মিথুশিলাক মুরমু
গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচজন নারীকে ‘সেরা জয়িতা পুরস্কার-২০২৩’ প্রদান করেছেন। পাঁচটি ক্যাটাগরি থেকে পাঁচজনকে বেছে নেয়া হয় পুরস্কারের জন্য। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেনÑ আনার কলি (অর্থনৈতিক সাফল্য), কল্যাণী মিনজী (শিক্ষা ও কর্মসংস্থান), কমলি রবিদাস (সফল মা), জাহানারা বেগম (নিপীড়ন প্রতিরোধ) এবং পাখি দত্ত হিজড়া (সামাজিক উন্নয়ন)। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন আদিবাসী (কল্যাণী মিনজী), একজন অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী (কমলি রবিদাস), অপরজন সামাজিকভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত (পাখি দত্ত হিজড়া) এবং দুইজন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে চেক, ক্রেস্ট, উত্তরীয় এবং সনদপত্র পেয়ে উজ্জীবিত হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, জয়িতা (বিজয়ী), একজন নারী যিনি সব বাধা জয় করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছান, মানে এটি একজন সংগ্রামী ও অদ্যম নারীর উদাহরণ।
আদিবাসী অনেক নারী স্থানীয় পর্যায়ে প্রায়ই ‘জয়িতা’ পুরস্কারে ভূষিত হন। পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী হিসেবে জীবন সংগ্রাম, বৈষম্য ও প্রতিকূল পরিবেশকে উপেক্ষা করে বিজয়ী হওয়ার অদম্য কাজ অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। গ্রামীণ নারীদের যে মনোচেতনা, সেটি এলাকা তথা দেশবাসীর জন্য অর্থাৎ সমগ্র নারী সমাজের জন্য অনুকরণীয় হয়ে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যকার সুকুমার বৃত্তিগুলোকে উজ্জীবিত ও পুরস্কৃত করে আরও চ্যালেঞ্জ গ্রহণে উৎসাহিত করে।
স্থানীয় প্রশাসন সত্যিকার জয়িতাদের খুঁজে বের করার যে নিষ্ঠা ও দায়িত্ব পালন করছে এবং আদিবাসী নারীদেরও যে দৃষ্টিসীমার মধ্যে রেখেছে; এটি আমাদের পুলকিত করে তোলে। আদিবাসী নারীরা ঘর সামলে মাঠের কাজেও সমানভাবে পারদর্শী। পুরুষদের ছাপিয়ে নারীরা পরিশ্রমের দিক দিয়ে যেমন গোছানো, কর্মঠ ও স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের জগতকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। সবকিছুকে জয় করেই আদিবাসী নারী কল্যাণী মিনজী প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জয়িতার পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। জয়িতা বিজয়ী অগ্রজ কল্যাণী মিনজীকে জানাই শুভেচ্ছা।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি দেশের ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের বাসা থেকে নিচে পড়ে মারা যায় প্রীতি ওরাং (১৫)। বলা হচ্ছে, ঢাকা মহানগরীর মোহাম্মদপুরের বাসার ৮তলা ফ্ল্যাট থেকে প্রীতি ওরাং রাস্তায় লাফ দিয়ে পড়লে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রীতি ওরাং দেশের সবচেয়ে বিলুপ্ত প্রায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একটির সদস্য। ওরাং সম্প্রদায় মূলত বৃহত্তর সিলেটাঞ্চলেই বসবাস করে থাকে। সহজ-সরল চরিত্রের অধিকারী ওরাংরা হারিয়েছে বসতভিটা, হারিয়েছে স্বাতন্ত্র্য; বেঁচে রয়েছে শুধু নামের শেষের পদবীটিই। চা বাগানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভিড়ে ভাষা ও সংস্কৃতিও আচ্ছন্ন হয়েছে।
প্রীতি ওরাং-এর জন্মভূমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ রহিমপুর ইউনিয়নের মিতিঙ্গা চা বাগানে। মা নমিতা ওরাং ও বাবা লোকেশ ওরাং দাবি করেছেনÑ তাদের মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থিত হয়েছেÑ
প্রীতি ওরাংরা জীবনযুদ্ধের জয়-পরাজয় দেখেছে চা বাগানে। সেক্ষেত্রে আত্মহত্যার লক্ষ্যে অষ্টম তলা থেকে লাফিয়ে পড়া কি বিশ^াসযোগ্য?
ওই বাসার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার চিপস কেন উধাও করা হলো?
দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধরত ওরাংসহ আদিবাসীরা অল্পতেই সন্তুষ্ট। দুমুঠো ভাত ও মোটা কাপড় এবং সামান্য অর্থের বিনিময়ে দিনরাত খেটেছেন প্রীতি ওরাং। তার চোখেমুখে ছিলো স্বপ্নÑ মা-বাবাকে আর্থিক স্বচ্ছ্বতা আনয়নে সহায়তা করা; বোন ও নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতা করা, সবকিছু নিমিষেই মিলিয়ে গেছে। বাবা-মা, বোন আত্মীয়রা এখন অকুল পাথরে, প্রীতির মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু?
চোখে সর্ষে ফুল দেখা মা নমিতা ওরাং বলেছেন, ‘আমার সন্তানের মৃত্যুর পর আমি বিছানায় ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই আমার সন্তানের লাশ দেখি। ...আপনারা আমার কষ্টের কথা অনুধাবন করেন। যাতে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয় এজন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।’
শীর্ণ শরীর নিয়ে প্রীতির বাবা লোকেশ ওরাং বাদী হয়ে অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় দ-বিধির ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী মামলা রজ্জু করেছেন। তবে আশঙ্কা করছেন, মামলা প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
ইতোমধ্যেই সামাজিক সংগঠনগুলো প্রীতি ওরাং হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে রাজপথে নেমে পড়েছেন। প্রীতির বসতবাটি চা বাগানের অভ্যন্তর থেকে কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনেও হত্যার প্রতিবাদ ও শাস্তির দাবিতে সামিল হয়েছে আপামর জনতা। সংখ্যালঘু আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে আদালতের দিকে।
[লেখক: কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
রোববার, ১৭ মার্চ ২০২৪
গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচজন নারীকে ‘সেরা জয়িতা পুরস্কার-২০২৩’ প্রদান করেছেন। পাঁচটি ক্যাটাগরি থেকে পাঁচজনকে বেছে নেয়া হয় পুরস্কারের জন্য। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেনÑ আনার কলি (অর্থনৈতিক সাফল্য), কল্যাণী মিনজী (শিক্ষা ও কর্মসংস্থান), কমলি রবিদাস (সফল মা), জাহানারা বেগম (নিপীড়ন প্রতিরোধ) এবং পাখি দত্ত হিজড়া (সামাজিক উন্নয়ন)। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন আদিবাসী (কল্যাণী মিনজী), একজন অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী (কমলি রবিদাস), অপরজন সামাজিকভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত (পাখি দত্ত হিজড়া) এবং দুইজন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে চেক, ক্রেস্ট, উত্তরীয় এবং সনদপত্র পেয়ে উজ্জীবিত হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, জয়িতা (বিজয়ী), একজন নারী যিনি সব বাধা জয় করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছান, মানে এটি একজন সংগ্রামী ও অদ্যম নারীর উদাহরণ।
আদিবাসী অনেক নারী স্থানীয় পর্যায়ে প্রায়ই ‘জয়িতা’ পুরস্কারে ভূষিত হন। পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী হিসেবে জীবন সংগ্রাম, বৈষম্য ও প্রতিকূল পরিবেশকে উপেক্ষা করে বিজয়ী হওয়ার অদম্য কাজ অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। গ্রামীণ নারীদের যে মনোচেতনা, সেটি এলাকা তথা দেশবাসীর জন্য অর্থাৎ সমগ্র নারী সমাজের জন্য অনুকরণীয় হয়ে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যকার সুকুমার বৃত্তিগুলোকে উজ্জীবিত ও পুরস্কৃত করে আরও চ্যালেঞ্জ গ্রহণে উৎসাহিত করে।
স্থানীয় প্রশাসন সত্যিকার জয়িতাদের খুঁজে বের করার যে নিষ্ঠা ও দায়িত্ব পালন করছে এবং আদিবাসী নারীদেরও যে দৃষ্টিসীমার মধ্যে রেখেছে; এটি আমাদের পুলকিত করে তোলে। আদিবাসী নারীরা ঘর সামলে মাঠের কাজেও সমানভাবে পারদর্শী। পুরুষদের ছাপিয়ে নারীরা পরিশ্রমের দিক দিয়ে যেমন গোছানো, কর্মঠ ও স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের জগতকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। সবকিছুকে জয় করেই আদিবাসী নারী কল্যাণী মিনজী প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জয়িতার পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। জয়িতা বিজয়ী অগ্রজ কল্যাণী মিনজীকে জানাই শুভেচ্ছা।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি দেশের ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের বাসা থেকে নিচে পড়ে মারা যায় প্রীতি ওরাং (১৫)। বলা হচ্ছে, ঢাকা মহানগরীর মোহাম্মদপুরের বাসার ৮তলা ফ্ল্যাট থেকে প্রীতি ওরাং রাস্তায় লাফ দিয়ে পড়লে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রীতি ওরাং দেশের সবচেয়ে বিলুপ্ত প্রায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একটির সদস্য। ওরাং সম্প্রদায় মূলত বৃহত্তর সিলেটাঞ্চলেই বসবাস করে থাকে। সহজ-সরল চরিত্রের অধিকারী ওরাংরা হারিয়েছে বসতভিটা, হারিয়েছে স্বাতন্ত্র্য; বেঁচে রয়েছে শুধু নামের শেষের পদবীটিই। চা বাগানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভিড়ে ভাষা ও সংস্কৃতিও আচ্ছন্ন হয়েছে।
প্রীতি ওরাং-এর জন্মভূমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ রহিমপুর ইউনিয়নের মিতিঙ্গা চা বাগানে। মা নমিতা ওরাং ও বাবা লোকেশ ওরাং দাবি করেছেনÑ তাদের মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থিত হয়েছেÑ
প্রীতি ওরাংরা জীবনযুদ্ধের জয়-পরাজয় দেখেছে চা বাগানে। সেক্ষেত্রে আত্মহত্যার লক্ষ্যে অষ্টম তলা থেকে লাফিয়ে পড়া কি বিশ^াসযোগ্য?
ওই বাসার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার চিপস কেন উধাও করা হলো?
দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধরত ওরাংসহ আদিবাসীরা অল্পতেই সন্তুষ্ট। দুমুঠো ভাত ও মোটা কাপড় এবং সামান্য অর্থের বিনিময়ে দিনরাত খেটেছেন প্রীতি ওরাং। তার চোখেমুখে ছিলো স্বপ্নÑ মা-বাবাকে আর্থিক স্বচ্ছ্বতা আনয়নে সহায়তা করা; বোন ও নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতা করা, সবকিছু নিমিষেই মিলিয়ে গেছে। বাবা-মা, বোন আত্মীয়রা এখন অকুল পাথরে, প্রীতির মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু?
চোখে সর্ষে ফুল দেখা মা নমিতা ওরাং বলেছেন, ‘আমার সন্তানের মৃত্যুর পর আমি বিছানায় ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই আমার সন্তানের লাশ দেখি। ...আপনারা আমার কষ্টের কথা অনুধাবন করেন। যাতে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয় এজন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।’
শীর্ণ শরীর নিয়ে প্রীতির বাবা লোকেশ ওরাং বাদী হয়ে অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় দ-বিধির ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী মামলা রজ্জু করেছেন। তবে আশঙ্কা করছেন, মামলা প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
ইতোমধ্যেই সামাজিক সংগঠনগুলো প্রীতি ওরাং হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে রাজপথে নেমে পড়েছেন। প্রীতির বসতবাটি চা বাগানের অভ্যন্তর থেকে কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনেও হত্যার প্রতিবাদ ও শাস্তির দাবিতে সামিল হয়েছে আপামর জনতা। সংখ্যালঘু আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে আদালতের দিকে।
[লেখক: কলামিস্ট]