alt

উপ-সম্পাদকীয়

পোলট্রি খাতের সংকট

মিহির কুমার রায়

: বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২
image

বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৭টির সঙ্গে পোলট্রি শিল্পের

সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বিধায় আলাদাভাবে এই শিল্পের গুরুত্ব অনায়াসেই চলে আসে। কারণ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির উপখাত হিসেবে পোলট্রি খাতের অবদান ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষের স্ব-নিয়োজিত কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে রয়েছে। যদি পরোক্ষ অংশটি যোগ করা হয় তবে এই অঙ্কটি দাঁড়ায় প্রায় ৮০ লাখ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ বলছে মানুষের প্রাণিজ আমিষ চাহিদার ৪৫ শতাংশ এখন পোলট্রি খাত নির্ভর এবং বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা যেখানে আত্মকর্মসংস্থান তথা উৎপাদন আয় বাড়ানোর অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত সংগঠনের নেতারা মনে করেন দেশে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। আবার শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে ১ শতাংশ হারে কমছে আবাদি জমি যা এক বিস্ময়কর চিত্র। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা তথা পুষ্টি নিরাপত্তায় এক জ্বলন্ত ভূমিকা রাখতে পারে এই খাতটি। খাদ্য কৃষি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য গাইড লাইন অনুযায়ী মানব দেহের শক্তির ৬০ শতাংশ আসবে শস্য জাতীয় পণ্য থেকে, ১৫ শতাংশ আসবে আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে এবং এই আমিষের ২০ শতাংশ হবে প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাছ, মাংস ও ডিম থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ১ জন মানুষ ৭ গ্রাম ডিম এবং ১৪ গ্রাম মুরগির মাংস খেয়ে থাকে যা থেকে আমিষ আসে যথাক্রমে ১ ও ৩ গ্রাম অথচ এই সংখ্যাটি হওয়ার কথা কমপক্ষে ১৫ গ্রাম। প্রবাদ আছে ‘সুস্থ খাবার সুস্থ জাতি’ এবং এর জন্য প্রয়োজন পোলট্রি উৎপাদনে জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থাপনা। একসময় এই শিল্পটি ছিল আমদানিনির্ভর কিন্তু বর্তমান বাজারে ক্রমাগত চাহিদার কারণে এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পোলট্রি খাদ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশই আধুনিক ফিড মিলগুলোতে উৎপন্ন হচ্ছে এবং এই খাদ্যে ব্যবহৃত ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হচ্ছে। এই পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ৪০ ভাগই নারী যা নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। দেশের আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে প্রতি সপ্তাহে ১ দশমিক ১০ কোটি ডিম ফোটানো হয় এবং এই শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হয় বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার। বাংলাদেশে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মুরগির মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয় যা ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটলসহ শপিংমলগুলোতে সরবরাহ করা হয়। এই ব্যাপারে দাতা সংস্থা কিংবা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগামী বিশ সালের মধ্যে ওই খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ১ কোটি জনশক্তির হবে বলে আশা করা যায়। কারণ এই খাতে ব্যবসা আরও পাঁচটি ব্যবসার মতো নয় এবং গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনী কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকে যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস সরবরাহ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। পুষ্টির মান বজায় রেখে অনায়সেই পোলট্রি বাজার রপ্তানিমুখী করা যায় বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে ষাট লাখ বাংলাদেশি রয়েছে যাদের কাছে দেশীয় মাংস ও ডিম খুব প্রিয়। কিন্তু এই ব্যবসায় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে যার রোগবালাই, আপদকালীন সময়ের জন্য প্রণোদনা, কর মওকুফ সুবিধা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি, নীতি সহায়তার অনুপস্থিতিতে, অ্যাডভান্স আয় কর, পোলট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া ওষুধের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ডিডিজিএসের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বলবত, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদের হার ইত্যাদি। তাই পোলট্রি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে সরকারের প্রাণিসম্পদ নীতিমালার বাস্তবায়ন অর্জনের লক্ষ্যে উপরোল্লিখত চ্যালেঞ্জসমূহের প্রাণিসম্পদের প্রচলিত খাত-উপখাতসমূহ যেমন মুরগির খামার স্থাপন, পশুখাদ্য, টিকা, ওষুধপত্র ক্রয় ইত্যাদিতে ঋত প্রদান করতে হবে স্বল্প সুদে। বর্তমানে পোলট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋত নিতে হয় শতকরা ১৬ টাকা হারে অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে প্রতিটি পোলট্রি ফার্মের ৬৫ শতাংশ খরচ হয় ফিডে যার মূল উপাদান ভুট্টা যার উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে অনায়াসেই ডিম বা মাংসের দাম কমে আসবে। কারণ ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হয়। দেশে অন্যান্য কৃষি পণ্যের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা করেছে বিশেষত আলু, দুধ, মাছ ইত্যাদি কিন্তু ডিম কিংবা মাংসের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় না। ‘সরকার পোলট্রিকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ফলে প্রতিটি খামারের নিবন্ধন জরুরি যা প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবে। করোনায় দেশের যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর অন্যতম হলো পোলট্রি খাত। বস্তুত পোলট্রি খাতের কয়েক লাখ প্রান্তিক খামারির অবস্থা এখন চরম সমস্যাক্রান্ত। তারা নিপতিত হয়েছেন উভয় সংকটে। একদিকে পোলট্রি খাদ্যের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে মুরগি ও ডিমের দাম। পোলট্রি দেশের অন্যতম শিল্প খাত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ মানুষ ও তাদের জীবিকা। এটি মানুষের অন্যতম খাদ্য চাহিদা প্রোটিনের উৎসও বটে। তাই এ খাতকে শুধু বাঁচিয়ে রাখা নয়, এর শ্রীবৃদ্ধিও ঘটানো উচিত। করোনার প্রথম ধাক্কার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে শুরু হয়েছে এর দ্বিতীয় ঢেউ। এ অবস্থায় মৎস্য ও প্রাণিখাদ্য প্রস্তুতকারক ফিড ইন্ডাস্ট্রির স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিড রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি ২০২৫ সাল নাগাদ পোলট্রি মাংস, ডিম ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের রপ্তানি মার্কেটে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জনের জন্য বর্তমান বছরের বাজেটে জন্য তিনটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে পোলট্রি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, সরকারের দেয়া বিদ্যমান সুবিধাগুলো অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর, কর ও শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি আরও অন্তত ১০ বছর অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অস্থিরতার কারণে রপ্তানিকারক দেশগুলো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রপ্তানির পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যে ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া কাঁচামাল পরিবহনে কনটেইনার ও জাহাজ ভাড়াও প্রায় ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর করোনা সংকটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা মূল্যের খামারিদের উৎপাদিত মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম ভ্রাম্যমাণ ব্যবস্থায় বিক্রি করা হয়েছিল। এবারো যদি সেই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়, তাহলে এ শিল্পের ক্ষতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। করোনার অভিঘাত শেষ হলে দেশে প্রাণিসম্পদের মেলা শুরু করতে হবে যা হবে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনী কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকে যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে করা যায় না। কারণ যখন উৎপাদন হয় তখনি বিক্রি করতে হয়, ফলে অস্থিতিশীল বাজারে উৎপাদকরা পুঁজি হারাচ্ছেন। তাছাড়া চাহিদার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সরবরাহ না থাকা, রোগবালাই, আপৎকালীন প্রণোদনা না থাকা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক, উৎসে আয়কর, পোলট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া, সুদের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্ক হার, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদের হার ইত্যাদি। পোলট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋত নিতে হয় ডাবল ডিজিটে অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানির আগ্রাসন দেশীয় খামারিদের সর্বনাশ করছে। অন্যদিকে কৃষিতে বিদ্যুৎ বিলে প্রণোদনা ও ছাড় থাকলেও পোলট্রি খামারিদের শিল্প খাতের বিল পরিশোধ করতে হয়। ফ্রোজেন মাংস আমদানি করে দেশীয় খামারিদের ক্ষতি করা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের পোলট্রি শিল্প চলে যাচ্ছে বিদেশি কোম্পানিদের হাতে যা কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন সহায়ক নয় এ ব্যাপারে প্রাণী স্বাস্থ্যসেবাকে জরুরি ঘোষণা করা, প্রতি উপজেলায় হাসপাতাল নির্মাণসহ পোলট্রি ভ্যাকসিন সেবা নিশ্চিতকরণ ও প্রাণিসম্পদ সেবাকে জরুরি সেবার আওতায় এনে এর লোকবল কাঠামো আধুনিকায়ন সময়ের দাবি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

[লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

বিসিএস জ্বরে পুড়ছে তারুণ্য

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পৃথিবী

নমিনির অনুপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির গচ্ছিত টাকা পাবে কে

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা

যদি শুধু বিনোদন সংস্কৃতি হয় তাহলে বাকি সব কী?

নতুন কারিকুলামে ইংরেজি শিক্ষা

বন্ধ হোক প্রশ্ন ফাঁস

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পোলট্রি খাতের সংকট

মিহির কুমার রায়

image

বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২

বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৭টির সঙ্গে পোলট্রি শিল্পের

সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বিধায় আলাদাভাবে এই শিল্পের গুরুত্ব অনায়াসেই চলে আসে। কারণ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির উপখাত হিসেবে পোলট্রি খাতের অবদান ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষের স্ব-নিয়োজিত কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে রয়েছে। যদি পরোক্ষ অংশটি যোগ করা হয় তবে এই অঙ্কটি দাঁড়ায় প্রায় ৮০ লাখ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ বলছে মানুষের প্রাণিজ আমিষ চাহিদার ৪৫ শতাংশ এখন পোলট্রি খাত নির্ভর এবং বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা যেখানে আত্মকর্মসংস্থান তথা উৎপাদন আয় বাড়ানোর অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত সংগঠনের নেতারা মনে করেন দেশে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। আবার শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে ১ শতাংশ হারে কমছে আবাদি জমি যা এক বিস্ময়কর চিত্র। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা তথা পুষ্টি নিরাপত্তায় এক জ্বলন্ত ভূমিকা রাখতে পারে এই খাতটি। খাদ্য কৃষি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য গাইড লাইন অনুযায়ী মানব দেহের শক্তির ৬০ শতাংশ আসবে শস্য জাতীয় পণ্য থেকে, ১৫ শতাংশ আসবে আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে এবং এই আমিষের ২০ শতাংশ হবে প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাছ, মাংস ও ডিম থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ১ জন মানুষ ৭ গ্রাম ডিম এবং ১৪ গ্রাম মুরগির মাংস খেয়ে থাকে যা থেকে আমিষ আসে যথাক্রমে ১ ও ৩ গ্রাম অথচ এই সংখ্যাটি হওয়ার কথা কমপক্ষে ১৫ গ্রাম। প্রবাদ আছে ‘সুস্থ খাবার সুস্থ জাতি’ এবং এর জন্য প্রয়োজন পোলট্রি উৎপাদনে জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থাপনা। একসময় এই শিল্পটি ছিল আমদানিনির্ভর কিন্তু বর্তমান বাজারে ক্রমাগত চাহিদার কারণে এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পোলট্রি খাদ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশই আধুনিক ফিড মিলগুলোতে উৎপন্ন হচ্ছে এবং এই খাদ্যে ব্যবহৃত ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হচ্ছে। এই পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ৪০ ভাগই নারী যা নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। দেশের আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে প্রতি সপ্তাহে ১ দশমিক ১০ কোটি ডিম ফোটানো হয় এবং এই শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হয় বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার। বাংলাদেশে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মুরগির মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয় যা ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটলসহ শপিংমলগুলোতে সরবরাহ করা হয়। এই ব্যাপারে দাতা সংস্থা কিংবা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগামী বিশ সালের মধ্যে ওই খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ১ কোটি জনশক্তির হবে বলে আশা করা যায়। কারণ এই খাতে ব্যবসা আরও পাঁচটি ব্যবসার মতো নয় এবং গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনী কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকে যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস সরবরাহ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। পুষ্টির মান বজায় রেখে অনায়সেই পোলট্রি বাজার রপ্তানিমুখী করা যায় বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে ষাট লাখ বাংলাদেশি রয়েছে যাদের কাছে দেশীয় মাংস ও ডিম খুব প্রিয়। কিন্তু এই ব্যবসায় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে যার রোগবালাই, আপদকালীন সময়ের জন্য প্রণোদনা, কর মওকুফ সুবিধা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি, নীতি সহায়তার অনুপস্থিতিতে, অ্যাডভান্স আয় কর, পোলট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া ওষুধের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ডিডিজিএসের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বলবত, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদের হার ইত্যাদি। তাই পোলট্রি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে সরকারের প্রাণিসম্পদ নীতিমালার বাস্তবায়ন অর্জনের লক্ষ্যে উপরোল্লিখত চ্যালেঞ্জসমূহের প্রাণিসম্পদের প্রচলিত খাত-উপখাতসমূহ যেমন মুরগির খামার স্থাপন, পশুখাদ্য, টিকা, ওষুধপত্র ক্রয় ইত্যাদিতে ঋত প্রদান করতে হবে স্বল্প সুদে। বর্তমানে পোলট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋত নিতে হয় শতকরা ১৬ টাকা হারে অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে প্রতিটি পোলট্রি ফার্মের ৬৫ শতাংশ খরচ হয় ফিডে যার মূল উপাদান ভুট্টা যার উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে অনায়াসেই ডিম বা মাংসের দাম কমে আসবে। কারণ ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হয়। দেশে অন্যান্য কৃষি পণ্যের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা করেছে বিশেষত আলু, দুধ, মাছ ইত্যাদি কিন্তু ডিম কিংবা মাংসের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় না। ‘সরকার পোলট্রিকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ফলে প্রতিটি খামারের নিবন্ধন জরুরি যা প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবে। করোনায় দেশের যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর অন্যতম হলো পোলট্রি খাত। বস্তুত পোলট্রি খাতের কয়েক লাখ প্রান্তিক খামারির অবস্থা এখন চরম সমস্যাক্রান্ত। তারা নিপতিত হয়েছেন উভয় সংকটে। একদিকে পোলট্রি খাদ্যের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে মুরগি ও ডিমের দাম। পোলট্রি দেশের অন্যতম শিল্প খাত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ মানুষ ও তাদের জীবিকা। এটি মানুষের অন্যতম খাদ্য চাহিদা প্রোটিনের উৎসও বটে। তাই এ খাতকে শুধু বাঁচিয়ে রাখা নয়, এর শ্রীবৃদ্ধিও ঘটানো উচিত। করোনার প্রথম ধাক্কার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে শুরু হয়েছে এর দ্বিতীয় ঢেউ। এ অবস্থায় মৎস্য ও প্রাণিখাদ্য প্রস্তুতকারক ফিড ইন্ডাস্ট্রির স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিড রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি ২০২৫ সাল নাগাদ পোলট্রি মাংস, ডিম ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের রপ্তানি মার্কেটে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জনের জন্য বর্তমান বছরের বাজেটে জন্য তিনটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে পোলট্রি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, সরকারের দেয়া বিদ্যমান সুবিধাগুলো অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর, কর ও শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি আরও অন্তত ১০ বছর অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অস্থিরতার কারণে রপ্তানিকারক দেশগুলো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রপ্তানির পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যে ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া কাঁচামাল পরিবহনে কনটেইনার ও জাহাজ ভাড়াও প্রায় ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর করোনা সংকটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা মূল্যের খামারিদের উৎপাদিত মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম ভ্রাম্যমাণ ব্যবস্থায় বিক্রি করা হয়েছিল। এবারো যদি সেই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়, তাহলে এ শিল্পের ক্ষতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। করোনার অভিঘাত শেষ হলে দেশে প্রাণিসম্পদের মেলা শুরু করতে হবে যা হবে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনী কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকে যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে করা যায় না। কারণ যখন উৎপাদন হয় তখনি বিক্রি করতে হয়, ফলে অস্থিতিশীল বাজারে উৎপাদকরা পুঁজি হারাচ্ছেন। তাছাড়া চাহিদার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সরবরাহ না থাকা, রোগবালাই, আপৎকালীন প্রণোদনা না থাকা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক, উৎসে আয়কর, পোলট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া, সুদের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্ক হার, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদের হার ইত্যাদি। পোলট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋত নিতে হয় ডাবল ডিজিটে অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানির আগ্রাসন দেশীয় খামারিদের সর্বনাশ করছে। অন্যদিকে কৃষিতে বিদ্যুৎ বিলে প্রণোদনা ও ছাড় থাকলেও পোলট্রি খামারিদের শিল্প খাতের বিল পরিশোধ করতে হয়। ফ্রোজেন মাংস আমদানি করে দেশীয় খামারিদের ক্ষতি করা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের পোলট্রি শিল্প চলে যাচ্ছে বিদেশি কোম্পানিদের হাতে যা কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন সহায়ক নয় এ ব্যাপারে প্রাণী স্বাস্থ্যসেবাকে জরুরি ঘোষণা করা, প্রতি উপজেলায় হাসপাতাল নির্মাণসহ পোলট্রি ভ্যাকসিন সেবা নিশ্চিতকরণ ও প্রাণিসম্পদ সেবাকে জরুরি সেবার আওতায় এনে এর লোকবল কাঠামো আধুনিকায়ন সময়ের দাবি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

[লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

back to top