায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। যানজটের কারণে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জ¦ালানি খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল-কলেজে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুল শেষে বিনোদন ও খেলাধুলার সময়টা যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে। বায়ু দূর্ষিত হচ্ছে। গাড়ির মধ্যে বসে থাকার কারণে হাঁটু, কোমর ও মেরুদ-ের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। যানজটের কারণে প্রজন্মের মধ্যে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। যেসব স্থানে যানজট প্রচন্ড চতুর্থমুখী রাস্তাগুলোতে ইউলুপ নির্মাণ করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী মহানগরে ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন।

প্রসাশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় যুবকদের সমন্বয়ে কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থা চালু এবং সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দায়িত্ব দিয়ে এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে ট্রাফিক বিভাগ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে পুলিশের জনবল সংকটের অজুহাত হতে জনগণ মুক্ত হবে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যৌথভাবে দায়িত্ব দেয়া হলে সামাজিক দায়বদ্ধতায় যার যার এলাকা সে সে যানজট মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

যানজটের সমস্যার বাইরে দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার দিকে নজর দিলেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর বিভৎষতা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পরিত্রাণের জন্য এবং নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য যেসব দপ্তরে দায়িত্ব রয়েছে তারাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তেমন তৎপর নয়। ফলে প্রতি বছরই সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণহানির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছরও দিবসটি মহাসমারোহে পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের যে প্রতিপাদ্য তা মূলত পথচারী, যাত্রী এবং সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ কীভাবে সড়ক পারাপার হবে ও যাত্রীদের আচরণ কী হওয়া উচিতÑ এটিই মূল বিষয় ছিল। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মসূচি শোভাযাত্রা ও পথচারীদের সচেতনতা সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ ছিল।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবমতে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ২১ হাজার ৬৬২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সড়কে ২ হাজার ২২২ এবং সর্বশেষ গত বছর ৩ হাজার ৭৭৬ জনের প্রাণ গেছে। অর্থাৎ প্রতি বছর দুর্ঘটনায় ও প্রাণহানি বাড়ছে।

বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ৭ থেকে ৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও মানুষের আয়স্কুল-সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লাইফ এক্সপেটেন্সি বিশ^ব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা, কোভিড-১৯, নানা রোগসহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুর তাৎক্ষণিক (রিয়েল টাইম) তথ্য প্রকাশ করে। তাদের হিসাবে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১৬.৭৪ জন মারা যান। ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮তম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৬তম।

সরকার টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে (এসডিজি) আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিত কোনো কর্মসূচি বাস্তবে পরিলক্ষিত হয়নি। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এসডিজির লক্ষ্য পূরণের পথে দুর্ঘটনা কমার কোন লক্ষণ নেই।

গত বছর নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত অর্থায়নের জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে বিশ^ব্যাংক। এ সময় সংস্থাটি বাংলাদেশ সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত নানা বিশ্লেষণ তুলে ধরে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বিশ্লেষণ করে বিশ^ব্যাংক বলেছে, এ সময় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশ দরিদ্র ও নি¤œআয়ের মানুষ। তাদের প্রায় অর্ধেক আবার পথচারী। এসডিজিতে আগামী এক দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য প্রায় ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে বলে জানায় বিশ^ব্যাংক। অথচ সরকার চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ ছাড়া আর কোন পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয়নি।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসের চাপায় নিহত হওয়ার পর ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। একপর্যায়ে তা ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে যানবাহনের কাগজপত্র চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করে, সংকেত মেনে যানবাহন চলাচল ও শৃঙ্খলায় রক্ষায় তৎপরতা দেখায়। সে সময় সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা বলেছিলেন, ‘শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, বিবেককে জাগ্রত করেছে।’

ওই বছর তড়িঘড়ি করে তৈরি করা হয় সড়ক পরিবহন আইন। আইন অমান্যের শাস্তি কঠোর করা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ধাক্কা খায় সরকার। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের নেতৃত্বাধীন পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘট ডেকে বসে। সরকার তাদের দাবি মেনে এই দুটি অপরাধের শাস্তি স্থগিত করে। আইনের প্রয়োগ শিথিল করে দেয়।

এর ফলে সড়ক পরিবহন আইনে লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির যে বিধান আছে, এর প্রয়োগ বন্ধ হয়ে যায়।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে দূরপাল্লার পথে চলাচলকারী যানের চালকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করার আশ^াস দিয়েছিল সরকার; তা বাস্তবায়ন হয়নি। মহাসড়কে উল্টো পথে যান চলাচল এবং মহাসড়কে রিকশা, থ্রি হুইলার এবং নসিমন করিমনের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে পারেনি। মহাসড়কে এ যানগুলো এবং উল্টোপথে যানচলাচল দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের জন্ম ১৯৯৫ সালে। কাউন্সিলের অধীনে ১৯৯৭ সালে থেকে দুুবছর মেয়াদি নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত কৌশলগত পরিকল্পনা করে আসছে সরকার। ২০১৭ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে। প্রতিবারই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অর্ধেক কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে কীভাবে দুর্ঘটনা কমানো হবে-এর কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক কোনো পদ্ধতি দাঁড় করাতে পারেনি সরকার। দুর্ঘটনা কমাতে সারা বছর ধরে যে কর্মসূচি থাকার কথা, এরও কোনো উল্লেখ নেই পরিকল্পনায়। নামকাওয়াস্তে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে কী কাজ করবে, এর ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হলেও নিরাপদ সড়কসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মনোযোগ নেই তাদের, বরং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর চার লেন সড়ক, উড়ালসড়ক, মেট্রোরেলসহ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপর। সড়ক আইন বাস্তবায়ন, পথচারী পারাপার নিশ্চিত করা, চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিত করা, যানবাহনের গতিনিয়ন্ত্রণÑ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।

২০১১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। উদ্দেশ্য ছিল সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে করণীয় ঠিক করা। কমিটি ৮৬ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল। এর বেশির ভাগই চালক, যানবাহন ও সড়ক-সংশ্লিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব ছিল। ওই প্রতিবেদন এখন বিআরটিএতে পড়ে আছে।

২০১৫ সালে গাড়িতে ‘স্পিড গভর্নর’ নামের একটি যন্ত্র বসিয়ে মহাসড়কে সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচল নিশ্চিতের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৬ সালে কাউন্সিল জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। তাও বাস্তাবয়ন হয়নি।

বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), বাংলাদেশ পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে রোড সেফটি উইং (নিরাপদ সড়কসংক্রান্ত শাখা) আছে। কিন্তু এসব দপ্তর সড়ক দুর্ঘটনার ওপর পূর্ণাঙ্গ কোনো গবেষণা করেনি। পুলিশ শুধু সড়ক দুঘটনায় যেসব মামলা হয়, এর নথি ধরে হতাহতের একটা হিসাব দেয়। সেটা ধরেই বেশির ভাগ বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি গবেষণা করে থাকে।

যান চলাচলের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বড় অংশীদার বিআরটিএ। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যসচিব ও সংস্থাটির চেয়ারম্যান। কিন্তু নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে সারা বছর তাদের তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। প্রতি বছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসকে কেন্দ্র করে কিছু পোস্টার-লিফলেট বিতরণ, সভা সেমিনার করে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে কিছু চালকের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের রোড সেফটি উইংয়ের বাজেটই বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। এর একটা অংশ চলে যায় বৈঠক আপ্যায়নে। বাকিটা পোস্টার ছাপিয়ে ব্যয় করা হয়।

সওজ ও এলজিইডি দেশের প্রায় সব সড়কের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। দুটি সংস্থারই রোড সেফটি ঊইং আছে। তবে তাদের দৃশ্যমান কোনো কর্মকা- চোখে পড়ে না। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে সংস্থাটি সচেতনতামূলক কিছু কর্মসূচি পালন করে। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এর বাইরে জনসচেতনতা ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নজরে পড়ে না।

উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সড়ক চওড়া হয়েছে, যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে কিন্তু সড়ক ও যানবাহনের ত্রুটি রয়েই গেছে। সড়কে প্রতিনিয়ত মৃত্যু যেন ওতপেতে রয়েছে। ফলে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি বাড়ছে।

সড়ক ও মহাসড়ক চওড়া করার পর গাড়ি, দূরপাল্লার বাস ও ট্রাকের গতি বেড়েছে। কিন্তু একই সড়কে ধীরগতির ব্যাটারি রিকশা, অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হয়নি। মহাসড়কের উপর হতে বাজার এবং দোকানপাট বন্ধ করা হয়নি। মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে দেখা যায় অভিযান চালিয়ে মহাসড়কের উপর স্থাপিত দোকান উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু দুয়েকদিন পর অদৃশ্য হস্তক্ষেপে তা আবার নির্মাণ হয়ে যায়।

বর্তমান সময়ে উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ। দেশের আকাশ ছোঁয়া উন্নয়ন বিশে^র নিকট বিস্ময়। অভ্যান্তরীণ শহর, নগর ও মহানগরীতে ট্রাফিক অব্যবস্থায় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিথর দাঁড়িয়ে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রম ও সময়ের অপচয় দেশের বিস্ময়কর উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বর্ণিত বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময়োপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এবং জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্ট করে যদি আধুনিক চিন্তা চেতনায় এবং দেশীয় স্থানীয় পরিবেশ ও অবস্থানকে মাথায় রেখে কাজ করলে অচিরেই দেশ যানজট হতে মুক্তি ও সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।

[লেখক : সম্পাদক, শিল্প শৈলী]

back to top