alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

রেজাউল করিম খোকন

: সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশ এখন প্রতি বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করছে, তার জন্য নতুন ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আদায় করা রাজস্ব ব্যবহার করে যাবতীয় পরিচালন খরচ মেটানো হচ্ছে এখন। রাজস্ব বাজেট থেকে ঋণের সুদ আসলের পুরো অর্থের জোগান দেয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বড় প্রকল্পে কঠিন শর্তের ঋণ নেয়া হচ্ছে। ওই সব ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়ও এসে গেছে। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। গত তিন অর্থবছরের বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে ২৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও প্রায় ১৫ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হবে। বাজেটের দলিলে শুধু সুদ খরচের বরাদ্দ দেখানো হয়।

বিদেশি ঋণের আসলের বড় অংশ ঋণ করে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায়ের বিকল্প নেই। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জিডিপির তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। প্রতি বছরই এই অনুপাত বেড়েছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৮০ শতাংশে। গত ডিসেম্বর মাস শেষে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৩৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ সরকারি ঋণ এবং ২০ শতাংশের মতো বেসরকারি খাতের ঋণ। গত অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৬ কোটি ডলার, যা আগের এক যুগের মধ্যে তিনগুণ বেড়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ডলার শোধ করতে হয়েছে।

শুধু এক বছরের ব্যবধানেই এই ঋণ পরিশোধ ১১০ কোটি ডলার বেড়েছে। এমন অবস্থায় সরকার চলতি অর্থবছরেই দাতাদের কাছ থেকে আরও ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের উদাহরণ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বলা যায়, এই প্রকল্পের সুদ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ৩৩ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে। গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৬ সাল থেকে প্রতি বছর ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ঋণ করে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্প রপ্তানি বাড়াতে পারছে কিনা, তা দেখতে হবে। এসব প্রকল্পে আয় হচ্ছে টাকায়। ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলারে। ডলারের দাম বাড়ার ফলে ঋণ পরিশোধে বেশি টাকাও খরচ হচ্ছে। এমনকি বেসরকারি খাতের ঋণ পরিশোধেও রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাসহ আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।

বিদেশি ঋণ কেন নেব, কীভাবে আমরা বিদেশি ঋণ পরিশোধ করব, কীভাবে আমরা রপ্তানির সক্ষমতা বাড়াবÑ তা নিয়ে বেশি চিন্তা করা উচিত। কারণ, রপ্তানি বাড়লে তা ঋণ পরিশোধকে সহজ করবে। এখন চিন্তা করা উচিত কীভাবে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য একজন বিশেষ উপদেষ্টা আছেন, যার একটি বিশাল ব্যবসায় অভিজ্ঞতা আছে। তাকে দুর্নীতি এবং বিশেষ সুবিধাভোগীদের মোকাবিলা করতে হবে। ঋণ করে বড় প্রকল্প করলে ২০-৩০ শতাংশ খরচ বেড়ে যায়। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা বড় ইস্যু হয়ে যায়।

রাজস্ব বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে একটি টাকাও দেয়া যাচ্ছে না। ঋণ নিয়ে এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর প্রতিফলন নেই। এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ এখনো ২৩ শতাংশে আছে, বরং সরকারের হিসাবে, জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে। মানুষের গড় আয়ু কমেছে, মৃত্যুহার বেড়েছে। আবার বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৫ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে চলতে হয়। গত দেড় দশকে এত কিছু করা হলো; তাহলে মানুষ এসবের সুফল পাচ্ছে না কেন? উল্টো আমরা কী দেখছি, ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়া হয় না। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের টাকা লুটপাট হয়েছে। বৈদেশিক ঋণে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পুঁজি সঞ্চয়ের নতুন উৎস হিসেবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে তা বেশি হয়েছে। মেগা প্রকল্পের সঙ্গে ওই বিশেষ গোষ্ঠীর টাকা পাচারের সংশ্লেষ রয়েছে ।

সরকার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থা এবং জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয়। এসব ঋণ নেয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি। ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার হলেও সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাতে এখনো মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণের কারণে অর্থনীতি দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের দেয়া প্রতিশ্রুতির ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার পাইপলাইনে তথা অলস পড়ে আছে। অর্থাৎ দাতাদের বরাদ্দ করা এই অর্থ এখনো ছাড় হয়নি, যা দেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ সক্ষমতার অভাবে বিদেশি সহায়তার অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে না। আবার দাতাদের দিক থেকেও কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অর্থ ছাড় করা যাচ্ছে না। অনেক দিন ধরে চলমান ডলার-সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাওয়ার এই সময় দাতাদের প্রতিশ্রুতির অর্থ ছাড় করাতে পারলে কিছুটা স্বস্তি মিলত। বিভিন্ন সময় নানা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। কিন্তু সব অর্থ ছাড় করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত দাতারা যে পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার তিন ভাগের এক ভাগও ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।

ডলার-সংকট ও রিজার্ভ পরিস্থিতিÑ এসব বিবেচনায় ডলারের প্রয়োজন মেটাতে দ্রুত বিদেশি সহায়তা ছাড় করা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থা অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে বাংলাদেশকে মোট ১৮ হাজার ৭৬৪ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বর্তমান বাজারমূল্যে দেশি মুদ্রায় ২০ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এর প্রায় ৩২ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ এখনো ব্যবহার করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিদেশি সহায়তা ব্যবহার না করতে না পারার হার ক্রমেই বাড়ছে। ৮ বছর আগে ২০১৬ সালে এই হার ছিল ২৯ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করতে পেরেছে ১২ হাজার ৬৮৭ কোটি ডলার। এছাড়া দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে ১ হাজার ৪২২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি বাতিল করেছে দাতা সংস্থা ও দেশগুলো। বাকি ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার এখন পাইপলাইনে পড়ে আছে, যা বাংলাদেশ চাইলে ব্যবহার করতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন সমস্যা আছে, তেমনি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দাতাদের নানা শর্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মন্ত্রণালয়গুলো বিদেশি সহায়তার প্রকল্পে কম আগ্রহ দেখান। তবে কয়েক বছর ধরে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় কয়েকগুণ বেড়েছে।

প্রতিশ্রুতির ঋণসহায়তা ছাড়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পাইপলাইনে থাকা অর্থের একটি অংশ বাজেট সহায়তা হিসেবে স্থানান্তর করে ছাড় করা যেতে পারে। এছাড়া বিদেশি সহায়তা ব্যবহার করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, এমন মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য প্রতি মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়া বাধ্যতামূলক করা যায়। পুরো বিষয়টিকে তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা উচিত। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে সব ধরনের সমস্যার সমাধান করে বিদেশি সহায়তার অর্থ দ্রুত ছাড় করতে হবে। আইএমএফের ঋণ নেয়া হয়েছে মূলত স্বস্তির জন্য। আমাদের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্যান্য সরবরাহকারী ঋণ এড়িয়ে চলা উচিত। বিদেশি ঋণ কোন প্রকল্পে খরচ হচ্ছে, কীভাবে খরচ হচ্ছে- এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

রেজাউল করিম খোকন

সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশ এখন প্রতি বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করছে, তার জন্য নতুন ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আদায় করা রাজস্ব ব্যবহার করে যাবতীয় পরিচালন খরচ মেটানো হচ্ছে এখন। রাজস্ব বাজেট থেকে ঋণের সুদ আসলের পুরো অর্থের জোগান দেয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বড় প্রকল্পে কঠিন শর্তের ঋণ নেয়া হচ্ছে। ওই সব ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়ও এসে গেছে। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। গত তিন অর্থবছরের বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে ২৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও প্রায় ১৫ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হবে। বাজেটের দলিলে শুধু সুদ খরচের বরাদ্দ দেখানো হয়।

বিদেশি ঋণের আসলের বড় অংশ ঋণ করে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায়ের বিকল্প নেই। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জিডিপির তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। প্রতি বছরই এই অনুপাত বেড়েছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৮০ শতাংশে। গত ডিসেম্বর মাস শেষে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৩৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ সরকারি ঋণ এবং ২০ শতাংশের মতো বেসরকারি খাতের ঋণ। গত অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৬ কোটি ডলার, যা আগের এক যুগের মধ্যে তিনগুণ বেড়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ডলার শোধ করতে হয়েছে।

শুধু এক বছরের ব্যবধানেই এই ঋণ পরিশোধ ১১০ কোটি ডলার বেড়েছে। এমন অবস্থায় সরকার চলতি অর্থবছরেই দাতাদের কাছ থেকে আরও ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের উদাহরণ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বলা যায়, এই প্রকল্পের সুদ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ৩৩ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে। গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৬ সাল থেকে প্রতি বছর ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ঋণ করে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্প রপ্তানি বাড়াতে পারছে কিনা, তা দেখতে হবে। এসব প্রকল্পে আয় হচ্ছে টাকায়। ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলারে। ডলারের দাম বাড়ার ফলে ঋণ পরিশোধে বেশি টাকাও খরচ হচ্ছে। এমনকি বেসরকারি খাতের ঋণ পরিশোধেও রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাসহ আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।

বিদেশি ঋণ কেন নেব, কীভাবে আমরা বিদেশি ঋণ পরিশোধ করব, কীভাবে আমরা রপ্তানির সক্ষমতা বাড়াবÑ তা নিয়ে বেশি চিন্তা করা উচিত। কারণ, রপ্তানি বাড়লে তা ঋণ পরিশোধকে সহজ করবে। এখন চিন্তা করা উচিত কীভাবে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য একজন বিশেষ উপদেষ্টা আছেন, যার একটি বিশাল ব্যবসায় অভিজ্ঞতা আছে। তাকে দুর্নীতি এবং বিশেষ সুবিধাভোগীদের মোকাবিলা করতে হবে। ঋণ করে বড় প্রকল্প করলে ২০-৩০ শতাংশ খরচ বেড়ে যায়। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা বড় ইস্যু হয়ে যায়।

রাজস্ব বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে একটি টাকাও দেয়া যাচ্ছে না। ঋণ নিয়ে এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর প্রতিফলন নেই। এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ এখনো ২৩ শতাংশে আছে, বরং সরকারের হিসাবে, জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে। মানুষের গড় আয়ু কমেছে, মৃত্যুহার বেড়েছে। আবার বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৫ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে চলতে হয়। গত দেড় দশকে এত কিছু করা হলো; তাহলে মানুষ এসবের সুফল পাচ্ছে না কেন? উল্টো আমরা কী দেখছি, ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়া হয় না। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের টাকা লুটপাট হয়েছে। বৈদেশিক ঋণে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পুঁজি সঞ্চয়ের নতুন উৎস হিসেবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে তা বেশি হয়েছে। মেগা প্রকল্পের সঙ্গে ওই বিশেষ গোষ্ঠীর টাকা পাচারের সংশ্লেষ রয়েছে ।

সরকার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থা এবং জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয়। এসব ঋণ নেয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি। ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার হলেও সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাতে এখনো মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণের কারণে অর্থনীতি দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের দেয়া প্রতিশ্রুতির ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার পাইপলাইনে তথা অলস পড়ে আছে। অর্থাৎ দাতাদের বরাদ্দ করা এই অর্থ এখনো ছাড় হয়নি, যা দেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ সক্ষমতার অভাবে বিদেশি সহায়তার অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে না। আবার দাতাদের দিক থেকেও কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অর্থ ছাড় করা যাচ্ছে না। অনেক দিন ধরে চলমান ডলার-সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাওয়ার এই সময় দাতাদের প্রতিশ্রুতির অর্থ ছাড় করাতে পারলে কিছুটা স্বস্তি মিলত। বিভিন্ন সময় নানা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। কিন্তু সব অর্থ ছাড় করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত দাতারা যে পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার তিন ভাগের এক ভাগও ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।

ডলার-সংকট ও রিজার্ভ পরিস্থিতিÑ এসব বিবেচনায় ডলারের প্রয়োজন মেটাতে দ্রুত বিদেশি সহায়তা ছাড় করা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থা অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে বাংলাদেশকে মোট ১৮ হাজার ৭৬৪ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বর্তমান বাজারমূল্যে দেশি মুদ্রায় ২০ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এর প্রায় ৩২ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ এখনো ব্যবহার করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিদেশি সহায়তা ব্যবহার না করতে না পারার হার ক্রমেই বাড়ছে। ৮ বছর আগে ২০১৬ সালে এই হার ছিল ২৯ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করতে পেরেছে ১২ হাজার ৬৮৭ কোটি ডলার। এছাড়া দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে ১ হাজার ৪২২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি বাতিল করেছে দাতা সংস্থা ও দেশগুলো। বাকি ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার এখন পাইপলাইনে পড়ে আছে, যা বাংলাদেশ চাইলে ব্যবহার করতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন সমস্যা আছে, তেমনি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দাতাদের নানা শর্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মন্ত্রণালয়গুলো বিদেশি সহায়তার প্রকল্পে কম আগ্রহ দেখান। তবে কয়েক বছর ধরে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় কয়েকগুণ বেড়েছে।

প্রতিশ্রুতির ঋণসহায়তা ছাড়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পাইপলাইনে থাকা অর্থের একটি অংশ বাজেট সহায়তা হিসেবে স্থানান্তর করে ছাড় করা যেতে পারে। এছাড়া বিদেশি সহায়তা ব্যবহার করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, এমন মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য প্রতি মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়া বাধ্যতামূলক করা যায়। পুরো বিষয়টিকে তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা উচিত। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে সব ধরনের সমস্যার সমাধান করে বিদেশি সহায়তার অর্থ দ্রুত ছাড় করতে হবে। আইএমএফের ঋণ নেয়া হয়েছে মূলত স্বস্তির জন্য। আমাদের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্যান্য সরবরাহকারী ঋণ এড়িয়ে চলা উচিত। বিদেশি ঋণ কোন প্রকল্পে খরচ হচ্ছে, কীভাবে খরচ হচ্ছে- এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top