alt

সম্পাদকীয়

সড়ক নিরাপত্তা ও ‘ভিশন জিরো’

কাজী তারিক আহম্মদ

: মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০২৪
image

দেশে গত জানুয়ারিতে ৫২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮৬ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। জানুয়ারিতে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতালে) এক হাজার ১৫৩ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৭২ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭৭১ জনসহ সারাদেশে তিন হাজার ৩৭৪ জন যাত্রী ও পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জরুরি বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। সেই হিসাবে হাসপাতালের তথ্যসহ আহত রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৪২৮ জন।

একই সময়ে রেলপথে ৪৪টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১ জন। নৌপথে ৭টি দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত ও ১৩ জন আহত হয়েছে। এছাড়া নিখোঁজ হয়েছে আরও তিনজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এদের মধ্যে ১৭০ জনই মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে। সংঘটিত দুর্ঘটনার ৫১ দশমিক ৬৩ শতাংশই গাড়িচাপা দেয়ার ঘটনা, ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে।

দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ১৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিশ্বে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। আর সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। সেই হিসাবে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। অর্থাৎ দুই হিসাবেই দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ জন বা তারও বেশি মানুষের প্রাণ যায়।

সরকারি বা বেসরকারি কোনো পরিসংখ্যানই কিন্তু বলছে না যে দেশে সড়কে শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। বরং এক্সপ্রেসওয়ে ও মহাসড়কে বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ইদানীং বেড়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, ক্ষমতাসীন দলের একটা অংশ সড়ক পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি করছে। এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠীই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনটির ভাষ্য, দেশে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো বিভিন্ন কমিটি গঠন ও সুপারিশমালা তৈরির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এই যখন বাংলাদেশের অবস্থা, পৃথিবীর অনেক দেশ কিন্তু সড়কে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে নীতি প্রণয়ন করছে। বিশ্বব্যাপী এই লক্ষ্যকে বলা হয় ‘ভিশন জিরো’। বিশ্বের অনেক দেশ এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে। সড়কে নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এ উদ্যোগের লক্ষ্য।

ভিশন জিরো

১৯৯৭ সালে সুইডিশ পার্লামেন্টে সড়ক নিরাপত্তার জন্য একটি নতুন দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য এবং নীতি কৌশল পাস হয়, যেটির নাম দেয়া হয় ভিশন জিরো। লক্ষ্য হলো সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ যেন নিহত বা গুরুতর আহত না হন।

ভিশন জিরো এখন বিশ্বব্যাপী একটি আন্দোলন। সড়ক নিরাপত্তার জন্য একটি পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে ট্রাফিক-সম্পর্কিত প্রাণহানি এবং গুরুতর জখম বন্ধ করার নৈতিক অবস্থান হলো এই ভিশন। এই নীতি কৌশলের ভিত্তি হলো সড়কে মৃত্যু ও জখম অগ্রহণযোগ্য এবং প্রতিরোধযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি শহর ভিশন জিরো লক্ষ্য গ্রহণ করেছে। এতে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ।

‘ভিশন জিরো’ হলো একটি নীতিগত অবস্থান। এটি এমন একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেটিকে বলা যেতে পারে সড়ক নিরাপত্তার প্যারাডাইম শিফট। এ নীতির আওতায় সড়ক নিরাপত্তার দায় ও দায়িত্ব যারা চলাচলের জন্য সড়ক ব্যবহার করে (পথচারী, যাত্রী ও যানবাহন চালক) তাদের কাছ থেকে বরং যারা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার নকশা করেন তাদের কাছে স্থানান্তর করা।

এই নীতির আওতায় মানবিক ত্রুটি ক্ষমা করা হয়। একটি নিরাপদ গতিশীল ব্যবস্থা তৈরি করতে মূল ব্যবস্থাপনা এবং কর্মক্ষেত্রগুলোকে একীভূত করা হয়।

ভিশন জিরোর নীতিগত ধারণাটি গৃহীত হয়েছে বলে তখনই ধরে নেয়া হবে যখন, একটি শহর নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার মূল নীতিগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি নতুন প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করবে। সুতরাং এটি সম্পূর্ণ একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। প্রয়োজন অনুযায়ী নীতি-কৌশল বদলাতে হয়।

এই নীতির সবচেয়ে বড় কথা হলো সড়ক নিরাপত্তার চূড়ান্ত দায়িত্ব সড়ক ব্যবহারকারীর কাছ থেকে, যারা পরিবহন ব্যবস্থা ডিজাইন করেন যেমন- সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্থা, যানবাহন নির্মাতা, আইনপ্রণেতা, বাণিজ্যিক পরিবহন অপারেটর, পুলিশ ইত্যাদির দিকে স্থানান্তরিত হয়। সড়ক ব্যবহারকারীর দায়িত্ব হলো আইন ও প্রবিধানগুলো মেনে চলা।

প্রথাগত সড়ক নিরাপত্তাব্যবস্থা এ যাবৎ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নানা ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে; কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, বেশির ভাগ দুর্ঘটনায় সড়ক ব্যবহারকারীদের দায় থাকে। তাই প্রচলিত কৌশলগুলোর লক্ষ্য থাকে, নিখুঁত নির্ভুল মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করা, যারা সর্বদা সব পরিস্থিতিতে সঠিক কাজটি করে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রায় সব সময়ই সড়ক ব্যবহারকারীর ওপর দোষ চাপানো হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও এমন দায় চাপানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বলা হয়েছে, রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে কিভাবে চলাচল করতে হয় সেই জ্ঞান না থাকার কারণেই তারা যানবাহনের চাকার নিচে প্রাণ ‘বিসর্জন’ দিয়েছেন। দেশের ট্রাফিক পুলিশও সব সময় রাস্তায় চলাচলকারীদের সড়ক ব্যবহার ও ট্রাফিক আইন শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে থাকে।

‘ভিশন জিরো’ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে, পরিবর্তে এটি অনুমান করা হয় যে- পৃথিবীতে কোনো নিখুঁত মানুষ নেই। ভুল করা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু একজন ব্যক্তির জীবন বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি তার ভুলের মাশুল হতে পারে না। এর পরিবর্তে পরিবহন ব্যবস্থার নকশাই এমনভাবে করতে হবে যাতে সড়ক দুর্ঘটনাগুলোতে গুরুতর ক্ষতি না হয়।

ভিশন থেকে বাস্তবায়ন

সুইডেন ‘ভিশন জিরো’ কৌশল বাস্তবায়নে এরই মধ্যে সফলতা পেয়েছে। দুই দশকের কিছু বেশি সময় ধরে সুইডেনের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা রাস্তায় শূন্য প্রাণহানি এবং শূন্য গুরুতর জখমের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। উদাহরণ স্বরূপ, অনেক সড়কে একটি কেন্দ্রীয় বাধা রাখা হয়েছে যাতে দুর্ঘটনা রোধ করা যায়; পুলিশ ক্যামেরায় দেখে গাড়ির গতিনিয়ন্ত্রণ করতে পারে; অনেক চৌরাস্তার মোড়ে গোলচত্বর নির্মাণ করা হয়েছে; স্বচালিত নিরাপদ গাড়িতে বিনিয়োগ করছে; শহুরে এলাকার জন্য যখন ট্র্যাফিক ডিজাইন করা হয়, তখন দুর্বল রাস্তা-ব্যবহারকারীদের (বৃদ্ধ, শিশু, অসুস্থ ইত্যাদি) ওপর আলাদা করে নজর রাখা হয়।

সুইডেনের সফলতা

সুইডিশ পার্লামেন্টে যখন ভিশন জিরো গৃহীত হয়, তখন প্রতি এক লাখে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতেন সাতজন। ওই সময়ে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিসংখ্যান বেশ কমই। এটি আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়ে সুইডেনের অনেকে সন্দিহান ছিলেন; কিন্তু ‘ভিশন জিরো’ বাস্তবায়নের পর সুইডেনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। একই সময়ে সড়কে যানবাহনের সংখ্যাও কিন্তু নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। তবে ভিশন জিরো দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মৃত্যুর হার কমে গেছে, এখন নতুন কৌশলের কথা ভাবছে সুইডেন সরকার।

ভিশন জিরো বেশ কয়েকটি দেশে আগ্রহ জাগিয়েছে

সুইডেনের ভিশন জিরোর সফলতায় উৎসাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। সবার আগে নর্ডিক প্রতিবেশী দেশগুলো এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ সড়ক নরওয়ের। দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে সড়কে মৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা শূন্যে আনতে চায় নর্ডিক দেশটি।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ভিশন জিরো গ্রহণ করেছে। এখন পর্যন্ত বেশ ভালো ফল পেয়েছে তারা। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ২০টি শহর নিউইয়র্ককে অনুসরণ করেছে।

[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী]

মধুপুর বন রক্ষায় ব্যবস্থা নিন

সড়ক দুর্ঘটনার হতাশাজনক চিত্র

সখীপুরে বংশাই নদীতে সেতু চাই

ইটভাটায় ফসলের ক্ষতি : এর দায় কার

টাঙ্গাইলে জলাশয় দখলের অভিযোগের সুরাহা করুন

অবৈধ বালু তোলা বন্ধে ব্যবস্থা নিন

টিসিবির পণ্য : ওজনে কম দেয়ার অভিযোগ আমলে নিন

ভৈরব নদে সেতু নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ আমলে নিন

ডায়রিয়া প্রতিরোধে চাই জনসচেতনতা

ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন সড়কে চলছে কীভাবে

গোবিন্দগঞ্জে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে গাছ কাটার অভিযোগ আমলে নিন

নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি

অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ব্যবহারে চাই সচেতনতা

অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

ভোলাডুবা হাওরের বোরো খেতের পানি নিষ্কাশনে ব্যবস্থা নিন

কিশোর গ্যাংয়ের প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে

আদমজী ইপিজেড সড়ক মেরামতে আর কত কালক্ষেপণ

নদ-নদীর নাব্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিন

চকরিয়ায় পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

গরমে দুর্বিষহ জনজীবন

ভালুকায় খাবার পানির সংকট নিরসনে ব্যবস্থা নিন

সড়কে চাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা

লঞ্চ চালাতে হবে নিয়ম মেনে

নতুন বছররে শুভচ্ছো

বিষ ঢেলে মাছ নিধনের অভিযোগ আমলে নিন

ঈদের আনন্দ স্পর্শ করুক সবার জীবন

মীরসরাইয়ের বন রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া জরুরি

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি

কৃষকরা কেন তামাক চাষে ঝুঁকছে

রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানির দায় কার

আর কত অপেক্ষার পর সেতু পাবে রানিশংকৈলের মানুষ^

পাহাড়ে ব্যাংক হামলা কেন

সিসা দূষণ রোধে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি

হার্টের রিংয়ের নির্ধারিত দর বাস্তবায়নে মনিটরিং জরুরি

রইচপুর খালে সেতু নির্মাণে আর কত অপেক্ষা

রাজধানীকে যানজটমুক্ত করা যাচ্ছে না কেন

tab

সম্পাদকীয়

সড়ক নিরাপত্তা ও ‘ভিশন জিরো’

কাজী তারিক আহম্মদ

image

মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০২৪

দেশে গত জানুয়ারিতে ৫২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮৬ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। জানুয়ারিতে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতালে) এক হাজার ১৫৩ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৭২ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭৭১ জনসহ সারাদেশে তিন হাজার ৩৭৪ জন যাত্রী ও পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জরুরি বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। সেই হিসাবে হাসপাতালের তথ্যসহ আহত রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৪২৮ জন।

একই সময়ে রেলপথে ৪৪টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১ জন। নৌপথে ৭টি দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত ও ১৩ জন আহত হয়েছে। এছাড়া নিখোঁজ হয়েছে আরও তিনজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এদের মধ্যে ১৭০ জনই মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে। সংঘটিত দুর্ঘটনার ৫১ দশমিক ৬৩ শতাংশই গাড়িচাপা দেয়ার ঘটনা, ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে।

দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ১৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিশ্বে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। আর সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। সেই হিসাবে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। অর্থাৎ দুই হিসাবেই দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ জন বা তারও বেশি মানুষের প্রাণ যায়।

সরকারি বা বেসরকারি কোনো পরিসংখ্যানই কিন্তু বলছে না যে দেশে সড়কে শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। বরং এক্সপ্রেসওয়ে ও মহাসড়কে বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ইদানীং বেড়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, ক্ষমতাসীন দলের একটা অংশ সড়ক পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি করছে। এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠীই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনটির ভাষ্য, দেশে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো বিভিন্ন কমিটি গঠন ও সুপারিশমালা তৈরির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এই যখন বাংলাদেশের অবস্থা, পৃথিবীর অনেক দেশ কিন্তু সড়কে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে নীতি প্রণয়ন করছে। বিশ্বব্যাপী এই লক্ষ্যকে বলা হয় ‘ভিশন জিরো’। বিশ্বের অনেক দেশ এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে। সড়কে নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এ উদ্যোগের লক্ষ্য।

ভিশন জিরো

১৯৯৭ সালে সুইডিশ পার্লামেন্টে সড়ক নিরাপত্তার জন্য একটি নতুন দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য এবং নীতি কৌশল পাস হয়, যেটির নাম দেয়া হয় ভিশন জিরো। লক্ষ্য হলো সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ যেন নিহত বা গুরুতর আহত না হন।

ভিশন জিরো এখন বিশ্বব্যাপী একটি আন্দোলন। সড়ক নিরাপত্তার জন্য একটি পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে ট্রাফিক-সম্পর্কিত প্রাণহানি এবং গুরুতর জখম বন্ধ করার নৈতিক অবস্থান হলো এই ভিশন। এই নীতি কৌশলের ভিত্তি হলো সড়কে মৃত্যু ও জখম অগ্রহণযোগ্য এবং প্রতিরোধযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি শহর ভিশন জিরো লক্ষ্য গ্রহণ করেছে। এতে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ।

‘ভিশন জিরো’ হলো একটি নীতিগত অবস্থান। এটি এমন একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেটিকে বলা যেতে পারে সড়ক নিরাপত্তার প্যারাডাইম শিফট। এ নীতির আওতায় সড়ক নিরাপত্তার দায় ও দায়িত্ব যারা চলাচলের জন্য সড়ক ব্যবহার করে (পথচারী, যাত্রী ও যানবাহন চালক) তাদের কাছ থেকে বরং যারা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার নকশা করেন তাদের কাছে স্থানান্তর করা।

এই নীতির আওতায় মানবিক ত্রুটি ক্ষমা করা হয়। একটি নিরাপদ গতিশীল ব্যবস্থা তৈরি করতে মূল ব্যবস্থাপনা এবং কর্মক্ষেত্রগুলোকে একীভূত করা হয়।

ভিশন জিরোর নীতিগত ধারণাটি গৃহীত হয়েছে বলে তখনই ধরে নেয়া হবে যখন, একটি শহর নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার মূল নীতিগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি নতুন প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করবে। সুতরাং এটি সম্পূর্ণ একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। প্রয়োজন অনুযায়ী নীতি-কৌশল বদলাতে হয়।

এই নীতির সবচেয়ে বড় কথা হলো সড়ক নিরাপত্তার চূড়ান্ত দায়িত্ব সড়ক ব্যবহারকারীর কাছ থেকে, যারা পরিবহন ব্যবস্থা ডিজাইন করেন যেমন- সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্থা, যানবাহন নির্মাতা, আইনপ্রণেতা, বাণিজ্যিক পরিবহন অপারেটর, পুলিশ ইত্যাদির দিকে স্থানান্তরিত হয়। সড়ক ব্যবহারকারীর দায়িত্ব হলো আইন ও প্রবিধানগুলো মেনে চলা।

প্রথাগত সড়ক নিরাপত্তাব্যবস্থা এ যাবৎ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নানা ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে; কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, বেশির ভাগ দুর্ঘটনায় সড়ক ব্যবহারকারীদের দায় থাকে। তাই প্রচলিত কৌশলগুলোর লক্ষ্য থাকে, নিখুঁত নির্ভুল মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করা, যারা সর্বদা সব পরিস্থিতিতে সঠিক কাজটি করে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রায় সব সময়ই সড়ক ব্যবহারকারীর ওপর দোষ চাপানো হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও এমন দায় চাপানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বলা হয়েছে, রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে কিভাবে চলাচল করতে হয় সেই জ্ঞান না থাকার কারণেই তারা যানবাহনের চাকার নিচে প্রাণ ‘বিসর্জন’ দিয়েছেন। দেশের ট্রাফিক পুলিশও সব সময় রাস্তায় চলাচলকারীদের সড়ক ব্যবহার ও ট্রাফিক আইন শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে থাকে।

‘ভিশন জিরো’ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে, পরিবর্তে এটি অনুমান করা হয় যে- পৃথিবীতে কোনো নিখুঁত মানুষ নেই। ভুল করা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু একজন ব্যক্তির জীবন বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি তার ভুলের মাশুল হতে পারে না। এর পরিবর্তে পরিবহন ব্যবস্থার নকশাই এমনভাবে করতে হবে যাতে সড়ক দুর্ঘটনাগুলোতে গুরুতর ক্ষতি না হয়।

ভিশন থেকে বাস্তবায়ন

সুইডেন ‘ভিশন জিরো’ কৌশল বাস্তবায়নে এরই মধ্যে সফলতা পেয়েছে। দুই দশকের কিছু বেশি সময় ধরে সুইডেনের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা রাস্তায় শূন্য প্রাণহানি এবং শূন্য গুরুতর জখমের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। উদাহরণ স্বরূপ, অনেক সড়কে একটি কেন্দ্রীয় বাধা রাখা হয়েছে যাতে দুর্ঘটনা রোধ করা যায়; পুলিশ ক্যামেরায় দেখে গাড়ির গতিনিয়ন্ত্রণ করতে পারে; অনেক চৌরাস্তার মোড়ে গোলচত্বর নির্মাণ করা হয়েছে; স্বচালিত নিরাপদ গাড়িতে বিনিয়োগ করছে; শহুরে এলাকার জন্য যখন ট্র্যাফিক ডিজাইন করা হয়, তখন দুর্বল রাস্তা-ব্যবহারকারীদের (বৃদ্ধ, শিশু, অসুস্থ ইত্যাদি) ওপর আলাদা করে নজর রাখা হয়।

সুইডেনের সফলতা

সুইডিশ পার্লামেন্টে যখন ভিশন জিরো গৃহীত হয়, তখন প্রতি এক লাখে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতেন সাতজন। ওই সময়ে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিসংখ্যান বেশ কমই। এটি আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়ে সুইডেনের অনেকে সন্দিহান ছিলেন; কিন্তু ‘ভিশন জিরো’ বাস্তবায়নের পর সুইডেনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। একই সময়ে সড়কে যানবাহনের সংখ্যাও কিন্তু নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। তবে ভিশন জিরো দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মৃত্যুর হার কমে গেছে, এখন নতুন কৌশলের কথা ভাবছে সুইডেন সরকার।

ভিশন জিরো বেশ কয়েকটি দেশে আগ্রহ জাগিয়েছে

সুইডেনের ভিশন জিরোর সফলতায় উৎসাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। সবার আগে নর্ডিক প্রতিবেশী দেশগুলো এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ সড়ক নরওয়ের। দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে সড়কে মৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা শূন্যে আনতে চায় নর্ডিক দেশটি।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ভিশন জিরো গ্রহণ করেছে। এখন পর্যন্ত বেশ ভালো ফল পেয়েছে তারা। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ২০টি শহর নিউইয়র্ককে অনুসরণ করেছে।

[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী]

back to top