alt

সাময়িকী

এক বাউল জীবনের কথা

গৌতম রায়

: রোববার, ২১ নভেম্বর ২০২১

র‌্যাডক্লিফের কাঁচি যে মানুষটির প্রসন্ন মুখে সব সময়েই একটা লুকনো ব্যথার খনির সন্ধান দিত, ‘শকুন’ থেকে ‘করতলে ছিন্নমাথা’র ক্লিন্নতাকে পদ্মার কোল ঘেঁষে বর্ধমানের রাঢ় বাংলার সংস্কৃতির মৃদু গুঞ্জনে আবর্তিত হতো, সেই মাটির স্পর্শ খুঁজে পাওয়া আপামর বাঙালি হাসান আজিজুল হক মিশে রইলেন এই মাটিতেই। যে সময়ে সেই মানুষটি এই পৃথিবীর বুক থেকে শেষ বায়ুটি নিয়ে পৃথিবীর বুকেই তা ফিরিয়ে দিচ্ছেন, সেই ক্ষণটিতে যে আমি সেই ‘আগুনপাখি’র দেশ বর্ধমানেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। রাঢ়ের আয়মাদারির অন্যতম পীঠস্থান পার্কাস রোডে আমার সেই সময়টিতে, অস্তমিত গোধূলিতে, মাগরিবের ছায়া বাঁকার জলে ঘর পাতার সেই পরমক্ষণটিতে কি নীড়হারা ‘শকুন’টি, আর সেই শকুন ঘিরে কিশোরটির অন্তহীন জাগরের তৃষ্ণাই স্বাতী নক্ষত্রের জলের জন্যে আকাশ পানে চেয়েছিল? সেভাবেই তৈরি হয়ে উঠছিল সাবিত্রীর কোনো নতুন উপাখ্যান? বৃষ্টি ছিল সারাদিন। হয়তো কবি অমিয় চক্রবর্তীর আলবার্ট সোয়াইৎজারের মহাপ্রয়াণের ঝলসিত কলমের মতোই বাঙালি উচ্চারণ করছে এখন, ‘প্রয়াণী গেছেন রাত্রে, বিশ্ববাসী পরম আত্মীয়হারা’।

অখ- বাঙালি জাতিসত্তার যে বীজ বপন করা হয়েছিল বাঙালির হৃদয়ে মহান একুশের চেতনার ভিতর দিয়ে, যে বীজের ফসল ছিলেন অন্নদাশঙ্কর, কাজী আবদুল ওদুদ, ডঃ শহীদুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আবু সয়ীদ আইয়ুব, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামানরা, সেই চেতনার সমুদ্রে প্রত্যক্ষ অবগাহন করা শেষ মানুষটি চলে গেলেন। মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে দেশ ভেঙে গেলেও বাঙালিকে যাঁরা ভাঙতে দেননি প্রাণ দিয়ে, সেই কর্মকা-ে অংশ নেওয়া প্রজন্মের বুঝি শেষ প্রতিনিধি ছিলেন হাসান আজিজুল হক। তাঁর পরে যাঁরা থাকলেন, তাঁরা এঁদের প্রবাহিনী ধারার ফসল। কিন্তু সেই ক্ষতের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই। তাই, ধেড়ে খোকাদের বাংলা ভাগের কঠিন-কঠোর- উদ্ধত-অসহায় সমালোচক অন্নদাশঙ্কর আর বর্ধমানের যবগ্রামের ছিন্নমূল হাসান আজিজুল হকের যন্ত্রণার যে অন্তরঙ্গ অনুভূতি, তাকে জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ধারণ করে যে কোনো রকমের বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সোচ্চার হওয়ার যে মেরুদণ্ড- তার শেষ নিঃশব্দ পদচারণা স্তব্ধ হয়ে পড়ার ব্যথাই আজ সব থেকে বেশি বুকে বাজছে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যার মূল মন্ত্রই হলো, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরোধিতা, সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মফস্বলে প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হককে অন্যতম আদিগুরু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়

দেশভাগের যন্ত্রণা আজকের প্রজন্মের বাঙালির বুকে বাজে রাজনীতির নানা দেনাপাওনার হিসেবনিকেশ থেকে। হাসান আজিজুল হকের মতো মানুষের বুকে সেই ব্যথা বেজেছিল অবিরত রক্তক্ষরণের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে। সেই যন্ত্রণা তাঁর জীবনে একদিনের জন্যেও উপশম হয় নি। বিজিত বাংলায় যশ, সম্মান, মর্যাদা- সবকিছুই পেয়েছেন হাসান আজিজুল হক। কিন্তু এই পাওয়ার তৃপ্তির ভিতরেও তাঁর কাছে সবস থেকে অতৃপ্তি ছিল বিভাজিত বাঙালির বুক থেকে বিভাজনজনিত রক্ত চুইয়ে পড়বার ব্যথা।

পূর্ব পাকিস্থানের রাজনীতির আবর্তন হাসান আজিজুল হক দেখেছেন। সেই দেখাকে খোদাই করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। কিন্তু সেই খোদাই কর্মের কালেও মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে বাঙালিকে বিভাজিত করবার ভুলটির উদ্দেশে সব সময়েই একটা সূক্ষ্ম প্রতিবাদ, বিরক্তির উচ্চারণ থেকে তিনি একবারের জন্যেও নিজেকে বিরত করেননি। হয়তো সেই সময়ের প্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্থানের ইসলামিকরণের জেরে বাঙালি সমাজের ভিতরে যে চেতনার, মননশীলতার দোলাচাল তৈরির প্রচেষ্টা চলছিল, বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলির ভিতরে থেকে যাঁরা সেই অশুভের আবাহনের বিরোধিতা করে যাচ্ছিলেন, তাঁদের ভিতরে হাসান আজিজুল হক এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কারণ, ঢাকা শহর কেন্দ্রিক যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের শুভলগ্ন ঘোষিত হচ্ছিল, তার প্রভাব মফস্বলে পাঁচের দশকের সূচনাপর্বের কালে তখনো সেভাবে পড়েনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যার মূল মন্ত্রই হলো, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরোধিতা, সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মফস্বলে প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হককে অন্যতম আদিগুরু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির প্রাঙ্গণে কখনো পা রাখেননি এই অতি বিরল প্রজাতির কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না থেকেও পশ্চিম পাকিস্থানের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে গ্রাম বাংলার মানুষের বৌদ্ধিক চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে কলমকে ব্যবহার করে হাসান আজিজুল হক যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই ভূমিকা একজন প্রথম সারির পলিটিকাল অ্যাকটিভিস্টের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না।

ভাষা আন্দোলনের পারস্পর্য বজায় রেখে কথাসাহিত্যের চর্চায় বাঙালি জীবনের বারমাস্যাকে যেভাবে হাসান আজিজুল হক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সূতিকাগৃহ নির্মাণ বললে অত্যুক্তি হবে না। হাসান আজিজুল হকের সেই সময়ের কলমের প্রভাব কোনো অংশেই মুনীর চৌধুরীদের ‘কবর’ নাটক বা জহির রায়হানদের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ফিল্ম বা শামসুর রাহমানদের ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ হয়ে, ‘বন্দি শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের সেই যমজ কবিতা, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ আর, ‘স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা’র ঐতিহাসিক মূল্যের থেকে কম নয়।

পশ্চিম পাকিস্থানের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে বাঙালিকে সচেতন করবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা পরিসরের ভিতরে সাহিত্য-সংস্কৃতির ভূমিকা ঐতিহাসিক। আর সেই ভূমিকাকে গ্রাম বাংলায় প্রবাহিত করবার ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক যে অবদান রেখে গেলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক এবং সার্থক করবার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাকে ঐতিহাসিক বললেও খুব কম বলা হয়।

পশ্চিম পাকিস্থানের পূর্ব পাকিস্থানের উপর সব ধরনের শোষণের পিছনে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযোদ্ধোত্তর সময়কালের আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির প্রভাব। সেই প্রভাবে সব থেকে ন্যক্কারজনক ভূমিকা ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের। সোভিয়েট ইউনিয়নের জ্বাজল্য উপস্থিতিতে ভারতীয় উপমহাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য কায়েমে পশ্চিম পাকিস্থানকে বোড়ের চাল হিসেবে বেছে নিয়েছিল আমেরিকা। সোভিয়েতের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের নিরিখে ভারতের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস, ভারতে সব ধরনের আস্থিরতা তৈরি, ধর্মীয় বিদ্বেষের বাতাবরণ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগকে কেন্দ্র করে যাতে চিরস্থায়ী করা যায় সেজন্যে ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আর সেই পাকিস্থানের সেই সময়ের দুটি অংশেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদকে দগদগে ঘায়ের মতো ছড়িয়ে দেওয়া ছিল মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের নয়া ঔপনিবেশিক কৌশল।

সেই কৌশলকে প্রতিহত করবার ক্ষেত্রে ভারতে যেমন অন্নদাশঙ্কর রায়, সমরেশ বসু, মুলকরাজ আনন্দ, উমাশঙ্কর যোশী, অমৃতা প্রীতমেরা প্রাণপণ লড়াই করেছেন, তেমনই বাংলাদেশে ঢাকা শহর কেন্দ্রিক বিশের দশকের ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’, ‘শিখা’ গোষ্ঠীর আমেজ বয়ে চলা প্রজন্ম লড়াই করেছেন। আর বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিম-লে, মফস্বলি বৃত্তান্তে কার্যত একদম একা লড়ে গিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রামীণ বাংলার বৌদ্ধিক পটভূমিতে স্থাপনের ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক যে অবদান রেখে গেলেন, সেই ভূমিকাকে ১৭৮৯ সালের মহান ফরাসি বিপ্লবকে আপামর ফরাসি দেশের মানুষদের মননলোকে উদ্ভাসিত করবার ক্ষেত্রে বুদ্ধিদীপ্ত বিভাসার সাধক দান্তে, রোবসপিয়াররা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে (’৭১) ঠিক সেই রকম ভূমিকাই পালন করেছিলেন আজ রাত্রির প্রথম যামে যে মানুষটির জীবনদীপ নিভে গেল, সেই সাহিত্য সাধক হাসান আজিজুল হক।

ছিন্নমূল হাসান আজিজুল হক দেশভাগের ব্যথাকে একটা ভিন্ন আঙ্গিকে দেখেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে ’৪৭-এর দেশভাগ ঘিরে যতো লেখেজোখা আছে তার সিংহভাগই ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হিন্দুর কথাতেই ভরা। আর প্রফুল্ল রায়ের মতো কেউ কেউ সেইসব কাহিনী লিখতে গিয়ে (কেয়াপাতার নৌকা) অবিভক্ত বাংলাতে জাতপাতের দীর্ণতায় জর্জরিত হিন্দু অভিজাতের যাপনচিত্রকে প্রকৃত ইতিহাসের বাইরে গিয়ে স্থাপন করেছেন। অভিজাত হিন্দু, তাও আবার বিত্তবান, সে নিম্নবর্গীয় কামলার আত্মীয়ের সঙ্গে বসে বাড়ির অন্দরমহলে রাতের খাওয়া সারছে, আর বাড়ির গৃহিণী তা পরিবেশন করছেন- প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’র এই বাস্তবায়ন কখনো জাতপাতের অনাচারে দীর্ণ পূর্ববঙ্গের অভিজাত, বিত্তবান হিন্দুদের জীবনে দেশভাগের আগে ঘটে নি। কিন্তু দেশভাগের জন্যে মুসলমানকেই একমাত্র দায়ী করে, বিঘে বিঘে জমি জিরেত ছেড়ে মুসলমানের ‘অত্যাচারে’ ‘হিন্দুস্থানে’ চলে আসার গপ্পো তৈরিতে না বলেও সূক্ষ্ম মুসলমান বিদ্বেষের যে অশুভ প্রবণতা দেশভাগের সাহিত্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে আছে, তেমন একটি নজিরও কিন্তু হাসান আজিজুল হকের একটি লেখাতেও নেই। হাসান আজিজুল হক দেশভাগের ক্ষতকে পাথরের মতো বুকে চেপে লিখেছেন, কিন্তু প্রতিবেশি হিন্দুদের সম্পর্কে কখনো একটিও অসাবধানী, অপমানজনক, অমর্যাদাকর, অসম্মানজনক শব্দ লেখেননি। একটিও ব্যতিক্রমী ঘটনাকে ক্রম হিসেবে দেখাতে চেয়ে ‘হিন্দু’ সমাজকে বিভাজনের কাঠগড়ায় তোলেননি। একজন মুসলমানেরও দেশত্যাগের জন্যে হিন্দুকে দায়ী করে ক্ষতকে চিরস্থায়ী করবার চেষ্টা করেন নি। দেশ-কাল-সমাজ-সময়কে অতিক্রম করে পারটিশন সাহিত্য ঘিরে যখন যেখানেই আলোচনা হোক না কেন, সন্দর্ভ রচনা হোক না কেন, এই ব্যতিক্রমী মানবিক চরিত্রের জন্যে বিশ্বকথাসাহিত্যে এক ব্যতিক্রমী স্রষ্টা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবেন সদ্য প্রয়াত হাসান আজিজুল হক।

১৯৬৪ সালে হাসান আজিজুল হকের প্রথম গ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন ও শীতের অরণ্য’ প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থের ভিতরেই রুক্ষ রাঢ়ের রূপ বর্ণনায় এক প্রতিরোধী প্রকৃতির তিনি প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। এই চিত্রাঙ্কন কিন্তু কখনোই নিছক প্রকৃতি নির্ভর ছিল না। প্রকৃতির কষ্টকঠিন বাস্তবতার ভিতরে সময়কে উপস্থাপন করে, সেই সময়ের পরিচালক ‘মানুষে’র বারমাস্যার চিত্ররূপ সৃষ্টি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারার এক নতুন আঙ্গিক প্রথম গ্রন্থের ভিতর দিয়েই হাসান আজিজুল হক মেলে ধরতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর এই প্রথম ছোটগল্পের সংকলনটির গল্পগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়, মানিকের মতো প্রত্যক্ষ রাজনীতি চর্চার অভিজ্ঞতা না থাকা যেন শিল্প সুষমার দিক থেকে হাসান আজিজুল হকের এই গল্পগুলি সাহিত্যের প্রাঙ্গণে এক নতুন ধারার সঙ্কেত দিচ্ছিল।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর লেখার সূচনা পর্বে যে বাঙালির জীবনসংগ্রামের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধগুলিকে তুলে আনছিলেন সেই বোধগুলি বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিম-লের বাইরে বের হয়নি কখনো। উত্তরবঙ্গ, রংপুর, বগুড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অভিজ্ঞতার ছাপ ইলিয়াসের লেখায় এসেছে। সেই ছাপ ইলিয়াসের লেখাকে একটা আঙ্গিকের অঙ্গীভূত করেছে। কিন্তু হাসান আজিজুল হক, তাঁর প্রথম গল্প গ্রন্থেই দুই বাংলার বাঙালি জনজীবন ঘিরে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার যে পরশ রেখেছেন, তেমনভাবে বাংলাদেশের মাটিতে বসে তাঁর সাহিত্যকর্মের সেই প্রথম যুগে খুব বেশি মানুষ সফলভাবে করেননি। এখানেও হাসান আজিজুল হকের সৃষ্টির একটা ব্যতিক্রমী ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কবিতায় মোহাজিরদের বেদনার কথা বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে যেমন শামসুর রাহমানের আগে আর কোনো স্রষ্টা ’৪৭ উত্তর পর্বে লেখেননি, তেমনই ধর্মের নামে দেশের সৃষ্টি হলেও এপার বাংলা থেকে ওপারে যাওয়া বাঙালি মুসলমানের যে আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, তাকে ঘিরে হাসান আজিজুল হকের আগে মনে হয় না কোনো বাঙালি কথা সাহিত্যিক কলম ধরেছেন। সমাজকর্মী হিসেবে সেই ছিন্নমূল বাঙালিদের হয়ে প্রথম সরব হয়েছিলেন বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল। দুপারের ছিন্নমূল বাঙালির হয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রাঙ্গণে প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর এবং কাজী আবদুল ওদুদ। কবিতার প্রাঙ্গণে শামসুর রাহমান। আর কথাসাহিত্যে এই বিষয়ে প্রথম সোচ্চার ব্যক্তিত্ব হলেন হাসান আজিজুল হক। পরবর্তীতে সেলিনা হোসেন তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’তে অত্যন্ত মরমী মনন নিয়ে এই যন্ত্রণাক্লিন্ন সময়কে এঁকেছেন।

প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থের অন্তর্গত ‘গুণীন’, ‘শকুন’ (এই গল্পটির কথা আলোচ্য প্রবন্ধের শুরুতেই আছে), ‘মন আর শঙ্খিনী’, ‘তৃষ্ণা’ ইত্যাদিকে আন্তর্জাতিক মানের ছোটগল্প বলে চিহ্নিত করা যায়। প্রায় প্রতিটি গল্পই যেভাবে রাঢ় বাংলা আর সেই রাঢ় ভূমির প্রতিরোধী প্রকৃতিকে উপস্থাপিত করেছে, সেই নিরিখে মনে পড়ে যায় বারেন্দ্রভূম ঘিরে অমিয়ভূষণ মজুমদারের আবেগকে। রাজনগর থেকে মধ্য সাধুখাঁ- উত্তরবঙ্গ আর বারেন্দ্রভূমকে প্রতিরোধের এক উর্বর জমি হিসেবে দেখিয়ে গিয়েছিলেন অমিয়ভূষণ নিরবচ্ছিন্নভাবে। তাঁর এইভাবে দেখানোর ভিতরে কখনো কখনো অস্মিতা যে আসেনি তা কিন্তু নয়। সেই অস্মিতা আবার কখনো জাত্যাভিমানকে ছুঁয়ে যেত। এমনকি ব্রাহ্মণ্যবাদী গরিমাকেও প্রশ্রয় দিতো। কারণ; তারাশঙ্করের সাহিত্যে রাঢ়ের জমিদারদের চরিত্র চিত্রণকে ব্যঙ্গ করে অমিয়ভূষণ এই নিবন্ধকারকে বলেছিলেন; দুটো চারটে তালুক নিয়ে আবার জমিদারি। তাই রাঢ়ের জমিদার খাজনা আদায়ে নীচু জাতের বাড়িতে নিজে যাচ্ছেন- তারাশঙ্করের সৃষ্টিতে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, উদাহরণকে মানতে পারেননি কখনো অমিয়ভূষণ। তাই উচ্চবর্ণের যৌনস্পৃহাতে নিম্নবর্গীয়দের ভোগ করাটাকে ব্রাহ্মণ্য বেরাদরিতে অবস্থাব ভাবার কথা বলতেন অমিয়ভূষণ। তাঁর এই ধরনের উচ্চবর্ণের জাত্যাভিমানী চেতনাই প্রমাণ করে সমাজকে, সমাজের মানুষকে চেনার-জানার প্রশ্নে সমরেশ বসুদের মতো জীবন রসিকদের কাছে তিনি ছিলেন নিতান্তই অর্বাচীন।

হাসান আজিজুল হক রাঢ় বাংলা কেন্দ্রিক চরিত্র চিত্রণে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন, আশরাফ-আতরাফের ফারাক এইসবকে একটিবারের জন্যেও আনেন নি। প্রতিরোধে জৈবিক আকাক্সক্ষার চিত্রবর্ণনেও তাই জীবনশৈলি বিবর্জিত একটি আখ্যানও হাসান আজিজুল হকের সৃষ্টিতে নেই। সেই কারণেই অমিয়ভূষণ ক্লাসিকধর্মিতার শিরোপা পেলেও তাঁর বরেন্দ্র আয়মাদারি কেন্দ্রিক ‘রাজনগরে’ উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাত রমণীর যে ব্যক্তিত্বের বিবরণ, তার সঙ্গে বাস্তবের খুব কম সম্পর্কই আমরা পাই। অথচ অন্ত্যজ জনজীবনের চরিত্রায়ণে হাসান আজিজুল হকের সৃষ্টিকে যেন আমাদের মনে হয় সমরেশ বসুর সৃষ্টির মতোই জীবন থেকে নেওয়া আখ্যান। যে আখ্যানে কোনো অবাস্তবতা নেই। নেই অমিয়ভূষণের বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী অস্মিতার বিপরীত কোনো মুসলমানী হাড়ের গরমের কথা।

গ্রামীণ পটভূমিকায় হাসান আজিজুল হকের লেখা গল্পগুলির সঙ্কলন, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। শহুরে নাগরিকতাকে অতিক্রম করে গ্রামীণ জীবনের খুঁটিনাটি সম্বলিত এই সঙ্কলনের গল্পগুলি পড়লে হঠাৎ করে পাঠকের মনে হতেই পারে, লেখক বুঝিবা কোনো এক অজ পাড়া গাঁয়ের বাসিন্দা। তা না হলে গ্রামীণ জীবনের ঔদার্য থেকে পুকুরঘাটের কোন্দলের এতো ডিটেলিং তিনি জানলেন কী করে? মফস্বল শহর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক তিনি। সমরেশ বসুর মতো নৈহাটি শহরের বারোদুয়ারের ভিতর দিয়ে অবাধে চলাফেরা করতে করতে বারোদুয়ারীদের কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা জানবার মতো যাপনচিত্র অভ্যস্থ নন হাসান আজিজুল হক। রিক্সা চালকদের সাথে বসে নুন, লঙ্কা সহযোগে সুধাপান করছেন হাসান আজিজুল হক- স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। সমরেশ বসুর প্রথম থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত যে বেপরোয়াপনা ছিল, বয়সে বিবাহিতা গৌরীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া, আতপুরের অস্বাস্থ্যকর বস্তির ভিতরে সন্তানদের নিয়ে ঘুপচি ঘরে বাস করেও সাহিত্য সৃষ্টি, পেট চালাতে চটকলের সাহেবসুবোদের বাড়িতে ডিম, কাঁচা সবজি বিক্রি, আবার উত্তমকুমারের বাড়িতে পার্টিতে গিয়ে পাহাড়ি সান্যালের অনুরোধে পত্নী গৌরীকে পিয়ানোর সামনে বসার সাহস জোগানো- এমন কোনো জীবনকে শুষে নিয়ে জীবনযাপন করবার নজির আমরা হাসান আজিজুল হকের জীবনে পাই না। আবার সেই হাসান আজিজুল হকেরই গ্রামজীবন কেন্দ্রিক গল্প সঙ্কলন ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ বা ‘জীবন ঘষে আগুন’ (প্রকাশকাল ১৯৮৫)-এর গল্পগুলোকে নির্দ্বিধায় সমরেশ বষুর কালজয়ী ছোটগল্প গুলির সমমানের গল্প বলে চিহ্নিত করতে পারি। আসলে আপাত গম্ভীর, শঙ্খ ঘোষের মতোই পোশাকী পরিপাট্যের পরিচয়বাহী, খানিকটা শঙ্খের মতোই ‘রিফাইন্ড জেন্টলম্যান’গোছের আদল নিয়েও হাসান আজিজুল হকের ভিতরে ‘দেখি নাই ফিরে’র ভাবনা আসা ইস্তক রামকিঙ্করের পরম ‘দোস্ত’ সমরেশের মতো একটা বাউল-ফকির-মিসকিন বাস করতো।

বাউল সমরেশকেও কখনো শততালির খিলকা পড়ে ভড়ং দেখাতে হয় নি। কিন্তু আদ্দির পাঞ্জাবির ধবধবে সাদা রঙের ভিতরেই যে উপনিষদের চরম সত্যান্বেষণ, ‘ত্যেন তক্তেন ভুঞ্ঝিতা’কে জীবন বেদ করে গোটা জীবন ধরে টেনে ছক্কা হেঁকে গিয়েছিলেন সমরেশ বসু, তেমনটাই শহুরে আবরণের ভিতরেই সেই, ‘দুনিয়া লোক সব বাওড়া হোকর ঘর ঘর বাঘিনী পালে’র চর্চা করে গেলেন হাসান আজিজুল হক। তা না হলে, ‘নামহীন গোত্রহীন’ (’৭৫), ‘আমরা অপেক্ষা করছি’ (’৮৯), ‘রোদে যাবো’ (’৯৫), ‘পাতালে হাসপাতালে’ (’৮১), ‘মা ও মেয়ের সংসারে’ (’৯৭)র লেখক, যেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধ বাক্সময় হয়েছে, সেই লেখকই ‘জীবন ঘষে আগুন’-এ অমন নিপুণ গ্রাম জীবনের বর্ণনা করতে পারতেন না।

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

এক বাউল জীবনের কথা

গৌতম রায়

রোববার, ২১ নভেম্বর ২০২১

র‌্যাডক্লিফের কাঁচি যে মানুষটির প্রসন্ন মুখে সব সময়েই একটা লুকনো ব্যথার খনির সন্ধান দিত, ‘শকুন’ থেকে ‘করতলে ছিন্নমাথা’র ক্লিন্নতাকে পদ্মার কোল ঘেঁষে বর্ধমানের রাঢ় বাংলার সংস্কৃতির মৃদু গুঞ্জনে আবর্তিত হতো, সেই মাটির স্পর্শ খুঁজে পাওয়া আপামর বাঙালি হাসান আজিজুল হক মিশে রইলেন এই মাটিতেই। যে সময়ে সেই মানুষটি এই পৃথিবীর বুক থেকে শেষ বায়ুটি নিয়ে পৃথিবীর বুকেই তা ফিরিয়ে দিচ্ছেন, সেই ক্ষণটিতে যে আমি সেই ‘আগুনপাখি’র দেশ বর্ধমানেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। রাঢ়ের আয়মাদারির অন্যতম পীঠস্থান পার্কাস রোডে আমার সেই সময়টিতে, অস্তমিত গোধূলিতে, মাগরিবের ছায়া বাঁকার জলে ঘর পাতার সেই পরমক্ষণটিতে কি নীড়হারা ‘শকুন’টি, আর সেই শকুন ঘিরে কিশোরটির অন্তহীন জাগরের তৃষ্ণাই স্বাতী নক্ষত্রের জলের জন্যে আকাশ পানে চেয়েছিল? সেভাবেই তৈরি হয়ে উঠছিল সাবিত্রীর কোনো নতুন উপাখ্যান? বৃষ্টি ছিল সারাদিন। হয়তো কবি অমিয় চক্রবর্তীর আলবার্ট সোয়াইৎজারের মহাপ্রয়াণের ঝলসিত কলমের মতোই বাঙালি উচ্চারণ করছে এখন, ‘প্রয়াণী গেছেন রাত্রে, বিশ্ববাসী পরম আত্মীয়হারা’।

অখ- বাঙালি জাতিসত্তার যে বীজ বপন করা হয়েছিল বাঙালির হৃদয়ে মহান একুশের চেতনার ভিতর দিয়ে, যে বীজের ফসল ছিলেন অন্নদাশঙ্কর, কাজী আবদুল ওদুদ, ডঃ শহীদুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আবু সয়ীদ আইয়ুব, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামানরা, সেই চেতনার সমুদ্রে প্রত্যক্ষ অবগাহন করা শেষ মানুষটি চলে গেলেন। মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে দেশ ভেঙে গেলেও বাঙালিকে যাঁরা ভাঙতে দেননি প্রাণ দিয়ে, সেই কর্মকা-ে অংশ নেওয়া প্রজন্মের বুঝি শেষ প্রতিনিধি ছিলেন হাসান আজিজুল হক। তাঁর পরে যাঁরা থাকলেন, তাঁরা এঁদের প্রবাহিনী ধারার ফসল। কিন্তু সেই ক্ষতের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই। তাই, ধেড়ে খোকাদের বাংলা ভাগের কঠিন-কঠোর- উদ্ধত-অসহায় সমালোচক অন্নদাশঙ্কর আর বর্ধমানের যবগ্রামের ছিন্নমূল হাসান আজিজুল হকের যন্ত্রণার যে অন্তরঙ্গ অনুভূতি, তাকে জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ধারণ করে যে কোনো রকমের বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সোচ্চার হওয়ার যে মেরুদণ্ড- তার শেষ নিঃশব্দ পদচারণা স্তব্ধ হয়ে পড়ার ব্যথাই আজ সব থেকে বেশি বুকে বাজছে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যার মূল মন্ত্রই হলো, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরোধিতা, সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মফস্বলে প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হককে অন্যতম আদিগুরু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়

দেশভাগের যন্ত্রণা আজকের প্রজন্মের বাঙালির বুকে বাজে রাজনীতির নানা দেনাপাওনার হিসেবনিকেশ থেকে। হাসান আজিজুল হকের মতো মানুষের বুকে সেই ব্যথা বেজেছিল অবিরত রক্তক্ষরণের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে। সেই যন্ত্রণা তাঁর জীবনে একদিনের জন্যেও উপশম হয় নি। বিজিত বাংলায় যশ, সম্মান, মর্যাদা- সবকিছুই পেয়েছেন হাসান আজিজুল হক। কিন্তু এই পাওয়ার তৃপ্তির ভিতরেও তাঁর কাছে সবস থেকে অতৃপ্তি ছিল বিভাজিত বাঙালির বুক থেকে বিভাজনজনিত রক্ত চুইয়ে পড়বার ব্যথা।

পূর্ব পাকিস্থানের রাজনীতির আবর্তন হাসান আজিজুল হক দেখেছেন। সেই দেখাকে খোদাই করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। কিন্তু সেই খোদাই কর্মের কালেও মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে বাঙালিকে বিভাজিত করবার ভুলটির উদ্দেশে সব সময়েই একটা সূক্ষ্ম প্রতিবাদ, বিরক্তির উচ্চারণ থেকে তিনি একবারের জন্যেও নিজেকে বিরত করেননি। হয়তো সেই সময়ের প্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্থানের ইসলামিকরণের জেরে বাঙালি সমাজের ভিতরে যে চেতনার, মননশীলতার দোলাচাল তৈরির প্রচেষ্টা চলছিল, বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলির ভিতরে থেকে যাঁরা সেই অশুভের আবাহনের বিরোধিতা করে যাচ্ছিলেন, তাঁদের ভিতরে হাসান আজিজুল হক এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কারণ, ঢাকা শহর কেন্দ্রিক যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের শুভলগ্ন ঘোষিত হচ্ছিল, তার প্রভাব মফস্বলে পাঁচের দশকের সূচনাপর্বের কালে তখনো সেভাবে পড়েনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যার মূল মন্ত্রই হলো, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরোধিতা, সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মফস্বলে প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হককে অন্যতম আদিগুরু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির প্রাঙ্গণে কখনো পা রাখেননি এই অতি বিরল প্রজাতির কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না থেকেও পশ্চিম পাকিস্থানের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে গ্রাম বাংলার মানুষের বৌদ্ধিক চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে কলমকে ব্যবহার করে হাসান আজিজুল হক যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই ভূমিকা একজন প্রথম সারির পলিটিকাল অ্যাকটিভিস্টের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না।

ভাষা আন্দোলনের পারস্পর্য বজায় রেখে কথাসাহিত্যের চর্চায় বাঙালি জীবনের বারমাস্যাকে যেভাবে হাসান আজিজুল হক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সূতিকাগৃহ নির্মাণ বললে অত্যুক্তি হবে না। হাসান আজিজুল হকের সেই সময়ের কলমের প্রভাব কোনো অংশেই মুনীর চৌধুরীদের ‘কবর’ নাটক বা জহির রায়হানদের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ফিল্ম বা শামসুর রাহমানদের ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ হয়ে, ‘বন্দি শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের সেই যমজ কবিতা, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ আর, ‘স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা’র ঐতিহাসিক মূল্যের থেকে কম নয়।

পশ্চিম পাকিস্থানের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে বাঙালিকে সচেতন করবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা পরিসরের ভিতরে সাহিত্য-সংস্কৃতির ভূমিকা ঐতিহাসিক। আর সেই ভূমিকাকে গ্রাম বাংলায় প্রবাহিত করবার ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক যে অবদান রেখে গেলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক এবং সার্থক করবার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাকে ঐতিহাসিক বললেও খুব কম বলা হয়।

পশ্চিম পাকিস্থানের পূর্ব পাকিস্থানের উপর সব ধরনের শোষণের পিছনে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযোদ্ধোত্তর সময়কালের আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির প্রভাব। সেই প্রভাবে সব থেকে ন্যক্কারজনক ভূমিকা ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের। সোভিয়েট ইউনিয়নের জ্বাজল্য উপস্থিতিতে ভারতীয় উপমহাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য কায়েমে পশ্চিম পাকিস্থানকে বোড়ের চাল হিসেবে বেছে নিয়েছিল আমেরিকা। সোভিয়েতের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের নিরিখে ভারতের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস, ভারতে সব ধরনের আস্থিরতা তৈরি, ধর্মীয় বিদ্বেষের বাতাবরণ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগকে কেন্দ্র করে যাতে চিরস্থায়ী করা যায় সেজন্যে ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আর সেই পাকিস্থানের সেই সময়ের দুটি অংশেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদকে দগদগে ঘায়ের মতো ছড়িয়ে দেওয়া ছিল মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের নয়া ঔপনিবেশিক কৌশল।

সেই কৌশলকে প্রতিহত করবার ক্ষেত্রে ভারতে যেমন অন্নদাশঙ্কর রায়, সমরেশ বসু, মুলকরাজ আনন্দ, উমাশঙ্কর যোশী, অমৃতা প্রীতমেরা প্রাণপণ লড়াই করেছেন, তেমনই বাংলাদেশে ঢাকা শহর কেন্দ্রিক বিশের দশকের ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’, ‘শিখা’ গোষ্ঠীর আমেজ বয়ে চলা প্রজন্ম লড়াই করেছেন। আর বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিম-লে, মফস্বলি বৃত্তান্তে কার্যত একদম একা লড়ে গিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রামীণ বাংলার বৌদ্ধিক পটভূমিতে স্থাপনের ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক যে অবদান রেখে গেলেন, সেই ভূমিকাকে ১৭৮৯ সালের মহান ফরাসি বিপ্লবকে আপামর ফরাসি দেশের মানুষদের মননলোকে উদ্ভাসিত করবার ক্ষেত্রে বুদ্ধিদীপ্ত বিভাসার সাধক দান্তে, রোবসপিয়াররা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে (’৭১) ঠিক সেই রকম ভূমিকাই পালন করেছিলেন আজ রাত্রির প্রথম যামে যে মানুষটির জীবনদীপ নিভে গেল, সেই সাহিত্য সাধক হাসান আজিজুল হক।

ছিন্নমূল হাসান আজিজুল হক দেশভাগের ব্যথাকে একটা ভিন্ন আঙ্গিকে দেখেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে ’৪৭-এর দেশভাগ ঘিরে যতো লেখেজোখা আছে তার সিংহভাগই ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হিন্দুর কথাতেই ভরা। আর প্রফুল্ল রায়ের মতো কেউ কেউ সেইসব কাহিনী লিখতে গিয়ে (কেয়াপাতার নৌকা) অবিভক্ত বাংলাতে জাতপাতের দীর্ণতায় জর্জরিত হিন্দু অভিজাতের যাপনচিত্রকে প্রকৃত ইতিহাসের বাইরে গিয়ে স্থাপন করেছেন। অভিজাত হিন্দু, তাও আবার বিত্তবান, সে নিম্নবর্গীয় কামলার আত্মীয়ের সঙ্গে বসে বাড়ির অন্দরমহলে রাতের খাওয়া সারছে, আর বাড়ির গৃহিণী তা পরিবেশন করছেন- প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’র এই বাস্তবায়ন কখনো জাতপাতের অনাচারে দীর্ণ পূর্ববঙ্গের অভিজাত, বিত্তবান হিন্দুদের জীবনে দেশভাগের আগে ঘটে নি। কিন্তু দেশভাগের জন্যে মুসলমানকেই একমাত্র দায়ী করে, বিঘে বিঘে জমি জিরেত ছেড়ে মুসলমানের ‘অত্যাচারে’ ‘হিন্দুস্থানে’ চলে আসার গপ্পো তৈরিতে না বলেও সূক্ষ্ম মুসলমান বিদ্বেষের যে অশুভ প্রবণতা দেশভাগের সাহিত্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে আছে, তেমন একটি নজিরও কিন্তু হাসান আজিজুল হকের একটি লেখাতেও নেই। হাসান আজিজুল হক দেশভাগের ক্ষতকে পাথরের মতো বুকে চেপে লিখেছেন, কিন্তু প্রতিবেশি হিন্দুদের সম্পর্কে কখনো একটিও অসাবধানী, অপমানজনক, অমর্যাদাকর, অসম্মানজনক শব্দ লেখেননি। একটিও ব্যতিক্রমী ঘটনাকে ক্রম হিসেবে দেখাতে চেয়ে ‘হিন্দু’ সমাজকে বিভাজনের কাঠগড়ায় তোলেননি। একজন মুসলমানেরও দেশত্যাগের জন্যে হিন্দুকে দায়ী করে ক্ষতকে চিরস্থায়ী করবার চেষ্টা করেন নি। দেশ-কাল-সমাজ-সময়কে অতিক্রম করে পারটিশন সাহিত্য ঘিরে যখন যেখানেই আলোচনা হোক না কেন, সন্দর্ভ রচনা হোক না কেন, এই ব্যতিক্রমী মানবিক চরিত্রের জন্যে বিশ্বকথাসাহিত্যে এক ব্যতিক্রমী স্রষ্টা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবেন সদ্য প্রয়াত হাসান আজিজুল হক।

১৯৬৪ সালে হাসান আজিজুল হকের প্রথম গ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন ও শীতের অরণ্য’ প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থের ভিতরেই রুক্ষ রাঢ়ের রূপ বর্ণনায় এক প্রতিরোধী প্রকৃতির তিনি প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। এই চিত্রাঙ্কন কিন্তু কখনোই নিছক প্রকৃতি নির্ভর ছিল না। প্রকৃতির কষ্টকঠিন বাস্তবতার ভিতরে সময়কে উপস্থাপন করে, সেই সময়ের পরিচালক ‘মানুষে’র বারমাস্যার চিত্ররূপ সৃষ্টি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারার এক নতুন আঙ্গিক প্রথম গ্রন্থের ভিতর দিয়েই হাসান আজিজুল হক মেলে ধরতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর এই প্রথম ছোটগল্পের সংকলনটির গল্পগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়, মানিকের মতো প্রত্যক্ষ রাজনীতি চর্চার অভিজ্ঞতা না থাকা যেন শিল্প সুষমার দিক থেকে হাসান আজিজুল হকের এই গল্পগুলি সাহিত্যের প্রাঙ্গণে এক নতুন ধারার সঙ্কেত দিচ্ছিল।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর লেখার সূচনা পর্বে যে বাঙালির জীবনসংগ্রামের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধগুলিকে তুলে আনছিলেন সেই বোধগুলি বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিম-লের বাইরে বের হয়নি কখনো। উত্তরবঙ্গ, রংপুর, বগুড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অভিজ্ঞতার ছাপ ইলিয়াসের লেখায় এসেছে। সেই ছাপ ইলিয়াসের লেখাকে একটা আঙ্গিকের অঙ্গীভূত করেছে। কিন্তু হাসান আজিজুল হক, তাঁর প্রথম গল্প গ্রন্থেই দুই বাংলার বাঙালি জনজীবন ঘিরে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার যে পরশ রেখেছেন, তেমনভাবে বাংলাদেশের মাটিতে বসে তাঁর সাহিত্যকর্মের সেই প্রথম যুগে খুব বেশি মানুষ সফলভাবে করেননি। এখানেও হাসান আজিজুল হকের সৃষ্টির একটা ব্যতিক্রমী ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কবিতায় মোহাজিরদের বেদনার কথা বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে যেমন শামসুর রাহমানের আগে আর কোনো স্রষ্টা ’৪৭ উত্তর পর্বে লেখেননি, তেমনই ধর্মের নামে দেশের সৃষ্টি হলেও এপার বাংলা থেকে ওপারে যাওয়া বাঙালি মুসলমানের যে আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, তাকে ঘিরে হাসান আজিজুল হকের আগে মনে হয় না কোনো বাঙালি কথা সাহিত্যিক কলম ধরেছেন। সমাজকর্মী হিসেবে সেই ছিন্নমূল বাঙালিদের হয়ে প্রথম সরব হয়েছিলেন বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল। দুপারের ছিন্নমূল বাঙালির হয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রাঙ্গণে প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর এবং কাজী আবদুল ওদুদ। কবিতার প্রাঙ্গণে শামসুর রাহমান। আর কথাসাহিত্যে এই বিষয়ে প্রথম সোচ্চার ব্যক্তিত্ব হলেন হাসান আজিজুল হক। পরবর্তীতে সেলিনা হোসেন তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’তে অত্যন্ত মরমী মনন নিয়ে এই যন্ত্রণাক্লিন্ন সময়কে এঁকেছেন।

প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থের অন্তর্গত ‘গুণীন’, ‘শকুন’ (এই গল্পটির কথা আলোচ্য প্রবন্ধের শুরুতেই আছে), ‘মন আর শঙ্খিনী’, ‘তৃষ্ণা’ ইত্যাদিকে আন্তর্জাতিক মানের ছোটগল্প বলে চিহ্নিত করা যায়। প্রায় প্রতিটি গল্পই যেভাবে রাঢ় বাংলা আর সেই রাঢ় ভূমির প্রতিরোধী প্রকৃতিকে উপস্থাপিত করেছে, সেই নিরিখে মনে পড়ে যায় বারেন্দ্রভূম ঘিরে অমিয়ভূষণ মজুমদারের আবেগকে। রাজনগর থেকে মধ্য সাধুখাঁ- উত্তরবঙ্গ আর বারেন্দ্রভূমকে প্রতিরোধের এক উর্বর জমি হিসেবে দেখিয়ে গিয়েছিলেন অমিয়ভূষণ নিরবচ্ছিন্নভাবে। তাঁর এইভাবে দেখানোর ভিতরে কখনো কখনো অস্মিতা যে আসেনি তা কিন্তু নয়। সেই অস্মিতা আবার কখনো জাত্যাভিমানকে ছুঁয়ে যেত। এমনকি ব্রাহ্মণ্যবাদী গরিমাকেও প্রশ্রয় দিতো। কারণ; তারাশঙ্করের সাহিত্যে রাঢ়ের জমিদারদের চরিত্র চিত্রণকে ব্যঙ্গ করে অমিয়ভূষণ এই নিবন্ধকারকে বলেছিলেন; দুটো চারটে তালুক নিয়ে আবার জমিদারি। তাই রাঢ়ের জমিদার খাজনা আদায়ে নীচু জাতের বাড়িতে নিজে যাচ্ছেন- তারাশঙ্করের সৃষ্টিতে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, উদাহরণকে মানতে পারেননি কখনো অমিয়ভূষণ। তাই উচ্চবর্ণের যৌনস্পৃহাতে নিম্নবর্গীয়দের ভোগ করাটাকে ব্রাহ্মণ্য বেরাদরিতে অবস্থাব ভাবার কথা বলতেন অমিয়ভূষণ। তাঁর এই ধরনের উচ্চবর্ণের জাত্যাভিমানী চেতনাই প্রমাণ করে সমাজকে, সমাজের মানুষকে চেনার-জানার প্রশ্নে সমরেশ বসুদের মতো জীবন রসিকদের কাছে তিনি ছিলেন নিতান্তই অর্বাচীন।

হাসান আজিজুল হক রাঢ় বাংলা কেন্দ্রিক চরিত্র চিত্রণে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন, আশরাফ-আতরাফের ফারাক এইসবকে একটিবারের জন্যেও আনেন নি। প্রতিরোধে জৈবিক আকাক্সক্ষার চিত্রবর্ণনেও তাই জীবনশৈলি বিবর্জিত একটি আখ্যানও হাসান আজিজুল হকের সৃষ্টিতে নেই। সেই কারণেই অমিয়ভূষণ ক্লাসিকধর্মিতার শিরোপা পেলেও তাঁর বরেন্দ্র আয়মাদারি কেন্দ্রিক ‘রাজনগরে’ উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাত রমণীর যে ব্যক্তিত্বের বিবরণ, তার সঙ্গে বাস্তবের খুব কম সম্পর্কই আমরা পাই। অথচ অন্ত্যজ জনজীবনের চরিত্রায়ণে হাসান আজিজুল হকের সৃষ্টিকে যেন আমাদের মনে হয় সমরেশ বসুর সৃষ্টির মতোই জীবন থেকে নেওয়া আখ্যান। যে আখ্যানে কোনো অবাস্তবতা নেই। নেই অমিয়ভূষণের বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী অস্মিতার বিপরীত কোনো মুসলমানী হাড়ের গরমের কথা।

গ্রামীণ পটভূমিকায় হাসান আজিজুল হকের লেখা গল্পগুলির সঙ্কলন, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। শহুরে নাগরিকতাকে অতিক্রম করে গ্রামীণ জীবনের খুঁটিনাটি সম্বলিত এই সঙ্কলনের গল্পগুলি পড়লে হঠাৎ করে পাঠকের মনে হতেই পারে, লেখক বুঝিবা কোনো এক অজ পাড়া গাঁয়ের বাসিন্দা। তা না হলে গ্রামীণ জীবনের ঔদার্য থেকে পুকুরঘাটের কোন্দলের এতো ডিটেলিং তিনি জানলেন কী করে? মফস্বল শহর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক তিনি। সমরেশ বসুর মতো নৈহাটি শহরের বারোদুয়ারের ভিতর দিয়ে অবাধে চলাফেরা করতে করতে বারোদুয়ারীদের কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা জানবার মতো যাপনচিত্র অভ্যস্থ নন হাসান আজিজুল হক। রিক্সা চালকদের সাথে বসে নুন, লঙ্কা সহযোগে সুধাপান করছেন হাসান আজিজুল হক- স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। সমরেশ বসুর প্রথম থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত যে বেপরোয়াপনা ছিল, বয়সে বিবাহিতা গৌরীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া, আতপুরের অস্বাস্থ্যকর বস্তির ভিতরে সন্তানদের নিয়ে ঘুপচি ঘরে বাস করেও সাহিত্য সৃষ্টি, পেট চালাতে চটকলের সাহেবসুবোদের বাড়িতে ডিম, কাঁচা সবজি বিক্রি, আবার উত্তমকুমারের বাড়িতে পার্টিতে গিয়ে পাহাড়ি সান্যালের অনুরোধে পত্নী গৌরীকে পিয়ানোর সামনে বসার সাহস জোগানো- এমন কোনো জীবনকে শুষে নিয়ে জীবনযাপন করবার নজির আমরা হাসান আজিজুল হকের জীবনে পাই না। আবার সেই হাসান আজিজুল হকেরই গ্রামজীবন কেন্দ্রিক গল্প সঙ্কলন ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ বা ‘জীবন ঘষে আগুন’ (প্রকাশকাল ১৯৮৫)-এর গল্পগুলোকে নির্দ্বিধায় সমরেশ বষুর কালজয়ী ছোটগল্প গুলির সমমানের গল্প বলে চিহ্নিত করতে পারি। আসলে আপাত গম্ভীর, শঙ্খ ঘোষের মতোই পোশাকী পরিপাট্যের পরিচয়বাহী, খানিকটা শঙ্খের মতোই ‘রিফাইন্ড জেন্টলম্যান’গোছের আদল নিয়েও হাসান আজিজুল হকের ভিতরে ‘দেখি নাই ফিরে’র ভাবনা আসা ইস্তক রামকিঙ্করের পরম ‘দোস্ত’ সমরেশের মতো একটা বাউল-ফকির-মিসকিন বাস করতো।

বাউল সমরেশকেও কখনো শততালির খিলকা পড়ে ভড়ং দেখাতে হয় নি। কিন্তু আদ্দির পাঞ্জাবির ধবধবে সাদা রঙের ভিতরেই যে উপনিষদের চরম সত্যান্বেষণ, ‘ত্যেন তক্তেন ভুঞ্ঝিতা’কে জীবন বেদ করে গোটা জীবন ধরে টেনে ছক্কা হেঁকে গিয়েছিলেন সমরেশ বসু, তেমনটাই শহুরে আবরণের ভিতরেই সেই, ‘দুনিয়া লোক সব বাওড়া হোকর ঘর ঘর বাঘিনী পালে’র চর্চা করে গেলেন হাসান আজিজুল হক। তা না হলে, ‘নামহীন গোত্রহীন’ (’৭৫), ‘আমরা অপেক্ষা করছি’ (’৮৯), ‘রোদে যাবো’ (’৯৫), ‘পাতালে হাসপাতালে’ (’৮১), ‘মা ও মেয়ের সংসারে’ (’৯৭)র লেখক, যেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধ বাক্সময় হয়েছে, সেই লেখকই ‘জীবন ঘষে আগুন’-এ অমন নিপুণ গ্রাম জীবনের বর্ণনা করতে পারতেন না।

back to top