রেজাউল করিম খোকন
আগামী অর্থবছরের বাজেট আসছে। এখন চলছে বাজেট প্রণয়নের চূড়ান্ত কাজ। আগামী বাজেট নিয়ে এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নানা গুঞ্জন। সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। টানা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেট নিয়ে আলোচনা, আগ্রহ, সবার কৌতূহল থাকাটা স্বাভাবিক। নানা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গত বেশ কয়েকটি বছর পার করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার মুখ থুবড়ে পড়েনি। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন অনেকেই। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, চরম বিপর্যয় নেমে আসবে, অভাব-দুর্ভিক্ষ-মন্দা গ্রাস করবে বাংলাদেশকে। এমন অনেক আশঙ্কার পর শেষ পর্যন্ত তেমন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেনি। এটাই আমাদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে।
এখনও আমাদের অর্থনীতি দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। নানা ধরনের আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা রয়েছে। তারপরও আমরা আশাবাদী। আগামী দিনগুলোতে আমাদের অর্থনীতি কোন দিকে এগোবে, তেমন কিছু চিন্তা ভাবনার আলোকে আলোচনা করতে গেলে বলা যায়, অর্থনীতির অস্থিরতা দৃশ্যত কিছুটা কমলেও শঙ্কা কাটেনি। ডলারে দামের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা আপাতত ঠেকানো গেছে। রিজার্ভের পতন কিছুটা সামাল দেয়া গেছে। আলোচিত ব্যাংক খাতের সমস্যাকে স্বীকার করে দেরিতে হলেও সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে ভালো ব্যাংককে বাধ্য করা হচ্ছে।
তবে খেলাপি ঋণ, স্বজনপ্রীতি, ব্যাংকমালিকদের অযাচিত হস্তক্ষেপÑ ব্যাংকের এ ধরনের চিরায়ত সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি এখনো সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরে আছে; যা সাধারণ মানুষকে ভোগাচ্ছে। শীঘ্রই কমবে, সেই আশাও কম। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। ডলার আসার অন্যতম প্রধান দুটি উৎস নিয়ে স্বস্তি আসেনি। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমশ বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত নয়; তবে সংকট থেকে উত্তরণ অর্থনীতিতে সংকট কেটে গেছে, তা বলা ভুল হবে। সংকট কাটার নির্ভরযোগ্য প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে না। কয়েক মাস আগেও নীতিনির্ধারকেরা সংকটকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে যেন একধরনের তুষ্টি ফিরে এসেছে। সংকট থাকা অবস্থায় যদি তারা বলেন, সংকট নেইÑ এটাই তো বড় সংকট। রপ্তানি আয় ছাড়া অন্য কোনো সূচকে সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রবাসী আয় বাড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তাই আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ার মতো অবস্থাও নেই।
ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কমছে না। ব্যাংক খাতের সমস্যার কথা স্বীকার করে গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক পথনকশা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে চুক্তি করেছে। এছাড়া কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল এই চারটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংক এই ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংস্থাটি বলছে, ব্যাংক একীভূত করায় সতর্ক থাকতে হবে। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত।
এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, ভালো ব্যাংক কখনো বাড়তি দায় নেয় না। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের অন্য সমস্যা, যেমন স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম, ব্যাংক পর্ষদে পরিবারের আধিপত্য, খেলাপি ঋণÑ এসব কমানোর দৃশ্যমান বড় কোনো উদ্যোগ নেই। খেলাপি ঋণ ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। গত ডিসেম্বর মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশের মতো। ব্যাংক খাতে কিছুটা স্বস্তির বিষয়ও আছে। যেমন ‘নয়-ছয় পদ্ধতি’ বাতিল করে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সুদহার উন্মুক্ত করা হয়েছে। দেড় বছর ধরে ডলারের বাজার বেশ অস্থির ছিল। ৮৬ টাকার ডলার ১১০ টাকা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক দরও কিছুটা কমেছে। এখন ১১৭-১১৮ টাকার মধ্যে আছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে এত মূল্যস্ফীতি আগে দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাও শিগগিরই মূল্যস্ফীতির কমার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছে। নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়ার পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে, কিন্তু আমরা পারছি না। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। কারণ, এ দেশের উৎপাদন খাতের প্রাথমিক ও কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। সেখানে খরচ বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ধরে রাখাসহ নানা কারণে রিজার্ভের বড় পতন আপাতত ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। ২০২৩ সালের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৪০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ নিয়ে। এই হিসাব অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গতানুগতিক হিসাব পদ্ধতি। তখন রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি ছিল না। পরের এক বছরে রিজার্ভ শুধু কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছিল ডিসেম্বর মাসে। আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাব পদ্ধতি অনুসারে ৭ ডিসেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯১৩ কোটি ডলার। পরে তিন মাস রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলারের আশপাশেই ছিল। সর্বশেষ ২৮ মার্চ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ডলার।
মূলত ডলার-সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিÑ এসব কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে। কিন্তু আমদানি খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের জোগান বাড়েনি। ফলে ক্ষয় হতে থাকে রিজার্ভের মজুত। তবে তিন মাস ধরে রিজার্ভের বড় ধরনের পতন হয়নি। রিজার্ভও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। কয়েক মাস ধরে ১৯-২০ বিলিয়ন ডলারে আটকে আছে রিজার্ভ। ব্যাংক খাতও নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় কিছুটা ভালো।
মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে আগামী বাজেটে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার তদারকি বাড়াতে হবে। আবার খেলাপি ঋণ কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, খেলাপি ঋণ ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে ফেলে। সার্বিকভাবে মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। চাপ কিছু কমলেও অর্থনীতি উত্তরণের পর্যায়ে যায়নি। জুনে যেমন নতুন বাজেট দেবেন নতুন অর্থমন্ত্রী, তেমনি নতুন মুদ্রানীতির ঘোষণা দিতে হবে গভর্নরকেও। দুই নীতির সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ, সাধারণ মানুষ বাজারে স্বস্তি চায়। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্তÑ সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার।
বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার। সব মিলিয়ে দেশের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের জন্য সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপরেই নির্ভর করছে ইতিহাসে কার স্থান কোথায় হবে। কে ভালো কে খারাপ, তারও ফয়সালা হবে। অন্তত বিশ্বের অন্যান্য দেশেই অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরকে এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়। আমরাও এভাবে মূল্যায়ন করতে চাই। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্তÑ সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
আগামী অর্থবছরের বাজেট আসছে। এখন চলছে বাজেট প্রণয়নের চূড়ান্ত কাজ। আগামী বাজেট নিয়ে এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নানা গুঞ্জন। সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। টানা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেট নিয়ে আলোচনা, আগ্রহ, সবার কৌতূহল থাকাটা স্বাভাবিক। নানা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গত বেশ কয়েকটি বছর পার করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার মুখ থুবড়ে পড়েনি। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন অনেকেই। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, চরম বিপর্যয় নেমে আসবে, অভাব-দুর্ভিক্ষ-মন্দা গ্রাস করবে বাংলাদেশকে। এমন অনেক আশঙ্কার পর শেষ পর্যন্ত তেমন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেনি। এটাই আমাদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে।
এখনও আমাদের অর্থনীতি দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। নানা ধরনের আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা রয়েছে। তারপরও আমরা আশাবাদী। আগামী দিনগুলোতে আমাদের অর্থনীতি কোন দিকে এগোবে, তেমন কিছু চিন্তা ভাবনার আলোকে আলোচনা করতে গেলে বলা যায়, অর্থনীতির অস্থিরতা দৃশ্যত কিছুটা কমলেও শঙ্কা কাটেনি। ডলারে দামের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা আপাতত ঠেকানো গেছে। রিজার্ভের পতন কিছুটা সামাল দেয়া গেছে। আলোচিত ব্যাংক খাতের সমস্যাকে স্বীকার করে দেরিতে হলেও সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে ভালো ব্যাংককে বাধ্য করা হচ্ছে।
তবে খেলাপি ঋণ, স্বজনপ্রীতি, ব্যাংকমালিকদের অযাচিত হস্তক্ষেপÑ ব্যাংকের এ ধরনের চিরায়ত সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি এখনো সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরে আছে; যা সাধারণ মানুষকে ভোগাচ্ছে। শীঘ্রই কমবে, সেই আশাও কম। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। ডলার আসার অন্যতম প্রধান দুটি উৎস নিয়ে স্বস্তি আসেনি। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমশ বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত নয়; তবে সংকট থেকে উত্তরণ অর্থনীতিতে সংকট কেটে গেছে, তা বলা ভুল হবে। সংকট কাটার নির্ভরযোগ্য প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে না। কয়েক মাস আগেও নীতিনির্ধারকেরা সংকটকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে যেন একধরনের তুষ্টি ফিরে এসেছে। সংকট থাকা অবস্থায় যদি তারা বলেন, সংকট নেইÑ এটাই তো বড় সংকট। রপ্তানি আয় ছাড়া অন্য কোনো সূচকে সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রবাসী আয় বাড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তাই আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ার মতো অবস্থাও নেই।
ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কমছে না। ব্যাংক খাতের সমস্যার কথা স্বীকার করে গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক পথনকশা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে চুক্তি করেছে। এছাড়া কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল এই চারটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংক এই ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংস্থাটি বলছে, ব্যাংক একীভূত করায় সতর্ক থাকতে হবে। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত।
এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, ভালো ব্যাংক কখনো বাড়তি দায় নেয় না। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের অন্য সমস্যা, যেমন স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম, ব্যাংক পর্ষদে পরিবারের আধিপত্য, খেলাপি ঋণÑ এসব কমানোর দৃশ্যমান বড় কোনো উদ্যোগ নেই। খেলাপি ঋণ ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। গত ডিসেম্বর মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশের মতো। ব্যাংক খাতে কিছুটা স্বস্তির বিষয়ও আছে। যেমন ‘নয়-ছয় পদ্ধতি’ বাতিল করে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সুদহার উন্মুক্ত করা হয়েছে। দেড় বছর ধরে ডলারের বাজার বেশ অস্থির ছিল। ৮৬ টাকার ডলার ১১০ টাকা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক দরও কিছুটা কমেছে। এখন ১১৭-১১৮ টাকার মধ্যে আছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে এত মূল্যস্ফীতি আগে দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাও শিগগিরই মূল্যস্ফীতির কমার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছে। নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়ার পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে, কিন্তু আমরা পারছি না। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। কারণ, এ দেশের উৎপাদন খাতের প্রাথমিক ও কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। সেখানে খরচ বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ধরে রাখাসহ নানা কারণে রিজার্ভের বড় পতন আপাতত ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। ২০২৩ সালের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৪০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ নিয়ে। এই হিসাব অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গতানুগতিক হিসাব পদ্ধতি। তখন রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি ছিল না। পরের এক বছরে রিজার্ভ শুধু কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছিল ডিসেম্বর মাসে। আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাব পদ্ধতি অনুসারে ৭ ডিসেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯১৩ কোটি ডলার। পরে তিন মাস রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলারের আশপাশেই ছিল। সর্বশেষ ২৮ মার্চ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ডলার।
মূলত ডলার-সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিÑ এসব কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে। কিন্তু আমদানি খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের জোগান বাড়েনি। ফলে ক্ষয় হতে থাকে রিজার্ভের মজুত। তবে তিন মাস ধরে রিজার্ভের বড় ধরনের পতন হয়নি। রিজার্ভও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। কয়েক মাস ধরে ১৯-২০ বিলিয়ন ডলারে আটকে আছে রিজার্ভ। ব্যাংক খাতও নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় কিছুটা ভালো।
মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে আগামী বাজেটে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার তদারকি বাড়াতে হবে। আবার খেলাপি ঋণ কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, খেলাপি ঋণ ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে ফেলে। সার্বিকভাবে মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। চাপ কিছু কমলেও অর্থনীতি উত্তরণের পর্যায়ে যায়নি। জুনে যেমন নতুন বাজেট দেবেন নতুন অর্থমন্ত্রী, তেমনি নতুন মুদ্রানীতির ঘোষণা দিতে হবে গভর্নরকেও। দুই নীতির সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ, সাধারণ মানুষ বাজারে স্বস্তি চায়। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্তÑ সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার।
বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার। সব মিলিয়ে দেশের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের জন্য সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপরেই নির্ভর করছে ইতিহাসে কার স্থান কোথায় হবে। কে ভালো কে খারাপ, তারও ফয়সালা হবে। অন্তত বিশ্বের অন্যান্য দেশেই অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরকে এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়। আমরাও এভাবে মূল্যায়ন করতে চাই। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্তÑ সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]