alt

উপ-সম্পাদকীয়

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

সংগীত কুমার

: মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

অবশেষে নানা নাটকীয়তা পর আগামী মে মাসের ৪ তারিখ থেকে ট্রেনের ভাড়ার ক্ষেত্রে রেয়াতি (ছাড়) ব্যবস্থা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে কোনো যাত্রী ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে ভ্রমণ করলে, তার ভাড়ার ক্ষেত্রে যে রেয়াত বা ছাড় পেয়ে আসছিল, তা আর পাবে না। যদিও এপ্রিলের পহেলা তারিখ থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর করার কথা ছিল, কিন্তু জনগণের অসন্তোষের মুখে পিছু হটে রেলওয়ে। এই নতুন ব্যবস্থায় দূরের গন্তব্যে ট্রেনের ভাড়া সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে ট্রেনের ভাড়া কী হারে বাড়ছে এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করেনি রেল কর্তৃপক্ষ। লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতেই নাকি এমন সিদ্ধান্তÑ বলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু আদৌ একমাত্র ভাড়া বৃদ্ধিই কি ট্রেনের লোকসান কমাতে পারবে?

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন গতির মধ্যে কিছুদিন আগেই বাড়ানো হয়েছে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এবার ট্রেনের যাত্রীরা ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ রেলওয়েতে দূরত্ব ও সেকশনভিত্তিক যে রেয়াতি ভোগ করে আসছিল, সেটাও হারাচ্ছে। ফলে, কোনো যাত্রী ১০০ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করলে, তাকে গুনতে হবে অতিরিক্ত ভাড়া। ১০১ থেকে ১৫০ ভ্রমণে একজন যাত্রীর ২০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি পাবে, ২৫১ থেকে ৪০০ কিলোমিটারে ২৫ শতাংশ এবং ৪০০ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণে ৩০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি পাবে।

২০১২ সালের অক্টোবরে সেকশনভিত্তিক রেয়াত প্রত্যাহার করে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে আরেক দফায় রেলের ভাড়া বাড়ানো হয় ৭ থেকে ৯ শতাংশ। তারপরেও রেলের লোকসান কমানো যাচ্ছে না কেন?

২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ লোকসান ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে রেলকে গুরুত্ব দেয়। সংস্থার উন্নয়নে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। পরিচালনা ব্যয় করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে রেল আয় করেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ১ টাকা আয় করতে রেল ব্যয় করছে ২ টাকা ৭৮ পয়সা। ২০১২ ও ২০১৬ সালে রেলের ভাড়া বাড়ানো হলেও লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। কারণ রেলের ভাড়া বৃদ্ধিই একমাত্র ও সঠিক উপায় নয়। এর জন্য যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে ট্রেন প্রতি আয় বাড়াতে হবে ও ব্যয় হ্রাস করতে হবে। ট্রেনে ভাড়া উত্তোলনে স্বচ্ছতা ও টিকেটের কালোবাজারি কঠোর হাতে বন্ধ করতে হবে।

যাত্রী পরিবহনে ভাড়া ছাড়াও আরও যেসব বিষয়ের ওপর ট্রেন প্রতি আয় নির্ভর করে, তার মধ্যে রয়েছেÑ ট্রেন প্রতি যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা, কোচের যাত্রী ধারণক্ষমতা ও কোচের সিটের কত শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে (অকুপেন্সি রেট), তার হার ইত্যাদি। কোচের সংখ্যা বাড়ালে ট্রেন থেকে আয় বাড়ে কিন্তু খরচ সমানুপাতে বাড়াতে হয় না। কারণ রেলওয়ের অনেক খরচ কোচের সংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, যেমনÑ রেললাইন, ইঞ্জিন, গার্ড, চালক, প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি। ফলে যেসব রুটে ট্রেন জনপ্রিয় এবং কোচগুলো সবসময় যাত্রীবোঝাই হয়ে চলে, সেসব ট্রেন ও ট্রেনের কোচসংখ্যা বাড়ানো হলে আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাংলাদেশে চাহিদা ও জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রুটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রেন ও ট্রেন প্রতি পর্যাপ্ত সংখ্যক কোচ বা বগি সরবরাহ না করার কারণে রেলের আয় বাড়ছে না।

তথ্য প্রযুক্তির যুগে অধিকাংশ যাত্রী এখন অনলাইনে টিকেট কাটেন। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব পেমেন্ট ব্যবস্থা না থাকায় বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়ের মতো কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ রেলওয়েরই অ্যাপ ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকা আয় করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে নিজস্ব পেমেন্ট সেবা চালু করলে এই বিপুল অর্থ অন্য কোম্পানিগুলোর কাছ যেত না।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩ অনুসারে, ২০০৯ থেকে জুন ২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে অর্জিত সাফল্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৪৩টি নতুন ট্রেন চালু, ৮৭৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ, ১৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন পুনর্বাসন/পুনর্র্নিমাণ, ১৪৬টি নতুন স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ, ২৩৭টি স্টেশন বিল্ডিং পুনর্বাসন/পুনর্র্নিমাণ, ১০৩৭টি নতুন সেতু নির্মাণ, ১০৯টি লোকোমোটিভ সংগ্রহ, ৬৫৮টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ, ৫৩০টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন, ৫১৬টি মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ, ২৭৭টি মালবাহী ওয়াগন পুনর্বাসন ইত্যাদি। এসব কাজে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার কতটুকু মৌলিক কাঠামোগত সমস্যা, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নতুন রেললাইন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের পেছনে অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন, কোচ ও লোকবলের ব্যবস্থা না করেই নতুন নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। যার ফলে নতুন নির্মিত লাইনগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রেন চালানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিদ্যমান ট্রেনগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক কোচ দেয়া হচ্ছে না। নানা অজুহাতে গরিবের ট্রেন বলে পরিচিত অনেক লোকাল ও কমিউটার ট্রেন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

একটি সমীক্ষা মোতাবেক, রেলের সব কটি ট্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হলে দরকার ৩ হাজারের বেশি কোচ ও প্রায় ৫০০ ইঞ্জিন। কিন্তু বর্তমানে রেলে কোচ আছে ১ হাজার ৭৮৮টি যার ৪৭ শতাংশেরই অর্থনৈতিক মেয়াদকাল শেষ। অন্যদিকে রেলে বর্তমান সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৯৫টি যার ৬০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। আর মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা ৩ হাজার ২৪৭ যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ।

এই জীর্ণ-পুরনো ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগনগুলোর প্রায় সময় নষ্ট থাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগানো যায় না। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন না থাকার কারণে একটি ইঞ্জিন দিয়েই একাধিক ট্রেন পরিচালনা করা হয়। ফলে পথিমধ্যে ট্রেন ইঞ্জিন বিকল ও শিডিউল বির্পযয় লেগেই থাকে।

শুধু পরিবহনের মাধ্যমে তো আর রেলকে লাভজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন মালামাল পরিবহনে গুরুত্ব প্রদান। মালবাহী ট্রেন যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলানায় বেশি লোড গ্রহণ করলেও উভয়েই একই ড্রাইভার, রেললাইন, সিগন্যাল-ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যবহার করে। ফলে মালবাহী ট্রেন যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি লোড বহন করলেও খরচ যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় দ্বিগুণেও কম হয়। রেলে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের দৈনিক গড় আয় যেখানে তিল লাখ টাকা, সেখানে একটি মালবাহী ট্রেনের গড় আয় সাত-আট লাখ টাকা। কিন্তু প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন ও ওয়াগন সংকটের কারণে বাংলাদেশ মালবাহী ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে পারছে না। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে রেলমন্ত্রীর দেয়া তথ্যানুসারে, দেশে ৩৫০টির বেশি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করলেও মালবাহী ট্রেন মাত্র ২০-২৫টি চলাচল করে, বিধায় রেলের আয় কম হচ্ছে।

রেলওয়ের লোকসানের কারণগুলো দূর না করে শুধু ভাড়া দফায় দফায় বাড়িয়ে কোনো লাফ হবে না। যেমন চৌবাচ্চায় পানি ভর্তি করার অঙ্কের কথা মনে করা যাক। চৌবাচ্চার তলা ফুটো রেখে যতই পানি ঢালা হোক না কেন, চৌবাচ্চা কিন্তু ভরবে না। যা ২০১২ ও ২০১৬ সালের ভাড়া বৃদ্ধির অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার।

তাই শুধু ভাড়া বৃদ্ধির মাধ্যমে নয়, লোকসানের মূল কারণগুলো উদ্ঘাটন এবং সেগুলো সমাধানের পথ বের করার মাধ্যমেই লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হওয়া সম্ভব।

[লেখক: শিক্ষার্থী, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]

তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে

ফের চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন জনসচেতনতা

ছবি

রবীন্দ্রনাথ ও গ্রীষ্মের তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বপ্ন-দুপুর

ছবি

লোকসভা নির্বাচন : কী হচ্ছে, কী হবে

জমির বায়না দলিল কার্যকর কিংবা বাতিলের আইনি প্রক্রিয়া

জনসেবায় পেশাদারিত্ব

খাদ্য কেবল নিরাপদ হলেই হবে না, পুষ্টিকরও হতে হবে

উচ্চশিক্ষাতেও আদিবাসীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে

ছবি

যুদ্ধটা এখনো শেষ হয়নি রনো ভাই

টাকার অবমূল্যায়ন কি জরুরি ছিল

পরিবার : বিশ্বের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান

তাপপ্রবাহে ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি : দীর্ঘমেয়াদে সুফল মিলতে পারে

ছবি

কী আছে ট্রাম্পের ভাগ্যে?

ছবি

বাংলার ‘ভাশুর কথাশিল্পী’ শওকত ওসমান

রাজধানীকে বসবাসযোগ্য করুন

সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়

মুখপাত্রদের তৈরি নয়, ‘তলাপাত্র’দের তৈরি জোট প্রসঙ্গে

চেকের মামলায় সাফাই সাক্ষী বনাম আসামি

ছবি

ডারউইনের খোঁজে নিউইয়র্কের জাদুঘরে

আদিবাসী হত্যার বিচার কোন পথে

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করুন

রম্যগদ্য : গলায় বেঁধা বড়শি

খেলার চেয়ে ‘ধুলা’ বেশি

জেগে উঠুক সুকুমার বৃত্তি

প্রসঙ্গ : লোকসভা নির্বাচন

ছবি

বারবার পুড়ছে বাংলাদেশের ফুসফুস

শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

বিসিএস জ্বরে পুড়ছে তারুণ্য

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

নমিনির অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির গচ্ছিত টাকা পাবে কে

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

যদি শুধু বিনোদন সংস্কৃতি হয় তাহলে বাকি সব কী?

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা

বন্ধ হোক প্রশ্ন ফাঁস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

সংগীত কুমার

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

অবশেষে নানা নাটকীয়তা পর আগামী মে মাসের ৪ তারিখ থেকে ট্রেনের ভাড়ার ক্ষেত্রে রেয়াতি (ছাড়) ব্যবস্থা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে কোনো যাত্রী ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে ভ্রমণ করলে, তার ভাড়ার ক্ষেত্রে যে রেয়াত বা ছাড় পেয়ে আসছিল, তা আর পাবে না। যদিও এপ্রিলের পহেলা তারিখ থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর করার কথা ছিল, কিন্তু জনগণের অসন্তোষের মুখে পিছু হটে রেলওয়ে। এই নতুন ব্যবস্থায় দূরের গন্তব্যে ট্রেনের ভাড়া সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে ট্রেনের ভাড়া কী হারে বাড়ছে এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করেনি রেল কর্তৃপক্ষ। লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতেই নাকি এমন সিদ্ধান্তÑ বলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু আদৌ একমাত্র ভাড়া বৃদ্ধিই কি ট্রেনের লোকসান কমাতে পারবে?

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন গতির মধ্যে কিছুদিন আগেই বাড়ানো হয়েছে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এবার ট্রেনের যাত্রীরা ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ রেলওয়েতে দূরত্ব ও সেকশনভিত্তিক যে রেয়াতি ভোগ করে আসছিল, সেটাও হারাচ্ছে। ফলে, কোনো যাত্রী ১০০ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করলে, তাকে গুনতে হবে অতিরিক্ত ভাড়া। ১০১ থেকে ১৫০ ভ্রমণে একজন যাত্রীর ২০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি পাবে, ২৫১ থেকে ৪০০ কিলোমিটারে ২৫ শতাংশ এবং ৪০০ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণে ৩০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি পাবে।

২০১২ সালের অক্টোবরে সেকশনভিত্তিক রেয়াত প্রত্যাহার করে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে আরেক দফায় রেলের ভাড়া বাড়ানো হয় ৭ থেকে ৯ শতাংশ। তারপরেও রেলের লোকসান কমানো যাচ্ছে না কেন?

২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ লোকসান ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে রেলকে গুরুত্ব দেয়। সংস্থার উন্নয়নে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। পরিচালনা ব্যয় করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে রেল আয় করেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ১ টাকা আয় করতে রেল ব্যয় করছে ২ টাকা ৭৮ পয়সা। ২০১২ ও ২০১৬ সালে রেলের ভাড়া বাড়ানো হলেও লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। কারণ রেলের ভাড়া বৃদ্ধিই একমাত্র ও সঠিক উপায় নয়। এর জন্য যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে ট্রেন প্রতি আয় বাড়াতে হবে ও ব্যয় হ্রাস করতে হবে। ট্রেনে ভাড়া উত্তোলনে স্বচ্ছতা ও টিকেটের কালোবাজারি কঠোর হাতে বন্ধ করতে হবে।

যাত্রী পরিবহনে ভাড়া ছাড়াও আরও যেসব বিষয়ের ওপর ট্রেন প্রতি আয় নির্ভর করে, তার মধ্যে রয়েছেÑ ট্রেন প্রতি যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা, কোচের যাত্রী ধারণক্ষমতা ও কোচের সিটের কত শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে (অকুপেন্সি রেট), তার হার ইত্যাদি। কোচের সংখ্যা বাড়ালে ট্রেন থেকে আয় বাড়ে কিন্তু খরচ সমানুপাতে বাড়াতে হয় না। কারণ রেলওয়ের অনেক খরচ কোচের সংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, যেমনÑ রেললাইন, ইঞ্জিন, গার্ড, চালক, প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি। ফলে যেসব রুটে ট্রেন জনপ্রিয় এবং কোচগুলো সবসময় যাত্রীবোঝাই হয়ে চলে, সেসব ট্রেন ও ট্রেনের কোচসংখ্যা বাড়ানো হলে আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাংলাদেশে চাহিদা ও জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রুটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রেন ও ট্রেন প্রতি পর্যাপ্ত সংখ্যক কোচ বা বগি সরবরাহ না করার কারণে রেলের আয় বাড়ছে না।

তথ্য প্রযুক্তির যুগে অধিকাংশ যাত্রী এখন অনলাইনে টিকেট কাটেন। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব পেমেন্ট ব্যবস্থা না থাকায় বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়ের মতো কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ রেলওয়েরই অ্যাপ ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকা আয় করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে নিজস্ব পেমেন্ট সেবা চালু করলে এই বিপুল অর্থ অন্য কোম্পানিগুলোর কাছ যেত না।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩ অনুসারে, ২০০৯ থেকে জুন ২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে অর্জিত সাফল্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৪৩টি নতুন ট্রেন চালু, ৮৭৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ, ১৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন পুনর্বাসন/পুনর্র্নিমাণ, ১৪৬টি নতুন স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ, ২৩৭টি স্টেশন বিল্ডিং পুনর্বাসন/পুনর্র্নিমাণ, ১০৩৭টি নতুন সেতু নির্মাণ, ১০৯টি লোকোমোটিভ সংগ্রহ, ৬৫৮টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ, ৫৩০টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন, ৫১৬টি মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ, ২৭৭টি মালবাহী ওয়াগন পুনর্বাসন ইত্যাদি। এসব কাজে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার কতটুকু মৌলিক কাঠামোগত সমস্যা, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নতুন রেললাইন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের পেছনে অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন, কোচ ও লোকবলের ব্যবস্থা না করেই নতুন নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। যার ফলে নতুন নির্মিত লাইনগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রেন চালানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিদ্যমান ট্রেনগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক কোচ দেয়া হচ্ছে না। নানা অজুহাতে গরিবের ট্রেন বলে পরিচিত অনেক লোকাল ও কমিউটার ট্রেন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

একটি সমীক্ষা মোতাবেক, রেলের সব কটি ট্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হলে দরকার ৩ হাজারের বেশি কোচ ও প্রায় ৫০০ ইঞ্জিন। কিন্তু বর্তমানে রেলে কোচ আছে ১ হাজার ৭৮৮টি যার ৪৭ শতাংশেরই অর্থনৈতিক মেয়াদকাল শেষ। অন্যদিকে রেলে বর্তমান সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৯৫টি যার ৬০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। আর মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা ৩ হাজার ২৪৭ যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ।

এই জীর্ণ-পুরনো ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগনগুলোর প্রায় সময় নষ্ট থাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগানো যায় না। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন না থাকার কারণে একটি ইঞ্জিন দিয়েই একাধিক ট্রেন পরিচালনা করা হয়। ফলে পথিমধ্যে ট্রেন ইঞ্জিন বিকল ও শিডিউল বির্পযয় লেগেই থাকে।

শুধু পরিবহনের মাধ্যমে তো আর রেলকে লাভজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন মালামাল পরিবহনে গুরুত্ব প্রদান। মালবাহী ট্রেন যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলানায় বেশি লোড গ্রহণ করলেও উভয়েই একই ড্রাইভার, রেললাইন, সিগন্যাল-ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যবহার করে। ফলে মালবাহী ট্রেন যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি লোড বহন করলেও খরচ যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় দ্বিগুণেও কম হয়। রেলে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের দৈনিক গড় আয় যেখানে তিল লাখ টাকা, সেখানে একটি মালবাহী ট্রেনের গড় আয় সাত-আট লাখ টাকা। কিন্তু প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন ও ওয়াগন সংকটের কারণে বাংলাদেশ মালবাহী ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে পারছে না। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে রেলমন্ত্রীর দেয়া তথ্যানুসারে, দেশে ৩৫০টির বেশি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করলেও মালবাহী ট্রেন মাত্র ২০-২৫টি চলাচল করে, বিধায় রেলের আয় কম হচ্ছে।

রেলওয়ের লোকসানের কারণগুলো দূর না করে শুধু ভাড়া দফায় দফায় বাড়িয়ে কোনো লাফ হবে না। যেমন চৌবাচ্চায় পানি ভর্তি করার অঙ্কের কথা মনে করা যাক। চৌবাচ্চার তলা ফুটো রেখে যতই পানি ঢালা হোক না কেন, চৌবাচ্চা কিন্তু ভরবে না। যা ২০১২ ও ২০১৬ সালের ভাড়া বৃদ্ধির অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার।

তাই শুধু ভাড়া বৃদ্ধির মাধ্যমে নয়, লোকসানের মূল কারণগুলো উদ্ঘাটন এবং সেগুলো সমাধানের পথ বের করার মাধ্যমেই লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হওয়া সম্ভব।

[লেখক: শিক্ষার্থী, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top