alt

উপ-সম্পাদকীয়

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

মিথুশিলাক মুরমু

: সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪
image

রাজধানীর বাসাবো বৌদ্ধ বিহারে ইফতার বিতরণ করা হচ্ছে

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিসর ও জর্দান সফরকালে মুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রোজা রেখেছিলেন। ২৪ মার্চ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এর বার্তায় লিখেছিলেন, ‘রমজানের এই সংহতির মিশনে রোজা রেখেছি। মূলত আমি যে মুসলিমদের সঙ্গে দেখা করছি তাদের বিশ^াসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তা করেছি। অবশ্য গাজায় অনেক ফিলিস্তিনি ইফতার করতে পারছে না জেনে আমার অন্তর ভেঙে পড়েছে।’ একজন খ্রিস্টান ধর্মানুসারী হিসেবে গুতেরেস-এর এমন মহত্ব সত্যিই অনুকরণীয়। ১৯৩টি দেশের আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘ। গুতেরেসকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলামসহ সব ধর্মের মানুষের ও রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা, মতবিনিময় ও দাপ্তরিক কাজগুলো সম্পাদন করতে হয়। তিনি যে সার্বজনীন, সেটি মিসর ও জর্দান সফরে প্রমাণ করেছেন। ইতোপূর্বে নেপাল সফরকালে হিমালয়ের দক্ষিণে লুম্বিনীতে প্রার্থনা করেছিলেন। লুম্বিনীকে তিনি আধ্যাত্মিক, প্রশান্তি এবং শান্তির স্থান বলে অভিহিত করেছিলেন। বর্তমানে প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল যুদ্ধেও তিনি নিজ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে প্রচেষ্টায় ত্রুটি করেননি। রাজধানীর সবুজবাগের ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার কর্তৃপক্ষ বিগত অর্ধদশক থেকে পুরো রমজান মাসে অত্র এলাকার অসহায়, দুস্থ, গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের হাতে প্রতিদিন ইফতারের পূর্বে তুলে দিচ্ছে ইফতারি সামগ্রী। আর এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা ধারণ করে এগিয়ে চলেছেন ধর্মরাজিকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বুদ্ধপ্রিয় মহাথের। এ বছর নিয়ে টানা আট বছর প্রতি রমজান মাসে ইফতারি সামগ্রী বিতরণ করে আসছেন। প্রথম ২ বছর প্রতিদিন ৫০০ প্যাকেট ইফতারি দেয়ার ব্যবস্থা ছিল, আর্থিক সংকটের কারণে পরবর্তীকালে প্যাকেট কমানো হয়। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিদিন ১৫০ জনকে ইফতারি দেয়া হচ্ছে। রমজান মাসের প্রতিদিন ঠিক ইফতারের আগে বৌদ্ধ মন্দিরের মূল ফটকের বাইরে এসে হতদরিদ্র রোজাদাররা অপেক্ষা করতে থাকেন। বিকেল ৫টার পরই খুলে দেয়া হয় মন্দিরের মূল ফটক। মূল ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ ভিক্ষু অপেক্ষমাণ রোজাদারদের হাতে তুলে দেন একটি করে টোকেন। টোকেন নিয়ে সারিবদ্ধভাবে মন্দিরের ভেতরে অপেক্ষা করতে থাকেন। রিকশাওয়ালা রোজাদার খলিল বলেছেন, ‘বিকেলে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় এখান থেকে ইফতার সংগ্রহ করি। আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য এটা খুবই উপকারী, আর তাদের জন্যও সওয়াবের কাজ। বৌদ্ধরা দিচ্ছে বলে ইফতারি নেয়া যাবে না, আমরা এ নীতি মানি না। কেন না তারা এগুলো ভালোবাসে ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই দিচ্ছেন’। অপরদিকে মন্দিরের ধর্মরাজিক বিভুতি ভিক্ষুও সাক্ষ্য দিয়েছেন, ‘প্রায় আট থেকে নয় বছর ধরে আমরা ইফতারি বিতরণ করছি। আমরা মনে করি, সবার আগে মানুষ। তারপর ধর্ম। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যাই হোক না কেন আমরা সবার আগে বাংলাদেশি। আর ধর্মের কাজ মানুষের সেবা করা। আমরা নানাভাবে মানুষের সেবা করার চেষ্টা করি। প্রতিদিন বিকেলে এখানে শত শত মানুষ আসে। যারা আসে, তাদের ইফতারি দেই।’ শুধু আমার দেশে নয়, পার্শ^বর্তী দেশ ভারতেও করোনাকালীন বর্ধমান শহরের রামকৃষ্ণপল্লী শিব কালী দুর্গা মন্দির কমিটি শহরের ভাঙাকুঠি এলাকায় মুসলিম ভাইবোনদের মাঝে ইফতারের সামগ্রী বিতরণ করে অপূর্ব ভালোবাসা প্রদর্শন করেছিলেন। এবারেই প্রথম চোখে পড়েছে ‘এক টাকায় ইফতারি দিচ্ছেন তিন ধর্মের ১২ বন্ধু’। খুলনা দৌলতপুরের মহেশ^রপাশা কালীবাড়ি বাজারে ‘ইকবাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’-এর স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেনসহ আরও ১১ জন মিলে দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে মাত্র ১ টাকায় ইফতার সামগ্রী বিক্রি করে যাচ্ছেন। এই ১২ জনের মধ্যে রয়েছেÑ ইসলাম ধর্মের ৮ জন, হিন্দু ৩ জন ও খ্রিস্টান ধর্মানুসারী ১ জন। ১২ জনই স্থানীয় বাজারে ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, কেউ ফলের ব্যবসায়ী, আবার কেউবা কারপেন্টার। গ্রামের সাধারণ রোজাদারদের জন্য ইফতারের তালিকায় যুক্ত করেছেন পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপের মতো সাধারণ ইফতারি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে মাত্র ১ টাকায় প্রাপ্তিতে প্রতিদিনই হোটেলের সামনে দীর্ঘ লাইন সত্যিই অভাবনীয় দৃশ্য। প্রতিদিন বিভিন্ন পদ মিলিয়ে ৭ হাজার টাকার কিছু বেশি ইফতার সামগ্রী এক টাকায় বিক্রি করে থাকেন। নিশ্চিত লোকসান জেনেও ধর্মানুরাগীদের প্রতি এরূপ ব্যবস্থার জের টানেন চাঁনরাতে। চাঁনরাতে ১২ জন মিলে হিসাব-নিকাশ করে ঘাটতি পূরণ করে থাকেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী গোবিন্দ কুমার দাস বলেছেন, ‘সব ধর্মেই তো মানুষের সেবার কথা বলা আছে। এই উদ্যোগের অংশ হতে পেরে ভালো লাগে। আমার বাড়িতে কোনো উৎসব কিংবা বিপদ-আপদ হলে আশপাশের মুসলমান ভাইয়েরাই তো সহায়তা করেন।’ খ্রিস্টান ধর্মের নিরঞ্জন বাড়ৈ-এর অভিব্যক্তি, ‘যে কোনো ভালো কাজে শামিল হতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। মানবসেবাই তো বড় সেবা। সেটাই মাথায় রাখি। মনে একটা তৃপ্তি পাই।’ সাম্প্রতিকালে সার্বজনীন শব্দটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের উৎসবগুলোকে প্রায়শঃই সার্বজনীন উৎসব হিসেবে সর্বধর্ম ও শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে। উৎসব ব্যতিত উপাসনালয়গুলোও এখন সার্বজনীন শব্দটি ব্যবহার করে সাইনবোর্ডে লিখছেন। বৌদ্ধদের চট্টগ্রামের শাকপুরা সার্বজনীন চাত্তাং বৌদ্ধ মন্দির। রাউজানের ১১নং পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের উত্তর গুজরার মধ্যম রূপচাঁন্দনগর গ্রামে ৫ বাড়ির সমন্বয়ে সর্বসাধারণের উপস্থিতিতে ‘মো. তকি সিকদার সার্বজনীন জামে মসজিদ’ নির্মিত হয়েছে। দূর্গাপূজাকে সার্বজনীন এবং বড়দিনকে সার্বজীনন উৎসব বলা হচ্ছে। ঈদকেও জাতীয় এবং সার্বজীনন উৎসব হিসেবে গণ্য করা হয়। কেউ উদ্যোগ নিয়ে ঈদকে জাতীয় বা সার্বজনীন বানায়নি, এটি হয়েছে সহজ, সরল ও সাবলীলভাবে। বড়দিনে ধর্ম-বর্ণের মানুষ সামিল হতে পারে। এটিই উৎসবের সার্বজনীন রূপ। আর সে সার্বজীনন রূপ পরিবার থেকে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ^ময় ছড়িয়ে দেবে শান্তির বার্তা। সম্প্রীতিমূলক আচরণ ও দৃষ্টান্ত এখনো সমাজে বিদ্যমান, অতীতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমাজকে ঋদ্ধ করেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম, আদিবাসী-অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক যেন দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র স্বার্থেই আমরা জড়িয়ে পড়ছি সহিংসতায়, ধর্মকে আঁকড়ে রেখে মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করি না। খুলনা দৌলতপুরের শিবুপদ দে’র ভাষায়, ‘...সম্প্রীতির সেই পরিবেশে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।’ আসুন, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা, দয়া, মমতা, ক্ষমা ও সহনশীলতা অনুশীলন করি।

[লেখক: কলামিস্ট]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

মিথুশিলাক মুরমু

image

রাজধানীর বাসাবো বৌদ্ধ বিহারে ইফতার বিতরণ করা হচ্ছে

সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিসর ও জর্দান সফরকালে মুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রোজা রেখেছিলেন। ২৪ মার্চ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এর বার্তায় লিখেছিলেন, ‘রমজানের এই সংহতির মিশনে রোজা রেখেছি। মূলত আমি যে মুসলিমদের সঙ্গে দেখা করছি তাদের বিশ^াসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তা করেছি। অবশ্য গাজায় অনেক ফিলিস্তিনি ইফতার করতে পারছে না জেনে আমার অন্তর ভেঙে পড়েছে।’ একজন খ্রিস্টান ধর্মানুসারী হিসেবে গুতেরেস-এর এমন মহত্ব সত্যিই অনুকরণীয়। ১৯৩টি দেশের আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘ। গুতেরেসকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলামসহ সব ধর্মের মানুষের ও রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা, মতবিনিময় ও দাপ্তরিক কাজগুলো সম্পাদন করতে হয়। তিনি যে সার্বজনীন, সেটি মিসর ও জর্দান সফরে প্রমাণ করেছেন। ইতোপূর্বে নেপাল সফরকালে হিমালয়ের দক্ষিণে লুম্বিনীতে প্রার্থনা করেছিলেন। লুম্বিনীকে তিনি আধ্যাত্মিক, প্রশান্তি এবং শান্তির স্থান বলে অভিহিত করেছিলেন। বর্তমানে প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল যুদ্ধেও তিনি নিজ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে প্রচেষ্টায় ত্রুটি করেননি। রাজধানীর সবুজবাগের ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার কর্তৃপক্ষ বিগত অর্ধদশক থেকে পুরো রমজান মাসে অত্র এলাকার অসহায়, দুস্থ, গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের হাতে প্রতিদিন ইফতারের পূর্বে তুলে দিচ্ছে ইফতারি সামগ্রী। আর এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা ধারণ করে এগিয়ে চলেছেন ধর্মরাজিকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বুদ্ধপ্রিয় মহাথের। এ বছর নিয়ে টানা আট বছর প্রতি রমজান মাসে ইফতারি সামগ্রী বিতরণ করে আসছেন। প্রথম ২ বছর প্রতিদিন ৫০০ প্যাকেট ইফতারি দেয়ার ব্যবস্থা ছিল, আর্থিক সংকটের কারণে পরবর্তীকালে প্যাকেট কমানো হয়। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিদিন ১৫০ জনকে ইফতারি দেয়া হচ্ছে। রমজান মাসের প্রতিদিন ঠিক ইফতারের আগে বৌদ্ধ মন্দিরের মূল ফটকের বাইরে এসে হতদরিদ্র রোজাদাররা অপেক্ষা করতে থাকেন। বিকেল ৫টার পরই খুলে দেয়া হয় মন্দিরের মূল ফটক। মূল ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ ভিক্ষু অপেক্ষমাণ রোজাদারদের হাতে তুলে দেন একটি করে টোকেন। টোকেন নিয়ে সারিবদ্ধভাবে মন্দিরের ভেতরে অপেক্ষা করতে থাকেন। রিকশাওয়ালা রোজাদার খলিল বলেছেন, ‘বিকেলে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় এখান থেকে ইফতার সংগ্রহ করি। আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য এটা খুবই উপকারী, আর তাদের জন্যও সওয়াবের কাজ। বৌদ্ধরা দিচ্ছে বলে ইফতারি নেয়া যাবে না, আমরা এ নীতি মানি না। কেন না তারা এগুলো ভালোবাসে ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই দিচ্ছেন’। অপরদিকে মন্দিরের ধর্মরাজিক বিভুতি ভিক্ষুও সাক্ষ্য দিয়েছেন, ‘প্রায় আট থেকে নয় বছর ধরে আমরা ইফতারি বিতরণ করছি। আমরা মনে করি, সবার আগে মানুষ। তারপর ধর্ম। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যাই হোক না কেন আমরা সবার আগে বাংলাদেশি। আর ধর্মের কাজ মানুষের সেবা করা। আমরা নানাভাবে মানুষের সেবা করার চেষ্টা করি। প্রতিদিন বিকেলে এখানে শত শত মানুষ আসে। যারা আসে, তাদের ইফতারি দেই।’ শুধু আমার দেশে নয়, পার্শ^বর্তী দেশ ভারতেও করোনাকালীন বর্ধমান শহরের রামকৃষ্ণপল্লী শিব কালী দুর্গা মন্দির কমিটি শহরের ভাঙাকুঠি এলাকায় মুসলিম ভাইবোনদের মাঝে ইফতারের সামগ্রী বিতরণ করে অপূর্ব ভালোবাসা প্রদর্শন করেছিলেন। এবারেই প্রথম চোখে পড়েছে ‘এক টাকায় ইফতারি দিচ্ছেন তিন ধর্মের ১২ বন্ধু’। খুলনা দৌলতপুরের মহেশ^রপাশা কালীবাড়ি বাজারে ‘ইকবাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’-এর স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেনসহ আরও ১১ জন মিলে দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে মাত্র ১ টাকায় ইফতার সামগ্রী বিক্রি করে যাচ্ছেন। এই ১২ জনের মধ্যে রয়েছেÑ ইসলাম ধর্মের ৮ জন, হিন্দু ৩ জন ও খ্রিস্টান ধর্মানুসারী ১ জন। ১২ জনই স্থানীয় বাজারে ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, কেউ ফলের ব্যবসায়ী, আবার কেউবা কারপেন্টার। গ্রামের সাধারণ রোজাদারদের জন্য ইফতারের তালিকায় যুক্ত করেছেন পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপের মতো সাধারণ ইফতারি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে মাত্র ১ টাকায় প্রাপ্তিতে প্রতিদিনই হোটেলের সামনে দীর্ঘ লাইন সত্যিই অভাবনীয় দৃশ্য। প্রতিদিন বিভিন্ন পদ মিলিয়ে ৭ হাজার টাকার কিছু বেশি ইফতার সামগ্রী এক টাকায় বিক্রি করে থাকেন। নিশ্চিত লোকসান জেনেও ধর্মানুরাগীদের প্রতি এরূপ ব্যবস্থার জের টানেন চাঁনরাতে। চাঁনরাতে ১২ জন মিলে হিসাব-নিকাশ করে ঘাটতি পূরণ করে থাকেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী গোবিন্দ কুমার দাস বলেছেন, ‘সব ধর্মেই তো মানুষের সেবার কথা বলা আছে। এই উদ্যোগের অংশ হতে পেরে ভালো লাগে। আমার বাড়িতে কোনো উৎসব কিংবা বিপদ-আপদ হলে আশপাশের মুসলমান ভাইয়েরাই তো সহায়তা করেন।’ খ্রিস্টান ধর্মের নিরঞ্জন বাড়ৈ-এর অভিব্যক্তি, ‘যে কোনো ভালো কাজে শামিল হতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। মানবসেবাই তো বড় সেবা। সেটাই মাথায় রাখি। মনে একটা তৃপ্তি পাই।’ সাম্প্রতিকালে সার্বজনীন শব্দটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের উৎসবগুলোকে প্রায়শঃই সার্বজনীন উৎসব হিসেবে সর্বধর্ম ও শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে। উৎসব ব্যতিত উপাসনালয়গুলোও এখন সার্বজনীন শব্দটি ব্যবহার করে সাইনবোর্ডে লিখছেন। বৌদ্ধদের চট্টগ্রামের শাকপুরা সার্বজনীন চাত্তাং বৌদ্ধ মন্দির। রাউজানের ১১নং পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের উত্তর গুজরার মধ্যম রূপচাঁন্দনগর গ্রামে ৫ বাড়ির সমন্বয়ে সর্বসাধারণের উপস্থিতিতে ‘মো. তকি সিকদার সার্বজনীন জামে মসজিদ’ নির্মিত হয়েছে। দূর্গাপূজাকে সার্বজনীন এবং বড়দিনকে সার্বজীনন উৎসব বলা হচ্ছে। ঈদকেও জাতীয় এবং সার্বজীনন উৎসব হিসেবে গণ্য করা হয়। কেউ উদ্যোগ নিয়ে ঈদকে জাতীয় বা সার্বজনীন বানায়নি, এটি হয়েছে সহজ, সরল ও সাবলীলভাবে। বড়দিনে ধর্ম-বর্ণের মানুষ সামিল হতে পারে। এটিই উৎসবের সার্বজনীন রূপ। আর সে সার্বজীনন রূপ পরিবার থেকে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ^ময় ছড়িয়ে দেবে শান্তির বার্তা। সম্প্রীতিমূলক আচরণ ও দৃষ্টান্ত এখনো সমাজে বিদ্যমান, অতীতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমাজকে ঋদ্ধ করেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম, আদিবাসী-অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক যেন দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র স্বার্থেই আমরা জড়িয়ে পড়ছি সহিংসতায়, ধর্মকে আঁকড়ে রেখে মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করি না। খুলনা দৌলতপুরের শিবুপদ দে’র ভাষায়, ‘...সম্প্রীতির সেই পরিবেশে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।’ আসুন, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা, দয়া, মমতা, ক্ষমা ও সহনশীলতা অনুশীলন করি।

[লেখক: কলামিস্ট]

back to top