alt

উপ-সম্পাদকীয়

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

শঙ্কর প্রসাদ দে

: বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার। আমেরিকায় সাপ্তাহিক ছুটি টার্গেট করে মামুন ওয়াশিংটন যাত্রার শিডিউল করে রেখেছিল। সকাল ৯টায় ল্যান্ড ক্রুজারের চাকা ঘুরতে শুরু করল। ড্রাইভিং সিটে মামুন নিজে, পাশের সিটে আমি। পেছনের সিটে রুনু, মামুনের স্ত্রী চিকিৎসক স্মৃতি ও মামুনের স্কুলপড়ুয়া একমাত্র মেয়ে। স্মৃতি ভাবি পায়ের ব্যথা নিয়ে আমাদের সঙ্গ দিতে দূরপাল্লার এই জার্নিতে যাচ্ছেন দেখে অভিভূত হলাম।

নিউইয়র্ক এমনিতে ট্রাফিক জ্যামের শহর। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় মোটামুটি মিনিট ১৫ ব্যবধানে উঠে গেলাম হাইওয়েতে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত গ্রামীণ জনপদ, পাঁচ-দশ মাইল পর একেকটি গ্রামের দেখা মেলে। মামুন বলছিল, যে হারে জন্মহার বাড়ছে, আগামী একশ বছর পরও আমেরিকায় অভিবাসন চাহিদা থেকেই যাবে। ৯৮,৩৩,৫১৬ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৩৪ কোটি। ৩ দিন নিউইয়র্ক ঘুরে বুঝলাম, এটা এক বিচিত্র দেশ। বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র হলো আমেরিকা।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রাজ্য ডেলওয়ারে। পেনসিলভানিয়ায় জন্ম হলেও বাইডেনের বাবা ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন শ^শুরবাড়ি ডেলওয়ারে। বাইডেনের শিক্ষা, আইন পেশা ও রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছে এই ডেলওয়ার রাজ্যে। এখান থেকেই তিনি ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বারবার সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই ট্রাম্প সম্পাদিত দুবাই চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে একমুহূর্তও দেরি করেননি। মার্কিনিরা এভাবে পালিয়ে এসেছিল ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নৌবাহিনীর বাধার মুখে মার্কিন সপ্তম নৌবহর লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ শুধুই ইতিহাস। আমরা সর্বশেষ সাক্ষী। একাত্তরে সোভিয়েত খাদ্য, ঔষধ, ডাক্তার, কূটনীতি ও সামরিক সহায়তা না পেলে আমাদের স্বাধীনতা আসতে আরো বহু সময় লেগে যেতো। মাত্র আড়াই হাজার বর্গমাইলের ছোটরাজ্য ডেলওয়ার ফেলে পা রাখলাম মেরিল্যান্ডে।

মেরিল্যান্ডে ঢুকতেই পড়ে বাল্টিমোর ব্রিজ। পাতাপস্কো নদীর উপর আমেরিকান বিখ্যাত কবির নামে করা হয়েছে ‘ফ্রান্সিস স্কট কি’ ব্রিজ। কে জানতো নান্দনিক এই ব্রিজটি সিঙ্গাপুরের মালবাহী এক জাহাজের ধাক্কায় দুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে ২৬ মার্চ ২০২৪।

মোটামুটি বিকাল ৩টার দিকে মামুন হাইওয়ে থেকে ডানদিকে টার্ন নিয়ে একটি শহরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল রোড ইন্ডিকেশন ‘বাল্টিমোর’। চারিদিকে জাহাজের ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড দেখে বুঝলাম, চেস্পিক উপসাগর ও পাতাপস্কো নদীর সংযোগস্থলে গড়ে উঠেছে এই ঝকঝকে সমুদ্রবন্দর। ঠিক যেন বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। সময়ের প্রেক্ষাপটে বাল্টিমোর পোতাশ্রয়ে সাজানো আছে মার্কিন নৌবাহিনীর, বাণিজ্যিক ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ব্যবহৃত বহু পুরনো সারি সারি কয়েকডজন জাহাজ। আমরা মুখোমুখি একটি জাহাজের সাথে ছবি তুললাম। এটি মার্কিন কর্তৃত্বাধীন হাওয়াই দীপপুঞ্জে অবস্থিত পার্ল হারবার মার্কিন ঘাঁটিতে ছিল। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাম্রাজ্যবাদী জাপান পার্লহারবারে আক্রমণ করলে জাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে এটিকে উদ্ধার করে এনে ইতিহাসের প্রয়োজনে বিমূর্ত করে রাখা হয়েছে। জাপান যদি পার্লহারবার আক্রমণ না করতো তবে যুদ্ধে জাপানের এই মর্মান্তিক ও লজ্জাকর পরিণতি হতো না।

শহরে ঢোকার সময় মামুন বললো, চেয়ে দেখো বিশ^খ্যাত জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়। অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে রইলাম বিশ^বিদ্যালয়ের দিকে। বলা হয়ে থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিশ^বিদ্যালয়। এ পর্যন্ত ৩৯ জন গবেষক শিক্ষার্থী এই বিশ^বিদ্যালয় থেকে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন। ১৮৭৩ সালে মৃত্যুর আগে হপকিনস একটি উইলে পৃথকভাবে ৭ মিলিয়ন ডলার দান করে গেছেন একটি মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য।

হপকিনস ভালোবেসেছিলেন আপন চাচাত বোন এলিজাবেথকে। সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চাচাতো বোনকে বিয়ে করতে পারেননি। এই দুঃখবোধ থেকে দুজনের কেউ বিয়ে করেননি। চিরকুমার হপকিনসের কর্মজীবন শুরু কাকার মুদি দোকান থেকে। খুব দ্রুতই তার ব্যবসায়িক মেধার বিকাশ ঘটে। যৌবনে বাল্টিমোর থেকে ওহাইও রেললাইন স্থাপনের ঠিকাদারি পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যে পরিণত হয়েছেন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিত্তবান ও হৃদয়বান ব্যক্তিত্বে। হার্ভার্ড প্রতিষ্ঠা করে গেছেন হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়। হপকিনসের ৭ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জন হপকিনস মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে তার সমাধিতে স্থাপিত মনুমেন্ট হাজার বছর ধরে সাক্ষ্য দেবে মার্কিন জনপদে এতো মহৎপ্রাণ ব্যক্তির জন্ম হয়েছিল।

হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় স্বনামধন্য বিভাগ হলো ফলিত পদার্থবিদ্যা। এই বিভাগটিতে নাসার সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী গবেষণায় লিপ্ত আছেন। মহাকাশ বিজ্ঞান তথা পদার্থবিদ্যায় সবচেয়ে বেশি স্কলারশিপ দিয়ে থাকে নাসা। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩.১ বিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশ স্টেশন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও পর্যবেক্ষণ, চন্দ্রে চন্দ্রযান প্রেরণ, মঙ্গলে মঙ্গলযান প্রেরণ, মঙ্গলে পারসিভিয়ারেন্স প্রেরণ, পারসিভিয়ান্স, হাবল টেলিস্কোপ, জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ এবং ভয়েজারসহ বহু মহাকাশ মিশন মনিটরিং করা হয় যৌথভাবে নাসার সাথে হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়ের কন্ট্রোল রুম থেকে। যতদূর জানা যায়Ñ এমআইটির পর মহাকাশ মনিটরিংয়ের দ্বিতীয় আঁতুড়ঘর হলো জন হপকিনসের পদার্থবিদ্যা বিভাগ।

প্রতিদিন মেডিসিনে নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে। সিনথেটিক ঔষধ আবিষ্কারের মান দিন দিন উন্নত হচ্ছে। নতুন নতুন আবিষ্কৃত ঔষধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো এই বিশ^বিদ্যালয়। কয়েক ধরনের ক্যান্সার এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। বেশ কয়েকটি ক্যান্সার নিয়েও মানুষ দীর্ঘজীবী হচ্ছেন। পুরাতন ম্যানুয়াল সার্জারির পরিবর্তে পেকো, রোবোটিকসহ নিত্যনতুন সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট আবিষ্কৃত হচ্ছে। কৃত্রিম রক্ত তৈরিতে হপকিনস এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। জার্মান ক্যারিকুলাম দিয়ে গড়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠ এই বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়। পশ্চিমে অস্তাচল সূর্য। মামুন তার ল্যান্ড ক্রুজার স্টার্ট দিলো। গন্তব্য ৪০ মাইল দূরবর্তী ওয়াশিংটন; অথচ জ্যামের কারণে সময় লেগে গেল ৪ ঘণ্টা। এই চার ঘণ্টা ধরে আচ্ছন্ন ছিলাম হপকিনসের মহত্ত্ব, কৃতিত্ব ও দানশীলতায়।

[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

শঙ্কর প্রসাদ দে

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার। আমেরিকায় সাপ্তাহিক ছুটি টার্গেট করে মামুন ওয়াশিংটন যাত্রার শিডিউল করে রেখেছিল। সকাল ৯টায় ল্যান্ড ক্রুজারের চাকা ঘুরতে শুরু করল। ড্রাইভিং সিটে মামুন নিজে, পাশের সিটে আমি। পেছনের সিটে রুনু, মামুনের স্ত্রী চিকিৎসক স্মৃতি ও মামুনের স্কুলপড়ুয়া একমাত্র মেয়ে। স্মৃতি ভাবি পায়ের ব্যথা নিয়ে আমাদের সঙ্গ দিতে দূরপাল্লার এই জার্নিতে যাচ্ছেন দেখে অভিভূত হলাম।

নিউইয়র্ক এমনিতে ট্রাফিক জ্যামের শহর। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় মোটামুটি মিনিট ১৫ ব্যবধানে উঠে গেলাম হাইওয়েতে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত গ্রামীণ জনপদ, পাঁচ-দশ মাইল পর একেকটি গ্রামের দেখা মেলে। মামুন বলছিল, যে হারে জন্মহার বাড়ছে, আগামী একশ বছর পরও আমেরিকায় অভিবাসন চাহিদা থেকেই যাবে। ৯৮,৩৩,৫১৬ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৩৪ কোটি। ৩ দিন নিউইয়র্ক ঘুরে বুঝলাম, এটা এক বিচিত্র দেশ। বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র হলো আমেরিকা।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রাজ্য ডেলওয়ারে। পেনসিলভানিয়ায় জন্ম হলেও বাইডেনের বাবা ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন শ^শুরবাড়ি ডেলওয়ারে। বাইডেনের শিক্ষা, আইন পেশা ও রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছে এই ডেলওয়ার রাজ্যে। এখান থেকেই তিনি ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বারবার সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই ট্রাম্প সম্পাদিত দুবাই চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে একমুহূর্তও দেরি করেননি। মার্কিনিরা এভাবে পালিয়ে এসেছিল ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নৌবাহিনীর বাধার মুখে মার্কিন সপ্তম নৌবহর লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ শুধুই ইতিহাস। আমরা সর্বশেষ সাক্ষী। একাত্তরে সোভিয়েত খাদ্য, ঔষধ, ডাক্তার, কূটনীতি ও সামরিক সহায়তা না পেলে আমাদের স্বাধীনতা আসতে আরো বহু সময় লেগে যেতো। মাত্র আড়াই হাজার বর্গমাইলের ছোটরাজ্য ডেলওয়ার ফেলে পা রাখলাম মেরিল্যান্ডে।

মেরিল্যান্ডে ঢুকতেই পড়ে বাল্টিমোর ব্রিজ। পাতাপস্কো নদীর উপর আমেরিকান বিখ্যাত কবির নামে করা হয়েছে ‘ফ্রান্সিস স্কট কি’ ব্রিজ। কে জানতো নান্দনিক এই ব্রিজটি সিঙ্গাপুরের মালবাহী এক জাহাজের ধাক্কায় দুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে ২৬ মার্চ ২০২৪।

মোটামুটি বিকাল ৩টার দিকে মামুন হাইওয়ে থেকে ডানদিকে টার্ন নিয়ে একটি শহরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল রোড ইন্ডিকেশন ‘বাল্টিমোর’। চারিদিকে জাহাজের ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড দেখে বুঝলাম, চেস্পিক উপসাগর ও পাতাপস্কো নদীর সংযোগস্থলে গড়ে উঠেছে এই ঝকঝকে সমুদ্রবন্দর। ঠিক যেন বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। সময়ের প্রেক্ষাপটে বাল্টিমোর পোতাশ্রয়ে সাজানো আছে মার্কিন নৌবাহিনীর, বাণিজ্যিক ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ব্যবহৃত বহু পুরনো সারি সারি কয়েকডজন জাহাজ। আমরা মুখোমুখি একটি জাহাজের সাথে ছবি তুললাম। এটি মার্কিন কর্তৃত্বাধীন হাওয়াই দীপপুঞ্জে অবস্থিত পার্ল হারবার মার্কিন ঘাঁটিতে ছিল। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাম্রাজ্যবাদী জাপান পার্লহারবারে আক্রমণ করলে জাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে এটিকে উদ্ধার করে এনে ইতিহাসের প্রয়োজনে বিমূর্ত করে রাখা হয়েছে। জাপান যদি পার্লহারবার আক্রমণ না করতো তবে যুদ্ধে জাপানের এই মর্মান্তিক ও লজ্জাকর পরিণতি হতো না।

শহরে ঢোকার সময় মামুন বললো, চেয়ে দেখো বিশ^খ্যাত জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়। অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে রইলাম বিশ^বিদ্যালয়ের দিকে। বলা হয়ে থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিশ^বিদ্যালয়। এ পর্যন্ত ৩৯ জন গবেষক শিক্ষার্থী এই বিশ^বিদ্যালয় থেকে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন। ১৮৭৩ সালে মৃত্যুর আগে হপকিনস একটি উইলে পৃথকভাবে ৭ মিলিয়ন ডলার দান করে গেছেন একটি মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য।

হপকিনস ভালোবেসেছিলেন আপন চাচাত বোন এলিজাবেথকে। সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চাচাতো বোনকে বিয়ে করতে পারেননি। এই দুঃখবোধ থেকে দুজনের কেউ বিয়ে করেননি। চিরকুমার হপকিনসের কর্মজীবন শুরু কাকার মুদি দোকান থেকে। খুব দ্রুতই তার ব্যবসায়িক মেধার বিকাশ ঘটে। যৌবনে বাল্টিমোর থেকে ওহাইও রেললাইন স্থাপনের ঠিকাদারি পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যে পরিণত হয়েছেন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিত্তবান ও হৃদয়বান ব্যক্তিত্বে। হার্ভার্ড প্রতিষ্ঠা করে গেছেন হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়। হপকিনসের ৭ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জন হপকিনস মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে তার সমাধিতে স্থাপিত মনুমেন্ট হাজার বছর ধরে সাক্ষ্য দেবে মার্কিন জনপদে এতো মহৎপ্রাণ ব্যক্তির জন্ম হয়েছিল।

হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় স্বনামধন্য বিভাগ হলো ফলিত পদার্থবিদ্যা। এই বিভাগটিতে নাসার সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী গবেষণায় লিপ্ত আছেন। মহাকাশ বিজ্ঞান তথা পদার্থবিদ্যায় সবচেয়ে বেশি স্কলারশিপ দিয়ে থাকে নাসা। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩.১ বিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশ স্টেশন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও পর্যবেক্ষণ, চন্দ্রে চন্দ্রযান প্রেরণ, মঙ্গলে মঙ্গলযান প্রেরণ, মঙ্গলে পারসিভিয়ারেন্স প্রেরণ, পারসিভিয়ান্স, হাবল টেলিস্কোপ, জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ এবং ভয়েজারসহ বহু মহাকাশ মিশন মনিটরিং করা হয় যৌথভাবে নাসার সাথে হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়ের কন্ট্রোল রুম থেকে। যতদূর জানা যায়Ñ এমআইটির পর মহাকাশ মনিটরিংয়ের দ্বিতীয় আঁতুড়ঘর হলো জন হপকিনসের পদার্থবিদ্যা বিভাগ।

প্রতিদিন মেডিসিনে নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে। সিনথেটিক ঔষধ আবিষ্কারের মান দিন দিন উন্নত হচ্ছে। নতুন নতুন আবিষ্কৃত ঔষধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো এই বিশ^বিদ্যালয়। কয়েক ধরনের ক্যান্সার এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। বেশ কয়েকটি ক্যান্সার নিয়েও মানুষ দীর্ঘজীবী হচ্ছেন। পুরাতন ম্যানুয়াল সার্জারির পরিবর্তে পেকো, রোবোটিকসহ নিত্যনতুন সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট আবিষ্কৃত হচ্ছে। কৃত্রিম রক্ত তৈরিতে হপকিনস এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। জার্মান ক্যারিকুলাম দিয়ে গড়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠ এই বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়। পশ্চিমে অস্তাচল সূর্য। মামুন তার ল্যান্ড ক্রুজার স্টার্ট দিলো। গন্তব্য ৪০ মাইল দূরবর্তী ওয়াশিংটন; অথচ জ্যামের কারণে সময় লেগে গেল ৪ ঘণ্টা। এই চার ঘণ্টা ধরে আচ্ছন্ন ছিলাম হপকিনসের মহত্ত্ব, কৃতিত্ব ও দানশীলতায়।

[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

back to top