alt

সাময়িকী

নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন

গৌতম রায়

: শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

আচ্ছা, প্রত্যেকের ভিতরে অত্যন্ত সুপ্তভাবে কি ‘ঠকানো’ বিষয়টা আমাদের জ্ঞান হওয়া ইস্তক আপনা আপনি চলে আসে? এই কথাটা হঠাৎ আজকে বেশ ভাবাচ্ছে আমাকে। নতুন বছরের শুরুর দিনটা আমাদের সকলেরই মনটা বেশ ফুরফুরে থাকে। এই ফুরফুরোমিটা বাদশা থেকে এতিম সকলেরই থাকে। তাই না? বাদশাহি এবাদতে চলা মানুষেরা, লোকেরাও বছরের, বিশেষ করে ইংরেজি বছরের শুরু আর শেষটা দারুণভাবে সেলিব্রেট করে।

আমি না বাদশা, না এতিম একজন লোক। মানুষ? কে জানে! কারো কাছে শরিফ। আবার অনেকেই আমাকে ইবলিশের ডাইরেক্ট প্রোডাক্ট বলে। তবে আমার সামনে নয়। আমার আড়ালে। সেই কারণেই কি ঘটকপাড়ার বুবাইকে বসে থাকতে দেখে বাঙাল পাড়ার ক্লাবে আগামী কাল যে ফিস্টি হতে চলেছে, তার জন্যে ফটকসে আমি কড়কড়ে দু’হাজার টাকা দিয়ে দিলাম?

জানি তো, কাল ফিস্টে মাল টানবে অনেকেই। আরে আমিই তো ক্লাবে মাল টানার বিরুদ্ধে খবরের কাগজে পোষ্ট এডিট লিখে বাহবা কুড়িয়েছি। দু’পয়সা আমার পকেটে সেই লেখার জন্যে এসেওছে। সেই আমিই কালকের পিকনিকের জন্যে টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হইনি।

আজ, বছরের শুরুর দিনটাকে সেলিব্রেট করবার জন্যে একটা বোতল ও আনিয়েছিলাম। সকলের সঙ্গে বসে দু’পেগ পানও করিয়াছি। পানসঙ্গী, আমার বাল্যবন্ধু সন্টু যখন চাট হিশেবে কেবলই মোটা মুড়ি একটি খবরের কাগজের উপর ঢালিয়াছে, তখন তার কিপটেপনা ঘিরিয়া মনে মনে খিস্তি করিলেও নিজেকে ‘মানুষ’, ‘লোক’ নয়, প্রমাণ করিতে সোনামুখ করিয়া সেই শুকনো মুড়ি সহযোগে মদ্যপানও করিয়াছি। বেশ জোরের সঙ্গেই ভাবিয়াছি যে, পত্নীর ভ্রাতাসূচক শুদ্ধাচ্চারণ যুক্ত ছেলেটি শুকনো ‘হুড়ুম’ সহযোগে এই শীতের রাত্রে আমাকে মদ্যপানে সঙ্গ দিয়া প্রকৃতপক্ষে আমাকে ঠকাইয়াছে।

ঠাকানো! বেশ ছেলেবেলায় আমাদের ‘দেশের বাড়ি’তে একটি প্রতিবেশি শিশুকন্যা কথার ছলে আমার মাকে বলেছিল; যানো ত্য, মা আমারে ঠাকাইছে। দাদুর পড়ার ঘরে ছিলাম আমি। মা, জ্যেঠিমাদের আড্ডা চলছিল দাদু, ঠাকুমার শোওয়ার ঘরে। পাশাপাশি ঘর বলে পাশের বাড়ির বাচ্চা মেয়েটার মজাদার উচ্চারণ কানে এসেছিল।

সেই দেশের বাড়িতে আজ আমার যাওয়ার অধিকারটুকুও নেই। কারণ? না, রাডক্লিফ কাঁটাতার দেয়নি আমার দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে। জ্যাঠতুতো দিদি আমার সই জাল করে আমার দেশের বাড়িকে অন্যদের ফ্ল্যাট করে দিয়েছে। আমাকে ঠকিয়েছে।

সেই ঠকানো নিয়ে মনে মনে যথেষ্ট শোরগোল করলেও আইন আদালতে আজও যেতে পারি নি। যাব, যাব ভেবেই গেছি। বিবেক বলছে, যাওয়া দরকার। কারণ, আমাকে ঠকানোর উচিত শান্তি ঠকবাজকে আমি দিতে চাই।

ঠকবাজ? আচ্ছা, এই যে পরশু দিন এক কিলো চা পাতা কেনার জন্যে দোকানে আটশো টাকা দিয়ে বললাম; আড়াইশো গ্রাম করে চারটে প্যাকেট করে দেবেন। তা সেই চা পাতা নেওয়ার সময় আড়াইশো গ্রাম করে মোট আটটা প্যাকেট, অর্থাৎ; এক কিলোর দাম দিয়ে, দু কিলো চা যখন পেলাম, একটিবারের জন্যেও দোকানদার কে বললাম না তো, আপনি ভুল করে এক কেজি বেশি চা দিয়ে দিয়েছেন।

চা নিয়ে বাড়ি ফিরে বরং এই এক কিলোর পয়সা দিয়ে দু কিলো চা পেয়ে যাওয়ার ঘটনাটা যখন আমার বৌ সুফিয়াকে বললাম, সে বেশ যুক্তি দিয়েই আমাকে বোঝালো; কতো জায়গায় তো ঠকে আসছ। একটু না হয় এবার দোকানদারই ঠকলো। তা বলে দোকানদার যদি বলে এই দু কিলোর ব্যাপারটা, একদম স্বীকার করো না যেন।

আটশো টাকা কেজি দরের চা পাতা কিনেছি। গড়পড়তা চাকরিজীবী নই এটা বোঝাই যায়। তা না হলে কেবল চায়ের পিছনে কেউ কি এতো বেশি খচ্চা করে? আমি একটা কলেজে পড়াই। আমার বৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। ছেলে নেই। মেয়ে নেই। তাদের পড়াশুনো, বিয়ের খরচ নিয়ে ভাববার কোনো প্রশ্নই তাই ওঠে না। সেই কারণেই যারা আটশো, হাজার টাকা দামের চা খাওয়ার দলের লোক, সুড়সুড় করে তাদের দলে ঢুকে গেছি। যদিও আমার মনে আছে, ছাত্রজীবনে বাড়ির চা কিনতে তিরিশ টাকা সমীরদাকে দিতাম। চায়ের দোকানের মালিক সমীরদা, সেই টাকার বিনিময়ে আমাকে পাঁচশো গ্রাম চা দিতো। সেই আমিই এখন আটশো, হাজারের চা কিনি। এতো দামি চা কেনার মুরোদ থাকা সত্ত্বেও চায়ের দোকানের ছেলেটার ভুলে এক কেজি চা বেশি চলে আসার পরেও আমি কিন্তু বেমালুম বেশি চা পাওয়ার বিষয়টা চেপে গেলাম। আমি কিন্তু রাজনীতির লোকেরা কীভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছেন, তা নিয়ে বেশ সন্দর্ভ গোছের উত্তর সম্পাদকীয় খবরের কাগজে লিখে একই সঙ্গে বাহবা এবং টু পাইস কামাই।

নতুন বছরের রাতে দেরাদুন রাইসের গরম ভাত আর চিংড়ির মালাইকারি খাব, মনের খাউস হয়েছে। কাঠবাঙাল আমি। তবু বাগবাজারী ভাষায় কতা কয়ে নিজেকে ঘটি প্রমাণ করবার বিফল চেষ্টা করি। হয়তো মনের অগোচরে তৃপ্তি মিত্রের ‘অপরাজিতা’ নাটকে, অপরাজিতার স্বামীর ‘বাঙাল’ বলে ফাল পেরে গাল দেওয়ার ব্যাপারটা আমার ভিতরে একটা ট্যাবু তৈরি করেছে। তাই আমি ঘটি হতে চেয়ে বাগবাজারী ভাষা রপ্ত করবার চেষ্টা করলেও সেই গোপাল ভাঁড়ের মাতৃভাষা চেনার কৌশল মোতাবেক, মাঝেমধ্যেই কলবলিয়ে গঙ্গাপার ছেড়ে, পদ্মাপারের লব্জ আওড়ে ফেলি। এই যেমন ‘হাউসে’র কথা বললুম। খাঁটি বোগরাইয়া, অর্থাৎ বগুড়ার লব্জ।

তা সেই ‘হাউস’ বা ‘ইচ্ছে’ যাই বলা যাক না কেন, তার তাগিদে, সেই চায়ের দোকানটার পাশের দোকান থেকেই দু কিলো চাল কিনলাম। সত্তর টাকা করে কিলো। কৃষকদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের কাগজে বেশ গরম গরম ‘মতামত’ লিখেছি। আরে আমি তো সেই কবে থেকে দেরাদুন রাইসের পেটেন্ট যাতে এই দেশের হাতে থাকে, তার জন্যে যিনি লড়াই টড়াই করছেন, তাঁর সভাতে গিয়েছি। সভা শেষে দাদাবৌদির বিরিয়ানি, তলার চাল, রেওয়াজি মাংস দিতে বলে, দোকানের মালিক রাজীবকে বলে, সেসব পেঁদিয়ে, কড়ায়গণ্ডায় দাম মিটিয়ে বাইরে এসে টুথপিক দিয়ে দাঁত খুঁচিয়েছিলাম। তারপরেও সেই দোকান কোন এমপিকে কবে কালো স্করপিও গিফট করেছিল, না করতে বাধ্য হয়েছিল, তা নিয়ে আসর গরম করেছি। এইসব কি আমার কৃষক সংহতির পরিচায়ক নয়? তাই আমরা স্বামী, স্ত্রী দুজনেই রোজগেরে। যাকে বলে উচ্চ মধ্যবিত্ত। সেই আমি কি নতুন বছরের শুরুতে দু’কেজি সত্তর টাকা দরের দেরাদুন রাইস কিনে, সেই চালের দোকানের পাশের, সেই চায়ের দোকানটাকে আড়চোখে দেখেও টুক করে কেটে পড়তে পারি না?

মটকাটা সকাল থেকেই খারাপ ছিল। দশ কিলোমিটার দূরে, পরের রেলস্টেশনের গায়ে দারুণ একটা মাছের আড়ত আছে। শীত পড়বার আগে গেছিলাম। দারুণ সস্তা। আমাদের মতো ডাঞ্চিবাবুরা যদি একটা আটপৌরে পাজামা, পাঞ্জাবি পরে সেখানে যায়, আড়তদারেরা বুঝেও না বোঝার ভান করে, পাইকারি দরেই দুচার কিলো পমফ্রেট বা গলদা চিড়িং তাদের কাছে অবলীলায় বেচে। আসলে আড়তদারদের যেমন বেচা নিয়ে কথা, গেরস্ত খদ্দের, নাকি হাফ গেরস্ত, মানে বাজারে মাছ নিয়ে বসবে, এইসব জাত বিচার তারা করে না। যেমন, হোলসেল ওষুধের দোকান থেকে আমার মতো লোকেরা অবলীলায় নিজের ডায়াবেটিস থেকে বৌয়ের থাইরয়েডের ওসুধ কিনে থাকি আর কি!

সেই দেশের বাড়িতে আজ আমার যাওয়ার অধিকারটুকুও নেই। কারণ? না, রাডক্লিফ কাঁটাতার দেয়নি আমার দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে। জ্যাঠতুতো দিদি আমার সই জাল করে আমার দেশের বাড়িকে অন্যদের ফ্ল্যাট করে দিয়েছে

নতুন বছরের শুরুতে গলদা চিংড়ির মালাইকারী খাব বলে একটা ছেলেকে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম সেই আড়তে। আমাদের পাড়ার বাজারে যে গলদা আটশোর নিচে মেলে না, আড়তে সেটাই তিনশো টাকা কিলো। ছেলেটা এনেছে গলদা নয়, বাগদাও নয়, মাঝারি সাইজের চিংড়ি। তাও আবার মাথা কাটা। সুফিয়া মাছ কাটতে পারে না। তাই বাজার থেকে মাছ কেটেই আনি। ছেলেটাকেও বলেছিলাম, মাছটা কেটে আনতে। আমাদের মতো ডাঞ্চিদের জন্যে মাছ কাটার মাসী বসে আড়তের পাশেই। দুতিন কিলো মাছ কাটতে পঞ্চাশ টাকা নেয়।

রাঁধবার আগেই সুফিয়া বলল, মাছের মুড়োগুলো নেই। কেবল ধরটা আছে। মটকাটা তখন থেকেই গরম। আমার ছোটবেলায়, তখন এতো চাষের চিংড়ি হতো না, না কি কেনবার সামর্থ্য ছিল না, কে জানে, আমার বড়মামা বাজার থেকে কেবল গলদা চিংড়ির মুড়ো আনত। সেই সময়ের বেশ প্রচলিত কথা, চিংড়ির ধরটা ফরেনে এক্সপোর্ট হয়, বেশ বিশ্বাস করতাম। তাই সুফিয়া বলার সাথে সাথেই মাথায় ক্লিক করে উঠলো, ব্যাটা যে ছেলেটাকে মাছ আনতে পাঠিয়েছিলাম, সে ব্যাটাই চিংড়ির মুড়োগুলো ঝেরে দিল না তো?

তার উপর, ছোট চিংড়ি বলে সুফিয়ার ব্যাজার মুখ আমাকে ভাবাচ্ছে, ও কী মনে মনে ভাবছে, পয়সা বাঁচাতে আমিই গলদার বদলে ছোট চিংড়ি আনতে বলেছিলাম? আসলে এই ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও হয়তো কোথাও আমাদের স্বামী-স্ত্রীর প্রায় তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবন, আর তার আগে দু’বছরের প্রেম, মোট বত্রিশ বছরের চেনাজানার দেওয়াল সত্যিই মজবুত কিনা, সেটা নিয়ে আমরা দুজনাই মাঝে মাঝে বেশ কনফিউজড হয়ে যাই। তার উপরে আজ কাগজে পড়লাম, স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট নাকি আমাদের মতো বিয়ের ক্ষেত্রে আর আগের মতো সুরক্ষা দিতে পারছে না। সেই সুরক্ষা না দিতে পারার কারণটা কেবল রাজনৈতিক, না সামাজিকও, তা ভেবেচিন্তে দেখার আগেই চিংড়ি ঘিরে এই আবছা আবছা সংশয়, মটকা কেন আমার গরম হবে না? আচ্ছা, আমাদের জেনারেশন ‘মটকা’ শব্দে অভ্যস্ত হলো কবে? আমাদের কালে তো ‘মেজাজ, মর্জি’ই জলচল ছিল। তখনই মাছ এনে দেওয়া ছেলেটাকে সুফিয়ার সামনে ফোন করলাম। ছেলেটা ফোন ধরলো না। মেজাজটা আরো খিঁচড়ে গেল। দুপুরে খেতে বসেও ফোন কললাম। সেবারও ফোন ধরলো না। বললাম; ব্যাটা বোধহয় বুঝেছে, ওর মাছের কেরামতিটা আমরা ধরে ফেলেছি। তাই ফোন ধরছে না।

সুফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেও বুঝলাম না, আমার কথাগুলো ও বিশ্বাস করছে, কি করছে না। তবু নিজেকে সৎ দেখানোর সুযোগ কে না ছাড়ে? কথাটা আবার রিপিট করলাম। আবার ও নীরবেই আর দুটো মাছ আর একটু গ্রেভি আমার পাতে ঢেলে দিল সুফিয়া।

নতুন বছরের শুরুর দিনেই ঠকছি, মাছে ঠকেছি, মালের চ্যাটে ঠকেছি- এটা ভেবেই চাল কিনে বেরিয়েই একটা বয়স্ক রিক্সাওয়ালার সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করে দিলাম। রিক্সা ট্যান্ড থেকে রিক্সা ধরলে আমার বাড়ির সামনের মোড়ের ভাড়া হয় কুড়ি টাকা। কিন্তু আমার একটা পেটোয়া রিক্সাওয়ালা আছে। যে কি না আমার জন্যে অবলীলায় বম্বে ডাইয়িংয়ের পাশের দোকান থেকে বস্তু কিনে, নিজের ঝোলা করে এনে দেয়। কাকপক্ষীতেও টের পায় না, ভদ্দরলোক প্রফেসার কাম লেখকের এই ঢুকুঢুকুপনা। তাই তাকে কুড়ির জায়গায়, তিরিশ টাকা ভাড়া দিলেও, আজ এই নিউ ইয়ার্স ডের রাত নটায়, প্রবল শীতের ভেতর কেবলমাত্র একটা লুঙ্গি আর শার্ট পরা রিক্সাওয়ালাকে জর্জ রোডে পেয়ে গেলাম, যার জন্যে আমাকে দুকিলো চাল আর অসীমদির বইয়ের দোকান থেকে কেনা কয়েকটা ইংরেজি বই, সেই রিক্সাট্যান্ড পর্যন্ত বইতে হলো না, সেই লোকটার সাথেই ভাড়া নিয়ে বারগেনিং করতে শুরু করে দিলাম।

লোকটা পঁচিশ টাকা চেয়েছিল। পাঁচ টাকা কমালাম। পাঁচ টাকা কমিয়েই বেশ পরিতৃপ্তি পেলাম। শীতের ভিতরে এতোটা পথ ঢিকঢিক করে টানতে রিক্সাওয়ালার যে কষ্ট হচ্ছে, সেটা বুঝেও নামার সময়ে কুড়ি টাকাই দিলাম। অথচ এই আমিই একদিন মন্ত্রীকে মাসে তিন কোটি টাকা তুলে দেওয়া এক দপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের এক টাকা নিয়ে রিক্সাওয়ালার সঙ্গে তক্কবিতক্ক নিয়ে কতো কথাই না বলিয়াছিলাম। তখন কিন্তু একটিবারের জন্যেও রিক্সাওয়ালা বলি নাই। সাধু অ্যাকসেন্টে রিক্সাচালকই বলিয়াছিলাম।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন

গৌতম রায়

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১

আচ্ছা, প্রত্যেকের ভিতরে অত্যন্ত সুপ্তভাবে কি ‘ঠকানো’ বিষয়টা আমাদের জ্ঞান হওয়া ইস্তক আপনা আপনি চলে আসে? এই কথাটা হঠাৎ আজকে বেশ ভাবাচ্ছে আমাকে। নতুন বছরের শুরুর দিনটা আমাদের সকলেরই মনটা বেশ ফুরফুরে থাকে। এই ফুরফুরোমিটা বাদশা থেকে এতিম সকলেরই থাকে। তাই না? বাদশাহি এবাদতে চলা মানুষেরা, লোকেরাও বছরের, বিশেষ করে ইংরেজি বছরের শুরু আর শেষটা দারুণভাবে সেলিব্রেট করে।

আমি না বাদশা, না এতিম একজন লোক। মানুষ? কে জানে! কারো কাছে শরিফ। আবার অনেকেই আমাকে ইবলিশের ডাইরেক্ট প্রোডাক্ট বলে। তবে আমার সামনে নয়। আমার আড়ালে। সেই কারণেই কি ঘটকপাড়ার বুবাইকে বসে থাকতে দেখে বাঙাল পাড়ার ক্লাবে আগামী কাল যে ফিস্টি হতে চলেছে, তার জন্যে ফটকসে আমি কড়কড়ে দু’হাজার টাকা দিয়ে দিলাম?

জানি তো, কাল ফিস্টে মাল টানবে অনেকেই। আরে আমিই তো ক্লাবে মাল টানার বিরুদ্ধে খবরের কাগজে পোষ্ট এডিট লিখে বাহবা কুড়িয়েছি। দু’পয়সা আমার পকেটে সেই লেখার জন্যে এসেওছে। সেই আমিই কালকের পিকনিকের জন্যে টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হইনি।

আজ, বছরের শুরুর দিনটাকে সেলিব্রেট করবার জন্যে একটা বোতল ও আনিয়েছিলাম। সকলের সঙ্গে বসে দু’পেগ পানও করিয়াছি। পানসঙ্গী, আমার বাল্যবন্ধু সন্টু যখন চাট হিশেবে কেবলই মোটা মুড়ি একটি খবরের কাগজের উপর ঢালিয়াছে, তখন তার কিপটেপনা ঘিরিয়া মনে মনে খিস্তি করিলেও নিজেকে ‘মানুষ’, ‘লোক’ নয়, প্রমাণ করিতে সোনামুখ করিয়া সেই শুকনো মুড়ি সহযোগে মদ্যপানও করিয়াছি। বেশ জোরের সঙ্গেই ভাবিয়াছি যে, পত্নীর ভ্রাতাসূচক শুদ্ধাচ্চারণ যুক্ত ছেলেটি শুকনো ‘হুড়ুম’ সহযোগে এই শীতের রাত্রে আমাকে মদ্যপানে সঙ্গ দিয়া প্রকৃতপক্ষে আমাকে ঠকাইয়াছে।

ঠাকানো! বেশ ছেলেবেলায় আমাদের ‘দেশের বাড়ি’তে একটি প্রতিবেশি শিশুকন্যা কথার ছলে আমার মাকে বলেছিল; যানো ত্য, মা আমারে ঠাকাইছে। দাদুর পড়ার ঘরে ছিলাম আমি। মা, জ্যেঠিমাদের আড্ডা চলছিল দাদু, ঠাকুমার শোওয়ার ঘরে। পাশাপাশি ঘর বলে পাশের বাড়ির বাচ্চা মেয়েটার মজাদার উচ্চারণ কানে এসেছিল।

সেই দেশের বাড়িতে আজ আমার যাওয়ার অধিকারটুকুও নেই। কারণ? না, রাডক্লিফ কাঁটাতার দেয়নি আমার দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে। জ্যাঠতুতো দিদি আমার সই জাল করে আমার দেশের বাড়িকে অন্যদের ফ্ল্যাট করে দিয়েছে। আমাকে ঠকিয়েছে।

সেই ঠকানো নিয়ে মনে মনে যথেষ্ট শোরগোল করলেও আইন আদালতে আজও যেতে পারি নি। যাব, যাব ভেবেই গেছি। বিবেক বলছে, যাওয়া দরকার। কারণ, আমাকে ঠকানোর উচিত শান্তি ঠকবাজকে আমি দিতে চাই।

ঠকবাজ? আচ্ছা, এই যে পরশু দিন এক কিলো চা পাতা কেনার জন্যে দোকানে আটশো টাকা দিয়ে বললাম; আড়াইশো গ্রাম করে চারটে প্যাকেট করে দেবেন। তা সেই চা পাতা নেওয়ার সময় আড়াইশো গ্রাম করে মোট আটটা প্যাকেট, অর্থাৎ; এক কিলোর দাম দিয়ে, দু কিলো চা যখন পেলাম, একটিবারের জন্যেও দোকানদার কে বললাম না তো, আপনি ভুল করে এক কেজি বেশি চা দিয়ে দিয়েছেন।

চা নিয়ে বাড়ি ফিরে বরং এই এক কিলোর পয়সা দিয়ে দু কিলো চা পেয়ে যাওয়ার ঘটনাটা যখন আমার বৌ সুফিয়াকে বললাম, সে বেশ যুক্তি দিয়েই আমাকে বোঝালো; কতো জায়গায় তো ঠকে আসছ। একটু না হয় এবার দোকানদারই ঠকলো। তা বলে দোকানদার যদি বলে এই দু কিলোর ব্যাপারটা, একদম স্বীকার করো না যেন।

আটশো টাকা কেজি দরের চা পাতা কিনেছি। গড়পড়তা চাকরিজীবী নই এটা বোঝাই যায়। তা না হলে কেবল চায়ের পিছনে কেউ কি এতো বেশি খচ্চা করে? আমি একটা কলেজে পড়াই। আমার বৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। ছেলে নেই। মেয়ে নেই। তাদের পড়াশুনো, বিয়ের খরচ নিয়ে ভাববার কোনো প্রশ্নই তাই ওঠে না। সেই কারণেই যারা আটশো, হাজার টাকা দামের চা খাওয়ার দলের লোক, সুড়সুড় করে তাদের দলে ঢুকে গেছি। যদিও আমার মনে আছে, ছাত্রজীবনে বাড়ির চা কিনতে তিরিশ টাকা সমীরদাকে দিতাম। চায়ের দোকানের মালিক সমীরদা, সেই টাকার বিনিময়ে আমাকে পাঁচশো গ্রাম চা দিতো। সেই আমিই এখন আটশো, হাজারের চা কিনি। এতো দামি চা কেনার মুরোদ থাকা সত্ত্বেও চায়ের দোকানের ছেলেটার ভুলে এক কেজি চা বেশি চলে আসার পরেও আমি কিন্তু বেমালুম বেশি চা পাওয়ার বিষয়টা চেপে গেলাম। আমি কিন্তু রাজনীতির লোকেরা কীভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছেন, তা নিয়ে বেশ সন্দর্ভ গোছের উত্তর সম্পাদকীয় খবরের কাগজে লিখে একই সঙ্গে বাহবা এবং টু পাইস কামাই।

নতুন বছরের রাতে দেরাদুন রাইসের গরম ভাত আর চিংড়ির মালাইকারি খাব, মনের খাউস হয়েছে। কাঠবাঙাল আমি। তবু বাগবাজারী ভাষায় কতা কয়ে নিজেকে ঘটি প্রমাণ করবার বিফল চেষ্টা করি। হয়তো মনের অগোচরে তৃপ্তি মিত্রের ‘অপরাজিতা’ নাটকে, অপরাজিতার স্বামীর ‘বাঙাল’ বলে ফাল পেরে গাল দেওয়ার ব্যাপারটা আমার ভিতরে একটা ট্যাবু তৈরি করেছে। তাই আমি ঘটি হতে চেয়ে বাগবাজারী ভাষা রপ্ত করবার চেষ্টা করলেও সেই গোপাল ভাঁড়ের মাতৃভাষা চেনার কৌশল মোতাবেক, মাঝেমধ্যেই কলবলিয়ে গঙ্গাপার ছেড়ে, পদ্মাপারের লব্জ আওড়ে ফেলি। এই যেমন ‘হাউসে’র কথা বললুম। খাঁটি বোগরাইয়া, অর্থাৎ বগুড়ার লব্জ।

তা সেই ‘হাউস’ বা ‘ইচ্ছে’ যাই বলা যাক না কেন, তার তাগিদে, সেই চায়ের দোকানটার পাশের দোকান থেকেই দু কিলো চাল কিনলাম। সত্তর টাকা করে কিলো। কৃষকদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের কাগজে বেশ গরম গরম ‘মতামত’ লিখেছি। আরে আমি তো সেই কবে থেকে দেরাদুন রাইসের পেটেন্ট যাতে এই দেশের হাতে থাকে, তার জন্যে যিনি লড়াই টড়াই করছেন, তাঁর সভাতে গিয়েছি। সভা শেষে দাদাবৌদির বিরিয়ানি, তলার চাল, রেওয়াজি মাংস দিতে বলে, দোকানের মালিক রাজীবকে বলে, সেসব পেঁদিয়ে, কড়ায়গণ্ডায় দাম মিটিয়ে বাইরে এসে টুথপিক দিয়ে দাঁত খুঁচিয়েছিলাম। তারপরেও সেই দোকান কোন এমপিকে কবে কালো স্করপিও গিফট করেছিল, না করতে বাধ্য হয়েছিল, তা নিয়ে আসর গরম করেছি। এইসব কি আমার কৃষক সংহতির পরিচায়ক নয়? তাই আমরা স্বামী, স্ত্রী দুজনেই রোজগেরে। যাকে বলে উচ্চ মধ্যবিত্ত। সেই আমি কি নতুন বছরের শুরুতে দু’কেজি সত্তর টাকা দরের দেরাদুন রাইস কিনে, সেই চালের দোকানের পাশের, সেই চায়ের দোকানটাকে আড়চোখে দেখেও টুক করে কেটে পড়তে পারি না?

মটকাটা সকাল থেকেই খারাপ ছিল। দশ কিলোমিটার দূরে, পরের রেলস্টেশনের গায়ে দারুণ একটা মাছের আড়ত আছে। শীত পড়বার আগে গেছিলাম। দারুণ সস্তা। আমাদের মতো ডাঞ্চিবাবুরা যদি একটা আটপৌরে পাজামা, পাঞ্জাবি পরে সেখানে যায়, আড়তদারেরা বুঝেও না বোঝার ভান করে, পাইকারি দরেই দুচার কিলো পমফ্রেট বা গলদা চিড়িং তাদের কাছে অবলীলায় বেচে। আসলে আড়তদারদের যেমন বেচা নিয়ে কথা, গেরস্ত খদ্দের, নাকি হাফ গেরস্ত, মানে বাজারে মাছ নিয়ে বসবে, এইসব জাত বিচার তারা করে না। যেমন, হোলসেল ওষুধের দোকান থেকে আমার মতো লোকেরা অবলীলায় নিজের ডায়াবেটিস থেকে বৌয়ের থাইরয়েডের ওসুধ কিনে থাকি আর কি!

সেই দেশের বাড়িতে আজ আমার যাওয়ার অধিকারটুকুও নেই। কারণ? না, রাডক্লিফ কাঁটাতার দেয়নি আমার দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে। জ্যাঠতুতো দিদি আমার সই জাল করে আমার দেশের বাড়িকে অন্যদের ফ্ল্যাট করে দিয়েছে

নতুন বছরের শুরুতে গলদা চিংড়ির মালাইকারী খাব বলে একটা ছেলেকে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম সেই আড়তে। আমাদের পাড়ার বাজারে যে গলদা আটশোর নিচে মেলে না, আড়তে সেটাই তিনশো টাকা কিলো। ছেলেটা এনেছে গলদা নয়, বাগদাও নয়, মাঝারি সাইজের চিংড়ি। তাও আবার মাথা কাটা। সুফিয়া মাছ কাটতে পারে না। তাই বাজার থেকে মাছ কেটেই আনি। ছেলেটাকেও বলেছিলাম, মাছটা কেটে আনতে। আমাদের মতো ডাঞ্চিদের জন্যে মাছ কাটার মাসী বসে আড়তের পাশেই। দুতিন কিলো মাছ কাটতে পঞ্চাশ টাকা নেয়।

রাঁধবার আগেই সুফিয়া বলল, মাছের মুড়োগুলো নেই। কেবল ধরটা আছে। মটকাটা তখন থেকেই গরম। আমার ছোটবেলায়, তখন এতো চাষের চিংড়ি হতো না, না কি কেনবার সামর্থ্য ছিল না, কে জানে, আমার বড়মামা বাজার থেকে কেবল গলদা চিংড়ির মুড়ো আনত। সেই সময়ের বেশ প্রচলিত কথা, চিংড়ির ধরটা ফরেনে এক্সপোর্ট হয়, বেশ বিশ্বাস করতাম। তাই সুফিয়া বলার সাথে সাথেই মাথায় ক্লিক করে উঠলো, ব্যাটা যে ছেলেটাকে মাছ আনতে পাঠিয়েছিলাম, সে ব্যাটাই চিংড়ির মুড়োগুলো ঝেরে দিল না তো?

তার উপর, ছোট চিংড়ি বলে সুফিয়ার ব্যাজার মুখ আমাকে ভাবাচ্ছে, ও কী মনে মনে ভাবছে, পয়সা বাঁচাতে আমিই গলদার বদলে ছোট চিংড়ি আনতে বলেছিলাম? আসলে এই ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও হয়তো কোথাও আমাদের স্বামী-স্ত্রীর প্রায় তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবন, আর তার আগে দু’বছরের প্রেম, মোট বত্রিশ বছরের চেনাজানার দেওয়াল সত্যিই মজবুত কিনা, সেটা নিয়ে আমরা দুজনাই মাঝে মাঝে বেশ কনফিউজড হয়ে যাই। তার উপরে আজ কাগজে পড়লাম, স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট নাকি আমাদের মতো বিয়ের ক্ষেত্রে আর আগের মতো সুরক্ষা দিতে পারছে না। সেই সুরক্ষা না দিতে পারার কারণটা কেবল রাজনৈতিক, না সামাজিকও, তা ভেবেচিন্তে দেখার আগেই চিংড়ি ঘিরে এই আবছা আবছা সংশয়, মটকা কেন আমার গরম হবে না? আচ্ছা, আমাদের জেনারেশন ‘মটকা’ শব্দে অভ্যস্ত হলো কবে? আমাদের কালে তো ‘মেজাজ, মর্জি’ই জলচল ছিল। তখনই মাছ এনে দেওয়া ছেলেটাকে সুফিয়ার সামনে ফোন করলাম। ছেলেটা ফোন ধরলো না। মেজাজটা আরো খিঁচড়ে গেল। দুপুরে খেতে বসেও ফোন কললাম। সেবারও ফোন ধরলো না। বললাম; ব্যাটা বোধহয় বুঝেছে, ওর মাছের কেরামতিটা আমরা ধরে ফেলেছি। তাই ফোন ধরছে না।

সুফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেও বুঝলাম না, আমার কথাগুলো ও বিশ্বাস করছে, কি করছে না। তবু নিজেকে সৎ দেখানোর সুযোগ কে না ছাড়ে? কথাটা আবার রিপিট করলাম। আবার ও নীরবেই আর দুটো মাছ আর একটু গ্রেভি আমার পাতে ঢেলে দিল সুফিয়া।

নতুন বছরের শুরুর দিনেই ঠকছি, মাছে ঠকেছি, মালের চ্যাটে ঠকেছি- এটা ভেবেই চাল কিনে বেরিয়েই একটা বয়স্ক রিক্সাওয়ালার সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করে দিলাম। রিক্সা ট্যান্ড থেকে রিক্সা ধরলে আমার বাড়ির সামনের মোড়ের ভাড়া হয় কুড়ি টাকা। কিন্তু আমার একটা পেটোয়া রিক্সাওয়ালা আছে। যে কি না আমার জন্যে অবলীলায় বম্বে ডাইয়িংয়ের পাশের দোকান থেকে বস্তু কিনে, নিজের ঝোলা করে এনে দেয়। কাকপক্ষীতেও টের পায় না, ভদ্দরলোক প্রফেসার কাম লেখকের এই ঢুকুঢুকুপনা। তাই তাকে কুড়ির জায়গায়, তিরিশ টাকা ভাড়া দিলেও, আজ এই নিউ ইয়ার্স ডের রাত নটায়, প্রবল শীতের ভেতর কেবলমাত্র একটা লুঙ্গি আর শার্ট পরা রিক্সাওয়ালাকে জর্জ রোডে পেয়ে গেলাম, যার জন্যে আমাকে দুকিলো চাল আর অসীমদির বইয়ের দোকান থেকে কেনা কয়েকটা ইংরেজি বই, সেই রিক্সাট্যান্ড পর্যন্ত বইতে হলো না, সেই লোকটার সাথেই ভাড়া নিয়ে বারগেনিং করতে শুরু করে দিলাম।

লোকটা পঁচিশ টাকা চেয়েছিল। পাঁচ টাকা কমালাম। পাঁচ টাকা কমিয়েই বেশ পরিতৃপ্তি পেলাম। শীতের ভিতরে এতোটা পথ ঢিকঢিক করে টানতে রিক্সাওয়ালার যে কষ্ট হচ্ছে, সেটা বুঝেও নামার সময়ে কুড়ি টাকাই দিলাম। অথচ এই আমিই একদিন মন্ত্রীকে মাসে তিন কোটি টাকা তুলে দেওয়া এক দপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের এক টাকা নিয়ে রিক্সাওয়ালার সঙ্গে তক্কবিতক্ক নিয়ে কতো কথাই না বলিয়াছিলাম। তখন কিন্তু একটিবারের জন্যেও রিক্সাওয়ালা বলি নাই। সাধু অ্যাকসেন্টে রিক্সাচালকই বলিয়াছিলাম।

back to top