জিয়াউদ্দীন আহমেদ
ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু নিয়ে বিগত কয়েক মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাড্ডায় ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে খৎনা করানোর কারণে নার্সারি শ্রেণীর শিক্ষার্থী আয়ানকে লাইফ সাপোর্ট দিয়েও বাঁচানো যায়নি। এই ঘটনার দেড় মাসের মাথায় মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জে এস হাসপাতালে একই ধরনের সার্জারির সময় অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার কারণে প্রাণহানি ঘটে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আহনাফ তাহমিদের। আমার চাচাতো ভাই ‘গানের আড্ডা’র কর্ণধার জামালউদ্দিন পিটুর ওপেন হার্ট সার্জারির সময়ও অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার কারণে তার আর জ্ঞান ফিরে আসেনি; তবুও আমরা বারডেমের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস করিনি।
যুগ যুগ ধরে হাজম দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে খৎনা করা হয়েছে, মৃত্যুর খবর শুনিনি; এখন ডাক্তার দিয়ে খৎনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হলো। গত ১৫ ফেব্রæয়ারি রাজধানীর ল্যাব-এইড হাসপাতালে এন্ডোস্কোপি করার সময় একজন অধ্যাপক চিকিৎসকের হাতে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক‚টনৈতিক ও কলাম লেখক প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমদের মৃত্যুর জন্যও তার স্বজনরা একজন চিকিৎসককে দায়ী করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে লিভারের অপারেশন করান ওই চিকিৎসক এবং এই অপারেশন করার দুই দিনের মধ্যে রক্তবমি করে আমার ভাই মারা যান। সেই অধ্যাপক বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসক। কিন্তু অভিযোগ আছে যে, তিনি বেশি সময় কাটান প্রাইভেট ক্লিনিকে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সেই চিকিৎসককে দৌড়ের ওপর রোগী দেখতে দেখেছি। সরকারি হাসপাতালের সব ডাক্তারই ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে আসেন এবং দৌড়াতে দৌড়াতে রোগী দেখা শেষ করে গাড়ির ভেতর ঢুকে দ্রæত অদৃশ্য হয়ে যান।
নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করেছেন। অননুমোদিত ক্লিনিক, হাসপাতাল সিলগালা করা হচ্ছে; কিন্তু এতদিন চলল কী করে? যারা ঘুষ খেয়ে এসব ক্লিনিক চলতে দিয়েছেন বা যেসব নামকরা সরকারি ডাক্তার এক ঘণ্টার বেশি নিজ কর্মস্থলে থাকেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
সমাজের সর্বত্র অপরাধের ছড়াছড়ি। চট্টগ্রাম নগরীর আবাসিক এলাকায় শিক্ষাশালা নামে কোচিং সেন্টারে ধর্ষণের শিকার এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। পানি পান করার অজুহাত দিয়ে ঘরে ঢুকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে এক ট্রাকচালক। পঞ্চগড়ে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসার তিন ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই মাদ্রাসার শিক্ষক মিজানুর রহমানকে। মাদ্রাসায় রোজার মধ্যেও বলাৎকার হচ্ছে। পাবনায় অস্ত্রের মুখে স্বামীকে জিম্মি করে অন্তঃসত্ত¡া স্ত্রীকে কিশোর গ্যাং ধর্ষণ করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে কয়েকজন ছাত্রনেতা। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐের বিধান করে আইন সংশোধন করা হলেও ধর্ষণ থামছে না।
তাই মনে হয়, মৃত্যুদÐ ধর্ষকদের মনে ভীতি সঞ্চার করতে পারেনি। ল²ীপুরে একটি মাদ্রাসায় দাখিল পরীক্ষার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভিডিওতে শিক্ষকদের অদ্ভুত কিছু আচরণ দেখা গেছেÑ একজন শিক্ষক দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন, অন্য শিক্ষকরা নিজ পকেট থেকে বের করে পরীক্ষার্থীদের হাতে হাতে নকল তুলে দিচ্ছেন, মোবাইল ফোন দেখে দেখে শিক্ষার্থীদের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছেন, বøাক বোর্ডে উত্তর লিখে দিচ্ছেন। রংপুরের পীরগাছায় দাখিল পরীক্ষা চলাকালে মেয়েকে নকল সরবরাহ করায় এক মাদ্রাসা শিক্ষককে চার মাসের কারাদÐ দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। চাঁদপুর শাহরাস্তিতে স্মার্টফোনের মাধ্যমে পরীক্ষা কেন্দ্রে নকল সরবরাহের দায়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দুই বছরের কারাদÐ হয়েছে।
ওই ঘটনা ছাড়াও চলতি বছরে মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক নকল সরবরাহের আরও বহু ঘটনা রয়েছে। পাসের হার বৃদ্ধি করে মাদ্রাসার অস্তিত্ব ও নিজের চাকরি রক্ষার স্বার্থে নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিতে মাদ্রাসার শিক্ষকরা কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। হিজাব না পরায় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের সৈয়দপুর আব্দুর রহমান স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষিকা সপ্তম শ্রেণীর ৯ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন। ২৮ ফেব্রæয়ারি, ২০১৪ সালের এই ঘটনাটি ঘটেছে ক্লাস চলাকালীন। অভিযুক্ত শিক্ষিকা আবার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা। হিজাব ছাড়া ছাত্রী আজকাল সচরাচর দেখাই যায় না। শিশু বয়সেও মেয়েদের হিজাব পরে রাস্তায় বের হতে দেখা যায়। সমাজের এই পরিবর্তন পরিবার থেকে উদ্ভুত; আস্তে আস্তে সবাই পরবে, শিক্ষকের শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল না। হজের জন্য পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়, কিন্তু হিজাব, বোরকা বা নিকাব পরিহিত কোন নারীর ছবি পাসপোর্টের জন্য গ্রহণযোগ্য হয় না, মুখমÐল প্রদর্শন না করে কোন নারী বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার হতে পারে না। নিকাব পরা নারীদেরও হজের সময় মুখমÐল উন্মুক্ত রাখতে হয়। এখানে নানা ব্যাখ্যা দিয়ে জায়েজ করা হয়।
তাই জোর করে হিজাব পরানোর নীতি থেকে আমাদের সরে আসা উচিত। ধর্মে শক্তি প্রয়োগের কথা আছে কিনা আমার জানা নেই; মনে হয় আছে, নতুবা শিথিল হিজাবের ফাঁক দিয়ে একটু চুল বেরিয়ে আসায় ইরানের নৈতিকতা পুলিশ ২২ বছর বয়সী মাসা আমিনিকে পিটিয়ে মেরে ফেলত না। হিজাব পরার বাধ্যতামূলক আইন বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন ইরান গুলি করে নিয়ন্ত্রণ করেছে। হিজাববিরোধী আন্দোলনে ৫০০ নাগরিক মারা গেছে এবং ২২৯ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। ভিন্নমত দমনে ইরান উত্তর কোরিয়ার চেয়েও নিষ্ঠুর। কিন্তু যে হিজাব নিয়ে মেয়েদের চুল কেটে দেয়া হলো সেই হিজাবের কথা আমাদের পবিত্র কোরআনের কোথাও নেই। কোরআনে মু’মিন নারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের জিলবার বা চাদরের একাংশ নিজেদের ওপর টেনে দিতে। কোরআনে আরও একটি নির্দেশনা রয়েছে এবং তা হলো নারীরা তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করবে। কিন্তু আলেমদের অভিমত ব্যাখ্যায় চালু হয়েছে বোরকা আর হিজাব।
কিন্তু নিরাপত্তার কারণে বহু দেশে বোরকা, নিকাব পরা নিষিদ্ধ, বিশেষ করে নাইজেরিয়ায় ইসলামিক সশস্ত্র জিহাদি গোষ্ঠী বোকো হারাম বোরকার ভেতর শরীরে বোমা বেঁধে মেয়েদের আত্মঘাতি আক্রমণে নিয়োজিত করছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি নওগাঁয় সরফতুল্লাহ ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় আরবি সাবজেক্টে ৫৯ জন ভুয়া পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। আটক করা সবাই হিজাব ও বোরকা পরা ছিল। কেন্দ্রটিতে ৪০টি মাদ্রাসার ৮৯৮ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় বোরকা পরা বহু প্রক্সি পরীক্ষার্থী ধরা পড়ছে। বোরকা পরে বোনের প্রক্সি দিতে এসে ভাই আটক হয়েছে, সংরক্ষিত আসনের এক সংসদ সদস্যের পক্ষে স্নাতক পরীক্ষা দিতে এসে ধরে পড়ে বোরকা পরিহিত আরেক নারী। মাদক পরিবহনে নারীদের বোরকা পরতে দেখা যায়।
উপরিল্লিখিত সবগুলো ঘটনা ২০২৪ সালের। এমন শত শত ঘটনা অহরহ ঘটে যাচ্ছে। এমন ঘটনা আগে ঘটলেও জনগণ জানতে পারত না, এখন সিসি ক্যামেরা বা স্মার্টফোনের বদৌলতে কিছু গোপন থাকছে না। আগে হতো বলে এখনো হবেÑ তা মেনে নেয়া যায় না। উন্নয়ন শুধু অবকাঠামোর ক্ষেত্রে হলে তা টেকসই হবে না, উন্নয়ন হতে হবে জাতির মানসিক জগতে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংক, বীমা, কাস্টম সর্বত্র ঘুষ আর দুনীতি চলমান রেখে শুধু রাস্তা-ঘাট পরিবহনের উন্নয়ন ঘটালে তা হবে খÐিত উন্নয়ন। খÐিত উন্নয়ন দিয়ে জনগণের মন সাময়িকভাবে জয় করা সম্ভব হলেও ব্যাপকতর অপরাধ সংস্কৃতির আঘাতে তা অল্প সময়ের মধ্যে ¤øান হয়ে যাবে। এই অপরাধ সংস্কৃতি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে নীতি-নির্ধারক নেতা ও কর্মকর্তাদের ক্লিন ইমেজ তৈরি করা। নেতা এবং নীতি-নির্ধারকদের প্রতি জনগণের ভক্তি শ্রদ্ধা না জাগা পর্যন্ত সমগ্র জাতির অপরাধের ভার বহন করতে তাদের।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১৬ মার্চ ২০২৪
ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু নিয়ে বিগত কয়েক মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাড্ডায় ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে খৎনা করানোর কারণে নার্সারি শ্রেণীর শিক্ষার্থী আয়ানকে লাইফ সাপোর্ট দিয়েও বাঁচানো যায়নি। এই ঘটনার দেড় মাসের মাথায় মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জে এস হাসপাতালে একই ধরনের সার্জারির সময় অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার কারণে প্রাণহানি ঘটে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আহনাফ তাহমিদের। আমার চাচাতো ভাই ‘গানের আড্ডা’র কর্ণধার জামালউদ্দিন পিটুর ওপেন হার্ট সার্জারির সময়ও অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার কারণে তার আর জ্ঞান ফিরে আসেনি; তবুও আমরা বারডেমের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস করিনি।
যুগ যুগ ধরে হাজম দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে খৎনা করা হয়েছে, মৃত্যুর খবর শুনিনি; এখন ডাক্তার দিয়ে খৎনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হলো। গত ১৫ ফেব্রæয়ারি রাজধানীর ল্যাব-এইড হাসপাতালে এন্ডোস্কোপি করার সময় একজন অধ্যাপক চিকিৎসকের হাতে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক‚টনৈতিক ও কলাম লেখক প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমদের মৃত্যুর জন্যও তার স্বজনরা একজন চিকিৎসককে দায়ী করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে লিভারের অপারেশন করান ওই চিকিৎসক এবং এই অপারেশন করার দুই দিনের মধ্যে রক্তবমি করে আমার ভাই মারা যান। সেই অধ্যাপক বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসক। কিন্তু অভিযোগ আছে যে, তিনি বেশি সময় কাটান প্রাইভেট ক্লিনিকে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সেই চিকিৎসককে দৌড়ের ওপর রোগী দেখতে দেখেছি। সরকারি হাসপাতালের সব ডাক্তারই ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে আসেন এবং দৌড়াতে দৌড়াতে রোগী দেখা শেষ করে গাড়ির ভেতর ঢুকে দ্রæত অদৃশ্য হয়ে যান।
নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করেছেন। অননুমোদিত ক্লিনিক, হাসপাতাল সিলগালা করা হচ্ছে; কিন্তু এতদিন চলল কী করে? যারা ঘুষ খেয়ে এসব ক্লিনিক চলতে দিয়েছেন বা যেসব নামকরা সরকারি ডাক্তার এক ঘণ্টার বেশি নিজ কর্মস্থলে থাকেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
সমাজের সর্বত্র অপরাধের ছড়াছড়ি। চট্টগ্রাম নগরীর আবাসিক এলাকায় শিক্ষাশালা নামে কোচিং সেন্টারে ধর্ষণের শিকার এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। পানি পান করার অজুহাত দিয়ে ঘরে ঢুকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে এক ট্রাকচালক। পঞ্চগড়ে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসার তিন ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই মাদ্রাসার শিক্ষক মিজানুর রহমানকে। মাদ্রাসায় রোজার মধ্যেও বলাৎকার হচ্ছে। পাবনায় অস্ত্রের মুখে স্বামীকে জিম্মি করে অন্তঃসত্ত¡া স্ত্রীকে কিশোর গ্যাং ধর্ষণ করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে কয়েকজন ছাত্রনেতা। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐের বিধান করে আইন সংশোধন করা হলেও ধর্ষণ থামছে না।
তাই মনে হয়, মৃত্যুদÐ ধর্ষকদের মনে ভীতি সঞ্চার করতে পারেনি। ল²ীপুরে একটি মাদ্রাসায় দাখিল পরীক্ষার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভিডিওতে শিক্ষকদের অদ্ভুত কিছু আচরণ দেখা গেছেÑ একজন শিক্ষক দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন, অন্য শিক্ষকরা নিজ পকেট থেকে বের করে পরীক্ষার্থীদের হাতে হাতে নকল তুলে দিচ্ছেন, মোবাইল ফোন দেখে দেখে শিক্ষার্থীদের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছেন, বøাক বোর্ডে উত্তর লিখে দিচ্ছেন। রংপুরের পীরগাছায় দাখিল পরীক্ষা চলাকালে মেয়েকে নকল সরবরাহ করায় এক মাদ্রাসা শিক্ষককে চার মাসের কারাদÐ দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। চাঁদপুর শাহরাস্তিতে স্মার্টফোনের মাধ্যমে পরীক্ষা কেন্দ্রে নকল সরবরাহের দায়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দুই বছরের কারাদÐ হয়েছে।
ওই ঘটনা ছাড়াও চলতি বছরে মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক নকল সরবরাহের আরও বহু ঘটনা রয়েছে। পাসের হার বৃদ্ধি করে মাদ্রাসার অস্তিত্ব ও নিজের চাকরি রক্ষার স্বার্থে নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিতে মাদ্রাসার শিক্ষকরা কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। হিজাব না পরায় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের সৈয়দপুর আব্দুর রহমান স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষিকা সপ্তম শ্রেণীর ৯ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন। ২৮ ফেব্রæয়ারি, ২০১৪ সালের এই ঘটনাটি ঘটেছে ক্লাস চলাকালীন। অভিযুক্ত শিক্ষিকা আবার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা। হিজাব ছাড়া ছাত্রী আজকাল সচরাচর দেখাই যায় না। শিশু বয়সেও মেয়েদের হিজাব পরে রাস্তায় বের হতে দেখা যায়। সমাজের এই পরিবর্তন পরিবার থেকে উদ্ভুত; আস্তে আস্তে সবাই পরবে, শিক্ষকের শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল না। হজের জন্য পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়, কিন্তু হিজাব, বোরকা বা নিকাব পরিহিত কোন নারীর ছবি পাসপোর্টের জন্য গ্রহণযোগ্য হয় না, মুখমÐল প্রদর্শন না করে কোন নারী বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার হতে পারে না। নিকাব পরা নারীদেরও হজের সময় মুখমÐল উন্মুক্ত রাখতে হয়। এখানে নানা ব্যাখ্যা দিয়ে জায়েজ করা হয়।
তাই জোর করে হিজাব পরানোর নীতি থেকে আমাদের সরে আসা উচিত। ধর্মে শক্তি প্রয়োগের কথা আছে কিনা আমার জানা নেই; মনে হয় আছে, নতুবা শিথিল হিজাবের ফাঁক দিয়ে একটু চুল বেরিয়ে আসায় ইরানের নৈতিকতা পুলিশ ২২ বছর বয়সী মাসা আমিনিকে পিটিয়ে মেরে ফেলত না। হিজাব পরার বাধ্যতামূলক আইন বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন ইরান গুলি করে নিয়ন্ত্রণ করেছে। হিজাববিরোধী আন্দোলনে ৫০০ নাগরিক মারা গেছে এবং ২২৯ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। ভিন্নমত দমনে ইরান উত্তর কোরিয়ার চেয়েও নিষ্ঠুর। কিন্তু যে হিজাব নিয়ে মেয়েদের চুল কেটে দেয়া হলো সেই হিজাবের কথা আমাদের পবিত্র কোরআনের কোথাও নেই। কোরআনে মু’মিন নারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের জিলবার বা চাদরের একাংশ নিজেদের ওপর টেনে দিতে। কোরআনে আরও একটি নির্দেশনা রয়েছে এবং তা হলো নারীরা তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করবে। কিন্তু আলেমদের অভিমত ব্যাখ্যায় চালু হয়েছে বোরকা আর হিজাব।
কিন্তু নিরাপত্তার কারণে বহু দেশে বোরকা, নিকাব পরা নিষিদ্ধ, বিশেষ করে নাইজেরিয়ায় ইসলামিক সশস্ত্র জিহাদি গোষ্ঠী বোকো হারাম বোরকার ভেতর শরীরে বোমা বেঁধে মেয়েদের আত্মঘাতি আক্রমণে নিয়োজিত করছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি নওগাঁয় সরফতুল্লাহ ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় আরবি সাবজেক্টে ৫৯ জন ভুয়া পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। আটক করা সবাই হিজাব ও বোরকা পরা ছিল। কেন্দ্রটিতে ৪০টি মাদ্রাসার ৮৯৮ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় বোরকা পরা বহু প্রক্সি পরীক্ষার্থী ধরা পড়ছে। বোরকা পরে বোনের প্রক্সি দিতে এসে ভাই আটক হয়েছে, সংরক্ষিত আসনের এক সংসদ সদস্যের পক্ষে স্নাতক পরীক্ষা দিতে এসে ধরে পড়ে বোরকা পরিহিত আরেক নারী। মাদক পরিবহনে নারীদের বোরকা পরতে দেখা যায়।
উপরিল্লিখিত সবগুলো ঘটনা ২০২৪ সালের। এমন শত শত ঘটনা অহরহ ঘটে যাচ্ছে। এমন ঘটনা আগে ঘটলেও জনগণ জানতে পারত না, এখন সিসি ক্যামেরা বা স্মার্টফোনের বদৌলতে কিছু গোপন থাকছে না। আগে হতো বলে এখনো হবেÑ তা মেনে নেয়া যায় না। উন্নয়ন শুধু অবকাঠামোর ক্ষেত্রে হলে তা টেকসই হবে না, উন্নয়ন হতে হবে জাতির মানসিক জগতে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংক, বীমা, কাস্টম সর্বত্র ঘুষ আর দুনীতি চলমান রেখে শুধু রাস্তা-ঘাট পরিবহনের উন্নয়ন ঘটালে তা হবে খÐিত উন্নয়ন। খÐিত উন্নয়ন দিয়ে জনগণের মন সাময়িকভাবে জয় করা সম্ভব হলেও ব্যাপকতর অপরাধ সংস্কৃতির আঘাতে তা অল্প সময়ের মধ্যে ¤øান হয়ে যাবে। এই অপরাধ সংস্কৃতি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে নীতি-নির্ধারক নেতা ও কর্মকর্তাদের ক্লিন ইমেজ তৈরি করা। নেতা এবং নীতি-নির্ধারকদের প্রতি জনগণের ভক্তি শ্রদ্ধা না জাগা পর্যন্ত সমগ্র জাতির অপরাধের ভার বহন করতে তাদের।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন]