মো. নূরুল আমিন
২০০৬ সালে আমি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি প্রশিক্ষণে নেপালে গিয়েছিলাম। প্রশিক্ষণ ক্লাসে একজন বক্তা বলেন, বাংলাদেশ ২০০৫ সালে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে; অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৫ বার টি আই এর তালিকায় দুর্নীতির শীর্ষে বাংলাদেশ। তখন মনে হয়েছে, যে দেশ ৫ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, সে দেশে আমি সৎ কর্মকর্তা দাবি করি কীভাবে? এ যে বড় লজ্জার।
আবার ২০১৯ সালে আমেরিকায় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম প্রশিক্ষণে। সে প্রশিক্ষণে আলোচনায় চিহ্নিত হয় যে, প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ দুর্নীতি। আলোচক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ১০টি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ প্রকাশ করতে বলেন। ভয়ই পেয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু দেখা গেল বাংলাদেশের নাম ১০ নম্বরের মধ্যে নেই। যেন ইজ্জত রক্ষা পেল। অর্থাৎ দুর্নীতি কমবেশি সবাইকে নাড়া দেয় এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার বিষয়টি সবাইকে স্পর্শ করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, দেশে আসার পর থেকে তিনি যে সবাই স্থানে বক্তব্য রেখেছেন, সবখানেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরে কঠোরভাবে বক্তব্য রেখেছেন, সে বক্তব্যগুলো যদি পাঠ্যসূচি ও জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে আলোচনায় তুলে ধরা হয়, তাহলে নবাগত কর্মকর্তাসহ সবার মনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাক্সিক্ষত নৈতিকতা জাগ্রত হতো এবং দুর্নীতি কমতে বাধ্য হতো।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেনÑ আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যানÑ করাপশন, খাদ্য কিনতে যানÑ করাপশন, জিনিস কিনতে যানÑ করাপশন, বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল।’
১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্লাকমার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে হোর্ড করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’
৭ জুন ১৯৭২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আর সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লোক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি। ঘুষখোরের নয় নম্বর ধারায় চাকরি যাবে, জেলখানায় যাবে। আর চোর, গু-া, বদমাইশ, ডাকাত, সাবধান হয়ে যাও।’
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৮ অক্টোবর, ১৯৭২ সালে পিজি হাসপাতালের রক্ত সংরক্ষণাগার এবং নতুন মহিলা ওয়ার্ডের উদ্বোধন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘আপনাদের কাছে বলতে গেলে বলতে হয়, আমি যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমি যেদিকে চাই সেদিকে ‘মানুষ’ খুব কম দেখি। মানুষ এত নীচ হয় কী করে? মানুষ মানুষের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে পয়সা নেয় কী করে? মানুষ গরিব-দুঃখীর কাছ থেকে কি করে লুট করে, আমি বুঝতে পারি না। এত রক্ত, ৩০ লক্ষ লোকের জীবন, এত শহীদ, এত মায়ের আর্তনাদ, এত শিশুর আর্তনাদ, এত বাপ-মায়ের ক্রন্দন, দেয়ালে দেয়ালে রক্তে লেখা, রাস্তায় রাস্তায় রক্তের স্বাক্ষরÑ আর সেইখানে বসে সরকারি কর্মচারীরা যদি তাদের টাকা-পয়সা খায়, তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, এ দুঃখ বলার জায়গা কোথায় আছে, আমাকে বুঝিয়ে বলুন। আইন দিয়ে তো এটা করা যায় না। এটা মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তনের দরকার, মনের পরিবর্তনের দরকার। মানবতাবোধ জাগ্রত হওয়ার দরকার।’
একই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শৃঙ্খলা ফিরে না আসলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সততা ফিরে না আসলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। আপনাদের প্রতি অভিশাপ পড়বে। ৩০ লক্ষ লোকের আত্মা আপনাদের অভিশাপ করবে। আপনারা দেখেছেন মুসলিম লীগের বড় বড় লিডাররা যারা বড় বড় বাড়ি করে আরামে ছিল একদিন অভিশাপে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেÑ আমাদের এই দেশে আমরা যারা আছি তারা যদি চরিত্রের পরিবর্তন না করি, তাহলে এমন দিন আসবে, এমন ঝড় আসবে, যে ঝড়ে আপনারা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবেন।’
১৮ জানুয়ারি, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কিন্তু কিছু কিছু লোক যখন মধু-মক্ষিকার গন্ধ পায়, তখন তারা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমায়। আওয়ামী লীগের নামে লুটতরাজ করে। পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগে কর্মীরা, আওয়ামী লীগ থেকে তাদের উৎখাত করে দিতে হবেÑ আওয়ামী লীগে থাকার তাদের অধিকার নাই। তাই বলছি, আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে, আজ আত্মসংযমের প্রয়োজন আছে, আজ আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে।’
একই বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, ‘ব্লাকমার্কেটিং করে কারা? রাগ করবেন না। আপনারা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আছেন, আপনারা রাগ করবেন না। ব্ল্যাকমার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারা ব্ল্যাকমার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া করছে তারা বেশি করে। হাইজ্যাকিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই। আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্ধিমান ওষুধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত করে মানুষকে খাওয়াই তারাই। নিশ্চয়ই গ্রামের লোক এসব পারে না। নিশ্চয়ই আমার কৃষক ভাইরা পারে না। নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক ভাইরা পারে না। পেটের মধ্যে যাদের বুদ্ধি বেশি আছে তারাই ব্লাকমার্কেটিয়ার।’
উপসংহারে তিনি দৃঢ়চিত্তে বলেন, ‘যেমনভাবে ২৫ মার্চ থেকে নয় মাস পর্যন্ত জনমত সৃষ্টি করে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলাম। তেমনি বাংলার মাটিতে জনমত সৃষ্টি করতে হবেÑ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও শোষকদের বিরুদ্ধে। আমি বিশ্বাস করি তাহলে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি উঠে যাবে।’
১১ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যে দুঃখী মানুষ দিনভর পরিশ্রম করে, তাদের পেটে খাবার নেই, গায়ে কাপড় নেই, বাসস্থানের বন্দোবস্ত নেই, লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। পাকিস্তানিরা আমাদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। কাগজ ছাড়া আমাদের কারো জন্য কিছু রেখে যায়নি। আমাকে বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে সব জিনিস আনতে হয়। কিন্তু চোরের দল সব লুট করে খায়, দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে। এবার আমি তাই শুধু জরুরি অবস্থাই ঘোষণা করিনি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, বাংলাদেশের মাটি থেকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর আর চোরাচালানকারীদের নির্মূল করব।’
একই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মুষ্টিমেয় চোরাকারবারী, মুনাফাখোর আর ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে পার করে দিয়ে আসে, জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়, খাবার জিনিস গুদামে মজুদ করে মানুষকে না খাইয়ে মারে। তাদের উৎখাত করতে হবে বাংলাদেশের বুক থেকে। আমি দেখবো, তারা কী করতে পারে। এবার প্রমাণ হয়ে যাবে, চোরের শক্তি বেশি না ইমানদারের শক্তি বেশি। অন্যায়ের কাছে আমি কোনো দিন মাথানত করিনি। বারবার পাকিস্তানিরা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি সব সময়ই বুক টান করে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কারণ আল্লাহ আমার সহায় ছিলেন।’
১৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, ‘আপনারা একরার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব।’ প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব।’ প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দেশকে ভালোবাসবো।’ যারা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে, থানা আক্রমণ করে, অস্ত্র নিয়ে আপনাদের মোকাবিলা করে, বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের উৎখাত করুন।’
বিভিন্ন সময় দেয়া বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তার আজীবন লালিত স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। ৭ মার্চের বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু যে মুক্তির সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের অর্থবহ মুক্তি আনতে হলে দুর্নীতি নির্মূলের কোন বিকল্প নেই।
[লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন; সাবেক সিনিয়র সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার]
মো. নূরুল আমিন
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
২০০৬ সালে আমি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি প্রশিক্ষণে নেপালে গিয়েছিলাম। প্রশিক্ষণ ক্লাসে একজন বক্তা বলেন, বাংলাদেশ ২০০৫ সালে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে; অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৫ বার টি আই এর তালিকায় দুর্নীতির শীর্ষে বাংলাদেশ। তখন মনে হয়েছে, যে দেশ ৫ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, সে দেশে আমি সৎ কর্মকর্তা দাবি করি কীভাবে? এ যে বড় লজ্জার।
আবার ২০১৯ সালে আমেরিকায় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম প্রশিক্ষণে। সে প্রশিক্ষণে আলোচনায় চিহ্নিত হয় যে, প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ দুর্নীতি। আলোচক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ১০টি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ প্রকাশ করতে বলেন। ভয়ই পেয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু দেখা গেল বাংলাদেশের নাম ১০ নম্বরের মধ্যে নেই। যেন ইজ্জত রক্ষা পেল। অর্থাৎ দুর্নীতি কমবেশি সবাইকে নাড়া দেয় এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার বিষয়টি সবাইকে স্পর্শ করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, দেশে আসার পর থেকে তিনি যে সবাই স্থানে বক্তব্য রেখেছেন, সবখানেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরে কঠোরভাবে বক্তব্য রেখেছেন, সে বক্তব্যগুলো যদি পাঠ্যসূচি ও জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে আলোচনায় তুলে ধরা হয়, তাহলে নবাগত কর্মকর্তাসহ সবার মনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাক্সিক্ষত নৈতিকতা জাগ্রত হতো এবং দুর্নীতি কমতে বাধ্য হতো।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেনÑ আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যানÑ করাপশন, খাদ্য কিনতে যানÑ করাপশন, জিনিস কিনতে যানÑ করাপশন, বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল।’
১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্লাকমার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে হোর্ড করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’
৭ জুন ১৯৭২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আর সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লোক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি। ঘুষখোরের নয় নম্বর ধারায় চাকরি যাবে, জেলখানায় যাবে। আর চোর, গু-া, বদমাইশ, ডাকাত, সাবধান হয়ে যাও।’
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৮ অক্টোবর, ১৯৭২ সালে পিজি হাসপাতালের রক্ত সংরক্ষণাগার এবং নতুন মহিলা ওয়ার্ডের উদ্বোধন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘আপনাদের কাছে বলতে গেলে বলতে হয়, আমি যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমি যেদিকে চাই সেদিকে ‘মানুষ’ খুব কম দেখি। মানুষ এত নীচ হয় কী করে? মানুষ মানুষের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে পয়সা নেয় কী করে? মানুষ গরিব-দুঃখীর কাছ থেকে কি করে লুট করে, আমি বুঝতে পারি না। এত রক্ত, ৩০ লক্ষ লোকের জীবন, এত শহীদ, এত মায়ের আর্তনাদ, এত শিশুর আর্তনাদ, এত বাপ-মায়ের ক্রন্দন, দেয়ালে দেয়ালে রক্তে লেখা, রাস্তায় রাস্তায় রক্তের স্বাক্ষরÑ আর সেইখানে বসে সরকারি কর্মচারীরা যদি তাদের টাকা-পয়সা খায়, তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, এ দুঃখ বলার জায়গা কোথায় আছে, আমাকে বুঝিয়ে বলুন। আইন দিয়ে তো এটা করা যায় না। এটা মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তনের দরকার, মনের পরিবর্তনের দরকার। মানবতাবোধ জাগ্রত হওয়ার দরকার।’
একই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শৃঙ্খলা ফিরে না আসলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সততা ফিরে না আসলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। আপনাদের প্রতি অভিশাপ পড়বে। ৩০ লক্ষ লোকের আত্মা আপনাদের অভিশাপ করবে। আপনারা দেখেছেন মুসলিম লীগের বড় বড় লিডাররা যারা বড় বড় বাড়ি করে আরামে ছিল একদিন অভিশাপে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেÑ আমাদের এই দেশে আমরা যারা আছি তারা যদি চরিত্রের পরিবর্তন না করি, তাহলে এমন দিন আসবে, এমন ঝড় আসবে, যে ঝড়ে আপনারা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবেন।’
১৮ জানুয়ারি, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কিন্তু কিছু কিছু লোক যখন মধু-মক্ষিকার গন্ধ পায়, তখন তারা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমায়। আওয়ামী লীগের নামে লুটতরাজ করে। পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগে কর্মীরা, আওয়ামী লীগ থেকে তাদের উৎখাত করে দিতে হবেÑ আওয়ামী লীগে থাকার তাদের অধিকার নাই। তাই বলছি, আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে, আজ আত্মসংযমের প্রয়োজন আছে, আজ আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে।’
একই বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, ‘ব্লাকমার্কেটিং করে কারা? রাগ করবেন না। আপনারা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আছেন, আপনারা রাগ করবেন না। ব্ল্যাকমার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারা ব্ল্যাকমার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া করছে তারা বেশি করে। হাইজ্যাকিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই। আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্ধিমান ওষুধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত করে মানুষকে খাওয়াই তারাই। নিশ্চয়ই গ্রামের লোক এসব পারে না। নিশ্চয়ই আমার কৃষক ভাইরা পারে না। নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক ভাইরা পারে না। পেটের মধ্যে যাদের বুদ্ধি বেশি আছে তারাই ব্লাকমার্কেটিয়ার।’
উপসংহারে তিনি দৃঢ়চিত্তে বলেন, ‘যেমনভাবে ২৫ মার্চ থেকে নয় মাস পর্যন্ত জনমত সৃষ্টি করে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলাম। তেমনি বাংলার মাটিতে জনমত সৃষ্টি করতে হবেÑ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও শোষকদের বিরুদ্ধে। আমি বিশ্বাস করি তাহলে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি উঠে যাবে।’
১১ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যে দুঃখী মানুষ দিনভর পরিশ্রম করে, তাদের পেটে খাবার নেই, গায়ে কাপড় নেই, বাসস্থানের বন্দোবস্ত নেই, লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। পাকিস্তানিরা আমাদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। কাগজ ছাড়া আমাদের কারো জন্য কিছু রেখে যায়নি। আমাকে বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে সব জিনিস আনতে হয়। কিন্তু চোরের দল সব লুট করে খায়, দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে। এবার আমি তাই শুধু জরুরি অবস্থাই ঘোষণা করিনি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, বাংলাদেশের মাটি থেকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর আর চোরাচালানকারীদের নির্মূল করব।’
একই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মুষ্টিমেয় চোরাকারবারী, মুনাফাখোর আর ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে পার করে দিয়ে আসে, জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়, খাবার জিনিস গুদামে মজুদ করে মানুষকে না খাইয়ে মারে। তাদের উৎখাত করতে হবে বাংলাদেশের বুক থেকে। আমি দেখবো, তারা কী করতে পারে। এবার প্রমাণ হয়ে যাবে, চোরের শক্তি বেশি না ইমানদারের শক্তি বেশি। অন্যায়ের কাছে আমি কোনো দিন মাথানত করিনি। বারবার পাকিস্তানিরা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি সব সময়ই বুক টান করে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কারণ আল্লাহ আমার সহায় ছিলেন।’
১৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, ‘আপনারা একরার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব।’ প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব।’ প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দেশকে ভালোবাসবো।’ যারা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে, থানা আক্রমণ করে, অস্ত্র নিয়ে আপনাদের মোকাবিলা করে, বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের উৎখাত করুন।’
বিভিন্ন সময় দেয়া বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তার আজীবন লালিত স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। ৭ মার্চের বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু যে মুক্তির সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের অর্থবহ মুক্তি আনতে হলে দুর্নীতি নির্মূলের কোন বিকল্প নেই।
[লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন; সাবেক সিনিয়র সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার]