alt

সাময়িকী

কাদামাখা পা, আলোর দূরবীন

মোহাম্মদ হোসাইন

: বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১

বাংলা একাডেমিতে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়

দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, ‘কবির শক্তির পরিচয় লাভ করা যায় তাঁর রূপক সৃষ্টিতে। এই মতের সত্যতা সর্বজনবিদিত। রূপকের স্থলে একটি ব্যাপকতর শব্দ, চিত্রকল্প ব্যবহার করে বলা হয়ে থাকে যে, কবির কল্পনা কতটা গভীর, বিস্তৃত বা জীবন্ত তা জানতে হলে তাঁর চিত্রকল্পগুলো পরীক্ষা করে দেখো, যথার্থ তথ্য খুঁজে পাবে।’ (অ্যারিস্টটলের কাব্যতথ্য)।

সে কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় নিম্নোক্ত পঙ্ক্তির উচ্চারণে-

‘শিশুটি আকাশ বন্ধক রেখে দুধ পান করছে।

মায়েরা অপুষ্ট, ক্ষত, ক্লান্ত ও বধির

রাত্রিকালীন অবগাহন শেষে স্তন দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে

এখন কাদা ও গোবরে হুটোপুটি খাচ্ছে;’

(কাদামাখা পা)

স্তবকটি পড়লেই একটি সময়ের চিত্রকল্প চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বোঝা যায়- এ বড় কঠিন সময়! যে সময়ে একটি নিষ্পাপ দুধশিশুও নিরাপদ নয়, নিরাপদ নয় তার মা, তার প্রতিবেশ। আবার, শেষ স্তবকে যেয়েই শোনা যাচ্ছে, অভয়বাণী, ‘দৃশ্যপট বদল হতে হতে ফেটে পড়লো চাঁদ/ যেন ডিমের ভেতর থেকে বাচ্চাটি নেমে পা ডুবিয়ে দিলো ডোবায়। বিদ্যুতের আলোয় রোয়া ওঠা মানুষগুলো চমকে ওঠে/ যেন ইস্পাতের ফলা ধার হচ্ছে, গলগণ্ডের ছেদ হচ্ছে!

আলোচ পঙ্ক্তিগুচ্ছ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, শিশুটি একটি দুঃসহ সময়ের প্রতিরূপ আর মা-টি যেন আমাদের স্বদেশের করূণ প্রতিচ্ছবি! কিন্তু, সেই দৃশ্যপটও বদলে যায়, শিশুটি হয়ে ওঠে আলোর প্রতিভূ- যা নিষ্পেষিত, নির্যাতিত মানুষকে চমকে দেয়। বলে দেয় দুঃসময়, দুঃশাসন চিরস্থায়ী নয়- জেগে উঠছে মানুষ, ইস্পাতের ফলায় শানান দেয়া হচ্ছে, যে ইস্পাত নতুন সমাজ বিনির্মাণ করার ব্রতী হয়ে আসছে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী এভাবেই আমাদেরকে তাঁর ‘কাদামাখা পা’ কবিতাগ্রন্থে একটি ভবিষ্যত সময়ের, ভবিষ্যত সমাজের ইঙ্গিত প্রদানে স্বনিষ্ঠ হন।

কাদামাখা পা বাংলা সাহিত্যের, বাংলাদেশের ক্রান্তিকালের এক অনবদ্য দলিল। যে সময়ে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, তখন দেশ ছিল মহাসংকটে নিপতিত। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, জ্বালাও, পোড়াও, জঙ্গি হামলা, অন্যদিকে সংস্কৃতি জগতেও বিশাল টানাপোড়েন। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির নগ্ন থাবা, পুঁজিবাদের চক্রান্ত, আন্তর্জাতিক পরিম-লে গণতন্ত্রের শত্রু সাম্রাজ্যবাদীদের আস্ফালন, এ সবই কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে অন্তর্গতভাবে আক্রান্ত করেছে, করেছে আন্দোলিত, আর তারই ফসল হিসেবে চরম সংকটময় মুহূর্তে কবি তাঁর কবিতায় রূপায়িত করেছেন শব্দ, পঙ্ক্তির ধারালো, ধাতব কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, রূপায়ন করেছেন ‘কাদামাখা পা’ কাব্যের নান্দনিক উপস্থাপনায়।

দশক বিচারে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বিশ শতকের ষাটের দশকের কবি। তাঁর কাব্যকৃতি তাঁকে দিয়েছে স্বতন্ত্র স্বরের মর্যাদা, তীক্ষè, তীব্র, পরিমিতিবোধের এক আলাদা উচ্চাসন। কবির কাব্যগ্রন্থের নামগুলো যেমন ভিন্নমাত্রা দান করে, তেমনি কবিতার ভুবনটিকেও নিয়ে গেছে অনন্য সাধারণের বাঙ্মময়তায়। তাঁর জীবনবোধ, তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর পরিক্রমণ একেবারেই নিজস্ব উপলব্ধিজাত, স্বতোৎসারিত। ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন, মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি- থেকে কাদামাখা পা, ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই, মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে, মৌলানার মন, আমি জেনারেল ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ, যা একজন কবিকে চিনে নিতে যথেষ্ট। তাঁর কাব্যশৈলী, কবিতার বুনন, নিরীক্ষা, যেন এক অপরিসীম রহস্যের আধার।

কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ব্যক্তি হিসেবে যেমন স্বতন্ত্র, কবিতায়ও তিনি স্বতন্ত্র। ‘কাদামাখা পা’য়ের কবিতার শিরনামগুলোও ভিন্নমাত্রার। দক্ষিণ পর্বে রয়েছে- পাঁচটি দীর্ঘ কবিতা, ইস্পাতের ফলা ধার হচ্ছে, সাথে চাকা, ফাঁকা পেলেই চেপে দেবে, গাই বিয়োলে সব খাবে বাবুর রাখাল, প্রফুল্ল প্রান্তরে কী ঘটেছিল কিছু, শোলার কাঠে খোলার নাও। তেমনি উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব পর্বেও পাঁচটি করে সর্বমোট ২০টি কবিতা। কবিতা বিভাজনও যে একটি দক্ষ নিপুণ শৈলির কাজ তা আমাদের প্রিয় অগ্রজ, প্রিয় কবি দেখিয়েছেন অপার মুগ্ধতায়।

কবি সিরাজী বরাবরই একজন আধুনিক মনষ্ক কবি। কি চিন্তায়, কি জীবনাচারে কিংবা ভাষা ব্যবহারে, শব্দ নির্মাণে। আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশটির অভ্যুদয়ের সাথেও রয়েছে তাঁর অনন্য ভূমিকা। রয়েছে সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনে, ন্যায্যাতার সংগ্রামে অপরিসীম অংশগ্রহণ- যা তাঁকে কবি হিসেবে, একজন সাহসী মানুষ হিসেবেও পৌঁছে দিয়েছে পথিকৃতের উচ্চতায়। তাঁর কবিতা আপাত সরল মনে হলেও, তা নিগূঢ় তত্ত্ব বহন করে, ইঙ্গিতময়তা এনে দেয়। যেমন- ‘ঝাঁকি মেরে রোদ ওঠে-/ রোদ বাড়ে, মাটি ঘামে/ রোদ বাড়ে, জল ফোঁসে/ রোদ বাড়ে, হাওয়া তাতে/ শুরু হয় ভুল, ঘন হয় আগুনের নাচ।’ এ রোদ যেন চেতনার, অন্তর্জাত শক্তির , সারস্বত বিদ্রোহের মেটাফর। এভাবে প্রতিটি কবিতা, প্রতিটি পঙ্ক্তিই বাঙালির, বাংলার চিরচেনা সংগ্রামের, জাগরণের কথা বলে, মুক্তির আস্বাদ এনে দেয়। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী তাঁর শব্দ চয়নে এমনই কুশলী, এমনই জাদুকর- কবিতাকে আস্তে আস্তে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যান, পাঠককে করে তোলেন অনুসন্ধিৎসু। কখনও কখনও পাঠককেও বিভ্রান্ত হতে হয়, পথ হারিয়ে ফেলতে হয়, যথার্থ পাঠক, যথানুকূল পাঠের অনভিজ্ঞতার কারণে, অথবা কবিতার ভেতরের অন্তর্জাল ছিন্ন করতে না পারার কারণে। কবি যেমন তার কবিতায় আড়াল তৈরি করেন, চারপাশে গড়ে তোলেন নির্মোহ আঁধার, ঠিক তেমনি একজন প্রকৃত পাঠককেও হতে হয় অনেক প্রাগ্রসর, কাব্যের মোহন গিঁট খোলার কারিগর, নতুবা কবিতার মৌল স্বাদ অধরাই থেকে যায়। পাঠক হয়ে পড়েন ক্লান্ত, অবসন্ন। আর তখনই কবির কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে, থেকে যায় অনালোকিত। যেমন- ‘বোঝা যায়, ধরা যায়, গড়া যায় না/ শংকিত প্রহর আর অপ্রসন্ন মেঘ/ কূলে কূলে কূলে কূলে বিরোধের ভাঙ্গা মাপে/ তাপে-শাপে থৈ ও অথৈ সর্ব ছারখার/ ...কাদায় প’ড়লো, ন’ড়ে উঠলো শুয়োর কিংবা জোঁক!’ (কাদামাখা পা)।

দার্শনিক হেগেল মনে করতেন, কবিতা মানবমনের বিশ্বজনীন শিল্প। সকল শিল্প-আঙ্গিকের মধ্যেই কবিতার উপস্থিতি এবং কবিতাই আর্টের উচ্চতম পর্যায়। আর এই চিরন্তন আর্টের বা কলারই পালন, তোষণ, লালনই করেছেন সমগ্র জীবন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনন্য এই কবিকে নিয়ে কোনো একজন লিখেছেন-

‘আধুনিক বাংলা কবিতার এক পরিচিত নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। রোমান্টিকতা, তীক্ষ্ণ বিচক্ষণতা এবং সাবলীল ভাষার মিশেলে যে কাব্যজাদুর জন্য তাঁর খ্যাতি, ‘পশ্চিমের গুপ্তচর’ কাব্যগ্রন্থে তা-ই আবার ফিরিয়ে এনে চমৎকৃত করেছেন কবি। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সৃষ্টি প্রতিভার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ইমেজারি। চেনা পরিচিত শহুরে জীবনের খ-চিত্রের সাথে কবিতার অনুভূতি এবং অক্ষর জড়িয়ে দিয়ে এক মোহময় জগৎ সৃষ্টি করেন। তাই তাঁর কবিতায় অতিপরিচিত ছাইরঙা ক্লেদাক্ত ছাদ আসে, আর তা হয়ে ওঠে পূর্ণিমার লীলাক্ষেত্র, ‘জলছাদে পাইপ গুঁজে দেয়া আছে/ তা দিয়ে নিয়মিত বের হয় বর্জ্য/ যতো মস্করা তার অর্ধেক আস্কারা পেলে/ রেলিং টপকে ঝাঁপ মারতো পূর্ণিমা’। কবি প্রতিদিনকার সুখী সকালের অক্ষরচিত্র এঁকেছেন, তারপর সেটাই উলটে দিয়ে হতবিহ্বল করেছেন পাঠককে। প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই এসেছে দেশপ্রেমের অতৃপ্ত পিপাসা এবং উপাসনা, এসেছে জীবনের নানা প্রাত্যহিকতায় অর্থ খোঁজার প্রচেষ্টা। গদ্যকবিতার স্বাভাবিকতার মধ্যেও ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন কবি সিরাজী:

‘শুয়ে আছে শোকের ভেতর; চতুর্দিকে অবিভাজ্য প্রকৃতির রূপ।

শুয়ে আছে অরণ্যের তলে; ঝরা লতা, মরা পাতা উড়ে গেলে প’ড়ে থাকে একা।

শুয়ে আছে ঢালে, অবনত খাদে; ফাঁদে নামে জল, বাঁধে আয়ু- চারু ফলাফল

শুয়ে আছে মোহনায়, অসময়; লোভ-গন্ধ জীর্ণ রুদ্ধ দিন, অসমাপ্ত ঋণ।’

(যতো দিন ভুলগুলো দূরবীন; কাদামাখা পা)।

ভুলও যে মানুষের জীবনে দূরবীন হয়ে হয়ে ওঠতে পারে ‘কাদামাখা পা’ কাব্যগ্রন্থে কবি তা আমাদের জানান দিচ্ছেন অসম্ভব মুন্সিয়ানায়। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী শুধু একজন মহত্ত্বম কবিই নন, তিনি একজন সংগঠক, প্রগতিমনষ্ক ব্যক্তিত্ব ও আলোর পরিব্রাজক। তাঁর কবিতা মহাকালের এক অনন্য সম্পদ।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

কাদামাখা পা, আলোর দূরবীন

মোহাম্মদ হোসাইন

বাংলা একাডেমিতে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়

বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১

দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, ‘কবির শক্তির পরিচয় লাভ করা যায় তাঁর রূপক সৃষ্টিতে। এই মতের সত্যতা সর্বজনবিদিত। রূপকের স্থলে একটি ব্যাপকতর শব্দ, চিত্রকল্প ব্যবহার করে বলা হয়ে থাকে যে, কবির কল্পনা কতটা গভীর, বিস্তৃত বা জীবন্ত তা জানতে হলে তাঁর চিত্রকল্পগুলো পরীক্ষা করে দেখো, যথার্থ তথ্য খুঁজে পাবে।’ (অ্যারিস্টটলের কাব্যতথ্য)।

সে কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় নিম্নোক্ত পঙ্ক্তির উচ্চারণে-

‘শিশুটি আকাশ বন্ধক রেখে দুধ পান করছে।

মায়েরা অপুষ্ট, ক্ষত, ক্লান্ত ও বধির

রাত্রিকালীন অবগাহন শেষে স্তন দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে

এখন কাদা ও গোবরে হুটোপুটি খাচ্ছে;’

(কাদামাখা পা)

স্তবকটি পড়লেই একটি সময়ের চিত্রকল্প চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বোঝা যায়- এ বড় কঠিন সময়! যে সময়ে একটি নিষ্পাপ দুধশিশুও নিরাপদ নয়, নিরাপদ নয় তার মা, তার প্রতিবেশ। আবার, শেষ স্তবকে যেয়েই শোনা যাচ্ছে, অভয়বাণী, ‘দৃশ্যপট বদল হতে হতে ফেটে পড়লো চাঁদ/ যেন ডিমের ভেতর থেকে বাচ্চাটি নেমে পা ডুবিয়ে দিলো ডোবায়। বিদ্যুতের আলোয় রোয়া ওঠা মানুষগুলো চমকে ওঠে/ যেন ইস্পাতের ফলা ধার হচ্ছে, গলগণ্ডের ছেদ হচ্ছে!

আলোচ পঙ্ক্তিগুচ্ছ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, শিশুটি একটি দুঃসহ সময়ের প্রতিরূপ আর মা-টি যেন আমাদের স্বদেশের করূণ প্রতিচ্ছবি! কিন্তু, সেই দৃশ্যপটও বদলে যায়, শিশুটি হয়ে ওঠে আলোর প্রতিভূ- যা নিষ্পেষিত, নির্যাতিত মানুষকে চমকে দেয়। বলে দেয় দুঃসময়, দুঃশাসন চিরস্থায়ী নয়- জেগে উঠছে মানুষ, ইস্পাতের ফলায় শানান দেয়া হচ্ছে, যে ইস্পাত নতুন সমাজ বিনির্মাণ করার ব্রতী হয়ে আসছে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী এভাবেই আমাদেরকে তাঁর ‘কাদামাখা পা’ কবিতাগ্রন্থে একটি ভবিষ্যত সময়ের, ভবিষ্যত সমাজের ইঙ্গিত প্রদানে স্বনিষ্ঠ হন।

কাদামাখা পা বাংলা সাহিত্যের, বাংলাদেশের ক্রান্তিকালের এক অনবদ্য দলিল। যে সময়ে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, তখন দেশ ছিল মহাসংকটে নিপতিত। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, জ্বালাও, পোড়াও, জঙ্গি হামলা, অন্যদিকে সংস্কৃতি জগতেও বিশাল টানাপোড়েন। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির নগ্ন থাবা, পুঁজিবাদের চক্রান্ত, আন্তর্জাতিক পরিম-লে গণতন্ত্রের শত্রু সাম্রাজ্যবাদীদের আস্ফালন, এ সবই কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে অন্তর্গতভাবে আক্রান্ত করেছে, করেছে আন্দোলিত, আর তারই ফসল হিসেবে চরম সংকটময় মুহূর্তে কবি তাঁর কবিতায় রূপায়িত করেছেন শব্দ, পঙ্ক্তির ধারালো, ধাতব কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, রূপায়ন করেছেন ‘কাদামাখা পা’ কাব্যের নান্দনিক উপস্থাপনায়।

দশক বিচারে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বিশ শতকের ষাটের দশকের কবি। তাঁর কাব্যকৃতি তাঁকে দিয়েছে স্বতন্ত্র স্বরের মর্যাদা, তীক্ষè, তীব্র, পরিমিতিবোধের এক আলাদা উচ্চাসন। কবির কাব্যগ্রন্থের নামগুলো যেমন ভিন্নমাত্রা দান করে, তেমনি কবিতার ভুবনটিকেও নিয়ে গেছে অনন্য সাধারণের বাঙ্মময়তায়। তাঁর জীবনবোধ, তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর পরিক্রমণ একেবারেই নিজস্ব উপলব্ধিজাত, স্বতোৎসারিত। ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন, মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি- থেকে কাদামাখা পা, ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই, মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে, মৌলানার মন, আমি জেনারেল ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ, যা একজন কবিকে চিনে নিতে যথেষ্ট। তাঁর কাব্যশৈলী, কবিতার বুনন, নিরীক্ষা, যেন এক অপরিসীম রহস্যের আধার।

কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ব্যক্তি হিসেবে যেমন স্বতন্ত্র, কবিতায়ও তিনি স্বতন্ত্র। ‘কাদামাখা পা’য়ের কবিতার শিরনামগুলোও ভিন্নমাত্রার। দক্ষিণ পর্বে রয়েছে- পাঁচটি দীর্ঘ কবিতা, ইস্পাতের ফলা ধার হচ্ছে, সাথে চাকা, ফাঁকা পেলেই চেপে দেবে, গাই বিয়োলে সব খাবে বাবুর রাখাল, প্রফুল্ল প্রান্তরে কী ঘটেছিল কিছু, শোলার কাঠে খোলার নাও। তেমনি উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব পর্বেও পাঁচটি করে সর্বমোট ২০টি কবিতা। কবিতা বিভাজনও যে একটি দক্ষ নিপুণ শৈলির কাজ তা আমাদের প্রিয় অগ্রজ, প্রিয় কবি দেখিয়েছেন অপার মুগ্ধতায়।

কবি সিরাজী বরাবরই একজন আধুনিক মনষ্ক কবি। কি চিন্তায়, কি জীবনাচারে কিংবা ভাষা ব্যবহারে, শব্দ নির্মাণে। আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশটির অভ্যুদয়ের সাথেও রয়েছে তাঁর অনন্য ভূমিকা। রয়েছে সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনে, ন্যায্যাতার সংগ্রামে অপরিসীম অংশগ্রহণ- যা তাঁকে কবি হিসেবে, একজন সাহসী মানুষ হিসেবেও পৌঁছে দিয়েছে পথিকৃতের উচ্চতায়। তাঁর কবিতা আপাত সরল মনে হলেও, তা নিগূঢ় তত্ত্ব বহন করে, ইঙ্গিতময়তা এনে দেয়। যেমন- ‘ঝাঁকি মেরে রোদ ওঠে-/ রোদ বাড়ে, মাটি ঘামে/ রোদ বাড়ে, জল ফোঁসে/ রোদ বাড়ে, হাওয়া তাতে/ শুরু হয় ভুল, ঘন হয় আগুনের নাচ।’ এ রোদ যেন চেতনার, অন্তর্জাত শক্তির , সারস্বত বিদ্রোহের মেটাফর। এভাবে প্রতিটি কবিতা, প্রতিটি পঙ্ক্তিই বাঙালির, বাংলার চিরচেনা সংগ্রামের, জাগরণের কথা বলে, মুক্তির আস্বাদ এনে দেয়। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী তাঁর শব্দ চয়নে এমনই কুশলী, এমনই জাদুকর- কবিতাকে আস্তে আস্তে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যান, পাঠককে করে তোলেন অনুসন্ধিৎসু। কখনও কখনও পাঠককেও বিভ্রান্ত হতে হয়, পথ হারিয়ে ফেলতে হয়, যথার্থ পাঠক, যথানুকূল পাঠের অনভিজ্ঞতার কারণে, অথবা কবিতার ভেতরের অন্তর্জাল ছিন্ন করতে না পারার কারণে। কবি যেমন তার কবিতায় আড়াল তৈরি করেন, চারপাশে গড়ে তোলেন নির্মোহ আঁধার, ঠিক তেমনি একজন প্রকৃত পাঠককেও হতে হয় অনেক প্রাগ্রসর, কাব্যের মোহন গিঁট খোলার কারিগর, নতুবা কবিতার মৌল স্বাদ অধরাই থেকে যায়। পাঠক হয়ে পড়েন ক্লান্ত, অবসন্ন। আর তখনই কবির কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে, থেকে যায় অনালোকিত। যেমন- ‘বোঝা যায়, ধরা যায়, গড়া যায় না/ শংকিত প্রহর আর অপ্রসন্ন মেঘ/ কূলে কূলে কূলে কূলে বিরোধের ভাঙ্গা মাপে/ তাপে-শাপে থৈ ও অথৈ সর্ব ছারখার/ ...কাদায় প’ড়লো, ন’ড়ে উঠলো শুয়োর কিংবা জোঁক!’ (কাদামাখা পা)।

দার্শনিক হেগেল মনে করতেন, কবিতা মানবমনের বিশ্বজনীন শিল্প। সকল শিল্প-আঙ্গিকের মধ্যেই কবিতার উপস্থিতি এবং কবিতাই আর্টের উচ্চতম পর্যায়। আর এই চিরন্তন আর্টের বা কলারই পালন, তোষণ, লালনই করেছেন সমগ্র জীবন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনন্য এই কবিকে নিয়ে কোনো একজন লিখেছেন-

‘আধুনিক বাংলা কবিতার এক পরিচিত নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। রোমান্টিকতা, তীক্ষ্ণ বিচক্ষণতা এবং সাবলীল ভাষার মিশেলে যে কাব্যজাদুর জন্য তাঁর খ্যাতি, ‘পশ্চিমের গুপ্তচর’ কাব্যগ্রন্থে তা-ই আবার ফিরিয়ে এনে চমৎকৃত করেছেন কবি। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সৃষ্টি প্রতিভার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ইমেজারি। চেনা পরিচিত শহুরে জীবনের খ-চিত্রের সাথে কবিতার অনুভূতি এবং অক্ষর জড়িয়ে দিয়ে এক মোহময় জগৎ সৃষ্টি করেন। তাই তাঁর কবিতায় অতিপরিচিত ছাইরঙা ক্লেদাক্ত ছাদ আসে, আর তা হয়ে ওঠে পূর্ণিমার লীলাক্ষেত্র, ‘জলছাদে পাইপ গুঁজে দেয়া আছে/ তা দিয়ে নিয়মিত বের হয় বর্জ্য/ যতো মস্করা তার অর্ধেক আস্কারা পেলে/ রেলিং টপকে ঝাঁপ মারতো পূর্ণিমা’। কবি প্রতিদিনকার সুখী সকালের অক্ষরচিত্র এঁকেছেন, তারপর সেটাই উলটে দিয়ে হতবিহ্বল করেছেন পাঠককে। প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই এসেছে দেশপ্রেমের অতৃপ্ত পিপাসা এবং উপাসনা, এসেছে জীবনের নানা প্রাত্যহিকতায় অর্থ খোঁজার প্রচেষ্টা। গদ্যকবিতার স্বাভাবিকতার মধ্যেও ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন কবি সিরাজী:

‘শুয়ে আছে শোকের ভেতর; চতুর্দিকে অবিভাজ্য প্রকৃতির রূপ।

শুয়ে আছে অরণ্যের তলে; ঝরা লতা, মরা পাতা উড়ে গেলে প’ড়ে থাকে একা।

শুয়ে আছে ঢালে, অবনত খাদে; ফাঁদে নামে জল, বাঁধে আয়ু- চারু ফলাফল

শুয়ে আছে মোহনায়, অসময়; লোভ-গন্ধ জীর্ণ রুদ্ধ দিন, অসমাপ্ত ঋণ।’

(যতো দিন ভুলগুলো দূরবীন; কাদামাখা পা)।

ভুলও যে মানুষের জীবনে দূরবীন হয়ে হয়ে ওঠতে পারে ‘কাদামাখা পা’ কাব্যগ্রন্থে কবি তা আমাদের জানান দিচ্ছেন অসম্ভব মুন্সিয়ানায়। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী শুধু একজন মহত্ত্বম কবিই নন, তিনি একজন সংগঠক, প্রগতিমনষ্ক ব্যক্তিত্ব ও আলোর পরিব্রাজক। তাঁর কবিতা মহাকালের এক অনন্য সম্পদ।

back to top