alt

উপ-সম্পাদকীয়

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখ-ে নজিরবিহীন হামলা করে হামাস। সেই হামলার পর থেকে হামাসের অস্ত্রদাতা ও পরামর্শদাতা হিসেবে ইরানকে দোষারোপ করে আসছে ইসরায়েল। প্রচন্ড জেদ ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে ২০২৪ সালের পহেলা এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেট ভবনে হামলা করে বসে ইসরায়েল। ইরান রেভ্যুলেশনারি গার্ডসের তথ্যানুযায়ী ওই হামলায় এলিট ফোর্স কুদসের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিসহ সাতজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। এ ঘটনার বারো দিনের মাথায় ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালায় ইরান। ১৩ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে ইরান নিজস্ব ভূখ- থেকে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মধ্যদিয়ে ইসরায়েলে অপারেশন ট্রু প্রমিজ নামক সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিমান ঘাঁটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েল সেনাবাহিনীর তথ্যমতে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। এরমধ্যে ৯৯ শতাংশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল সীমায় প্রবেশের পূর্বেই ধ্বংস করতে সমর্থ হয়েছে বলে ইসরায়েলের দাবি। যাই হোক ইরানের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ইসরায়েলের মিত্রদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু না করেও ১০০০ কিলোমিটার দূরত্বের ইসরায়েলকে হতভম্ব করার সক্ষমতা ইরানের রয়েছে।

ইসরায়েল বিভিন্ন সময়ে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা করার হুমকি দিয়েছে। কারণ ইরানের অস্ত্র কর্মসূচিকে তারা নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে। ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা অনুযায়ী ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে ইসরায়েলি হামলার আশঙ্কা আছে। ইরান ইসরায়েলের চেয়ে আয়তন ও জনসংখ্যায় যেমন বৃহৎ আবার সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই। একটা দীর্ঘস্থায়ী বৃহৎ যুদ্ধে অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য ইরানের তুলনায় দেশ হিসেবে ইসরায়েল বেশ ছোট। সুতরাং ইসরায়েলকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ঘোষণা ইরানের শক্তি সামর্থের বিষয়টি সামনে এনে দাঁড় করায়। ইরানের বিপ্লবী সরকার ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানে ইসরায়েলের অস্তিত্বকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করে না। অন্যদিকে ইরানের ইসরায়েল বিরোধী মনোভাব ও সামগ্রিক উত্থানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে ইসরায়েলের শাসকগোষ্ঠী। এই স্নায়ুগত মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কারণে কখনো একসুরে কথা বলতে পারেনি দেশ দুটি।

ইসরায়েলের মিত্ররা দেশটিকে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা চালানোর বিষয়ে সতর্ক করেছে। তারা জানিয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে সিরিয়ার আধা-সামরিক বাহিনী বা লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা আসতে পারে। উভয় সংগঠনই ইরানের কাছ থেকে সরাসরি সমর্থন পেয়ে থাকে। ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক চলে আসছে। ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার স্বীকার করে না এবং ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চায়। ওদিকে ইসরায়েলও তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবেই দেখে ইরানকে। ছয় মাস আগে গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাসকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে আসা ইরানে হামলা বাড়িয়েছে ইসরায়েল। ইরান এর প্রতিশোধমূলক জবাব দেওয়ার পর এখন সামরিকভাবে পাল্টা জবাব দেওয়ার চিন্তাভাবনা করার পাশাপাশি কূটনৈতিক দিক থেকেও ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টায় আছে ইসরায়েল। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপর জাতিসংঘের আরোপিত কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত অক্টোবরে। তারপরও ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ। নতুন আরও নিষেধাজ্ঞাও তারা আরোপ করছে। সব মিলিয়ে যেকোনো সময় ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরুর শঙ্কা ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। এমনটি হলে মধ্যপ্রাচ্য খুব বেশি অশান্ত হয়ে পড়বে।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, ইরানের সামরিক বাহিনী, বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (রেভল্যুশনারি গার্ড) দেশের অভ্যন্তরে ইসলামি রক্ষণশীলদের কাছ থেকে বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী হাজারও মানুষকে হত্যা করেছে; কিন্তু এরপরও তেহরান যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে মনে করছেন ইরানি ইসলামপন্থিরা। এই নিয়ে তাদের মধ্যে গোস্সা বাড়ছে। আর সেই চাপ গিয়ে পড়েছে ইরানি বাহিনীর ওপর। ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বুঝতে পারছিল, তাদের কিছু একটা করতেই হবে; কিন্তু যেটাই করা হোক না কেন, তা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি উত্তেজনা এড়িয়ে। কেননা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাতে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া থেকে সচেতনভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ইরান। ইরানে ইসলামপন্থিদের অসন্তোষের আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। সেটি হলো সিরিয়ায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর কয়েকজন কমান্ডারকে হত্যার পরও কিছুই করতে না পারা। ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বুঝতে পারছিল, তাদের কিছু একটা করতেই হবে; কিন্তু যেটাই করা হোক না কেন, তা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি উত্তেজনা এড়িয়ে। কেননা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাতে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া থেকে সচেতনভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ইরান।

সিরিয়ায় ইরানি কনসুলেট ভবনে আগ্রাসী হামলার জবাবে ইসরায়েলে ইরানের নজিরবিহীন ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর অঞ্চলটিতে চলমান উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। এ হামলা মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে বলে সতর্ক করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা। এর ফলে বিশ্বজুড়ে বহুমুখী প্রভাব পড়বে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। এতে বাংলাদেশকেও ভুগতে হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ইরানের হামলায় আরব দেশগুলো ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে : ইসরায়েলি ভূখ-ে ইরানি আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতাকে অনস্বীকার্য করে তুলেছে। সংঘর্ষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো রান্ডা সিøম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, আগের যুদ্ধগুলোতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ ছিল না; কিন্তু এখন আমরা এই যুগে প্রবেশ করছি- যেখানে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ হচ্ছে, যা এ অঞ্চলকে টেনে আনতে পারে সংঘাতের দিকে। শুধু এই অঞ্চলকে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও টেনে আনতে পারে। এর ফলে এখন আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা সব সময় টেবিলে থাকবে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সংঘাত ইসরায়েল এবং কিছু আরব রাষ্ট্রের মধ্যে তুলনামূলকভাবে নতুন সম্পর্ককে আরো টেনে আনবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, সেই সম্পর্কগুলো ঠা-া হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, যেসব আরব সরকার সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে- তাদের কেউই তাদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়।

যুদ্ধ কখনো শান্তি বয়ে আনে না। যুদ্ধের পরিস্থিতি শুনলে কেবল বর্বরতা, নৃশংসতা, ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিচ্ছবি দৃশ্যপটে চিত্রিত হয়। যুদ্ধে জয়-পরাজয় সময়ের ব্যাপার; কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ের ব্যবধানে হাজারও নারী, শিশুর করুণ মৃত্যু, খাদ্যাভাব, নির্ঘুম দিবস-রজনী, দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক পৃথিবীকে অসুস্থ করে তোলে। যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা মন্থর করে দেয়। ধ্বংস ও ক্ষতির তালিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেকোনো যুদ্ধ জনজীবনের জন্য অভিশাপ হলেও কিছু মানুষের জন্য সুযোগ তৈরি করে। সেরকম একটি পশ্চিমা অপচেষ্টা ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্বকে যুদ্ধের রূপ দিতে পারে। পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের আক্রমণে সমর্থন ও ইরানি প্রতিশোধে উস্কানি দিয়ে বিশ্ববাসীকে নতুন একটি যুদ্ধময় পরিস্থিতির লীলা দেখানোর চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রতিক আতঙ্কে শান্তিকামী বিশ্বজনতা সন্ত্রস্ত ও হতচকিত। এমনিতেই বিশ্ববাসী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে শঙ্কিত। নতুন করে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ঝনঝনানি বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধ শুরু হলে আবারো বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হতে পারে আবালবৃদ্ধবনিতা। তা না হলে, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ ক্রুসেডেও পরিণত হতে পারে। ইসরাইল ও ইরানের সামরিক শক্তির এই প্রদর্শন আরব বিশ্বসহ সমগ্র বিশ্বে যুদ্ধের ভয়ার্ত বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যীয় অঞ্চলে এই মুহূর্তে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হলে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানি শাসকদের কঠোর জবাবে সন্তুষ্ট নয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। কানাডার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ইসরায়েলের প্রতি। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার বক্তব্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের আকাশ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এছাড়া বাইডেন প্রশাসনের সমর্থন বরাবরই ইসরায়েলের প্রতি। এই যুদ্ধ কেবল আঞ্চলিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এর বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া আরও ভয়াবহ হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে

ফের চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন জনসচেতনতা

ছবি

রবীন্দ্রনাথ ও গ্রীষ্মের তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বপ্ন-দুপুর

ছবি

লোকসভা নির্বাচন : কী হচ্ছে, কী হবে

জমির বায়না দলিল কার্যকর কিংবা বাতিলের আইনি প্রক্রিয়া

জনসেবায় পেশাদারিত্ব

খাদ্য কেবল নিরাপদ হলেই হবে না, পুষ্টিকরও হতে হবে

উচ্চশিক্ষাতেও আদিবাসীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে

ছবি

যুদ্ধটা এখনো শেষ হয়নি রনো ভাই

টাকার অবমূল্যায়ন কি জরুরি ছিল

পরিবার : বিশ্বের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান

তাপপ্রবাহে ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি : দীর্ঘমেয়াদে সুফল মিলতে পারে

ছবি

কী আছে ট্রাম্পের ভাগ্যে?

ছবি

বাংলার ‘ভাশুর কথাশিল্পী’ শওকত ওসমান

রাজধানীকে বসবাসযোগ্য করুন

সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়

মুখপাত্রদের তৈরি নয়, ‘তলাপাত্র’দের তৈরি জোট প্রসঙ্গে

চেকের মামলায় সাফাই সাক্ষী বনাম আসামি

ছবি

ডারউইনের খোঁজে নিউইয়র্কের জাদুঘরে

আদিবাসী হত্যার বিচার কোন পথে

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করুন

রম্যগদ্য : গলায় বেঁধা বড়শি

খেলার চেয়ে ‘ধুলা’ বেশি

জেগে উঠুক সুকুমার বৃত্তি

প্রসঙ্গ : লোকসভা নির্বাচন

ছবি

বারবার পুড়ছে বাংলাদেশের ফুসফুস

শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

বিসিএস জ্বরে পুড়ছে তারুণ্য

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

নমিনির অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির গচ্ছিত টাকা পাবে কে

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

যদি শুধু বিনোদন সংস্কৃতি হয় তাহলে বাকি সব কী?

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা

বন্ধ হোক প্রশ্ন ফাঁস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখ-ে নজিরবিহীন হামলা করে হামাস। সেই হামলার পর থেকে হামাসের অস্ত্রদাতা ও পরামর্শদাতা হিসেবে ইরানকে দোষারোপ করে আসছে ইসরায়েল। প্রচন্ড জেদ ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে ২০২৪ সালের পহেলা এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেট ভবনে হামলা করে বসে ইসরায়েল। ইরান রেভ্যুলেশনারি গার্ডসের তথ্যানুযায়ী ওই হামলায় এলিট ফোর্স কুদসের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিসহ সাতজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। এ ঘটনার বারো দিনের মাথায় ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালায় ইরান। ১৩ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে ইরান নিজস্ব ভূখ- থেকে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মধ্যদিয়ে ইসরায়েলে অপারেশন ট্রু প্রমিজ নামক সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিমান ঘাঁটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েল সেনাবাহিনীর তথ্যমতে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। এরমধ্যে ৯৯ শতাংশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল সীমায় প্রবেশের পূর্বেই ধ্বংস করতে সমর্থ হয়েছে বলে ইসরায়েলের দাবি। যাই হোক ইরানের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ইসরায়েলের মিত্রদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু না করেও ১০০০ কিলোমিটার দূরত্বের ইসরায়েলকে হতভম্ব করার সক্ষমতা ইরানের রয়েছে।

ইসরায়েল বিভিন্ন সময়ে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা করার হুমকি দিয়েছে। কারণ ইরানের অস্ত্র কর্মসূচিকে তারা নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে। ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা অনুযায়ী ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে ইসরায়েলি হামলার আশঙ্কা আছে। ইরান ইসরায়েলের চেয়ে আয়তন ও জনসংখ্যায় যেমন বৃহৎ আবার সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই। একটা দীর্ঘস্থায়ী বৃহৎ যুদ্ধে অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য ইরানের তুলনায় দেশ হিসেবে ইসরায়েল বেশ ছোট। সুতরাং ইসরায়েলকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ঘোষণা ইরানের শক্তি সামর্থের বিষয়টি সামনে এনে দাঁড় করায়। ইরানের বিপ্লবী সরকার ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানে ইসরায়েলের অস্তিত্বকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করে না। অন্যদিকে ইরানের ইসরায়েল বিরোধী মনোভাব ও সামগ্রিক উত্থানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে ইসরায়েলের শাসকগোষ্ঠী। এই স্নায়ুগত মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কারণে কখনো একসুরে কথা বলতে পারেনি দেশ দুটি।

ইসরায়েলের মিত্ররা দেশটিকে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা চালানোর বিষয়ে সতর্ক করেছে। তারা জানিয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে সিরিয়ার আধা-সামরিক বাহিনী বা লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা আসতে পারে। উভয় সংগঠনই ইরানের কাছ থেকে সরাসরি সমর্থন পেয়ে থাকে। ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক চলে আসছে। ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার স্বীকার করে না এবং ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চায়। ওদিকে ইসরায়েলও তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবেই দেখে ইরানকে। ছয় মাস আগে গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাসকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে আসা ইরানে হামলা বাড়িয়েছে ইসরায়েল। ইরান এর প্রতিশোধমূলক জবাব দেওয়ার পর এখন সামরিকভাবে পাল্টা জবাব দেওয়ার চিন্তাভাবনা করার পাশাপাশি কূটনৈতিক দিক থেকেও ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টায় আছে ইসরায়েল। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপর জাতিসংঘের আরোপিত কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত অক্টোবরে। তারপরও ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ। নতুন আরও নিষেধাজ্ঞাও তারা আরোপ করছে। সব মিলিয়ে যেকোনো সময় ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরুর শঙ্কা ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। এমনটি হলে মধ্যপ্রাচ্য খুব বেশি অশান্ত হয়ে পড়বে।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, ইরানের সামরিক বাহিনী, বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (রেভল্যুশনারি গার্ড) দেশের অভ্যন্তরে ইসলামি রক্ষণশীলদের কাছ থেকে বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী হাজারও মানুষকে হত্যা করেছে; কিন্তু এরপরও তেহরান যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে মনে করছেন ইরানি ইসলামপন্থিরা। এই নিয়ে তাদের মধ্যে গোস্সা বাড়ছে। আর সেই চাপ গিয়ে পড়েছে ইরানি বাহিনীর ওপর। ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বুঝতে পারছিল, তাদের কিছু একটা করতেই হবে; কিন্তু যেটাই করা হোক না কেন, তা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি উত্তেজনা এড়িয়ে। কেননা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাতে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া থেকে সচেতনভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ইরান। ইরানে ইসলামপন্থিদের অসন্তোষের আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। সেটি হলো সিরিয়ায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর কয়েকজন কমান্ডারকে হত্যার পরও কিছুই করতে না পারা। ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বুঝতে পারছিল, তাদের কিছু একটা করতেই হবে; কিন্তু যেটাই করা হোক না কেন, তা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি উত্তেজনা এড়িয়ে। কেননা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাতে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া থেকে সচেতনভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ইরান।

সিরিয়ায় ইরানি কনসুলেট ভবনে আগ্রাসী হামলার জবাবে ইসরায়েলে ইরানের নজিরবিহীন ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর অঞ্চলটিতে চলমান উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। এ হামলা মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে বলে সতর্ক করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা। এর ফলে বিশ্বজুড়ে বহুমুখী প্রভাব পড়বে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। এতে বাংলাদেশকেও ভুগতে হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ইরানের হামলায় আরব দেশগুলো ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে : ইসরায়েলি ভূখ-ে ইরানি আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতাকে অনস্বীকার্য করে তুলেছে। সংঘর্ষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো রান্ডা সিøম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, আগের যুদ্ধগুলোতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ ছিল না; কিন্তু এখন আমরা এই যুগে প্রবেশ করছি- যেখানে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ হচ্ছে, যা এ অঞ্চলকে টেনে আনতে পারে সংঘাতের দিকে। শুধু এই অঞ্চলকে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও টেনে আনতে পারে। এর ফলে এখন আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা সব সময় টেবিলে থাকবে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সংঘাত ইসরায়েল এবং কিছু আরব রাষ্ট্রের মধ্যে তুলনামূলকভাবে নতুন সম্পর্ককে আরো টেনে আনবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, সেই সম্পর্কগুলো ঠা-া হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, যেসব আরব সরকার সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে- তাদের কেউই তাদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়।

যুদ্ধ কখনো শান্তি বয়ে আনে না। যুদ্ধের পরিস্থিতি শুনলে কেবল বর্বরতা, নৃশংসতা, ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিচ্ছবি দৃশ্যপটে চিত্রিত হয়। যুদ্ধে জয়-পরাজয় সময়ের ব্যাপার; কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ের ব্যবধানে হাজারও নারী, শিশুর করুণ মৃত্যু, খাদ্যাভাব, নির্ঘুম দিবস-রজনী, দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক পৃথিবীকে অসুস্থ করে তোলে। যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা মন্থর করে দেয়। ধ্বংস ও ক্ষতির তালিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেকোনো যুদ্ধ জনজীবনের জন্য অভিশাপ হলেও কিছু মানুষের জন্য সুযোগ তৈরি করে। সেরকম একটি পশ্চিমা অপচেষ্টা ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্বকে যুদ্ধের রূপ দিতে পারে। পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের আক্রমণে সমর্থন ও ইরানি প্রতিশোধে উস্কানি দিয়ে বিশ্ববাসীকে নতুন একটি যুদ্ধময় পরিস্থিতির লীলা দেখানোর চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রতিক আতঙ্কে শান্তিকামী বিশ্বজনতা সন্ত্রস্ত ও হতচকিত। এমনিতেই বিশ্ববাসী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে শঙ্কিত। নতুন করে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ঝনঝনানি বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধ শুরু হলে আবারো বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হতে পারে আবালবৃদ্ধবনিতা। তা না হলে, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ ক্রুসেডেও পরিণত হতে পারে। ইসরাইল ও ইরানের সামরিক শক্তির এই প্রদর্শন আরব বিশ্বসহ সমগ্র বিশ্বে যুদ্ধের ভয়ার্ত বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যীয় অঞ্চলে এই মুহূর্তে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হলে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানি শাসকদের কঠোর জবাবে সন্তুষ্ট নয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। কানাডার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ইসরায়েলের প্রতি। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার বক্তব্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের আকাশ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এছাড়া বাইডেন প্রশাসনের সমর্থন বরাবরই ইসরায়েলের প্রতি। এই যুদ্ধ কেবল আঞ্চলিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এর বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া আরও ভয়াবহ হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top