alt

উপ-সম্পাদকীয়

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০৪ মে ২০২৪

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলায় ১১ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এলিট ফোর্স কুদসের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং তার সহযোগী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রহিমিও রয়েছেন। সিরিয়ায় আমেরিকা ও রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি থাকলেও ইরান তাদের সামরিক ঘাঁটি থাকার কথা অস্বীকার করেছে, তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনীকে পরামর্শ দেয়ার জন্য ইরানের যে কয়েকজন সেনা পাঠানো হয়েছিল তারা এখনও আছে।

আমেরিকা এবং ইসরায়েলের অভিযোগ হচ্ছে এই সব সামরিক উপদেষ্টা ইরানসমর্থিত সিরিয়ার সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং তারাই সিরিয়া থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করে থাকে। তাই আমেরিকা এবং ইসরায়েল নিয়মিত সিরিয়ার অভ্যন্তরে শিয়া মিলিশিয়াদের ওপর বিমান হামলা চালায়। এবার ইসরায়েল শিয়া মিলিশিয়াদের ওপর নয়, খোদ ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের ওপর বোমা ফেলেছে।

ইসরায়েল মনে করে সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেট ভবনটি কূটনৈতিক কনভেনশন দ্বারা পরিচালিত হয়নি, কারণ ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ডের সদস্যরা সেটিকে একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেছিল। ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু আমেরিকা বা তাদের মিত্ররা এই হামলার নিন্দা করেনি। ইরান ব্যতীত অন্য কোন দেশের দূতাবাসে এভাবে বোমা মেরে কূটনীতিকদের মেরে ফেলার নজির আমার জানামতে আর নেই। ১৯৭৯ সনে ইরান ইসলামি বিপ্লবীদের দখলে চলে গেলে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি মিশরে পালিয়ে যান; তাকে ফেরত দেয়ার দাবি তুলে ইরানি বিপ্লবীরা ইরানে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস দখল করে ৫২ জন কূটনীতিককে ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রেখেছিল; কিন্তু দূতাবাসে আক্রমণ করেনি।

ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী দূতাবাসে আক্রমণ করা যায় না, কারণ কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দূতাবাস এবং কূটনীতিকরা এত বেশি অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে যে, হোস্ট কান্ট্রির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিনা অনুমতিতে দূতাবাসে প্রবেশ করতেও পারে না, কোন অপরাধের জন্য কোন কূটনীতিককে গ্রেপ্তার বা তাদের বিচার করাও যায় না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের গোপন তথ্য ফাঁসকারী উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ ২০১২ সনে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়ে ২০১৯ সন পর্যন্ত দূতাবাসের ভেতর নির্বিঘেœ বসবাস করেন, ইকুয়েডর দূতাবাসে অবস্থানকালীন তার দুটি সন্তানেরও জন্ম হয়।

সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরানি দূতাবাসকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল সিরিয়ার; কিন্তু আইএস-এর আক্রমণ ও দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে সিরিয়া একেবারেই বিধ্বস্ত, রাশিয়া সমর্থন না করলে বিদ্রোহীদের হাতে বাশার আল আসাদ সরকারের পতন নিশ্চিত ছিল।আমেরিকা বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার শক্তি না থাকায় সিরিয়া নিশ্চুপ থাকে। সিরিয়া একেবারেই ক্লান্ত, কয়েকবার ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরেছে। ইসরায়েল ১৯৬৭ সন থেকে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে রেখেছে; শুধু দখল করে রাখেনি, ১৯৮১ সনে ইসরায়েল গোলানকে নিজের অংশ করে নিয়েছে, আর গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে এক ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কত বড় অরাজকতা। নীরবে সহ্য করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

আমেরিকা এবং ইউরোপ যতদিন ইসরায়েলকে শর্তহীন সমর্থন দিয়ে যাবে ততদিন মধ্যপ্রাচ্যে এই অরাজকতা থাকবে। শুধু ইসরায়েল বা আমেরিকাকে দোষারোপ করা হলে অর্ধেক সত্য বলা হয়, পুরো সত্য হচ্ছে কুর্দি দমানোর নামে তুরস্কও সিরিয়ার অভ্যন্তরে প্রায়ই আক্রমণ করে। ইরান থেকে ইসরায়েলের নিকটতম দূরত্ব ১০০০ কিলোমিটার। ইরান ইদানীং নিজেকে কিছুটা শক্তিশালী ভাবছে, তাই ঘোষণা দিয়েই তারা ইসরায়েলের ওপর তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। কিন্তু ইসরায়েলের মাটিতে পড়েছে নিক্ষিপ্ত বোমা-ড্রোনের মাত্র এক শতাংশ। বাকি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

এই ধ্বংসের কাজ ইসরায়েল একা করেনি, করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স; মুসলিম দেশ জর্ডানও ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে গর্ব বোধ করছে। এখন শোনা যাচ্ছে, সৌদি আরবও ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করেছে। তাই ইসরায়েলের বন্ধু শুধু আমেরিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও। ইরাক আক্রমণ করার সময় আমেরিকা সৌদি আরবের ভূমি ব্যবহার করেছিল, মিশরের অপ্সরীরা আমেরিকান সেনাদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ছিল। আফগানিস্তান আক্রমণে পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করেছে আমেরিকা। লিবিয়া আক্রমণেও আরব ভূমি ব্যবহৃত হয়েছে। ইসরায়েলও ইরানের ইস্পাহান শহরে মিসাইল ছুড়েছে, তবে ইরানের মতো এত বেশি নয়।

ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ইস্পাহানের দূরত্ব সাড়ে তিনশ কিলোমিটার, এই শহর ও তার আশপাশের এলাকায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। ইস্পাহান শহরে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ইরানকে বুঝিয়ে দিল যে, তারাও ইরানের সংবেদনশীল গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে, বাড়াবাড়ি করলে পরের বারের হামলা হবে ভয়াবহ।

ইসরায়েল যে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সফল হয়েছে তা অনেকটা প্রমাণিত। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েল অনেক বেশি ক্ষমতাবান, এই ক্ষেত্রে ইরানকে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে সামরিক খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েও লাভ নেই, কারণ আমেরিকা ঘোষণা দিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে ইরানকে জিততে দেয়া হবে না। গাজা যুদ্ধে আমেরিকার দূতিয়ালিতে মুসলিম দেশগুলো নীরবতা পালন করছে, ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যুও তাদের নীরবতা ভাঙতে পারেনি। ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বলেছিলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়।’

ইরান আর গোলা ছুড়বে বলে মনে হয় না, কারণ পরিপূর্ণ যুদ্ধ হলে ইরান তার পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষা করতে পারবে না। ইসরায়েল ও ইরান বছরের পর বছর ধরে রক্তক্ষয়ী ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি, সিরিয়া ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া মাঝে মাঝে ইসরায়েলের ওপর রকেট হামলা চালায়। এছাড়া ১৯৯২ সনে ইরানের ঘনিষ্ঠ একটি ইসলামিক জিহাদি দল বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাস উড়িয়ে দেয়; এতে ২৯ জন নিহত হয়। ইসরায়েলও এদের ওপর বিমান হামলা করেই যাচ্ছে।

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের কয়েকজন বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে, ইরান টেরও পায়নি। কিছুদিন আগে হিজবুল্লাহ নেতা আব্বাস আল-মুসাভিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলে ইরানের বোমা নিক্ষেপকে পশ্চিমা বিশ্ব আগ্রাসি তৎপরতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং এজন্য ইরানের ওপর আরও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসছে। অন্যদিকে ইরানের উপর দুইবারের আক্রমণকে পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে উল্লেখ করেছে; বিশ্বের মেরূকরণ স্পষ্টতই ইসরায়েলের পক্ষে।

ইরানের কাছে ইসরায়েল হলো ‘ছোট শয়তান’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ‘বড় শয়তান’। বিগত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর নানামুখী নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের কবলে পড়ে ইরান কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তারপরও এই মুহূর্তে ইরান এবং ইসরায়েলের যুদ্ধ চায় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; কারণ করোনা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থিরতা এখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে আকাশ এবং সমুদ্রপথ কিছুটা হলেও বন্ধ হয়ে যাবে। যুদ্ধ শুরু হলে যাত্রীবাহী ও কার্গো বিমানকে নিক্ষিপ্ত গোলা এড়িয়ে চলাচল করতে হবে, বেড়ে যাবে পরিবহন খরচ। ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিলে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা স্থবির হয়ে যাবে। জ্বালানি তেলের দাম আবার দ্বিগুণ হয়ে যাবে, বিশ্ব অর্থনীতিতে পুনরায় স্থবিরতা নেমে আসবে, মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে থাকবে। রাগ হলে হুমায়ূন আহমেদ তার নাটকের চরিত্রগুলোকে গ্লাস বা কিছু একটা ধ্বংস করতে বলতেন। ইরান এবং ইসরায়েলও একই আচরণ করেছে, বোমা বর্ষণ করে নিজেদের রাগ থামিয়েছে। তাই দুই পক্ষের হামলা যতটা না শত্রুপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য, তার চেয়ে বেশি মুখ রক্ষার জন্য, একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করার ইচ্ছে কারোই নেই।

ইসরায়েল তার প্রতিশোধ পর্ব নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করছে না। হামলার আগে দুটি দেশই প্রতিবেশী দেশসহ আমেরিকাকে এই মর্মে অবহিত রেখেছিল যে, হামলা হবে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত, হামলার পর দ্বিতীয়বার তারা আর বোমা নিক্ষেপ করবে না। আমেরিকাও উভয় দেশকে আক্রমণের সম্মতি দিয়েছিল। তারপরও যাত্রার কুশলীবদের মতো হাত-পা ছুড়ে স্ব স্ব দেশের জনগণকে তুষ্ট রাখতে শীর্ষ নেতাকে বলতে হচ্ছে, ‘নেহি ছোড়েঙ্গে’। কিন্তু খেলা শেষ, অন্তত এবারের মতো। এটাই রাজনীতি। মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতÑ তার অবসান জরুরি।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল]

পরিবার : বিশ্বের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান

তাপপ্রবাহে ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি : দীর্ঘমেয়াদে সুফল মিলতে পারে

ছবি

কী আছে ট্রাম্পের ভাগ্যে?

ছবি

বাংলার ‘ভাশুর কথাশিল্পী’ শওকত ওসমান

রাজধানীকে বসবাসযোগ্য করুন

সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়

মুখপাত্রদের তৈরি নয়, ‘তলাপাত্র’দের তৈরি জোট প্রসঙ্গে

চেকের মামলায় সাফাই সাক্ষী বনাম আসামি

ছবি

ডারউইনের খোঁজে নিউইয়র্কের জাদুঘরে

আদিবাসী হত্যার বিচার কোন পথে

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করুন

রম্যগদ্য : গলায় বেঁধা বড়শি

খেলার চেয়ে ‘ধুলা’ বেশি

জেগে উঠুক সুকুমার বৃত্তি

প্রসঙ্গ : লোকসভা নির্বাচন

ছবি

বারবার পুড়ছে বাংলাদেশের ফুসফুস

শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

বিসিএস জ্বরে পুড়ছে তারুণ্য

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

নমিনির অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির গচ্ছিত টাকা পাবে কে

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

যদি শুধু বিনোদন সংস্কৃতি হয় তাহলে বাকি সব কী?

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা

বন্ধ হোক প্রশ্ন ফাঁস

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ০৪ মে ২০২৪

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলায় ১১ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এলিট ফোর্স কুদসের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং তার সহযোগী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রহিমিও রয়েছেন। সিরিয়ায় আমেরিকা ও রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি থাকলেও ইরান তাদের সামরিক ঘাঁটি থাকার কথা অস্বীকার করেছে, তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনীকে পরামর্শ দেয়ার জন্য ইরানের যে কয়েকজন সেনা পাঠানো হয়েছিল তারা এখনও আছে।

আমেরিকা এবং ইসরায়েলের অভিযোগ হচ্ছে এই সব সামরিক উপদেষ্টা ইরানসমর্থিত সিরিয়ার সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং তারাই সিরিয়া থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করে থাকে। তাই আমেরিকা এবং ইসরায়েল নিয়মিত সিরিয়ার অভ্যন্তরে শিয়া মিলিশিয়াদের ওপর বিমান হামলা চালায়। এবার ইসরায়েল শিয়া মিলিশিয়াদের ওপর নয়, খোদ ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের ওপর বোমা ফেলেছে।

ইসরায়েল মনে করে সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেট ভবনটি কূটনৈতিক কনভেনশন দ্বারা পরিচালিত হয়নি, কারণ ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ডের সদস্যরা সেটিকে একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেছিল। ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু আমেরিকা বা তাদের মিত্ররা এই হামলার নিন্দা করেনি। ইরান ব্যতীত অন্য কোন দেশের দূতাবাসে এভাবে বোমা মেরে কূটনীতিকদের মেরে ফেলার নজির আমার জানামতে আর নেই। ১৯৭৯ সনে ইরান ইসলামি বিপ্লবীদের দখলে চলে গেলে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি মিশরে পালিয়ে যান; তাকে ফেরত দেয়ার দাবি তুলে ইরানি বিপ্লবীরা ইরানে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস দখল করে ৫২ জন কূটনীতিককে ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রেখেছিল; কিন্তু দূতাবাসে আক্রমণ করেনি।

ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী দূতাবাসে আক্রমণ করা যায় না, কারণ কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দূতাবাস এবং কূটনীতিকরা এত বেশি অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে যে, হোস্ট কান্ট্রির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিনা অনুমতিতে দূতাবাসে প্রবেশ করতেও পারে না, কোন অপরাধের জন্য কোন কূটনীতিককে গ্রেপ্তার বা তাদের বিচার করাও যায় না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের গোপন তথ্য ফাঁসকারী উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ ২০১২ সনে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়ে ২০১৯ সন পর্যন্ত দূতাবাসের ভেতর নির্বিঘেœ বসবাস করেন, ইকুয়েডর দূতাবাসে অবস্থানকালীন তার দুটি সন্তানেরও জন্ম হয়।

সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরানি দূতাবাসকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল সিরিয়ার; কিন্তু আইএস-এর আক্রমণ ও দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে সিরিয়া একেবারেই বিধ্বস্ত, রাশিয়া সমর্থন না করলে বিদ্রোহীদের হাতে বাশার আল আসাদ সরকারের পতন নিশ্চিত ছিল।আমেরিকা বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার শক্তি না থাকায় সিরিয়া নিশ্চুপ থাকে। সিরিয়া একেবারেই ক্লান্ত, কয়েকবার ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরেছে। ইসরায়েল ১৯৬৭ সন থেকে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে রেখেছে; শুধু দখল করে রাখেনি, ১৯৮১ সনে ইসরায়েল গোলানকে নিজের অংশ করে নিয়েছে, আর গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে এক ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কত বড় অরাজকতা। নীরবে সহ্য করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

আমেরিকা এবং ইউরোপ যতদিন ইসরায়েলকে শর্তহীন সমর্থন দিয়ে যাবে ততদিন মধ্যপ্রাচ্যে এই অরাজকতা থাকবে। শুধু ইসরায়েল বা আমেরিকাকে দোষারোপ করা হলে অর্ধেক সত্য বলা হয়, পুরো সত্য হচ্ছে কুর্দি দমানোর নামে তুরস্কও সিরিয়ার অভ্যন্তরে প্রায়ই আক্রমণ করে। ইরান থেকে ইসরায়েলের নিকটতম দূরত্ব ১০০০ কিলোমিটার। ইরান ইদানীং নিজেকে কিছুটা শক্তিশালী ভাবছে, তাই ঘোষণা দিয়েই তারা ইসরায়েলের ওপর তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। কিন্তু ইসরায়েলের মাটিতে পড়েছে নিক্ষিপ্ত বোমা-ড্রোনের মাত্র এক শতাংশ। বাকি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

এই ধ্বংসের কাজ ইসরায়েল একা করেনি, করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স; মুসলিম দেশ জর্ডানও ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে গর্ব বোধ করছে। এখন শোনা যাচ্ছে, সৌদি আরবও ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করেছে। তাই ইসরায়েলের বন্ধু শুধু আমেরিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও। ইরাক আক্রমণ করার সময় আমেরিকা সৌদি আরবের ভূমি ব্যবহার করেছিল, মিশরের অপ্সরীরা আমেরিকান সেনাদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ছিল। আফগানিস্তান আক্রমণে পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করেছে আমেরিকা। লিবিয়া আক্রমণেও আরব ভূমি ব্যবহৃত হয়েছে। ইসরায়েলও ইরানের ইস্পাহান শহরে মিসাইল ছুড়েছে, তবে ইরানের মতো এত বেশি নয়।

ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ইস্পাহানের দূরত্ব সাড়ে তিনশ কিলোমিটার, এই শহর ও তার আশপাশের এলাকায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। ইস্পাহান শহরে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ইরানকে বুঝিয়ে দিল যে, তারাও ইরানের সংবেদনশীল গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে, বাড়াবাড়ি করলে পরের বারের হামলা হবে ভয়াবহ।

ইসরায়েল যে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সফল হয়েছে তা অনেকটা প্রমাণিত। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েল অনেক বেশি ক্ষমতাবান, এই ক্ষেত্রে ইরানকে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে সামরিক খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েও লাভ নেই, কারণ আমেরিকা ঘোষণা দিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে ইরানকে জিততে দেয়া হবে না। গাজা যুদ্ধে আমেরিকার দূতিয়ালিতে মুসলিম দেশগুলো নীরবতা পালন করছে, ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যুও তাদের নীরবতা ভাঙতে পারেনি। ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বলেছিলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়।’

ইরান আর গোলা ছুড়বে বলে মনে হয় না, কারণ পরিপূর্ণ যুদ্ধ হলে ইরান তার পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষা করতে পারবে না। ইসরায়েল ও ইরান বছরের পর বছর ধরে রক্তক্ষয়ী ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি, সিরিয়া ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া মাঝে মাঝে ইসরায়েলের ওপর রকেট হামলা চালায়। এছাড়া ১৯৯২ সনে ইরানের ঘনিষ্ঠ একটি ইসলামিক জিহাদি দল বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাস উড়িয়ে দেয়; এতে ২৯ জন নিহত হয়। ইসরায়েলও এদের ওপর বিমান হামলা করেই যাচ্ছে।

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের কয়েকজন বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে, ইরান টেরও পায়নি। কিছুদিন আগে হিজবুল্লাহ নেতা আব্বাস আল-মুসাভিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলে ইরানের বোমা নিক্ষেপকে পশ্চিমা বিশ্ব আগ্রাসি তৎপরতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং এজন্য ইরানের ওপর আরও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসছে। অন্যদিকে ইরানের উপর দুইবারের আক্রমণকে পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে উল্লেখ করেছে; বিশ্বের মেরূকরণ স্পষ্টতই ইসরায়েলের পক্ষে।

ইরানের কাছে ইসরায়েল হলো ‘ছোট শয়তান’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ‘বড় শয়তান’। বিগত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর নানামুখী নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের কবলে পড়ে ইরান কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তারপরও এই মুহূর্তে ইরান এবং ইসরায়েলের যুদ্ধ চায় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; কারণ করোনা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থিরতা এখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে আকাশ এবং সমুদ্রপথ কিছুটা হলেও বন্ধ হয়ে যাবে। যুদ্ধ শুরু হলে যাত্রীবাহী ও কার্গো বিমানকে নিক্ষিপ্ত গোলা এড়িয়ে চলাচল করতে হবে, বেড়ে যাবে পরিবহন খরচ। ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিলে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা স্থবির হয়ে যাবে। জ্বালানি তেলের দাম আবার দ্বিগুণ হয়ে যাবে, বিশ্ব অর্থনীতিতে পুনরায় স্থবিরতা নেমে আসবে, মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে থাকবে। রাগ হলে হুমায়ূন আহমেদ তার নাটকের চরিত্রগুলোকে গ্লাস বা কিছু একটা ধ্বংস করতে বলতেন। ইরান এবং ইসরায়েলও একই আচরণ করেছে, বোমা বর্ষণ করে নিজেদের রাগ থামিয়েছে। তাই দুই পক্ষের হামলা যতটা না শত্রুপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য, তার চেয়ে বেশি মুখ রক্ষার জন্য, একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করার ইচ্ছে কারোই নেই।

ইসরায়েল তার প্রতিশোধ পর্ব নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করছে না। হামলার আগে দুটি দেশই প্রতিবেশী দেশসহ আমেরিকাকে এই মর্মে অবহিত রেখেছিল যে, হামলা হবে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত, হামলার পর দ্বিতীয়বার তারা আর বোমা নিক্ষেপ করবে না। আমেরিকাও উভয় দেশকে আক্রমণের সম্মতি দিয়েছিল। তারপরও যাত্রার কুশলীবদের মতো হাত-পা ছুড়ে স্ব স্ব দেশের জনগণকে তুষ্ট রাখতে শীর্ষ নেতাকে বলতে হচ্ছে, ‘নেহি ছোড়েঙ্গে’। কিন্তু খেলা শেষ, অন্তত এবারের মতো। এটাই রাজনীতি। মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতÑ তার অবসান জরুরি।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top