alt

সাময়িকী

বৃত্তের ভিতরে

শ্যামলী রক্ষিত

: শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১

ভোরের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল সুমনার। মনে পড়ে গেল কাল তো তার পাশের ঘরেই শুয়েছিল সুপ্রভাত। একবার উঁকি দিয়ে দেখল। কই বিছানায় তো নেই! কোথায় গেল আবার! বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল তার। গেল কোথায় মানুষটা! পরশু থেকেই কেমন গুম হয়ে আছে। ঘুম চোখে এঘর ওঘর দেখল। কিন্তু কোত্থাও নেই। ভাবল নিচের ফ্ল্যাটেই ঘুমাচ্ছে বোধ হয়। ঘুমাক একটু শান্তি করে। ঘুম ভাঙিয়ে লাভ নেই। ডাক্তার বার বার বলেছেন পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোটা খুব জরুরি। দরকার হলে ঘুমের ওষুধ দুটো করে নিতে বলেছেন! পাশ ফিরে শুলো সুমনা। কিন্তু ঘুম আসছিল না তার। মনের পর্দায় নানান আঁকিবুঁকি চলছিল তখন। নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন।

সারাদিন বাড়িতে বসে বসে শুধু চিন্তা করছে মানুষটা। বাজার দোকান সব তো বাড়ি থেকেই হয়ে যাচ্ছে। গেটের ধারে সবজি, মাছ, ফল সব আসছে। আর মুদিখানার মালপত্র সব অনলাইনে। কাজেই বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনে শামুক খিল দিয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই মানুষের। সামান্য ব্যাংকে যেতে গেলেই ভয় পাচ্ছে সবাই। একে তো করোনার আতংক তার ওপর আছে পুলিশের ভয়। একদম বাড়ির বাইরে বেরুনোর উপায় নেই। আর সুপ্রভাত তো ওসবে অভ্যস্তও নয়! অফিস আর বাড়ি এটুকুই তার জগৎ। কলকাতায় নয় নয় করে বারো চৌদ্দ বছর বাস করছে। কিন্তু কারুর সঙ্গে মেশে না। সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। ইদানীং টিভি পর্যন্ত দেখে না। সারাটা দিন শুধু গুম হয়ে বসে থাকে। সুমনার নানাভাবে কথা বলানোর চেষ্টা করে। সুপ্রভাতের ভালো লাগা বিষয় নিয়ে বার বার প্রসঙ্গ তুলে কথা বলে। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার যেন উৎসাহ নেই।

এই সব চিন্তা করতে করতেই কখন ঘুমিয়ে গেল সুমনা। ঘুম ভাঙার পর দেখল, ভারি কালো জলভরা মেঘ! দমকে দমকে বৃষ্টি। সারা শহর জুড়ে নীরবতার বাতাবরণ। যেন শহরের রাজপথে শোক পালনে নিমগ্ন জনতার সুদীর্ঘ মিছিল। কখনো ঝিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে, কখনো ঝমঝম করে। একে তো করোনায় আক্রান্ত হবার আতঙ্কে জর্জরিত মানুষ। কী করবে কীভাবে বেঁচে থাকবে সংক্রমিত হলেইবা কী করবে সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত। ঘরের বাইরে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বেরুচ্ছে না। বহুদিন ধরে কেউ কারুর মুখ দেখে না। কোন আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব কেউ কারো বাড়ি আসা যাওয়া করে না। কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় যে যেমন করে পারছে তার জীবনের মুক্তির বাতাসটুকু খুঁজে নিচ্ছে। কিন্তু সে আর কত ভালো লাগে! মশারি খুলতে খুলতে বন্দেমাতরম ধ্বনি শুনে জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটে চোখ চলে গেল সুমনার। পত পত করে তেরঙ্গা পতাকা উড়ছে। পনেরই আগস্ট। বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। তবুও সকাল হয় নি যেন। এতটা বেলা অব্দি তো সুপ্রভাত ঘুমিয়ে থাকে না! দেখি একবার গিয়ে।

কদিন ধরেই মন খারাপ করে বসে থাকছে। সুমনা অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ওর সেই এক কথা। এর আগের বার আমার ভুলে তছনছ হয়ে গেছে সব কিছু। সেই ভুলের মাশুল আমাকে সারাটা জীবন ধরে বহন করতে হবে। অমন সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা আমার। অত বড় করে, নিজের দোষে বিসর্জন দিয়েছি। তখন তোমার কথা শুনলে আমার এই চরম সর্বনাশ হতো না সুমনা। অমন চনমনে প্রাণচঞ্চল মেয়েটা কিনা একদিনের জ্বরেই চলে গেল! চারিদিকে এত বড় বড় নার্সিংহোম, ডাক্তার সব কিছু থাকতেও সামান্য জ্বরে মিমিকে হারালাম। সঙ্গে সঙ্গে যদি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম তাহলে হয়ত, মেয়েটা আমার বেঁচে যেত। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সে আসছে। আমার মিমি মা। কত কা- করে তবে সে আবার আসছে।পৃথিবীর এই ভয়ংকর অসুখের সময় কি করে যে সুস্থ থাকবে তোমরা। সুপ্রভাত হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল , কী করে আমি রক্ষা করবো তোমাদের?

এত ভয় পাচ্ছো কেন? এত দিন পরে ঠাকুর যখন মুখ তুলে চেয়েছেন, তখন তিনিই রক্ষা করবেন। চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো!

কিন্তু তখনকার মত চুপ করল বটে। একটু স্থির হলো যেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার যাকে তাই। এই কদিন সুমনার কোনো কথাও আর শুনতে চাইছে না। কিচ্ছু বলতে গেলে বিরক্ত হয়ে বলছে প্লিজ সুমনা আমাকে একা থাকতে দাও।

ভয়ে সুমনা কিছু বলে নি আর। ভয়ংকর একটা আতংকে থাকে সুপ্রভাত। সুমনাকে কিচ্ছু করতে দেয় না। বাইরের কোনো জিনিস নিয়ে এসে স্যানিটাইজ করে, সাবান জলে ধুয়ে, নিচের ঘরে সব কিছু রেখে দেয়। দু তিন দিন পরে সে সব নিজে তুলে নিয়ে আসে। নিচের ঘরে তার ঢোকা বারণ। ওপরে উঠতে পর্যন্ত চাইছে না কদিন। বলছে আমাকে মাঝে মাঝে অফিস যেতে হচ্ছে সুমনা। তোমার সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া বা বেশি কাছাকাছি হওয়া ঠিক নয়। কাল সন্ধ্যেবেলায় সুমনা জোর করেই এক প্রকার ডেকে এনে ওপরে বসে থাকা করিয়েছে।

বলেছে তোমাকে আমার কাছে থাকতে হবে কেন।

কোথায় থাকব তবে।

তুমি বসে টিভি দেখো। খবর শোনো, গান শোনো।

আমার ওসব ভালো লাগে না।

তাহলে সিনেমা দেখো। তুমি তো উত্তম কুমারের ফ্যান। কত ভালো ভালো পুরনো বাংলা সিনেমা হচ্ছে কদিন ধরে উত্তম সুচিত্রার! দেখো ভালো লাগবে।

এখানে তোমার কাছে থাকাটা নিরাপদ নয় , তোমাদের জন্যে।

ওরকম করলে আমি মায়ের কাছে গিয়ে থাকব বলে দিচ্ছি। আমার ভালো লাগছে না। সত্যিই আমি মায়ের কাছেই চলে যাব।

ভয়ে শিউরে উঠে বলল, আমি তোমাকে এখন কোথাও যেতে দোবো না সুমনা। আমার সব সময় কেমন একটা ভয় করছে। ভীষণ একটা আতংক। খেতে ইচ্ছা করছে না। ঘুমাতে পারছি না। একটা অস্থিরতা চারিদিক থেকে আমাকে যেন চেপে ধরছে। কী করব কিচ্ছু ভাবতে পারছি না সুমনা।

এরকম পরিস্থিতিতে যেমন সাবধানতা নেওয়া দরকার তুমি তো সে সব করছো। তাহলে এত ভয় কিসের। কোনো চিন্তা নেই! আমরা ভালো থাকবো দেখো।

এর পর সুপ্রভাত আর কোনো কথা বলল না। গলায় কপালে হাত দিয়ে দেখল গা গরম কিনা! ঢোক গিলে দেখল গলায় ব্যথা লাগছে কিনা। তার পর জানলা দিয়ে পশ্চিমের গোধূলি বিকেল আস্তে আস্তে কেমন করে গম্ভীর সুন্দর মায়াময় হয়ে সন্ধ্যের আঁচলে মুখ লুকাছিল তন্ময় হয়ে দেখছিল।মনে মনে তার সেই বুদবুদ উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ বুদবুদের গতি সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে বুদবুদের দৌরাত্ম বাড়ছে।কিছুতেই তাকে আর কন্ট্রোল করতে পারছে না সুপ্রভাত। একবার তার দোষে সে সব হারিয়েছে। এবারও যদি কিছু হয়! না তা আর কিছুতেই হতে দেবে না। তার জন্যে যদি নিজেকে সরে যেতে হয় তাও...

অবাক হয়ে দেখছিল আর ভাবছিল সুমনা এ কী পাগলামি শুরু করল মানুষটা। এখন এই পরিস্থিতিতে উঠতে বসতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছে তার। এদিকে তার নিজের জন্যে তো আতংক আছেই। আর একমাস পরে নার্সিং হোমে ভর্তি হবার ডেট। এই মানুষটাকে নিয়ে কী করে যে কী করবে সে কিচ্ছু ভাবতেই পারছে না।

মশারির দড়ি খুলতে খুলতে সুমনার মনে পড়ে গেল কাল শরীরটা খারাপ বলছিল! গত পরশু থেকেই কেবল গায়ে হাত দিয়ে দেখছিল জ্বর আছে কিনা। থার্মোমিটার নিয়েও দেখেছে কয়েকবার। টেম্পারেচার এক্কেবারে নরমাল আছে, তবু বারবার বলছে কেমন জ্বর জ্বর লাগছে আমার। ঢোক গিলে বলছে গলা ব্যথা লাগছে। গা হাত পা ম্যাজ ম্যাজ করছে। সারাদিন নিচের ঘরেই ছিল। খাবার বেড়ে নিয়ে, নিচে গিয়ে খেয়েছে। সুমনা এই নিয়ে প্রচ- অশান্তি করেছে। তবে পাশের ঘরে শুয়েছিল রাতে। কখন যে আবার উঠে গেছে কে জানে !

ডাক্তারবাবু কত করে বুঝিয়ে বললেন। দেখুন মনের অসুখ নিজেকেই চেষ্টা করে সারাতে হয়। আপনি শিক্ষিত মানুষ। এত বড় পোস্টে চাকরি করেন। পরিস্থিতির চাপ আপনাকে সামলাতে জানতে হবে।

সব জানি ডাক্তারবাবু। কিন্তু কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছি না।

গোটা পৃথিবীর মানুষের এখন একই রকম অবস্থা। ভয়ঙ্কর আতংকের মধ্যেই মানুষ বেঁচে আছে। আপনি সুস্থ সবল মানুষ। আপনার সুগার প্রেসার সব নর্মাল! অযথা ভয় পেয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না।

আমি ইচ্ছা করে কিছু করছি না ডাক্তার বাবু। আপনি আমাকে বাঁচান। আপনার কিচ্ছু হয় নি মিস্টার বাগচি। সাবধানে থাকলে কিছু হবেও না।

ডাক্তারের কাউন্সেলিং এর পর দুতিন দিন বেশ ভালোই ছিল। তারপর আবার সেই গুম হয়ে আছে। বোবা মানুষের সংসার যেন। সুমনা ভাবল এখন নিচে গেলেই রেগে যাবে। তবু একবার যাই দেখি জ্বর টর সত্যিই হলো কিনা।

দরজা খুলে চৌকাঠে জল দিয়েই নিচে নামছিল সুমনা। কিছুটা নামার পর দেখল সিঁড়ির দিকে জানলাটা খোলা-ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে। শব্দ শুনে আসপাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বেরিয়ে এসে, সুমনাকে তুলবে কি? জানলা দিয়ে তাদেরও দৃষ্টি চলে গেল সুপ্রভাতের ঝুলন্ত দেহের উপর। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে সুপ্রভাত। মুহূর্তের মধ্যে লোকজন জড়ো হয়ে গেল কিন্তু দরজা ভেঙে কেউ ঘরে ঢুকতে পারল না। করোনার আতংক থেকে বেরিয়ে এসে কেউ সুপ্রভাতকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করল না। থানায় পুলিশকে খবর দেবার ঘণ্টা খানেক পর এসে হাজির হলো। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, সব দেখেশুনে লিখে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে জ্ঞান ফিরল সুমনার! হাহাকার করে উঠল সে। ওকে আগে নামান বড়বাবু প্লিজ। ফেলে রেখে চলে যাবেন না আপনারা। দোহাই আপনাদের !

বড়ো বাবু বললেন, আমরা বডিতে হাত দিতে পারব না ম্যাডাম। ওনার কোবিদ পজিটিভ কিনা কে বলতে পারে!

সুমনা আট মাসের সন্তান পেটে নিয়ে ,আছাড় কাছাড় করে কাঁদছে। পাশের বস্তির লোকজন এসে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। হায় হায় করছে সবাই কিন্তু দরজা ভেঙে বডিটাকে নামাতে সাহস পায় নি কেউ। একে করোনার ভয়, তার ওপর পুলিশের ছোঁয়া। ঝুলতেই থাকল সুপ্রভাতের শরীরটা। বেশ কিছুক্ষণ পর ফ্লাটেরই কেউ একজন জানলাটা আলতো করে বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে। দৃশ্যটা দেখা যাচ্ছে না, ভীষণ আতংকে আর অসহায়তায় থর থর করে কাঁপছে প্রত্যেকটা মানুষ।

প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা পর সুপ্রভাতের বডি নামল। দরজা ভাঙ্গার বিকট শব্দে সারা পাড়া খান খান হয়ে যাচ্ছিল তখন। ভয়ে আতঙ্কে সবার শরীর যেন বাতাসে ভাসছে। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাই যেন সন্ধিহান। পচা গন্ধে কাক চিল এসে বসেছে ছাতের মাথায়। সুমনার কান্না যেন শহরের অলিতে গলিতে ধাক্কা খেতে খেতে সবার কানের পর্দায় ভেদ করে বুকের গভীরে উত্তাল শোকের ঢেউ তুলছে। ক্রমশ সেই গোঙানিতে চাপা পড়ে যাচ্ছিল মানুষের অস্তিত্ব! যেন গভীর অন্ধকারময় এক অচেতন অনুভূতির দুয়ারে এসে দাঁড়িয়ে আছে যে যার বৃত্তে। কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারছে না। চারিদিকে জল বেষ্ঠিত দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

বৃত্তের ভিতরে

শ্যামলী রক্ষিত

শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১

ভোরের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল সুমনার। মনে পড়ে গেল কাল তো তার পাশের ঘরেই শুয়েছিল সুপ্রভাত। একবার উঁকি দিয়ে দেখল। কই বিছানায় তো নেই! কোথায় গেল আবার! বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল তার। গেল কোথায় মানুষটা! পরশু থেকেই কেমন গুম হয়ে আছে। ঘুম চোখে এঘর ওঘর দেখল। কিন্তু কোত্থাও নেই। ভাবল নিচের ফ্ল্যাটেই ঘুমাচ্ছে বোধ হয়। ঘুমাক একটু শান্তি করে। ঘুম ভাঙিয়ে লাভ নেই। ডাক্তার বার বার বলেছেন পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোটা খুব জরুরি। দরকার হলে ঘুমের ওষুধ দুটো করে নিতে বলেছেন! পাশ ফিরে শুলো সুমনা। কিন্তু ঘুম আসছিল না তার। মনের পর্দায় নানান আঁকিবুঁকি চলছিল তখন। নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন।

সারাদিন বাড়িতে বসে বসে শুধু চিন্তা করছে মানুষটা। বাজার দোকান সব তো বাড়ি থেকেই হয়ে যাচ্ছে। গেটের ধারে সবজি, মাছ, ফল সব আসছে। আর মুদিখানার মালপত্র সব অনলাইনে। কাজেই বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনে শামুক খিল দিয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই মানুষের। সামান্য ব্যাংকে যেতে গেলেই ভয় পাচ্ছে সবাই। একে তো করোনার আতংক তার ওপর আছে পুলিশের ভয়। একদম বাড়ির বাইরে বেরুনোর উপায় নেই। আর সুপ্রভাত তো ওসবে অভ্যস্তও নয়! অফিস আর বাড়ি এটুকুই তার জগৎ। কলকাতায় নয় নয় করে বারো চৌদ্দ বছর বাস করছে। কিন্তু কারুর সঙ্গে মেশে না। সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। ইদানীং টিভি পর্যন্ত দেখে না। সারাটা দিন শুধু গুম হয়ে বসে থাকে। সুমনার নানাভাবে কথা বলানোর চেষ্টা করে। সুপ্রভাতের ভালো লাগা বিষয় নিয়ে বার বার প্রসঙ্গ তুলে কথা বলে। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার যেন উৎসাহ নেই।

এই সব চিন্তা করতে করতেই কখন ঘুমিয়ে গেল সুমনা। ঘুম ভাঙার পর দেখল, ভারি কালো জলভরা মেঘ! দমকে দমকে বৃষ্টি। সারা শহর জুড়ে নীরবতার বাতাবরণ। যেন শহরের রাজপথে শোক পালনে নিমগ্ন জনতার সুদীর্ঘ মিছিল। কখনো ঝিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে, কখনো ঝমঝম করে। একে তো করোনায় আক্রান্ত হবার আতঙ্কে জর্জরিত মানুষ। কী করবে কীভাবে বেঁচে থাকবে সংক্রমিত হলেইবা কী করবে সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত। ঘরের বাইরে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বেরুচ্ছে না। বহুদিন ধরে কেউ কারুর মুখ দেখে না। কোন আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব কেউ কারো বাড়ি আসা যাওয়া করে না। কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় যে যেমন করে পারছে তার জীবনের মুক্তির বাতাসটুকু খুঁজে নিচ্ছে। কিন্তু সে আর কত ভালো লাগে! মশারি খুলতে খুলতে বন্দেমাতরম ধ্বনি শুনে জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটে চোখ চলে গেল সুমনার। পত পত করে তেরঙ্গা পতাকা উড়ছে। পনেরই আগস্ট। বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। তবুও সকাল হয় নি যেন। এতটা বেলা অব্দি তো সুপ্রভাত ঘুমিয়ে থাকে না! দেখি একবার গিয়ে।

কদিন ধরেই মন খারাপ করে বসে থাকছে। সুমনা অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ওর সেই এক কথা। এর আগের বার আমার ভুলে তছনছ হয়ে গেছে সব কিছু। সেই ভুলের মাশুল আমাকে সারাটা জীবন ধরে বহন করতে হবে। অমন সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা আমার। অত বড় করে, নিজের দোষে বিসর্জন দিয়েছি। তখন তোমার কথা শুনলে আমার এই চরম সর্বনাশ হতো না সুমনা। অমন চনমনে প্রাণচঞ্চল মেয়েটা কিনা একদিনের জ্বরেই চলে গেল! চারিদিকে এত বড় বড় নার্সিংহোম, ডাক্তার সব কিছু থাকতেও সামান্য জ্বরে মিমিকে হারালাম। সঙ্গে সঙ্গে যদি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম তাহলে হয়ত, মেয়েটা আমার বেঁচে যেত। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সে আসছে। আমার মিমি মা। কত কা- করে তবে সে আবার আসছে।পৃথিবীর এই ভয়ংকর অসুখের সময় কি করে যে সুস্থ থাকবে তোমরা। সুপ্রভাত হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল , কী করে আমি রক্ষা করবো তোমাদের?

এত ভয় পাচ্ছো কেন? এত দিন পরে ঠাকুর যখন মুখ তুলে চেয়েছেন, তখন তিনিই রক্ষা করবেন। চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো!

কিন্তু তখনকার মত চুপ করল বটে। একটু স্থির হলো যেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার যাকে তাই। এই কদিন সুমনার কোনো কথাও আর শুনতে চাইছে না। কিচ্ছু বলতে গেলে বিরক্ত হয়ে বলছে প্লিজ সুমনা আমাকে একা থাকতে দাও।

ভয়ে সুমনা কিছু বলে নি আর। ভয়ংকর একটা আতংকে থাকে সুপ্রভাত। সুমনাকে কিচ্ছু করতে দেয় না। বাইরের কোনো জিনিস নিয়ে এসে স্যানিটাইজ করে, সাবান জলে ধুয়ে, নিচের ঘরে সব কিছু রেখে দেয়। দু তিন দিন পরে সে সব নিজে তুলে নিয়ে আসে। নিচের ঘরে তার ঢোকা বারণ। ওপরে উঠতে পর্যন্ত চাইছে না কদিন। বলছে আমাকে মাঝে মাঝে অফিস যেতে হচ্ছে সুমনা। তোমার সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া বা বেশি কাছাকাছি হওয়া ঠিক নয়। কাল সন্ধ্যেবেলায় সুমনা জোর করেই এক প্রকার ডেকে এনে ওপরে বসে থাকা করিয়েছে।

বলেছে তোমাকে আমার কাছে থাকতে হবে কেন।

কোথায় থাকব তবে।

তুমি বসে টিভি দেখো। খবর শোনো, গান শোনো।

আমার ওসব ভালো লাগে না।

তাহলে সিনেমা দেখো। তুমি তো উত্তম কুমারের ফ্যান। কত ভালো ভালো পুরনো বাংলা সিনেমা হচ্ছে কদিন ধরে উত্তম সুচিত্রার! দেখো ভালো লাগবে।

এখানে তোমার কাছে থাকাটা নিরাপদ নয় , তোমাদের জন্যে।

ওরকম করলে আমি মায়ের কাছে গিয়ে থাকব বলে দিচ্ছি। আমার ভালো লাগছে না। সত্যিই আমি মায়ের কাছেই চলে যাব।

ভয়ে শিউরে উঠে বলল, আমি তোমাকে এখন কোথাও যেতে দোবো না সুমনা। আমার সব সময় কেমন একটা ভয় করছে। ভীষণ একটা আতংক। খেতে ইচ্ছা করছে না। ঘুমাতে পারছি না। একটা অস্থিরতা চারিদিক থেকে আমাকে যেন চেপে ধরছে। কী করব কিচ্ছু ভাবতে পারছি না সুমনা।

এরকম পরিস্থিতিতে যেমন সাবধানতা নেওয়া দরকার তুমি তো সে সব করছো। তাহলে এত ভয় কিসের। কোনো চিন্তা নেই! আমরা ভালো থাকবো দেখো।

এর পর সুপ্রভাত আর কোনো কথা বলল না। গলায় কপালে হাত দিয়ে দেখল গা গরম কিনা! ঢোক গিলে দেখল গলায় ব্যথা লাগছে কিনা। তার পর জানলা দিয়ে পশ্চিমের গোধূলি বিকেল আস্তে আস্তে কেমন করে গম্ভীর সুন্দর মায়াময় হয়ে সন্ধ্যের আঁচলে মুখ লুকাছিল তন্ময় হয়ে দেখছিল।মনে মনে তার সেই বুদবুদ উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ বুদবুদের গতি সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে বুদবুদের দৌরাত্ম বাড়ছে।কিছুতেই তাকে আর কন্ট্রোল করতে পারছে না সুপ্রভাত। একবার তার দোষে সে সব হারিয়েছে। এবারও যদি কিছু হয়! না তা আর কিছুতেই হতে দেবে না। তার জন্যে যদি নিজেকে সরে যেতে হয় তাও...

অবাক হয়ে দেখছিল আর ভাবছিল সুমনা এ কী পাগলামি শুরু করল মানুষটা। এখন এই পরিস্থিতিতে উঠতে বসতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছে তার। এদিকে তার নিজের জন্যে তো আতংক আছেই। আর একমাস পরে নার্সিং হোমে ভর্তি হবার ডেট। এই মানুষটাকে নিয়ে কী করে যে কী করবে সে কিচ্ছু ভাবতেই পারছে না।

মশারির দড়ি খুলতে খুলতে সুমনার মনে পড়ে গেল কাল শরীরটা খারাপ বলছিল! গত পরশু থেকেই কেবল গায়ে হাত দিয়ে দেখছিল জ্বর আছে কিনা। থার্মোমিটার নিয়েও দেখেছে কয়েকবার। টেম্পারেচার এক্কেবারে নরমাল আছে, তবু বারবার বলছে কেমন জ্বর জ্বর লাগছে আমার। ঢোক গিলে বলছে গলা ব্যথা লাগছে। গা হাত পা ম্যাজ ম্যাজ করছে। সারাদিন নিচের ঘরেই ছিল। খাবার বেড়ে নিয়ে, নিচে গিয়ে খেয়েছে। সুমনা এই নিয়ে প্রচ- অশান্তি করেছে। তবে পাশের ঘরে শুয়েছিল রাতে। কখন যে আবার উঠে গেছে কে জানে !

ডাক্তারবাবু কত করে বুঝিয়ে বললেন। দেখুন মনের অসুখ নিজেকেই চেষ্টা করে সারাতে হয়। আপনি শিক্ষিত মানুষ। এত বড় পোস্টে চাকরি করেন। পরিস্থিতির চাপ আপনাকে সামলাতে জানতে হবে।

সব জানি ডাক্তারবাবু। কিন্তু কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছি না।

গোটা পৃথিবীর মানুষের এখন একই রকম অবস্থা। ভয়ঙ্কর আতংকের মধ্যেই মানুষ বেঁচে আছে। আপনি সুস্থ সবল মানুষ। আপনার সুগার প্রেসার সব নর্মাল! অযথা ভয় পেয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না।

আমি ইচ্ছা করে কিছু করছি না ডাক্তার বাবু। আপনি আমাকে বাঁচান। আপনার কিচ্ছু হয় নি মিস্টার বাগচি। সাবধানে থাকলে কিছু হবেও না।

ডাক্তারের কাউন্সেলিং এর পর দুতিন দিন বেশ ভালোই ছিল। তারপর আবার সেই গুম হয়ে আছে। বোবা মানুষের সংসার যেন। সুমনা ভাবল এখন নিচে গেলেই রেগে যাবে। তবু একবার যাই দেখি জ্বর টর সত্যিই হলো কিনা।

দরজা খুলে চৌকাঠে জল দিয়েই নিচে নামছিল সুমনা। কিছুটা নামার পর দেখল সিঁড়ির দিকে জানলাটা খোলা-ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে। শব্দ শুনে আসপাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বেরিয়ে এসে, সুমনাকে তুলবে কি? জানলা দিয়ে তাদেরও দৃষ্টি চলে গেল সুপ্রভাতের ঝুলন্ত দেহের উপর। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে সুপ্রভাত। মুহূর্তের মধ্যে লোকজন জড়ো হয়ে গেল কিন্তু দরজা ভেঙে কেউ ঘরে ঢুকতে পারল না। করোনার আতংক থেকে বেরিয়ে এসে কেউ সুপ্রভাতকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করল না। থানায় পুলিশকে খবর দেবার ঘণ্টা খানেক পর এসে হাজির হলো। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, সব দেখেশুনে লিখে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে জ্ঞান ফিরল সুমনার! হাহাকার করে উঠল সে। ওকে আগে নামান বড়বাবু প্লিজ। ফেলে রেখে চলে যাবেন না আপনারা। দোহাই আপনাদের !

বড়ো বাবু বললেন, আমরা বডিতে হাত দিতে পারব না ম্যাডাম। ওনার কোবিদ পজিটিভ কিনা কে বলতে পারে!

সুমনা আট মাসের সন্তান পেটে নিয়ে ,আছাড় কাছাড় করে কাঁদছে। পাশের বস্তির লোকজন এসে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। হায় হায় করছে সবাই কিন্তু দরজা ভেঙে বডিটাকে নামাতে সাহস পায় নি কেউ। একে করোনার ভয়, তার ওপর পুলিশের ছোঁয়া। ঝুলতেই থাকল সুপ্রভাতের শরীরটা। বেশ কিছুক্ষণ পর ফ্লাটেরই কেউ একজন জানলাটা আলতো করে বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে। দৃশ্যটা দেখা যাচ্ছে না, ভীষণ আতংকে আর অসহায়তায় থর থর করে কাঁপছে প্রত্যেকটা মানুষ।

প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা পর সুপ্রভাতের বডি নামল। দরজা ভাঙ্গার বিকট শব্দে সারা পাড়া খান খান হয়ে যাচ্ছিল তখন। ভয়ে আতঙ্কে সবার শরীর যেন বাতাসে ভাসছে। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাই যেন সন্ধিহান। পচা গন্ধে কাক চিল এসে বসেছে ছাতের মাথায়। সুমনার কান্না যেন শহরের অলিতে গলিতে ধাক্কা খেতে খেতে সবার কানের পর্দায় ভেদ করে বুকের গভীরে উত্তাল শোকের ঢেউ তুলছে। ক্রমশ সেই গোঙানিতে চাপা পড়ে যাচ্ছিল মানুষের অস্তিত্ব! যেন গভীর অন্ধকারময় এক অচেতন অনুভূতির দুয়ারে এসে দাঁড়িয়ে আছে যে যার বৃত্তে। কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারছে না। চারিদিকে জল বেষ্ঠিত দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।

back to top