alt

উপ-সম্পাদকীয়

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

এস ডি সুব্রত

: সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উৎসব বাংলা নববর্ষ । আদিবাসী সংস্কৃতিরও অন্যতম বর্ষবরণ উৎসব হচ্ছে বৈসাবি। বৈসাবি হচ্ছে ত্রিপুরা, মার্মা, চাকমা এবং তঞ্চংগ্যা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপনের সম্মিলিত নাম। নববর্ষ উপলক্ষে ত্রিপুরারা যে উৎসব করে থাকে তা হলো বৈসু। এর অন্যান্য নাম বৈসুক, বাসুই। মারমাদের অনুষ্ঠানের নাম সাংগ্রাই আর চাকমা এবং তঞ্চংগ্যাদের অনুষ্ঠানের নাম বিজু। এই তিনটি উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তৈরি হয়েছে বৈসাবি। বৈসু থেকে বৈ, সাংগ্রাই থেকে সা এবং বিজু থেকে বি নিয়ে হয়েছে বৈসাবি। এই উৎসব পালিত হয় বঙ্গাব্দের সঙ্গে। তবে বঙ্গাব্দের ক্ষেত্রে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিই উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু বৈসু, সাংগ্রাই এবং বিজু পালিত হয় একাধিক দিন ধরে।

বৈসু উৎসব : ত্রিপুরা জাতির তিন দিনব্যাপী পালিত নববর্ষের উৎসব বৈসু। ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এই উৎসবটি তিন দিন ধরে উৎযাপন করা হয়। একে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলোÑ

১. হারি বৈসু : চৈত্র সংক্রান্তির পূর্ব-দিনে এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন এরা আগামী দিনের সুখ ও সম্পদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থন করে। এরা নদীর তীরে, মন্দিরে, বিশেষ পবিত্র স্থানে ফুল, ধুপ এবং দীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এই দিন এরা বিশেষভাবে গবাদিপশুর পরিচর্যা করে। পশুদের পানি দিয়ে পরিষ্কার করে গলায় মালা পরায়। এরপর কিশোর-কিশোরীদের ফুল নিয়ে খেলা শুরু হয়। এছাড়া পাড়া-প্রতিবেশীদের এরা ফুল উপহার দেয়।

২. বিসুমা : চৈত্র সংক্রান্তিতে এই উৎসব করা হয়। এ দিনকে বলা যায় খাদ্য উৎসব। এদিন তারা পুরানো বিবাদ ভুলে গিয়ে পরস্পরের বাড়িতে মিষ্টান্নসহ নানা ধরনের মুখোরোচক খাবার পাঠায়। এই উৎসবের প্রধান আকর্যণ থাকে জনপ্রিয় খাবার ‘গণত্মক বা পাচন’। এর পাশাপাশি থাকে নানা ধরনের পিঠা, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল। এছাড়া ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির সংমিশ্রণে তৈরি হয় বিশেষ ধরনের খাবার। এদিন দরিদ্র লোকদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়।

৩. বিসিকতাল : এই দিন নববর্ষকে বরণ করা হয়। নববর্ষের প্রথম দিনে এরা আগামী দিনের সুখ ও সম্পদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। এ দিনের বিশেষ আয়োজন থাকে ফুল ও পানি নিয়ে খেলার আয়োজন। বিশেষ করে পানি নিয়ে খেলাটা উৎসবটি বৈসুর-এর প্রধান আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য পানি দিয়ে পুরানো দিনের সবাই গ্লানি ধুয়ে দেয়া। কিন্তু এ খেলাটিতে প্রতিজ্ঞার বিষয়টির চেয়ে বড় হয়ে উঠে পানি ছুঁঙে উল্লাসে মেতে ওঠা। মারমা যুবক-যুবতীরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে।

সাংগ্রাই উৎসব : মার্মা জাতির চার দিনব্যাপী পালিত নববর্ষের উৎসব। এদের অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী বৎসরের শেষ তিন দিন ধরে আর শেষ দিন অনুষ্ঠিত হয় বৎসরের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখেই তারা সে উৎসবের আয়োজন করেন। এ উপলক্ষে তারা আকর্ষণীয় নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পানিখেলা সেসব অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। ওই দিন মারমা তরুণ-তরুণীরা একে অপরের প্রতি পানি ছিটিয়ে আনন্দ করেন। পানি ছিটানোর মাধ্যমে তারা বিগত বছরের গ্লানি ও কালিমা ধুয়ে-মুছে দূর করেন। তাছাড়া পানিখেলার মাধ্যমে তারা পছন্দের মানুষটিকেও খুঁজে নেন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ওই দিন মারমা সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে নতুন উন্মাদনা ও আনন্দের সৃষ্টি হয়। উৎসবের দিন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নৌকা বা বিশাল কোনো পাত্র পানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। তার দুই পাশে মারমা তরুণী ও যুবতীরা সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করেন। সদ্য তরুণ ও যুবকেরা সেই স্থানে পানিপূর্ণ পাত্র হাতে আসেন ও অপেক্ষমাণ তরুণী ও যুবতীদের দেহে পানি ছিটান। এতে পানিখেলার স্থানটি হাসি-আনন্দে ভরে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী মারমা পোশাক পরে তারা ঘুরে বেড়ান ও রঙিন পানি ছিটিয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ভালো খাবার তৈরি করে আপ্যায়ন করেন। রাতে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করেন এবং নতুন বছরের জন্য শান্তি ও কল্যাণ কামনা করেন।

বিজু উৎসব : চাকমাদের বড় সামাজিক উৎসব হল বিজু। এই উৎসবটির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো পুরাতন বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরকে সাদরে গ্রহণ করা। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং পহেলা বৈশাখ নিয়ে মোট তিন দিন ধরে বিজু উৎসব চলে।এই উৎসবটির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো পুরাতন বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরকে সাদরে গ্রহণ করা। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং পহেলা বৈশাখ নিয়ে মোট তিন দিন ধরে বিজু উৎসব চলে। বিজু উৎসবে তিন দিনের আলাদা নাম করণ করা হয়েছে। যেমন- প্রথম দিন ফুল বিজু, দ্বিতীয় দিন মূল বিজু ও তৃতীয় দিন গোজ্যাপোজ্যা। ফুল বিজু উৎসবের দিনে ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। সূর্যোদয়ের সময় নদীর ঘাটে ফুল দিয়ে পানির দেবতা ‘গোঙামা’কে পূজা দেওয়া হয়। এছাড়া সবাই দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে কলাপাতায় ফুল ও বাতি প্রজ্বালিত করে নদী, ছড়া, খাল কিংবা পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত নৈবেদ্যতে থাকে আতপ চাল, ফল-মুল, চিনি বা গুড়। এই দিনে নিকটস্থ বৌদ্ধবিহার পরিষ্কার করা হয় এবং বুদ্ধমূর্তি স্নান করানো হয়। মূল বিজুর দিনে ঘরে ঘরে নানাবিধ খাদ্যের আয়োজন করা হয়। এই দিনে বত্রিশ প্রকার সব্জি দিয়ে এক প্রকার খাবার তৈরি করা হয়। এই খাদ্যকে বলা হয় ‘পাজন’। ৩৬ রকমের পদ দিয়ে প্রকৃত পাজন বানানো হয়। তবে নিতান্তই সবাই উপকরণ না পাওয়া গেলে কমপক্ষে ২০টি পদ পাজনে থাকেই। সচারচর পাজন-এর যে সবাই উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তা হলো— বুনো আলু, চিংড়ি মাছ, কাঁচা কাঁঠাল, মটর, ছোলা, সিমের বিচি, কচি বেত, বাঁশের ডগা এবং অন্যান্য গ্রীষ্মকালীন সব্জি। গোজ্যাপোজ্যা অনুষ্ঠানে নিকট আত্মীয়-স্বজনকে আপ্যায়ন করা হয়। নতুন বছরের শুভ কামনায় বিহারে গিয়ে বুদ্ধের আশীর্বাদ গ্রহণ করা হয় এবং পাড়ার ছোটরা বয়স্কদের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। উৎসবের শেষ দিনটিতে চাকমারা আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠে। আনন্দের উপকরণ হিসেবে নৃত্যগীত ও মাত্রাধিক মদ্যপান করে করে। বিজু উৎসবকে সামনে রেখে দুই ধরনের মদ তৈরি করা হয়। একটা হলো দো-চোয়ানি যেটি ভাত পচিয়ে তার রস পাতিত করে এই মদ তৈরি করা হয়। দুইবার পাতন করার কারণে একে দো-চোয়ানি বলে। দো-চোয়ানির রঙ একেবারে পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে থাকে। আরেক ধরনের মদ হলো জগরা বা কাঞ্জি। পচা ভাতের রস থেকে উৎপন্ন মদ। এই মদে ঈষৎ সাদা রঙের হয়। এর স্বাদ অম্লমধুর। এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে খুবই কম। যদিও বৈসাবি ত্রিপুরা, মার্মা, চাকমা এবং তঞ্চংগ্যাদের উৎসব; কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকার সবাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মতো করে এই উৎসব পালন করে থাকে। এছাড়া স্থানীয় বাঙালিরাও এই উৎসবে যোগদান করে থাকে। ফলে ক্রমে ক্রমে পাহাড়ি এলাকায় বৈসাবি একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাঙালির বর্ষবরণ উৎসবের মতো আদিবাসী সংস্কৃতির বৈসাবি উৎসব হয়ে উঠুক সার্বজনীন। টিকে থাকুক বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে।

[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

এস ডি সুব্রত

সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উৎসব বাংলা নববর্ষ । আদিবাসী সংস্কৃতিরও অন্যতম বর্ষবরণ উৎসব হচ্ছে বৈসাবি। বৈসাবি হচ্ছে ত্রিপুরা, মার্মা, চাকমা এবং তঞ্চংগ্যা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপনের সম্মিলিত নাম। নববর্ষ উপলক্ষে ত্রিপুরারা যে উৎসব করে থাকে তা হলো বৈসু। এর অন্যান্য নাম বৈসুক, বাসুই। মারমাদের অনুষ্ঠানের নাম সাংগ্রাই আর চাকমা এবং তঞ্চংগ্যাদের অনুষ্ঠানের নাম বিজু। এই তিনটি উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তৈরি হয়েছে বৈসাবি। বৈসু থেকে বৈ, সাংগ্রাই থেকে সা এবং বিজু থেকে বি নিয়ে হয়েছে বৈসাবি। এই উৎসব পালিত হয় বঙ্গাব্দের সঙ্গে। তবে বঙ্গাব্দের ক্ষেত্রে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিই উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু বৈসু, সাংগ্রাই এবং বিজু পালিত হয় একাধিক দিন ধরে।

বৈসু উৎসব : ত্রিপুরা জাতির তিন দিনব্যাপী পালিত নববর্ষের উৎসব বৈসু। ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এই উৎসবটি তিন দিন ধরে উৎযাপন করা হয়। একে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলোÑ

১. হারি বৈসু : চৈত্র সংক্রান্তির পূর্ব-দিনে এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন এরা আগামী দিনের সুখ ও সম্পদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থন করে। এরা নদীর তীরে, মন্দিরে, বিশেষ পবিত্র স্থানে ফুল, ধুপ এবং দীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এই দিন এরা বিশেষভাবে গবাদিপশুর পরিচর্যা করে। পশুদের পানি দিয়ে পরিষ্কার করে গলায় মালা পরায়। এরপর কিশোর-কিশোরীদের ফুল নিয়ে খেলা শুরু হয়। এছাড়া পাড়া-প্রতিবেশীদের এরা ফুল উপহার দেয়।

২. বিসুমা : চৈত্র সংক্রান্তিতে এই উৎসব করা হয়। এ দিনকে বলা যায় খাদ্য উৎসব। এদিন তারা পুরানো বিবাদ ভুলে গিয়ে পরস্পরের বাড়িতে মিষ্টান্নসহ নানা ধরনের মুখোরোচক খাবার পাঠায়। এই উৎসবের প্রধান আকর্যণ থাকে জনপ্রিয় খাবার ‘গণত্মক বা পাচন’। এর পাশাপাশি থাকে নানা ধরনের পিঠা, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল। এছাড়া ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির সংমিশ্রণে তৈরি হয় বিশেষ ধরনের খাবার। এদিন দরিদ্র লোকদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়।

৩. বিসিকতাল : এই দিন নববর্ষকে বরণ করা হয়। নববর্ষের প্রথম দিনে এরা আগামী দিনের সুখ ও সম্পদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। এ দিনের বিশেষ আয়োজন থাকে ফুল ও পানি নিয়ে খেলার আয়োজন। বিশেষ করে পানি নিয়ে খেলাটা উৎসবটি বৈসুর-এর প্রধান আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য পানি দিয়ে পুরানো দিনের সবাই গ্লানি ধুয়ে দেয়া। কিন্তু এ খেলাটিতে প্রতিজ্ঞার বিষয়টির চেয়ে বড় হয়ে উঠে পানি ছুঁঙে উল্লাসে মেতে ওঠা। মারমা যুবক-যুবতীরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে।

সাংগ্রাই উৎসব : মার্মা জাতির চার দিনব্যাপী পালিত নববর্ষের উৎসব। এদের অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী বৎসরের শেষ তিন দিন ধরে আর শেষ দিন অনুষ্ঠিত হয় বৎসরের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখেই তারা সে উৎসবের আয়োজন করেন। এ উপলক্ষে তারা আকর্ষণীয় নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পানিখেলা সেসব অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। ওই দিন মারমা তরুণ-তরুণীরা একে অপরের প্রতি পানি ছিটিয়ে আনন্দ করেন। পানি ছিটানোর মাধ্যমে তারা বিগত বছরের গ্লানি ও কালিমা ধুয়ে-মুছে দূর করেন। তাছাড়া পানিখেলার মাধ্যমে তারা পছন্দের মানুষটিকেও খুঁজে নেন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ওই দিন মারমা সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে নতুন উন্মাদনা ও আনন্দের সৃষ্টি হয়। উৎসবের দিন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নৌকা বা বিশাল কোনো পাত্র পানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। তার দুই পাশে মারমা তরুণী ও যুবতীরা সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করেন। সদ্য তরুণ ও যুবকেরা সেই স্থানে পানিপূর্ণ পাত্র হাতে আসেন ও অপেক্ষমাণ তরুণী ও যুবতীদের দেহে পানি ছিটান। এতে পানিখেলার স্থানটি হাসি-আনন্দে ভরে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী মারমা পোশাক পরে তারা ঘুরে বেড়ান ও রঙিন পানি ছিটিয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ভালো খাবার তৈরি করে আপ্যায়ন করেন। রাতে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করেন এবং নতুন বছরের জন্য শান্তি ও কল্যাণ কামনা করেন।

বিজু উৎসব : চাকমাদের বড় সামাজিক উৎসব হল বিজু। এই উৎসবটির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো পুরাতন বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরকে সাদরে গ্রহণ করা। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং পহেলা বৈশাখ নিয়ে মোট তিন দিন ধরে বিজু উৎসব চলে।এই উৎসবটির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো পুরাতন বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরকে সাদরে গ্রহণ করা। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং পহেলা বৈশাখ নিয়ে মোট তিন দিন ধরে বিজু উৎসব চলে। বিজু উৎসবে তিন দিনের আলাদা নাম করণ করা হয়েছে। যেমন- প্রথম দিন ফুল বিজু, দ্বিতীয় দিন মূল বিজু ও তৃতীয় দিন গোজ্যাপোজ্যা। ফুল বিজু উৎসবের দিনে ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। সূর্যোদয়ের সময় নদীর ঘাটে ফুল দিয়ে পানির দেবতা ‘গোঙামা’কে পূজা দেওয়া হয়। এছাড়া সবাই দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে কলাপাতায় ফুল ও বাতি প্রজ্বালিত করে নদী, ছড়া, খাল কিংবা পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত নৈবেদ্যতে থাকে আতপ চাল, ফল-মুল, চিনি বা গুড়। এই দিনে নিকটস্থ বৌদ্ধবিহার পরিষ্কার করা হয় এবং বুদ্ধমূর্তি স্নান করানো হয়। মূল বিজুর দিনে ঘরে ঘরে নানাবিধ খাদ্যের আয়োজন করা হয়। এই দিনে বত্রিশ প্রকার সব্জি দিয়ে এক প্রকার খাবার তৈরি করা হয়। এই খাদ্যকে বলা হয় ‘পাজন’। ৩৬ রকমের পদ দিয়ে প্রকৃত পাজন বানানো হয়। তবে নিতান্তই সবাই উপকরণ না পাওয়া গেলে কমপক্ষে ২০টি পদ পাজনে থাকেই। সচারচর পাজন-এর যে সবাই উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তা হলো— বুনো আলু, চিংড়ি মাছ, কাঁচা কাঁঠাল, মটর, ছোলা, সিমের বিচি, কচি বেত, বাঁশের ডগা এবং অন্যান্য গ্রীষ্মকালীন সব্জি। গোজ্যাপোজ্যা অনুষ্ঠানে নিকট আত্মীয়-স্বজনকে আপ্যায়ন করা হয়। নতুন বছরের শুভ কামনায় বিহারে গিয়ে বুদ্ধের আশীর্বাদ গ্রহণ করা হয় এবং পাড়ার ছোটরা বয়স্কদের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। উৎসবের শেষ দিনটিতে চাকমারা আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠে। আনন্দের উপকরণ হিসেবে নৃত্যগীত ও মাত্রাধিক মদ্যপান করে করে। বিজু উৎসবকে সামনে রেখে দুই ধরনের মদ তৈরি করা হয়। একটা হলো দো-চোয়ানি যেটি ভাত পচিয়ে তার রস পাতিত করে এই মদ তৈরি করা হয়। দুইবার পাতন করার কারণে একে দো-চোয়ানি বলে। দো-চোয়ানির রঙ একেবারে পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে থাকে। আরেক ধরনের মদ হলো জগরা বা কাঞ্জি। পচা ভাতের রস থেকে উৎপন্ন মদ। এই মদে ঈষৎ সাদা রঙের হয়। এর স্বাদ অম্লমধুর। এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে খুবই কম। যদিও বৈসাবি ত্রিপুরা, মার্মা, চাকমা এবং তঞ্চংগ্যাদের উৎসব; কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকার সবাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মতো করে এই উৎসব পালন করে থাকে। এছাড়া স্থানীয় বাঙালিরাও এই উৎসবে যোগদান করে থাকে। ফলে ক্রমে ক্রমে পাহাড়ি এলাকায় বৈসাবি একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাঙালির বর্ষবরণ উৎসবের মতো আদিবাসী সংস্কৃতির বৈসাবি উৎসব হয়ে উঠুক সার্বজনীন। টিকে থাকুক বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে।

[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক]

back to top