ধারাবাহিক উপন্যাস : চৌদ্দ
আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পঁচিশ.
মুরাসাকির লেখা এগিয়ে যাচ্ছে। পাঠকেরা যে বিষয়টি নিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছেন তা হল গেঞ্জির সঙ্গে ফুজিতসুবোর দৈহিক সম্পর্ক এবং ফুজিতসুবোর সন্তান সম্ভাবা হয়ে পড়া।
একদিন বিদগ্ধ রমণী খ্যাত সম্রাটমাতা সেনশি তাকে (মুরাসাকি) দরবারে ডাকালেন। খাতির করে আপ্যায়ন করালেন। পরে প্রসঙ্গটা তুলে জানতে চাইলেন যাকে মা বলে গ্রহণ করেছিল গেঞ্জি, তার কাছে লালিত পালিত হলো-তার সঙ্গে অসামাজিক সম্পর্ক কতটা গ্রহণযোগ্য। এ প্রশ্নটা শুধু আমার নয়, তুমি বোধ হয় জানো, আমার এখানে বিদগ্ধ ব্যক্তিদের আড্ডা হয়, তাদেরও একই প্রশ্ন।
মুরাসাকি সেনশির কথা শুনে হেসে দিয়ে বললেন, শুনে আমার খুব ভালো লাগছে যে, আমার লেখা নিয়ে আপনাদের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিরা আলাপ-আলোচনা করেন।
আমি বলছি না যে সমাজে এরকম ঘটে না। তাহলে তো নৈতিকতার দিকটার উপেক্ষা করা হয়।
আমি এ নিয়ে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু আমার প্রধান চরিত্রটি দাবি করছে যে, ব্যাপারটি এরকমই হওয়া উচিত।
এরকম দাবিটা কেন?
বলছি। বলে হাসলেন মুরাসাকি।
সেনশি বললেন, হাসলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে। বল কি বলছিলে?
মানব সম্পর্কের অদ্ভুত কিছু দিক আছে-যা বাস্তবের সমাজ সংসারের প্রচলিত নৈতিক মূল্যবোধকে মেনে চলে না। মানুষ এ সম্পর্কেরও কথাটাও জানতে চায়- যদিও সামাজিকভাবে কিংবা নৈতিকভাবে তা অপছন্দ করে। সেই অপছন্দের মূল ব্যক্তিটি গেঞ্জি। হেইয়ান সমাজের ব্যভিচার তার ওপর ভর করেছে। সে একটার পর একটা যৌন অপরাধ করে যাবে এবং একটা কঠিন পরিণতির দিকে অগ্রসর হবে।
তার সন্তানের কথা তো কেউ জানল না। সবাই জানল এই সন্তানের পিতা সম্রাট কিরিতসুবো।
দৃশ্যত তাই ঘটছে। তবে একটা বিষয় তো ভুলে গেলে চলবে না ফুজিতসুরো সম্রাটের স্ত্রী। তার মায়ের মর্যাদা ধরে রাখার কথা। সম্রাজ্ঞীর শ্রদ্ধাজনক অবস্থান ভুলে যাবার কথা নয়। অথচ তিনি প্রশ্রয় দিলেন। সমাজের গভীরে যদি তার অবস্থানের কথা বলি, তা হলে তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। ভোগ মানসিকতা এবং ভোগলালসা কোনো মূল্যবোধকে মানছে না। দেখুন, তা শুধু ফুজিতসুরোর মধ্যেই সীমবাদ্ধ থাকছে না। স্ত্রীর সঙ্গে গেঞ্জির সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। সে তখন অনেক নারীর সঙ্গে অতৃপ্ত এবং অসম্পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। আমাদের সমাজের ওপরের স্তরের সম্ভ্রান্ত মুখোশটার ভেতর অতৃপ্তির খেলাটা ব্যাপকভাবে ঘটছে। গেঞ্জি একজন প্রিন্স। সম্রাটের দরবারে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি বলে উপযুক্ত মর্যাদা না দেয়ায় সে আত্মসম্মানবোধও হারিয়েছে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে সে বোকামি বা অবজ্ঞার শিকার। আবার সম্রাটতনয় বলে ক্ষমতাও দেখায়। জানালার পাশে এক সুন্দরী মহিলাকে দেখে অনুমতি ছাড়াই তার গৃহে প্রবেশ করে এবং তাকে বিছানায় যেতে বাধ্য করে।
গেঞ্জি কিতাইয়ামা গিয়ে মাত্র দশ বছরের একটি মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে আসে।
নাম মুরাসাকি। মেয়েটিকে নিয়ে আসার কারণ হল সে দেখতে ফুজিতসুবোর মতো। সামাজিক কারণে এখন গেঞ্জি ফুজিতসুবোর কাছে যেতে পারে না, কিন্তু এত নারীসঙ্গের পরও প্রচ-ভাবে মনের ভেতর তার আকর্ষণ অনুভব করে। মুরাসাকিকে নিয়ে আসার অন্যতম কারণ এটি।
মুরাসাকি কি তুমি? এ প্রশ্ন বোদ্ধাদের অনেকেই আমাকে করেছে।
এ প্রশ্ন শুনে মুরাসাকি হাসলেন। বললেন, অবাক ব্যাপার দরবারে আমাকে এই নামে অনেকে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। আমার নিজের নাম তাকাকু ডুবে যেতে বসেছে।
আমি একটি কথা বলি?
বলুন।
তোমাকে ভবিষ্যতের মানুষ এ নামেই চিনবে। তুমি হয়ত জানো আমি প্রচুর পড়ি। তোমার লেখা যা পাই, অন্য কারো লেখায় তা পাই না। হেইয়ান সম্রাটের দরবার কেন্দ্রিক এরকম মনোগাতারি শুধু বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিকই নয়, দূরদর্শিতায়, অন্তদৃষ্টিতে মেধা ও প্রতিভাস্পর্শে অসাধারণ এক সৃষ্টি হচ্ছে। আমি খুব আনন্দ পাচ্ছি তুমি লিখে যাও। পাঠক হিসেবে আমি তোমাকে অনুসরণ করছি। আমাদেরকে বঞ্চিত করো না যেন।
আপনার উৎসাহ আমাকে অনুভূতিপ্রবণ করে তুলছে।
লেখক তো অনুভূতি ও আবেগপ্রবণ হবেই। তারপরও তোমার কাল্পনিক বাস্তবতা- অবিশ্বাস্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সততা এবং সাহস।
সেনশির দরবার থেকে ফেরার পথে সেদিনকার সেই শোনাগনের কথা মনে হলো। ভাবলেন মানুষ মানুষে কত পার্থক্য।
ওঝা চলে যাবার পর সম্রাজ্ঞী শোশির মাতা রিনশি বললেন, এই লোকগুলোকে আমার একদম পছন্দ নয়। বৈদ্য, শ্রাইন-প্যাগোডা, পুরোহিত ভান্তে সবই নাকচ করে দিল?
তাদের পছন্দ করার দরকার নেই তোমার। আমাদের দরকার কাজ। আর সে বলল, বলেই কি সব নাকচ হয়ে যাবে?
দেখুন আবার হিতে বিপরীত করে বসে কিনা।
তেইশিরা কোনো জাদু-টাদু করেনি তো?
আপনার যত অমূলক কথা।
কেন? কালো জাদু বলে কিছু নেই নাকি? এছাড়া অপশক্তির খারাপ দৃষ্টি তো রয়েছেই।
এসবের জন্য শ্রাইনের পুরোহিতক আর প্যাগোডার ভান্তেরা রয়েছেন। নিয়মিত যাচ্ছি আমি সেখানে।
সবই করতে হয়। আমাদের একজন প্রিন্স চাই। একদিন তুমি হবে সম্রাট মাতা। এখন যেমন সেনশি।
সে কিসব দিয়ে গেছে এসব গায়ে পরতে হবে?
গহনার মতো করে দেব সুন্দর লাগবে।
বনাজি ঔষধ খেতে হবে?
হ্যাঁ, মা। খেতে তো হবেই।
ওর বেশভুষা দেখে তো আমার রুচি চলে গেছে।
শ্রেষ্ঠ সম্রাজ্ঞী হতে হলে সবরকম অভিজ্ঞতাও থাকতে হয়।
ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে।
বুঝতে পেরেছি আমি।
মাতা চলে গেলে সম্রাজ্ঞী দরবারে গিয়ে বসলেন। ইমন এবং মুরাসাকিসহ সকল লেডি-ইন-ওয়েটিং এবং দরবারের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত আছেন।
সম্রাজ্ঞী সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার কাছে সেই কাজ বেশি মূল্যবান- যা এই দরবারের গৌরব বৃদ্ধি করে। সুতরাং গৌরববৃদ্ধির কাজ যারা করবে তারাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। বার বছর বয়সে আমি সম্রাজ্ঞী হয়েছি। এখন প্রায় কুড়ি। অভিজ্ঞতা কম হয়নি। অনেক মূল্য দিতে হয়েছে এ জন্য। কার কী কাজ আমি তা বুঝি। আমরা বেশি আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত থাকি। কারণ যে কোনো সম্রাটের শাসনই গৌরব পায় আনুষ্ঠানিকতায় এবং উৎসবে। প্রতিটি অনুষ্ঠান ও উৎসবকে উপভোগ্য ও প্রাণময় করে তুলতে হবে।
এবার আসল কথায় আসি। এখানে বোধ করি এতদিনে কারো বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এই প্রাসাদের মধ্যে একটি অঘোষিত ঠাণ্ডাযুদ্ধ চলছে। আমরা একটি পক্ষ। আমরা কি হারতে পারি? পারি না। তাই আমি এমন কোনো দিক নেই, যে দিকে দৃষ্টি দিইনি এবং তা ওপরে তুলে ধরার চেষ্টা করিনি ও সমৃদ্ধির শীর্ষে নিয়ে যেতে চাইনি। এ কাজে তোমরা আমাকে সহযোগিতা করেছো। আমাদের কিছু সুবিধা আছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের পক্ষে আছেন এবং সম্রাটেরও আশীর্বাদ রয়েছে। তারপরও দেখে-শুনে পা ফেলতে হবে। এখানকার মেঝে বড় পিচ্ছিল। তাই চোখ-কান খোলা রাখা দরকার। তোমরা নিজেদের মধ্যে এমন কাজ করবে না- যা পরস্পরের আস্থা ও ঐক্য নষ্ট করে। আমার কাছে তথ্য আছে নিজের সামান্য সুবিধার জন্য কে কী করে। আমার জানার বাইরে কেউ কিছু করলে তার জন্য মূল্য দিতে হবে।
এখন তোমরা যাও। শুধু তাকাকু থাকবে।
সবাই চলে গেলে সম্রাজ্ঞী বললেন, তাকাকু, তুমি নাকি চীনা ধ্রুপদি জানো?
মহামান্যা, আমি এই ভাষাটা জানি। তবে তা তো গোপনীয় বিষয়, আপনাকে কে বলল?
যেই বলুক তাও গোপনীয়। এ কথা জানার পর আমার তোমার প্রতি আগ্রহ অনেক বেড়ে গেছে। আমি তোমার কাছে এ ভাষা শিখব এবং চীনা ধ্রুপদি সাহিত্য আত্মস্থ করব। পারবে না তুমি সাহায্য করতে?
এটা আমার সৌভাগ্য সম্রাজ্ঞী।
আমরা নির্দিষ্ট একটা সময় করে নেবো। গোপনে এই চীনা ধ্রুপদি র চর্চা করব আমরা। কেউ জানবে না। এই দরবারের গৌরবের সোনালি পালক হবে চীনা ধ্রুপদি ভাষা এবং সাহিত্য। সম্রাটের দরবারের পুরুষেরাই শুধু এ ভাষা নিয়ে আমাদের সামনে অহংকার করবে, আমরা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখব তা হবে না।
কিন্তু মহামান্যা তার চর্চা যে নিষেধাজ্ঞার জাঁতাকলে আবদ্ধ হয়ে আছে।
তুমি শিখলে কী করে?
আমার ভাইকে শিক্ষক বাড়িতে শেখাতেন। শুনে শুনে আমি শিখে ফেলি।
চমৎকার। এভাবে আমিও তোমার কাছ থেকে শিখে নেব।
শত্রুরা জানলে সমস্যা হবে।
শত্রুর মুখে ছাই। আমরা এগিয়ে যাই। বলে হাসলেন তিনি।
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান
ছাব্বিশ.
ইঝোমি অন্য যাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন সবাই ছিল তার অনুগত। প্রিন্স তামেতাকা ছিলেন ভীষণ অনুরক্ত। তার ভাই অতসুমিচি একেবারে বিপরীত। তাকে বাগে আনতে ইঝোমিকে হৃদয়ে প্রায় ঘর্ষণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে হচ্ছে। তবুও তা স্থায়ী করা যাচ্ছে না। আজ হৃদয়ে তো কালই উধাও, দৃশ্যপটে নেই। তাই কত কবিতাপত্র, কত মানাভিমান, হৃদয়ে হৃদয়ে কুস্তি যেন। বাঙালি পাঠকের এখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার কথা মনে হতে পারে। হায় প্রেম পাগলিনী রাধিকা! বড়াইয়ের কাছে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে তার অনুযোগের শেষ নেই। ইঝোমির সমস্যা হচ্ছে তার আর অতসুমিচির মাঝখানে কোনো বড়াই নেই। তার দুঃখগুলো, কবিতা আকারে ডায়েরিতে লিখে রাখেন। মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে কবিতালাপ চলে। এসব কবিতাপত্রে ইঝোমির অশ্রু আর অনুনয়ের করুণ প্রকাশ ঘটে। কখনো বা বুঝতে পারেন, তখন নিজের ওপর জেদ হয় এবং কবিতায়ও তার প্রকাশ ঘটে।
তিনি প্রিন্সকে আসতে বলেছিলেন। প্রিন্স লিখে পাঠান, আমাকে তুমি কী ভাবো? উদ্বেগ বোধ কর?
এটা তোমার কাছে ভালোবাসার কথা বলার জন্য গতানুগতিক হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য তা সকাল। কিছুই তুলনা করা যায় না।
প্রত্যুত্তরে ইঝোমি লিখলেন :
গতানুগতিক হোক আর না হোক
ভাবনাগুলো তার ওপর নির্ভর করে চলে না
প্রথমবারের মত আমি ফাঁদেই পা রাখলাম।
মনে মনে বললেন, কী অদ্ভুত এক মানুষ। আমি কী এমন করেছি। কত নম্রভাবে কথা বলতেন প্রয়াত প্রিন্স। কত ভালোবাসা ছিল তার। তিনি অনুতপ্ত হলেন, অনুশোচনায় তার মন অশান্ত হয়ে উঠল। ঠিক এ সময়ই অতসুমিচির বার্তাবাহক ছেলেটা এলো। ইঝোমি যেন সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন। কিন্তু একি! সে কোনো পত্র বা বার্তা নিয়ে আসেনি। কাক্সিক্ষত পত্র না পেয়ে বড় মর্মাহত হলেন। মনে মনে বললেন, এ কেমন প্রেম। তার কান্না চলে এলো। কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বার্তাবাহক ছেলেটিকে বললেন- দাঁড়াও, তুমি পত্র নিয়ে যাবে। লিখলেন-
আমার হৃদয় কি শুধু অপেক্ষার যন্ত্রণাই ভোগ করবে
মনে হয় প্রতীক্ষার যন্ত্রণা সবচেয়ে নিকৃষ্ট যন্ত্রণা
আজ রাতে আর প্রতীক্ষা নয়-
প্রিন্স কবিতাটি পড়ে গভীরভাবে সহানুভূতিবোধ করলেন। ইঝোমির প্রতি তার দয়ার উদ্রেক হলো। তার সংযত হয়ে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তার স্ত্রীকে ফেলে যাবেন কি করে? স্ত্রীকে যে তিনি খুব ভালোবাসেন তা নয়। প্রতিরাতে এভাবে যাওয়াটাই দৃষ্টিকটু। আগের প্রিন্স এমনটা ছিলেন না। এটা হচ্ছে গভীরভাবে ভালো না বাসার লক্ষণ।
সন্ধ্যার পর পত্রের জবাব এলো :
সে কি বলেছে সে তার সমস্ত অন্তর দিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করেছে
আমি কি আমার ভালোবাসার গৃহকোণে বিশ্রাম
না নিয়ে অন্য কর্মে প্রবৃত্ত হতে পারি?
তখন আমি ভাবি কত হালকাভাবেই না শ্রদ্ধা কর আমাকে।
ইঝোমি লিখলেন-
কেন আমি আপনাকে হালকাভাবে নেব?
কবিতায় লিখলেন,
‘আমি এক ফোটা শিশির মাত্র
একটি পাতায় ঝুলে আছি
আজও আমি চঞ্চল অস্থির নই
এজন্যই বোধহয় শাখাপল্লব ঝেরে ফেলেনি
জন্মের আগে থেকেই বিশ্বে এভাবে আছি।’
অনুগ্রহ করে আমাকে একফোটা স্থিতিহীন শিশির ভাবুন, পাতার আশ্রয় ছাড়া যার গতি নেই।
মহামান্য যুবরাজ ভাবেন আসবেন। দিন রায়, রাত আসে। তিনি আসেন না। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলো না থাকার সময় ইঝোমি লিখলেন-
যদি আজ যৌবনে ভাটা পড়ে
আপনার উষ্ণবাসন্তিসুর ওগো কোকিল
কখন আমি শুনতে পাব?
প্রিন্স লিখলেন জবাবে :
বসন্তে কোকিলের গান যন্ত্রণায় ভরা
দেখ এবং তুমি শুনবে তার গ্রীষ্মের পূর্ণকণ্ঠ গান
আজ বসন্ত থেকে।
অবশেষে প্রিন্স এলেন লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে। কিন্তু হায়! এখনই ইঝোমি উপাসনা এবং নিজেকে পবিত্র করার জন্য প্যাগোডায় যাচ্ছেন। তিনি কি ফিরে যাবেন, এত প্রতীক্ষার পর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এলেন। না, ফিরে গেলেন না, উপাসনালয় থেকে ফিরে এসেও ইঝোমি উপাসনায় রাত কাটালেন। প্রিন্স তা বসে বসে দেখলেন।
মুরাসাকি লিখতে বসেছেন। উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনী বিনির্মাণ ও ঘটনার প্রাসঙ্গিকতায় তাকে আগের চেয়ে বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হচ্ছে। বিদগ্ধ পাঠকদের রুচির দিকে তাকে লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে।
সম্রাজ্ঞী ফুজিতসুরোর গর্ভে গেঞ্জির সন্তান। তা তাদেরকে গোপন করতে হবে। এই গোপনীয়তার বড় উপায় হচ্ছে স্ত্রীর সঙ্গে গেঞ্জির সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নেয়া। স্ত্রীর সঙ্গে গেঞ্জি কৌশলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিয়েছে। সে বুঝাতে চায় স্ত্রীর প্রতি তার প্রেম অবিচ্ছেদ্য। ভুল যা হয়ে গেছে তার জন্য স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চায় সে। স্ত্রী অয়ী তাকে ক্ষমা করে দেয়। একটি সন্তানেরও জন্ম দেয় এরা। সন্তানটিকে গেঞ্জি খুব স্নেহ করে। এতে অয়ীর আস্থা আরো বেড়ে যায় গেঞ্জির ওপর।
কিন্তু সন্তানটি কিছু দিন পর মারা যায়। গেঞ্জি এতে খুব দুঃখ পায়। হতাশা তাকে উদাসীন করে দেয়। অয়ী নিজেও দুঃখিত স্বামীর অবস্থা দেখে। তার জন্যও দুঃখ হয় তার। শোক ভুলে গেঞ্জিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
একটু স্বাভাবিক হয়েই গেঞ্জি স্ত্রীর কাছে নয়, অপহরণ করে আনা মুরাসাকির কাছে যায়। মুরাসাকি এখন আর কিশোরী বালিকা নয়, পূর্ণ যৌবনা যুবতী নারী। তার সঙ্গে ভোগবিলাসে মত্ত হয় গেঞ্জি। মুরাসাকি আত্মসচেতন নারী। গেঞ্জিকে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে।
এবারে ইমন গেঞ্জি চরিত্রের বহুচারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। বললেন, ইঝোমি আর গেঞ্জির মধ্যে পার্থক্য কী? কেন এভাবে গেঞ্জির কাহিনী উপন্যাসে গুরুত্ব পাচ্ছে?
ইঝোমির কথা এখানে কেন আসছে বুঝতে পারছি না। একজন নারী, আরেকজন পুরুষ এই যা।
পার্থক্য তো অবশ্যই আছে। ইঝোমি বহুপ্রেমে আসক্ত। আর গেঞ্জি বহুকামে। এখানে প্রেম নেই, আছে দেহ এবং চোখের নেশা। উপন্যাস লেখার সময় ইঝোমির কথা আমার মনেই আসে না।
বহুকামিতা কেন? যুব সমাজকে আকৃষ্ট করার জন্য?
আমি যতদূর জানি, আমার গেঞ্জির পাঠকের প্রায় সবাই ঋদ্ধ এবং বিদগ্ধ ব্যক্তি।
তাদের জন্য এই পরিবেশনা?
সমস্যা কোথায়? মনোগাতারিটা শেষ হতে দিন। সব প্রশ্নের জবাব পাবেন। আমি এখনই কিছু বলতে চাই না।
তবে তোমার লেখা পাগল হয়ে পড়ছে সবাই।
শত্রুও পড়ছে নিশ্চয়ই।
সেদিন সেই শোনাগন তোমাকে হেয়প্রতিপন্ন করছিল, এখন দারুণ ঈর্ষান্বিত।
সেদিনও ঈর্ষা থেকেই এসব করেছেন, আমি তাকে সম্মানই করি।
সম্রাটের দরবারে কেউ কেউ বাস্তবের সম্রাট, সম্রাজ্ঞী এবং যুবরাজদের তোমার উপন্যাসে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
এটা একটা জাদুর আয়না। যেখানে পুরো হেইয়ান সাম্রাজ্যকে দেখা যাবে, তবে আলাদা করে কাউকে চিহ্নিত করতে আমি দেব না।
মিচিনাগা?
তার জীবন কি এরকম? তিনি তো মহান প্রধানমন্ত্রী এবং মহামান্যার সম্মানিত বাবা।
তুমি হাসালে আমাকে।
তবে কি জানেন, এই মনোগাতারি লেখার কাজে উৎসাহদাতাদের তিনি একজন।
তিনি তোমার শুভার্থী তাই।
মনে হয় না। দেখে মনে হচ্ছে আমার লেখার উপকারভোগী তার মেয়ে। তার মেয়ের জন্যই এই ক্লেশ শিকার করা।
তা তো বটেই। তুমি এখন এই দরবারের ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছো। ইদানীং তুমি ছবিও এঁকে দিচ্ছ স্ক্রলগুলোতে।
ছোটবেলা থেকে ক্যালিগ্রাফি এবং ছবি আঁকার কাজ করতে হয়েছে। বাবার নির্দেশ ছিল তা যেন চালিয়ে যাই। এখন বেশ কাজে লাগছে।
ঠিক বলেছ। বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি। আর ঈর্ষণীয়ও বটে। মেধাবী কাজের অন্যতম নির্দশন এটি।
শুনে মুরাসাকি হাসলেন। বললেন, শেষ যাতে করতে পারি, সে আশীর্বাদ চাই। আপনার একটা কবিতা শুনতে চাই।
শুনবে? তা হলে শোনো।
‘গেল বসন্তে
ঝরে যাওয়া ফুলগুলো একঝাঁক
এবারো ফুটেছে পুনরায়
আমাদের বিচ্ছেদ বেদনাময়
যদি মাত্র এটিই খুব বেশি আবশ্যক ছিল, তবে থাক।’
আপু একটি কথা বলি?
বলো।
মিচিতাকার কথা মনে হয়?
ইমন জবাবে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ওঠি। ক্রমশ...
ধারাবাহিক উপন্যাস : চৌদ্দ
আবুল কাসেম
শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পঁচিশ.
মুরাসাকির লেখা এগিয়ে যাচ্ছে। পাঠকেরা যে বিষয়টি নিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছেন তা হল গেঞ্জির সঙ্গে ফুজিতসুবোর দৈহিক সম্পর্ক এবং ফুজিতসুবোর সন্তান সম্ভাবা হয়ে পড়া।
একদিন বিদগ্ধ রমণী খ্যাত সম্রাটমাতা সেনশি তাকে (মুরাসাকি) দরবারে ডাকালেন। খাতির করে আপ্যায়ন করালেন। পরে প্রসঙ্গটা তুলে জানতে চাইলেন যাকে মা বলে গ্রহণ করেছিল গেঞ্জি, তার কাছে লালিত পালিত হলো-তার সঙ্গে অসামাজিক সম্পর্ক কতটা গ্রহণযোগ্য। এ প্রশ্নটা শুধু আমার নয়, তুমি বোধ হয় জানো, আমার এখানে বিদগ্ধ ব্যক্তিদের আড্ডা হয়, তাদেরও একই প্রশ্ন।
মুরাসাকি সেনশির কথা শুনে হেসে দিয়ে বললেন, শুনে আমার খুব ভালো লাগছে যে, আমার লেখা নিয়ে আপনাদের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিরা আলাপ-আলোচনা করেন।
আমি বলছি না যে সমাজে এরকম ঘটে না। তাহলে তো নৈতিকতার দিকটার উপেক্ষা করা হয়।
আমি এ নিয়ে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু আমার প্রধান চরিত্রটি দাবি করছে যে, ব্যাপারটি এরকমই হওয়া উচিত।
এরকম দাবিটা কেন?
বলছি। বলে হাসলেন মুরাসাকি।
সেনশি বললেন, হাসলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে। বল কি বলছিলে?
মানব সম্পর্কের অদ্ভুত কিছু দিক আছে-যা বাস্তবের সমাজ সংসারের প্রচলিত নৈতিক মূল্যবোধকে মেনে চলে না। মানুষ এ সম্পর্কেরও কথাটাও জানতে চায়- যদিও সামাজিকভাবে কিংবা নৈতিকভাবে তা অপছন্দ করে। সেই অপছন্দের মূল ব্যক্তিটি গেঞ্জি। হেইয়ান সমাজের ব্যভিচার তার ওপর ভর করেছে। সে একটার পর একটা যৌন অপরাধ করে যাবে এবং একটা কঠিন পরিণতির দিকে অগ্রসর হবে।
তার সন্তানের কথা তো কেউ জানল না। সবাই জানল এই সন্তানের পিতা সম্রাট কিরিতসুবো।
দৃশ্যত তাই ঘটছে। তবে একটা বিষয় তো ভুলে গেলে চলবে না ফুজিতসুরো সম্রাটের স্ত্রী। তার মায়ের মর্যাদা ধরে রাখার কথা। সম্রাজ্ঞীর শ্রদ্ধাজনক অবস্থান ভুলে যাবার কথা নয়। অথচ তিনি প্রশ্রয় দিলেন। সমাজের গভীরে যদি তার অবস্থানের কথা বলি, তা হলে তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। ভোগ মানসিকতা এবং ভোগলালসা কোনো মূল্যবোধকে মানছে না। দেখুন, তা শুধু ফুজিতসুরোর মধ্যেই সীমবাদ্ধ থাকছে না। স্ত্রীর সঙ্গে গেঞ্জির সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। সে তখন অনেক নারীর সঙ্গে অতৃপ্ত এবং অসম্পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। আমাদের সমাজের ওপরের স্তরের সম্ভ্রান্ত মুখোশটার ভেতর অতৃপ্তির খেলাটা ব্যাপকভাবে ঘটছে। গেঞ্জি একজন প্রিন্স। সম্রাটের দরবারে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি বলে উপযুক্ত মর্যাদা না দেয়ায় সে আত্মসম্মানবোধও হারিয়েছে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে সে বোকামি বা অবজ্ঞার শিকার। আবার সম্রাটতনয় বলে ক্ষমতাও দেখায়। জানালার পাশে এক সুন্দরী মহিলাকে দেখে অনুমতি ছাড়াই তার গৃহে প্রবেশ করে এবং তাকে বিছানায় যেতে বাধ্য করে।
গেঞ্জি কিতাইয়ামা গিয়ে মাত্র দশ বছরের একটি মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে আসে।
নাম মুরাসাকি। মেয়েটিকে নিয়ে আসার কারণ হল সে দেখতে ফুজিতসুবোর মতো। সামাজিক কারণে এখন গেঞ্জি ফুজিতসুবোর কাছে যেতে পারে না, কিন্তু এত নারীসঙ্গের পরও প্রচ-ভাবে মনের ভেতর তার আকর্ষণ অনুভব করে। মুরাসাকিকে নিয়ে আসার অন্যতম কারণ এটি।
মুরাসাকি কি তুমি? এ প্রশ্ন বোদ্ধাদের অনেকেই আমাকে করেছে।
এ প্রশ্ন শুনে মুরাসাকি হাসলেন। বললেন, অবাক ব্যাপার দরবারে আমাকে এই নামে অনেকে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। আমার নিজের নাম তাকাকু ডুবে যেতে বসেছে।
আমি একটি কথা বলি?
বলুন।
তোমাকে ভবিষ্যতের মানুষ এ নামেই চিনবে। তুমি হয়ত জানো আমি প্রচুর পড়ি। তোমার লেখা যা পাই, অন্য কারো লেখায় তা পাই না। হেইয়ান সম্রাটের দরবার কেন্দ্রিক এরকম মনোগাতারি শুধু বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিকই নয়, দূরদর্শিতায়, অন্তদৃষ্টিতে মেধা ও প্রতিভাস্পর্শে অসাধারণ এক সৃষ্টি হচ্ছে। আমি খুব আনন্দ পাচ্ছি তুমি লিখে যাও। পাঠক হিসেবে আমি তোমাকে অনুসরণ করছি। আমাদেরকে বঞ্চিত করো না যেন।
আপনার উৎসাহ আমাকে অনুভূতিপ্রবণ করে তুলছে।
লেখক তো অনুভূতি ও আবেগপ্রবণ হবেই। তারপরও তোমার কাল্পনিক বাস্তবতা- অবিশ্বাস্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সততা এবং সাহস।
সেনশির দরবার থেকে ফেরার পথে সেদিনকার সেই শোনাগনের কথা মনে হলো। ভাবলেন মানুষ মানুষে কত পার্থক্য।
ওঝা চলে যাবার পর সম্রাজ্ঞী শোশির মাতা রিনশি বললেন, এই লোকগুলোকে আমার একদম পছন্দ নয়। বৈদ্য, শ্রাইন-প্যাগোডা, পুরোহিত ভান্তে সবই নাকচ করে দিল?
তাদের পছন্দ করার দরকার নেই তোমার। আমাদের দরকার কাজ। আর সে বলল, বলেই কি সব নাকচ হয়ে যাবে?
দেখুন আবার হিতে বিপরীত করে বসে কিনা।
তেইশিরা কোনো জাদু-টাদু করেনি তো?
আপনার যত অমূলক কথা।
কেন? কালো জাদু বলে কিছু নেই নাকি? এছাড়া অপশক্তির খারাপ দৃষ্টি তো রয়েছেই।
এসবের জন্য শ্রাইনের পুরোহিতক আর প্যাগোডার ভান্তেরা রয়েছেন। নিয়মিত যাচ্ছি আমি সেখানে।
সবই করতে হয়। আমাদের একজন প্রিন্স চাই। একদিন তুমি হবে সম্রাট মাতা। এখন যেমন সেনশি।
সে কিসব দিয়ে গেছে এসব গায়ে পরতে হবে?
গহনার মতো করে দেব সুন্দর লাগবে।
বনাজি ঔষধ খেতে হবে?
হ্যাঁ, মা। খেতে তো হবেই।
ওর বেশভুষা দেখে তো আমার রুচি চলে গেছে।
শ্রেষ্ঠ সম্রাজ্ঞী হতে হলে সবরকম অভিজ্ঞতাও থাকতে হয়।
ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে।
বুঝতে পেরেছি আমি।
মাতা চলে গেলে সম্রাজ্ঞী দরবারে গিয়ে বসলেন। ইমন এবং মুরাসাকিসহ সকল লেডি-ইন-ওয়েটিং এবং দরবারের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত আছেন।
সম্রাজ্ঞী সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার কাছে সেই কাজ বেশি মূল্যবান- যা এই দরবারের গৌরব বৃদ্ধি করে। সুতরাং গৌরববৃদ্ধির কাজ যারা করবে তারাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। বার বছর বয়সে আমি সম্রাজ্ঞী হয়েছি। এখন প্রায় কুড়ি। অভিজ্ঞতা কম হয়নি। অনেক মূল্য দিতে হয়েছে এ জন্য। কার কী কাজ আমি তা বুঝি। আমরা বেশি আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত থাকি। কারণ যে কোনো সম্রাটের শাসনই গৌরব পায় আনুষ্ঠানিকতায় এবং উৎসবে। প্রতিটি অনুষ্ঠান ও উৎসবকে উপভোগ্য ও প্রাণময় করে তুলতে হবে।
এবার আসল কথায় আসি। এখানে বোধ করি এতদিনে কারো বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এই প্রাসাদের মধ্যে একটি অঘোষিত ঠাণ্ডাযুদ্ধ চলছে। আমরা একটি পক্ষ। আমরা কি হারতে পারি? পারি না। তাই আমি এমন কোনো দিক নেই, যে দিকে দৃষ্টি দিইনি এবং তা ওপরে তুলে ধরার চেষ্টা করিনি ও সমৃদ্ধির শীর্ষে নিয়ে যেতে চাইনি। এ কাজে তোমরা আমাকে সহযোগিতা করেছো। আমাদের কিছু সুবিধা আছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের পক্ষে আছেন এবং সম্রাটেরও আশীর্বাদ রয়েছে। তারপরও দেখে-শুনে পা ফেলতে হবে। এখানকার মেঝে বড় পিচ্ছিল। তাই চোখ-কান খোলা রাখা দরকার। তোমরা নিজেদের মধ্যে এমন কাজ করবে না- যা পরস্পরের আস্থা ও ঐক্য নষ্ট করে। আমার কাছে তথ্য আছে নিজের সামান্য সুবিধার জন্য কে কী করে। আমার জানার বাইরে কেউ কিছু করলে তার জন্য মূল্য দিতে হবে।
এখন তোমরা যাও। শুধু তাকাকু থাকবে।
সবাই চলে গেলে সম্রাজ্ঞী বললেন, তাকাকু, তুমি নাকি চীনা ধ্রুপদি জানো?
মহামান্যা, আমি এই ভাষাটা জানি। তবে তা তো গোপনীয় বিষয়, আপনাকে কে বলল?
যেই বলুক তাও গোপনীয়। এ কথা জানার পর আমার তোমার প্রতি আগ্রহ অনেক বেড়ে গেছে। আমি তোমার কাছে এ ভাষা শিখব এবং চীনা ধ্রুপদি সাহিত্য আত্মস্থ করব। পারবে না তুমি সাহায্য করতে?
এটা আমার সৌভাগ্য সম্রাজ্ঞী।
আমরা নির্দিষ্ট একটা সময় করে নেবো। গোপনে এই চীনা ধ্রুপদি র চর্চা করব আমরা। কেউ জানবে না। এই দরবারের গৌরবের সোনালি পালক হবে চীনা ধ্রুপদি ভাষা এবং সাহিত্য। সম্রাটের দরবারের পুরুষেরাই শুধু এ ভাষা নিয়ে আমাদের সামনে অহংকার করবে, আমরা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখব তা হবে না।
কিন্তু মহামান্যা তার চর্চা যে নিষেধাজ্ঞার জাঁতাকলে আবদ্ধ হয়ে আছে।
তুমি শিখলে কী করে?
আমার ভাইকে শিক্ষক বাড়িতে শেখাতেন। শুনে শুনে আমি শিখে ফেলি।
চমৎকার। এভাবে আমিও তোমার কাছ থেকে শিখে নেব।
শত্রুরা জানলে সমস্যা হবে।
শত্রুর মুখে ছাই। আমরা এগিয়ে যাই। বলে হাসলেন তিনি।
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান
ছাব্বিশ.
ইঝোমি অন্য যাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন সবাই ছিল তার অনুগত। প্রিন্স তামেতাকা ছিলেন ভীষণ অনুরক্ত। তার ভাই অতসুমিচি একেবারে বিপরীত। তাকে বাগে আনতে ইঝোমিকে হৃদয়ে প্রায় ঘর্ষণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে হচ্ছে। তবুও তা স্থায়ী করা যাচ্ছে না। আজ হৃদয়ে তো কালই উধাও, দৃশ্যপটে নেই। তাই কত কবিতাপত্র, কত মানাভিমান, হৃদয়ে হৃদয়ে কুস্তি যেন। বাঙালি পাঠকের এখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার কথা মনে হতে পারে। হায় প্রেম পাগলিনী রাধিকা! বড়াইয়ের কাছে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে তার অনুযোগের শেষ নেই। ইঝোমির সমস্যা হচ্ছে তার আর অতসুমিচির মাঝখানে কোনো বড়াই নেই। তার দুঃখগুলো, কবিতা আকারে ডায়েরিতে লিখে রাখেন। মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে কবিতালাপ চলে। এসব কবিতাপত্রে ইঝোমির অশ্রু আর অনুনয়ের করুণ প্রকাশ ঘটে। কখনো বা বুঝতে পারেন, তখন নিজের ওপর জেদ হয় এবং কবিতায়ও তার প্রকাশ ঘটে।
তিনি প্রিন্সকে আসতে বলেছিলেন। প্রিন্স লিখে পাঠান, আমাকে তুমি কী ভাবো? উদ্বেগ বোধ কর?
এটা তোমার কাছে ভালোবাসার কথা বলার জন্য গতানুগতিক হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য তা সকাল। কিছুই তুলনা করা যায় না।
প্রত্যুত্তরে ইঝোমি লিখলেন :
গতানুগতিক হোক আর না হোক
ভাবনাগুলো তার ওপর নির্ভর করে চলে না
প্রথমবারের মত আমি ফাঁদেই পা রাখলাম।
মনে মনে বললেন, কী অদ্ভুত এক মানুষ। আমি কী এমন করেছি। কত নম্রভাবে কথা বলতেন প্রয়াত প্রিন্স। কত ভালোবাসা ছিল তার। তিনি অনুতপ্ত হলেন, অনুশোচনায় তার মন অশান্ত হয়ে উঠল। ঠিক এ সময়ই অতসুমিচির বার্তাবাহক ছেলেটা এলো। ইঝোমি যেন সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন। কিন্তু একি! সে কোনো পত্র বা বার্তা নিয়ে আসেনি। কাক্সিক্ষত পত্র না পেয়ে বড় মর্মাহত হলেন। মনে মনে বললেন, এ কেমন প্রেম। তার কান্না চলে এলো। কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বার্তাবাহক ছেলেটিকে বললেন- দাঁড়াও, তুমি পত্র নিয়ে যাবে। লিখলেন-
আমার হৃদয় কি শুধু অপেক্ষার যন্ত্রণাই ভোগ করবে
মনে হয় প্রতীক্ষার যন্ত্রণা সবচেয়ে নিকৃষ্ট যন্ত্রণা
আজ রাতে আর প্রতীক্ষা নয়-
প্রিন্স কবিতাটি পড়ে গভীরভাবে সহানুভূতিবোধ করলেন। ইঝোমির প্রতি তার দয়ার উদ্রেক হলো। তার সংযত হয়ে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তার স্ত্রীকে ফেলে যাবেন কি করে? স্ত্রীকে যে তিনি খুব ভালোবাসেন তা নয়। প্রতিরাতে এভাবে যাওয়াটাই দৃষ্টিকটু। আগের প্রিন্স এমনটা ছিলেন না। এটা হচ্ছে গভীরভাবে ভালো না বাসার লক্ষণ।
সন্ধ্যার পর পত্রের জবাব এলো :
সে কি বলেছে সে তার সমস্ত অন্তর দিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করেছে
আমি কি আমার ভালোবাসার গৃহকোণে বিশ্রাম
না নিয়ে অন্য কর্মে প্রবৃত্ত হতে পারি?
তখন আমি ভাবি কত হালকাভাবেই না শ্রদ্ধা কর আমাকে।
ইঝোমি লিখলেন-
কেন আমি আপনাকে হালকাভাবে নেব?
কবিতায় লিখলেন,
‘আমি এক ফোটা শিশির মাত্র
একটি পাতায় ঝুলে আছি
আজও আমি চঞ্চল অস্থির নই
এজন্যই বোধহয় শাখাপল্লব ঝেরে ফেলেনি
জন্মের আগে থেকেই বিশ্বে এভাবে আছি।’
অনুগ্রহ করে আমাকে একফোটা স্থিতিহীন শিশির ভাবুন, পাতার আশ্রয় ছাড়া যার গতি নেই।
মহামান্য যুবরাজ ভাবেন আসবেন। দিন রায়, রাত আসে। তিনি আসেন না। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলো না থাকার সময় ইঝোমি লিখলেন-
যদি আজ যৌবনে ভাটা পড়ে
আপনার উষ্ণবাসন্তিসুর ওগো কোকিল
কখন আমি শুনতে পাব?
প্রিন্স লিখলেন জবাবে :
বসন্তে কোকিলের গান যন্ত্রণায় ভরা
দেখ এবং তুমি শুনবে তার গ্রীষ্মের পূর্ণকণ্ঠ গান
আজ বসন্ত থেকে।
অবশেষে প্রিন্স এলেন লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে। কিন্তু হায়! এখনই ইঝোমি উপাসনা এবং নিজেকে পবিত্র করার জন্য প্যাগোডায় যাচ্ছেন। তিনি কি ফিরে যাবেন, এত প্রতীক্ষার পর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এলেন। না, ফিরে গেলেন না, উপাসনালয় থেকে ফিরে এসেও ইঝোমি উপাসনায় রাত কাটালেন। প্রিন্স তা বসে বসে দেখলেন।
মুরাসাকি লিখতে বসেছেন। উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনী বিনির্মাণ ও ঘটনার প্রাসঙ্গিকতায় তাকে আগের চেয়ে বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হচ্ছে। বিদগ্ধ পাঠকদের রুচির দিকে তাকে লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে।
সম্রাজ্ঞী ফুজিতসুরোর গর্ভে গেঞ্জির সন্তান। তা তাদেরকে গোপন করতে হবে। এই গোপনীয়তার বড় উপায় হচ্ছে স্ত্রীর সঙ্গে গেঞ্জির সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নেয়া। স্ত্রীর সঙ্গে গেঞ্জি কৌশলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিয়েছে। সে বুঝাতে চায় স্ত্রীর প্রতি তার প্রেম অবিচ্ছেদ্য। ভুল যা হয়ে গেছে তার জন্য স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চায় সে। স্ত্রী অয়ী তাকে ক্ষমা করে দেয়। একটি সন্তানেরও জন্ম দেয় এরা। সন্তানটিকে গেঞ্জি খুব স্নেহ করে। এতে অয়ীর আস্থা আরো বেড়ে যায় গেঞ্জির ওপর।
কিন্তু সন্তানটি কিছু দিন পর মারা যায়। গেঞ্জি এতে খুব দুঃখ পায়। হতাশা তাকে উদাসীন করে দেয়। অয়ী নিজেও দুঃখিত স্বামীর অবস্থা দেখে। তার জন্যও দুঃখ হয় তার। শোক ভুলে গেঞ্জিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
একটু স্বাভাবিক হয়েই গেঞ্জি স্ত্রীর কাছে নয়, অপহরণ করে আনা মুরাসাকির কাছে যায়। মুরাসাকি এখন আর কিশোরী বালিকা নয়, পূর্ণ যৌবনা যুবতী নারী। তার সঙ্গে ভোগবিলাসে মত্ত হয় গেঞ্জি। মুরাসাকি আত্মসচেতন নারী। গেঞ্জিকে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে।
এবারে ইমন গেঞ্জি চরিত্রের বহুচারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। বললেন, ইঝোমি আর গেঞ্জির মধ্যে পার্থক্য কী? কেন এভাবে গেঞ্জির কাহিনী উপন্যাসে গুরুত্ব পাচ্ছে?
ইঝোমির কথা এখানে কেন আসছে বুঝতে পারছি না। একজন নারী, আরেকজন পুরুষ এই যা।
পার্থক্য তো অবশ্যই আছে। ইঝোমি বহুপ্রেমে আসক্ত। আর গেঞ্জি বহুকামে। এখানে প্রেম নেই, আছে দেহ এবং চোখের নেশা। উপন্যাস লেখার সময় ইঝোমির কথা আমার মনেই আসে না।
বহুকামিতা কেন? যুব সমাজকে আকৃষ্ট করার জন্য?
আমি যতদূর জানি, আমার গেঞ্জির পাঠকের প্রায় সবাই ঋদ্ধ এবং বিদগ্ধ ব্যক্তি।
তাদের জন্য এই পরিবেশনা?
সমস্যা কোথায়? মনোগাতারিটা শেষ হতে দিন। সব প্রশ্নের জবাব পাবেন। আমি এখনই কিছু বলতে চাই না।
তবে তোমার লেখা পাগল হয়ে পড়ছে সবাই।
শত্রুও পড়ছে নিশ্চয়ই।
সেদিন সেই শোনাগন তোমাকে হেয়প্রতিপন্ন করছিল, এখন দারুণ ঈর্ষান্বিত।
সেদিনও ঈর্ষা থেকেই এসব করেছেন, আমি তাকে সম্মানই করি।
সম্রাটের দরবারে কেউ কেউ বাস্তবের সম্রাট, সম্রাজ্ঞী এবং যুবরাজদের তোমার উপন্যাসে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
এটা একটা জাদুর আয়না। যেখানে পুরো হেইয়ান সাম্রাজ্যকে দেখা যাবে, তবে আলাদা করে কাউকে চিহ্নিত করতে আমি দেব না।
মিচিনাগা?
তার জীবন কি এরকম? তিনি তো মহান প্রধানমন্ত্রী এবং মহামান্যার সম্মানিত বাবা।
তুমি হাসালে আমাকে।
তবে কি জানেন, এই মনোগাতারি লেখার কাজে উৎসাহদাতাদের তিনি একজন।
তিনি তোমার শুভার্থী তাই।
মনে হয় না। দেখে মনে হচ্ছে আমার লেখার উপকারভোগী তার মেয়ে। তার মেয়ের জন্যই এই ক্লেশ শিকার করা।
তা তো বটেই। তুমি এখন এই দরবারের ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছো। ইদানীং তুমি ছবিও এঁকে দিচ্ছ স্ক্রলগুলোতে।
ছোটবেলা থেকে ক্যালিগ্রাফি এবং ছবি আঁকার কাজ করতে হয়েছে। বাবার নির্দেশ ছিল তা যেন চালিয়ে যাই। এখন বেশ কাজে লাগছে।
ঠিক বলেছ। বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি। আর ঈর্ষণীয়ও বটে। মেধাবী কাজের অন্যতম নির্দশন এটি।
শুনে মুরাসাকি হাসলেন। বললেন, শেষ যাতে করতে পারি, সে আশীর্বাদ চাই। আপনার একটা কবিতা শুনতে চাই।
শুনবে? তা হলে শোনো।
‘গেল বসন্তে
ঝরে যাওয়া ফুলগুলো একঝাঁক
এবারো ফুটেছে পুনরায়
আমাদের বিচ্ছেদ বেদনাময়
যদি মাত্র এটিই খুব বেশি আবশ্যক ছিল, তবে থাক।’
আপু একটি কথা বলি?
বলো।
মিচিতাকার কথা মনে হয়?
ইমন জবাবে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ওঠি। ক্রমশ...