alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রশাসনকে মাটির কাছাকাছি আসতে হবে

শেখর ভট্টাচার্য

: শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমাদের দেশে বেশকিছু ধারণা আছে, যা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে সমাজ রাষ্ট্র ও পরিবার গ্রহণ করেছে। যিনি কম কথা বলেন, মুখে গাম্ভীর্য নিয়ে থাকেন, অনুভূতি প্রকাশে সতর্ক অর্থাৎ হাসি, কান্না, আশা, হতাশা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সাবধানী, তার ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে বাঙালি উচ্চ ধারণা পোষন করে। কপট গাম্ভীর্য প্রদর্শনকে কপটতার সমতুল্য বলা যায়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নিজেকে আড়াল করা হয়। এ রকম জীবনযাপন অনেক ক্ষেত্রে অভিনয় কিংবা একটু রূঢ়ভাবে বললে ভন্ডামীর সমতুল্য মনে করা যায়। এই “ভন্ডামী”কে যুগের পর যুগ বাঙালি উচ্চতর ব্যক্তিত্ব হিসাবে গণ্য করে নিজেদের আচরণের সাংস্কৃতির মানকে নীচের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমাগত। ব্যক্তিত্বের এ রকম ধরন আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এ বিষয়ে আমাদের ন্যূনতম মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায় না।

ব্যক্তিত্ব বিষয়টি মনোবিজ্ঞানে খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। ব্যক্তিত্বকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই দুটি ভাগ অনুযায়ী মানুষকে আমরা দুরকমভাবে দেখে থাকি। এক ধরনের মানুষ আছেন অন্তর্মুখী এবং অন্য ধরনের মানুষ বহির্মুখী। মানুষ তার পরিবার সমাজ, স্কুল, বংশধারা ইত্যাদির প্রভাবে দুই উপায়ে নিজেদের প্রকাশ করে। অন্তর্মুখী মানুষ তুলনামূলকভাবে নিজেদের একটু কম প্রকাশ করে থাকেন। নিজেদের অনুভূতি আচার, আচরণ স্বাভাবিকভাবে যতটুকু প্রকাশিত হয় তার থেকে বেশি অপ্রাকাশিত থেকে যায়। এক সময় মানুষের ধারণা ছিল, অন্তর্মুখী মানুষ যে কোন কর্মে নেতৃত্ব দিতে বহির্মুখী মানুষের তুলনায় কম সক্ষম। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে নেতৃত্ব মানেই কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করা নয়। নেতৃত্বের আরও অসংখ্য গুণ রয়েছে। অনেক অন্তর্মুখী মানুষের নেতৃত্ব ঈর্ষণীয়, অনুকরণীয় হয়ে থাকে। বহির্মুখী মানুষ অন্তর্মুখী মানুষের থেকে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে একটু বেশি সফল হতে পারেন কারন বহির্মুখিতার কারণে তারা যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে থাকেন। চিন্তার ধরন, জ্ঞান, মানসিকতা, নেতৃত্ব এসব বিষয়ে অন্তর্মুখী ও বহর্মুখী মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুণগত কোন পার্থক্য দেখা যায় না। ব্যক্তিত্বের দুটি ধরন এবং ধরন অনুযায়ী নিজেকে উপস্থাপন এগুলো হলো স্বতঃস্ফূর্ত এবং অতি স্বাভাবিক। মানুষের এ রকম আচরণ হওয়া কাক্সিক্ষত। কিন্তু উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নিজের আচরণকে পরিবর্তন করে খোলসের ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে নিজের ভিন্ন ও কৃত্রিম পরিচয় উপস্থাপনের মাধ্যমে যে “ব্যক্তিত্ব” তুলে ধরা হয়, এখানে সে’ কপট এবং অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিত্বের কথাই বলা হচ্ছে এতোক্ষণ।

সামাজিক ক্ষমতা এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী এই কপট আচরনের মাত্রা বেড়ে যায়। পদমর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষের থেকে দূরে চলে যেতে চান। তাদের সঙ্গে দেখা করা সাধারণ মানুষের জন্য যাতে দুরূহ হয়ে পড়ে এ জন্য পূর্ব অনুমতিসহ নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখা হয়। আমাদের দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী, একটি অফিসের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা “সবচেয়ে বড়” হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখেন। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন না, তিনি মুখটাকে অন্ধকার করে রাখবেন, তিনি সব সময় মনে করিয়ে দেবেন তার সময় খুব মূল্যবান। এই মানুষটিই তার কক্ষে অনেক ক্ষমতাশালী ও বিত্তবান মানুষের সঙ্গে হাস্যরসসহ নানা কথার ফুলঝুরি ছোটান। এই যে তার আচরণ সেটি হলো উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অবশ্যই অফিসের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার দায়িত্ব অনেক বেশি। দায়িত্ব অনুযায়ী তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে হয়, সবার কথা শোনার মতো পর্যাপ্ত সময় তার হাতে থাকে না, তাই বলে তিনি সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন? আমাদের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা যে কোন পর্যায়েরই হন না কেন, তিনি প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের সেবা প্রদান করার ম্যান্ডেট নিয়ে চাকরি শুরু করেন তাই জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের জনসেবক বা সিভিল সার্ভেন্ট বলা হয়। আধুনিক যুগে তারা হচ্ছেন নাগরিকদের বন্ধু। আমাদের নীল রক্তের আভিজাত্য অনেক সময় বন্ধু, সেবক ইত্যাদি ভাবতে বাধা প্রদান করে থাকে। সর্বার্থে তারা দায়বদ্ধ সাধারণ নাগরিকদের নিকট কিন্তু মনোজগতে সেই দায়বদ্ধতার উপস্থিতি সব সময় দেখা যায় না। গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী নাগরিকেরাই তার প্রভু। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হলো, গণতন্ত্রের এই মৌলবাণী উপেক্ষিত হয়ে থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, আমাদের কর্মকর্তারা মনে করেন তাদের জবাবদিহিতা নিম্নমুখী নয়, জবাবদিহিতা ঊর্ধ্বমুখী। কর্মকর্তার যিনি তত্ত্বাবধায়ক থাকেন তিনি যদি সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে আর কোন পর্যায়ের সন্তুষ্টির প্রয়োজন পড়ে না। এ ক্ষেত্রে সেবা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টি পরিমাপের কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যেভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন একইভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও জনসম্পৃক্ততা ও জনগণের নিকট জবাবদিহিতাকে এড়িয়ে যান। এই যে জবাবদিহিতার স্থান ও মাত্রা কমে যাওয়া, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা তা অনুমোদন করে না। গণতন্ত্রের মৌলবাণীকে অবজ্ঞা করা হয়। এই যে কথাগুলো বলা হলো তা কিন্তু নতুন কোন কথা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা জনপ্রশাসন বিষয়ের অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরের কথা।

বাঙালি শাসকদের আচরণ সম্পর্কে প্রথাবিরোধী লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আছে। এ পর্যবেক্ষণটি আমাদের প্রশাসকদের আচরণের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। হুমায়ুন আজাদ তার ধরন বা স্টাইল অনুযায়ী সরাসরি তার পর্যবেক্ষণে বলেন; “কর্মকর্তা, তিনি যত নিম্নস্তরেই থাকুন-না-কোনো, তিনি আগন্তকের দিকে মুখ তুলেও তাকাবেন না; তাকালে মুখটি দেখে নিয়েই নানা অকাজে মন দেবেন। তিনি হয়তো পান খাবেন, অপ্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, পাশের টেবিলে কাউকে ডেকে বাজে কথা বলবেন, আগন্তুকের দিকে মনোযোগ দেবেন না। সামনে কোন আসন থাকলেও আগন্তুককে বসতে বলবেন না। অন্যকে অপমান ক’রে নিজেকে সমমানিত করে আনন্দ পান।’ (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৫৫-২৫৬) হয়তো কেউ কেউ তার এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তিনি সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করেই এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এ সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আরও গবেষণার দরকার পড়তে পারে। তবু এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে বাঙালি শাসকদের পরিচয় কিছুটা হলেও পাওয়া যেতে পারে।

“দুর্ব্যবহার যে দুর্নীতির শামিল এরকম চিন্তা-ভাবনা আমাদের দেশের প্রচলিত প্রথাবিরোধী ধারণা। স্যার বা ম্যাডাম না বলে সম্বোধন করা, আমাদের সংস্কৃতিতে কেউ কল্পনাও করতে পারেন না

সম্প্রতি আমাদের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। গণতন্ত্রের মৌলবাণীর প্রতিধ্বনি করে তিনি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একটি ছোট কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত অহমের (আমি উচ্চতর) সংস্কৃতি ভাঙার জন্য একটি মত প্রকাশ করেন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, “সরকারি সেবা নিতে আসা জনসাধারণকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোন নীতি নেই। ৭ সেপ্টেম্বর, সচিবালয়ের গণমাধ্যম কেন্দ্রে আয়োজিত এক সংলাপে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম এ সংলাপের আয়োজন করে। সেবা নিতে আসা জনগণের সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভালো ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে ফরহাদ হোসেন বলেন, দুর্ব্যবহারও দুর্নীতির শামিল। “দুর্ব্যবহার যে দুর্নীতির শামিল এরকম চিন্তা-ভাবনা আমাদের দেশের প্রচলিত প্রথাবিরোধী ধারণা। স্যার বা ম্যাডাম না বলে সম্বোধন করা, আমাদের সংস্কৃতিতে কেউ কল্পনাও করতে পারেন না। সেবা প্রদানের মধ্যে সেবকের আস্থাভাজন হওয়াই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে স্থান পায় না। সম্বোধনে অবশ্যই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সৌজন্য উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু সম্বোধন যেন আভিজাত্য সৃষ্টির দিকে নিয়ে না যায়। অন্যকে হীন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।

আমাদের প্রশাসন, সমাজ ও পরিবার কৃত্রিমভাবে উচ্চতর হওয়ার যে সংস্কৃতিকে সঠিক বলে মনে করেন, সে সংস্কৃতি তারা তারা তাদের পূর্বসূরীদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন এবং পূর্বসূরীরা এ ধারা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পেয়ে এসেছেন। হাস্যকর বিষয়, ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় এরকম সংকীর্ণ চিন্তা এবং এর অনুশীলনকে বর্জন করা হয়েছে অনেক পূর্বেই। তারা জনসেবক, জনগণের কর্মচারী হয়ে উঠেছেন। তারা তাদের অফিস সংস্কৃতিও সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছে। ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তা প্রয়োজনে নিজের টেবিল থেকে ওঠে, তার অধীনস্থ কর্মকর্তার কাছে যাওয়াটাই এখন তাদের সংস্কৃতি। অধীনস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে কল দিয়ে ডেকে নিয়ে আসা শিষ্টচারবহির্ভূত বলে গণ্য করা হয়। মানুষের সেবা প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত জনসেবক হিসেবে তারা নিজেদের দায় থেকে মুক্ত হতে পারেন না। অনেকেই যুক্তি দেখান আমাদের সমাজের মানুষেরা কপট গাম্ভীর্যসহ অন্যান্য কৃত্রিম আচরণকেই সম্মান করে অভ্যস্থ। এরকম “মুখোশ পরা ব্যক্তিত্ব” নিয়ে মানুষের সামনে হাজির না হলে মানুষ “বড় কর্মকর্তা” ভাবতে কুণ্ঠাবোধ করবে। অফিস এবং সেবাগ্রহীতাকে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হবে না। এ রকম ভাবনা আসলে আমাদের চিন্তার দৈন্যতা। আমাদের রুচি সংস্কৃতি ও চিন্তার মানের ওপর প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়। খুব কম সংখ্যক হলেও আমাদের দেশে কিছু উদার এবং প্রকৃত অর্থে আধুনিক মনোভাবাপন্ন অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা সেবা প্রদানকালে নিজেদের সেবক হিসেবে উপস্থাপন করেন। তারা যেহেতু সংখ্যায় কম এ জন্য তাদের আচরণকে প্রতিনিধিত্বশীল বলে আখ্যায়িত করা যায় না।

বঙ্গবন্ধুকে “মুজিব ভাই”, “শেখ সাহেব”, “শেখ মুজিবুর” বলে আখ্যায়িত করা হতো। আমাদের গণমুখী প্রধাণমন্ত্রীকে গ্রামের কৃষক, জেলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা কর্মীরা “আপা” বলে সম্বোধন করে অভ্যস্থ। কোন দিন শুনিনি এ রকম সম্বোধনে তিনি তাদের অনুৎসাহিত করছেন। আমরা কি বঙ্গবন্ধুর থেকে সব দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট? আমরা কেন তার মতো মাটির কাছাকাছি যেতে পারি না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কিন্তু সব স্তরের মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা একটি অঙ্গীকার ছিল? অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার গতির সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে আমাদের আচরণের সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে যেমন মানুষে মানুষে বৈষম্য কমিয়ে নিয়ে আসা আবশ্যক একইভাবে আমাদের প্রশাসনকে গণতন্ত্রের মৌলবাণী অনুসরণ করে আধুনিক ও মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসাও খুব জরুরি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রশাসনকে মাটির কাছাকাছি আসতে হবে

শেখর ভট্টাচার্য

শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমাদের দেশে বেশকিছু ধারণা আছে, যা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে সমাজ রাষ্ট্র ও পরিবার গ্রহণ করেছে। যিনি কম কথা বলেন, মুখে গাম্ভীর্য নিয়ে থাকেন, অনুভূতি প্রকাশে সতর্ক অর্থাৎ হাসি, কান্না, আশা, হতাশা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সাবধানী, তার ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে বাঙালি উচ্চ ধারণা পোষন করে। কপট গাম্ভীর্য প্রদর্শনকে কপটতার সমতুল্য বলা যায়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নিজেকে আড়াল করা হয়। এ রকম জীবনযাপন অনেক ক্ষেত্রে অভিনয় কিংবা একটু রূঢ়ভাবে বললে ভন্ডামীর সমতুল্য মনে করা যায়। এই “ভন্ডামী”কে যুগের পর যুগ বাঙালি উচ্চতর ব্যক্তিত্ব হিসাবে গণ্য করে নিজেদের আচরণের সাংস্কৃতির মানকে নীচের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমাগত। ব্যক্তিত্বের এ রকম ধরন আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এ বিষয়ে আমাদের ন্যূনতম মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায় না।

ব্যক্তিত্ব বিষয়টি মনোবিজ্ঞানে খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। ব্যক্তিত্বকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই দুটি ভাগ অনুযায়ী মানুষকে আমরা দুরকমভাবে দেখে থাকি। এক ধরনের মানুষ আছেন অন্তর্মুখী এবং অন্য ধরনের মানুষ বহির্মুখী। মানুষ তার পরিবার সমাজ, স্কুল, বংশধারা ইত্যাদির প্রভাবে দুই উপায়ে নিজেদের প্রকাশ করে। অন্তর্মুখী মানুষ তুলনামূলকভাবে নিজেদের একটু কম প্রকাশ করে থাকেন। নিজেদের অনুভূতি আচার, আচরণ স্বাভাবিকভাবে যতটুকু প্রকাশিত হয় তার থেকে বেশি অপ্রাকাশিত থেকে যায়। এক সময় মানুষের ধারণা ছিল, অন্তর্মুখী মানুষ যে কোন কর্মে নেতৃত্ব দিতে বহির্মুখী মানুষের তুলনায় কম সক্ষম। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে নেতৃত্ব মানেই কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করা নয়। নেতৃত্বের আরও অসংখ্য গুণ রয়েছে। অনেক অন্তর্মুখী মানুষের নেতৃত্ব ঈর্ষণীয়, অনুকরণীয় হয়ে থাকে। বহির্মুখী মানুষ অন্তর্মুখী মানুষের থেকে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে একটু বেশি সফল হতে পারেন কারন বহির্মুখিতার কারণে তারা যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে থাকেন। চিন্তার ধরন, জ্ঞান, মানসিকতা, নেতৃত্ব এসব বিষয়ে অন্তর্মুখী ও বহর্মুখী মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুণগত কোন পার্থক্য দেখা যায় না। ব্যক্তিত্বের দুটি ধরন এবং ধরন অনুযায়ী নিজেকে উপস্থাপন এগুলো হলো স্বতঃস্ফূর্ত এবং অতি স্বাভাবিক। মানুষের এ রকম আচরণ হওয়া কাক্সিক্ষত। কিন্তু উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নিজের আচরণকে পরিবর্তন করে খোলসের ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে নিজের ভিন্ন ও কৃত্রিম পরিচয় উপস্থাপনের মাধ্যমে যে “ব্যক্তিত্ব” তুলে ধরা হয়, এখানে সে’ কপট এবং অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিত্বের কথাই বলা হচ্ছে এতোক্ষণ।

সামাজিক ক্ষমতা এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী এই কপট আচরনের মাত্রা বেড়ে যায়। পদমর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষের থেকে দূরে চলে যেতে চান। তাদের সঙ্গে দেখা করা সাধারণ মানুষের জন্য যাতে দুরূহ হয়ে পড়ে এ জন্য পূর্ব অনুমতিসহ নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখা হয়। আমাদের দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী, একটি অফিসের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা “সবচেয়ে বড়” হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখেন। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন না, তিনি মুখটাকে অন্ধকার করে রাখবেন, তিনি সব সময় মনে করিয়ে দেবেন তার সময় খুব মূল্যবান। এই মানুষটিই তার কক্ষে অনেক ক্ষমতাশালী ও বিত্তবান মানুষের সঙ্গে হাস্যরসসহ নানা কথার ফুলঝুরি ছোটান। এই যে তার আচরণ সেটি হলো উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অবশ্যই অফিসের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার দায়িত্ব অনেক বেশি। দায়িত্ব অনুযায়ী তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে হয়, সবার কথা শোনার মতো পর্যাপ্ত সময় তার হাতে থাকে না, তাই বলে তিনি সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন? আমাদের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা যে কোন পর্যায়েরই হন না কেন, তিনি প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের সেবা প্রদান করার ম্যান্ডেট নিয়ে চাকরি শুরু করেন তাই জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের জনসেবক বা সিভিল সার্ভেন্ট বলা হয়। আধুনিক যুগে তারা হচ্ছেন নাগরিকদের বন্ধু। আমাদের নীল রক্তের আভিজাত্য অনেক সময় বন্ধু, সেবক ইত্যাদি ভাবতে বাধা প্রদান করে থাকে। সর্বার্থে তারা দায়বদ্ধ সাধারণ নাগরিকদের নিকট কিন্তু মনোজগতে সেই দায়বদ্ধতার উপস্থিতি সব সময় দেখা যায় না। গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী নাগরিকেরাই তার প্রভু। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হলো, গণতন্ত্রের এই মৌলবাণী উপেক্ষিত হয়ে থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, আমাদের কর্মকর্তারা মনে করেন তাদের জবাবদিহিতা নিম্নমুখী নয়, জবাবদিহিতা ঊর্ধ্বমুখী। কর্মকর্তার যিনি তত্ত্বাবধায়ক থাকেন তিনি যদি সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে আর কোন পর্যায়ের সন্তুষ্টির প্রয়োজন পড়ে না। এ ক্ষেত্রে সেবা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টি পরিমাপের কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যেভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন একইভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও জনসম্পৃক্ততা ও জনগণের নিকট জবাবদিহিতাকে এড়িয়ে যান। এই যে জবাবদিহিতার স্থান ও মাত্রা কমে যাওয়া, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা তা অনুমোদন করে না। গণতন্ত্রের মৌলবাণীকে অবজ্ঞা করা হয়। এই যে কথাগুলো বলা হলো তা কিন্তু নতুন কোন কথা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা জনপ্রশাসন বিষয়ের অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরের কথা।

বাঙালি শাসকদের আচরণ সম্পর্কে প্রথাবিরোধী লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আছে। এ পর্যবেক্ষণটি আমাদের প্রশাসকদের আচরণের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। হুমায়ুন আজাদ তার ধরন বা স্টাইল অনুযায়ী সরাসরি তার পর্যবেক্ষণে বলেন; “কর্মকর্তা, তিনি যত নিম্নস্তরেই থাকুন-না-কোনো, তিনি আগন্তকের দিকে মুখ তুলেও তাকাবেন না; তাকালে মুখটি দেখে নিয়েই নানা অকাজে মন দেবেন। তিনি হয়তো পান খাবেন, অপ্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, পাশের টেবিলে কাউকে ডেকে বাজে কথা বলবেন, আগন্তুকের দিকে মনোযোগ দেবেন না। সামনে কোন আসন থাকলেও আগন্তুককে বসতে বলবেন না। অন্যকে অপমান ক’রে নিজেকে সমমানিত করে আনন্দ পান।’ (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৫৫-২৫৬) হয়তো কেউ কেউ তার এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তিনি সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করেই এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এ সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আরও গবেষণার দরকার পড়তে পারে। তবু এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে বাঙালি শাসকদের পরিচয় কিছুটা হলেও পাওয়া যেতে পারে।

“দুর্ব্যবহার যে দুর্নীতির শামিল এরকম চিন্তা-ভাবনা আমাদের দেশের প্রচলিত প্রথাবিরোধী ধারণা। স্যার বা ম্যাডাম না বলে সম্বোধন করা, আমাদের সংস্কৃতিতে কেউ কল্পনাও করতে পারেন না

সম্প্রতি আমাদের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। গণতন্ত্রের মৌলবাণীর প্রতিধ্বনি করে তিনি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একটি ছোট কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত অহমের (আমি উচ্চতর) সংস্কৃতি ভাঙার জন্য একটি মত প্রকাশ করেন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, “সরকারি সেবা নিতে আসা জনসাধারণকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোন নীতি নেই। ৭ সেপ্টেম্বর, সচিবালয়ের গণমাধ্যম কেন্দ্রে আয়োজিত এক সংলাপে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম এ সংলাপের আয়োজন করে। সেবা নিতে আসা জনগণের সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভালো ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে ফরহাদ হোসেন বলেন, দুর্ব্যবহারও দুর্নীতির শামিল। “দুর্ব্যবহার যে দুর্নীতির শামিল এরকম চিন্তা-ভাবনা আমাদের দেশের প্রচলিত প্রথাবিরোধী ধারণা। স্যার বা ম্যাডাম না বলে সম্বোধন করা, আমাদের সংস্কৃতিতে কেউ কল্পনাও করতে পারেন না। সেবা প্রদানের মধ্যে সেবকের আস্থাভাজন হওয়াই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে স্থান পায় না। সম্বোধনে অবশ্যই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সৌজন্য উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু সম্বোধন যেন আভিজাত্য সৃষ্টির দিকে নিয়ে না যায়। অন্যকে হীন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।

আমাদের প্রশাসন, সমাজ ও পরিবার কৃত্রিমভাবে উচ্চতর হওয়ার যে সংস্কৃতিকে সঠিক বলে মনে করেন, সে সংস্কৃতি তারা তারা তাদের পূর্বসূরীদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন এবং পূর্বসূরীরা এ ধারা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পেয়ে এসেছেন। হাস্যকর বিষয়, ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় এরকম সংকীর্ণ চিন্তা এবং এর অনুশীলনকে বর্জন করা হয়েছে অনেক পূর্বেই। তারা জনসেবক, জনগণের কর্মচারী হয়ে উঠেছেন। তারা তাদের অফিস সংস্কৃতিও সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছে। ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তা প্রয়োজনে নিজের টেবিল থেকে ওঠে, তার অধীনস্থ কর্মকর্তার কাছে যাওয়াটাই এখন তাদের সংস্কৃতি। অধীনস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে কল দিয়ে ডেকে নিয়ে আসা শিষ্টচারবহির্ভূত বলে গণ্য করা হয়। মানুষের সেবা প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত জনসেবক হিসেবে তারা নিজেদের দায় থেকে মুক্ত হতে পারেন না। অনেকেই যুক্তি দেখান আমাদের সমাজের মানুষেরা কপট গাম্ভীর্যসহ অন্যান্য কৃত্রিম আচরণকেই সম্মান করে অভ্যস্থ। এরকম “মুখোশ পরা ব্যক্তিত্ব” নিয়ে মানুষের সামনে হাজির না হলে মানুষ “বড় কর্মকর্তা” ভাবতে কুণ্ঠাবোধ করবে। অফিস এবং সেবাগ্রহীতাকে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হবে না। এ রকম ভাবনা আসলে আমাদের চিন্তার দৈন্যতা। আমাদের রুচি সংস্কৃতি ও চিন্তার মানের ওপর প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়। খুব কম সংখ্যক হলেও আমাদের দেশে কিছু উদার এবং প্রকৃত অর্থে আধুনিক মনোভাবাপন্ন অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা সেবা প্রদানকালে নিজেদের সেবক হিসেবে উপস্থাপন করেন। তারা যেহেতু সংখ্যায় কম এ জন্য তাদের আচরণকে প্রতিনিধিত্বশীল বলে আখ্যায়িত করা যায় না।

বঙ্গবন্ধুকে “মুজিব ভাই”, “শেখ সাহেব”, “শেখ মুজিবুর” বলে আখ্যায়িত করা হতো। আমাদের গণমুখী প্রধাণমন্ত্রীকে গ্রামের কৃষক, জেলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা কর্মীরা “আপা” বলে সম্বোধন করে অভ্যস্থ। কোন দিন শুনিনি এ রকম সম্বোধনে তিনি তাদের অনুৎসাহিত করছেন। আমরা কি বঙ্গবন্ধুর থেকে সব দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট? আমরা কেন তার মতো মাটির কাছাকাছি যেতে পারি না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কিন্তু সব স্তরের মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা একটি অঙ্গীকার ছিল? অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার গতির সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে আমাদের আচরণের সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে যেমন মানুষে মানুষে বৈষম্য কমিয়ে নিয়ে আসা আবশ্যক একইভাবে আমাদের প্রশাসনকে গণতন্ত্রের মৌলবাণী অনুসরণ করে আধুনিক ও মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসাও খুব জরুরি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top