alt

উপ-সম্পাদকীয়

কৃষিপণ্যের মূল্যেই শুধু গাত্রদাহ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: সোমবার, ১৮ মার্চ ২০২৪
image

নিত্যপণ্যের মূল্য শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। সরকারের নানা ধরনের তদারকি টিম তৈরি করেছে, টিমগুলো মাঠে নেমে গেছে; তারা এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। তারা কতটুকু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে তা বাজারের পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করলেই দেখা যায়। দাম বাড়া নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করা হচ্ছে শুধু কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে। যেমন কাঁচামরিচের দাম যদি বেড়ে ৩০০ টাকা কেজি হয়, তাহলে গণমাধ্যমসহ ফেইসবুকে ঝালের ঝড় উঠে; কিন্তু এই দাম বাড়াটা সাময়িক যা আবার কমে ২০ টাকায় চলে আসে। কাঁচামরিচের দাম বাড়ার কারণ কিন্তু মজুতদারির জন্য হয় না। দাম বৃদ্ধির কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবহন জটিলতা।

শোনা যাচ্ছে বাজারে লেবুর দাম প্রতিটি ২০ টাকা হয়ে গেছে। লেবুর এই দাম বাড়ার জন্য দায়ী কে? দেশের কৃষক কি এই লেবুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন? নাকি স্বল্পপুঁজির লেবু ব্যবসায়ীরা এর দাম বাড়ালো? লেবুর দাম নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রকরা গলদঘর্ম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ টাকার লেবু ১৩ টাকায় বিক্রি করায় লেবু বিক্রেতার জরিমানা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। একজন লেবু বিক্রেতার মূলধন কত? তাছাড়া যারা লেবু বিক্রি করে তাদের পক্ষে সিন্ডিকেট তৈরি করাটাও সম্ভব না। রোজায় লেবুর চাহিদা এতই বেড়েছে যে তার জোগান সামলানোটাই বিক্রেতাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে লেবু উৎপাদনকারী কৃষক তো আর হঠাৎ করে এই চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লেবুর উৎপাদন বাড়াতে পারে না।

চাহিদা ও জোগানের বিস্তর ফারাকের চক্করে পড়ে স্বল্পপুঁজির লেবু ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক কৃষকরা একটু-আধটু বেশি দাম নিচ্ছেন। যদিও বিষয়টি অন্যায় কিন্তু এর চেয়ে অধিক অপরাধী সিন্ডিকেটদের নিয়ে তোলপাড় হয় না, যা হচ্ছে লেবুর দাম নিয়ে। রমজানের আগে মাল্টা ফল (বিদেশ থেকে আমদানি করা) ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে রাজশাহীর বাজারে বিক্রি হতো। প্রথম রোজার ইফতারের সময় তার দাম রাজশাহী মহানগরীর অনেক জায়গায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হয়ে গিয়েছিল। মাল্টার বিষয়টি নিয়ে কোন তোলপাড় হয়নি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমগুলোতে। দেশের কৃষকের লেবু বরই, পেয়ারা, কাঁচামরিচের দাম বাড়লে তা নিয়ে তোলপাড় করে তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমগুলো। বর্তমান সময়টা চৈত্র মাস, এই সময়টা লেবুর মৌসুম নয়; তারপরও কৃষি দপ্তর নানাবিধ লেবুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। তার জন্য এ অসময়ে এখন লেবু পাওয়া যায়। এই হাইব্রিড উৎপাদনের ফলে বাজারে এখন লেবু পাওয়া যাচ্ছে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে হলে এ সময় লেবু পাওয়া যাওয়ার কথা ছিল না।

বর্তমানে খুচরা বাজারে মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৫০ টাকা। প্রান্তিক কৃষক মোটা চালের ধান বাজারে বিক্রি করে থাকেন নয়শ থেকে ১ হাজার টাকায়। এক মণ ধানে ২৬ থেকে ২৮ কেজি চাল উৎপাদন হয়। এক মণ ধানের চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪শ টাকায়। এক মণ ধান থেকে চাল উৎপাদন করতে বড় চাতাল বা মিলে খুব বেশি হলে খরচ হয় ৫০ টাকা। প্রতি মণ ধানে চাল তৈরি করে মিল মালিকরা লাভ করছেন প্রায় ৩৫০ টাকা থেকে চারশ টাকা। শতকরা হিসাব করলে দেখা যাবে প্রায় ৪০ শতাংশ লাভ হয়। এই লাভটা ভোগ করে চালকল মালিক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত। কৃষক কিন্তু তার উৎপাদন খরচের নায্যমূল্যটাও পায় না। কারণ বর্তমানে বড় বড় মিল গড়ে উঠার কারণে গ্রামপর্যায়ে প্রান্তিকরা আর ধান থেকে চাল বানাতে পারে না। এখানে একটা প্রশ্ন চলে আসে, প্রান্তিক কৃষক থেকে ধান কিনে চাল বানিয়ে খুচরা বাজারে চাল বিক্রি করার যে চ্যানেলটা কাজ করছে তা কিভাবে মনিটরিং বা তদারক করেন বর্তমানের বাজার মনিটরিং টিম। তারা কি মোহাম্মদপুর কৃষি বাজার, বাদামতলীর চালের আড়ত দেখেই শেষ করেন? নাকি প্রান্তিক কৃষক থেকে ধান কিনে তা চালে পরিণত করার পর্যন্ত যে স্তরগুলো আছে তা মনিটরিং করেন।

বর্তমানে বাজার মনিটরিংয়ের নামে যা চলছে তাতে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পাওয়ার কোন আশাই দেখছেন না। পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করে গগনচুম্বি। অথচ বর্তমানে দেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের মৌসুম চলছে। গ্রামের মাঠগুলোতে কৃষকেরা মাটির নিচ থেকে পেঁয়াজ তুলছেন। তাহলে কেন পেঁয়াজের বাজারে আগুন? তার নেপথ্যে কারা কাজ করছে তা কি দেখছেন বাজার মনিটরিং টিম? ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ফলে ভরা উৎপাদন মৌসুমে কৃষক তার পেঁয়াজের ন্যায্যদাম পাচ্ছে না। পেঁয়াজ ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তারা কোটি টাকার মালিক। বর্তমানে গ্রামের কৃষকেরা মুড়িকাটা পেঁয়াজ পাইকারদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ৫০-৬৫ টাকার দরে দাম পাচ্ছেন।

কৃষক বাধ্য হয়ে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে, কারণ পেঁয়াজ ফলানোর উৎপাদন খরচ তাকে মিটাতে হয়েছে ধারদেনা করে। বর্তমানে সরকার আলুও ভারত থেকে আমদানি করছেন বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য। ভারতীয় আলু আসার সুবাদে প্রতি কেজি আলু ২৫-৩৫ টাকা দরে স্থানভেদে কেনাবেচা হচ্ছে। এখন আলু উঠানোর সময়। কৃষকেরা মাঠ থেকে আলু উঠাচ্ছেন আর ঠিক ওই সময়ই সরকার ভারত থেকে আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের। তাহলে কৃষকের অবস্থাটা কি দাঁড়ায়। একজন প্রান্তিক কৃষক কত টাকা করে আলু বিক্রি করতে পারবেন যদি খুচরা বাজারে এ দাম হয়। কিভাবে একজন কৃষক তার উৎপাদন খরচ মেটাবেন তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন।

প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে সস্তা মূল্যে কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা আলু কিনে আবার মজুদ করবে। তারপর বাজারে আলুর সংকট সৃষ্টি হবে। এ বিষয়টি কি কথিত সুশীলরা ভেবেছেন কখনো। অবশ্যই এরা মুনাফার আশায় আলু মজুদের কাজটি করবে। এ পেঁয়াজ এই আলু আড়ৎদাররা মজুদ করে রাখবে, আর ভারতীয় ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে একটা সময় আমদানিটা বন্ধ করে দেবে আর তখন পেঁয়াজ আলুর থেকে মোটা অংকের মুনাফা হাতিয়ে নেবে। আর ওই সময়টায় কৃষকের হাতে আলু পেঁয়াজ থাকবে না, যা দিয়ে সিন্ডিকেট রোধের ব্যবস্থা করা যাবে। বাজার যারা মনিটরিং করেন তারা উৎপাদক (কৃষক) পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত কৃষিপণ্যের হাতবদলটা কিভাবে মনিটরিং করেন তারও একটি ব্যাখ্যা থাকা দরকার। আর এ ব্যাখ্যাটা গণমাধ্যমে আসা উচিত; যা সাধারণ মানুষ দেখে বুঝতে পারবে মূল সমস্যাটা কে করছে। এ ধরনের ব্যাখ্যার ব্যবস্থাটা যদি থাকে তাহলে প্রতীয়মান হয়ে যাবে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাটা আসলে কি কৃষকবান্ধব না আড়ৎদার মজুদারবান্ধব।

২০২৩ সালে বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হতো ১০৯ টাকা দরে; বর্তমানে ওই চিনি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। দেশের সিংহ ভাগ চিনি আমদানি করে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী। বিদেশের বাজারে পাইকারি দরে প্রতি কেজি চিনি কিনে কত টাকা করে বিক্রি করছেন তা কি বাজার মনিটরিং টিম তদারক করেন। নাকি বাজার মনিটরিং টিম খুচরা বিক্রেতার ওপর এসে তাফালিং করে বেড়ান। এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। চিনির দাম কিন্তু কমবে না, কাঁচামরিচ, আলু পেঁয়াজ, লেবু (যেগুলো দেশের কৃষক উৎপাদন করে) ইত্যাদির দাম কমবে। চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে অথচ দেশের সরকারি চিনিকলগুলোর কোন সংস্কার করা হয় না। এদিকে সরকারি চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি চিনিকল।

দেশের চিনিকলগুলো চালু থাকলে শ্রমিকের ও কৃষকের কর্মসংস্থান হতো। দেশের যে কয়েকটি সরকারি চিনিকল চালু আছে সেগুলোতে আখ সাপ্লাই দিয়ে কৃষক সময়মতো ন্যায্যমূল্যটাও পায় না। সার্বিকভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে প্রশ্ন আসে, সরকার কৃষকের জন্য কতটুকু করছেন? অথচ প্রতিটি রাজনৈতিক দল সেøাগান দেয়Ñ কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, বাস্তবে তার চিত্রটা পুরো উল্টো।

সুতরাং কাগজে নয় বাস্তব কর্মকা- দিয়ে প্রমাণ করুন সরকার কৃষকবান্ধব।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কৃষিপণ্যের মূল্যেই শুধু গাত্রদাহ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

image

সোমবার, ১৮ মার্চ ২০২৪

নিত্যপণ্যের মূল্য শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। সরকারের নানা ধরনের তদারকি টিম তৈরি করেছে, টিমগুলো মাঠে নেমে গেছে; তারা এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। তারা কতটুকু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে তা বাজারের পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করলেই দেখা যায়। দাম বাড়া নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করা হচ্ছে শুধু কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে। যেমন কাঁচামরিচের দাম যদি বেড়ে ৩০০ টাকা কেজি হয়, তাহলে গণমাধ্যমসহ ফেইসবুকে ঝালের ঝড় উঠে; কিন্তু এই দাম বাড়াটা সাময়িক যা আবার কমে ২০ টাকায় চলে আসে। কাঁচামরিচের দাম বাড়ার কারণ কিন্তু মজুতদারির জন্য হয় না। দাম বৃদ্ধির কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবহন জটিলতা।

শোনা যাচ্ছে বাজারে লেবুর দাম প্রতিটি ২০ টাকা হয়ে গেছে। লেবুর এই দাম বাড়ার জন্য দায়ী কে? দেশের কৃষক কি এই লেবুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন? নাকি স্বল্পপুঁজির লেবু ব্যবসায়ীরা এর দাম বাড়ালো? লেবুর দাম নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রকরা গলদঘর্ম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ টাকার লেবু ১৩ টাকায় বিক্রি করায় লেবু বিক্রেতার জরিমানা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। একজন লেবু বিক্রেতার মূলধন কত? তাছাড়া যারা লেবু বিক্রি করে তাদের পক্ষে সিন্ডিকেট তৈরি করাটাও সম্ভব না। রোজায় লেবুর চাহিদা এতই বেড়েছে যে তার জোগান সামলানোটাই বিক্রেতাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে লেবু উৎপাদনকারী কৃষক তো আর হঠাৎ করে এই চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লেবুর উৎপাদন বাড়াতে পারে না।

চাহিদা ও জোগানের বিস্তর ফারাকের চক্করে পড়ে স্বল্পপুঁজির লেবু ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক কৃষকরা একটু-আধটু বেশি দাম নিচ্ছেন। যদিও বিষয়টি অন্যায় কিন্তু এর চেয়ে অধিক অপরাধী সিন্ডিকেটদের নিয়ে তোলপাড় হয় না, যা হচ্ছে লেবুর দাম নিয়ে। রমজানের আগে মাল্টা ফল (বিদেশ থেকে আমদানি করা) ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে রাজশাহীর বাজারে বিক্রি হতো। প্রথম রোজার ইফতারের সময় তার দাম রাজশাহী মহানগরীর অনেক জায়গায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হয়ে গিয়েছিল। মাল্টার বিষয়টি নিয়ে কোন তোলপাড় হয়নি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমগুলোতে। দেশের কৃষকের লেবু বরই, পেয়ারা, কাঁচামরিচের দাম বাড়লে তা নিয়ে তোলপাড় করে তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমগুলো। বর্তমান সময়টা চৈত্র মাস, এই সময়টা লেবুর মৌসুম নয়; তারপরও কৃষি দপ্তর নানাবিধ লেবুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। তার জন্য এ অসময়ে এখন লেবু পাওয়া যায়। এই হাইব্রিড উৎপাদনের ফলে বাজারে এখন লেবু পাওয়া যাচ্ছে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে হলে এ সময় লেবু পাওয়া যাওয়ার কথা ছিল না।

বর্তমানে খুচরা বাজারে মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৫০ টাকা। প্রান্তিক কৃষক মোটা চালের ধান বাজারে বিক্রি করে থাকেন নয়শ থেকে ১ হাজার টাকায়। এক মণ ধানে ২৬ থেকে ২৮ কেজি চাল উৎপাদন হয়। এক মণ ধানের চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪শ টাকায়। এক মণ ধান থেকে চাল উৎপাদন করতে বড় চাতাল বা মিলে খুব বেশি হলে খরচ হয় ৫০ টাকা। প্রতি মণ ধানে চাল তৈরি করে মিল মালিকরা লাভ করছেন প্রায় ৩৫০ টাকা থেকে চারশ টাকা। শতকরা হিসাব করলে দেখা যাবে প্রায় ৪০ শতাংশ লাভ হয়। এই লাভটা ভোগ করে চালকল মালিক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত। কৃষক কিন্তু তার উৎপাদন খরচের নায্যমূল্যটাও পায় না। কারণ বর্তমানে বড় বড় মিল গড়ে উঠার কারণে গ্রামপর্যায়ে প্রান্তিকরা আর ধান থেকে চাল বানাতে পারে না। এখানে একটা প্রশ্ন চলে আসে, প্রান্তিক কৃষক থেকে ধান কিনে চাল বানিয়ে খুচরা বাজারে চাল বিক্রি করার যে চ্যানেলটা কাজ করছে তা কিভাবে মনিটরিং বা তদারক করেন বর্তমানের বাজার মনিটরিং টিম। তারা কি মোহাম্মদপুর কৃষি বাজার, বাদামতলীর চালের আড়ত দেখেই শেষ করেন? নাকি প্রান্তিক কৃষক থেকে ধান কিনে তা চালে পরিণত করার পর্যন্ত যে স্তরগুলো আছে তা মনিটরিং করেন।

বর্তমানে বাজার মনিটরিংয়ের নামে যা চলছে তাতে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পাওয়ার কোন আশাই দেখছেন না। পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করে গগনচুম্বি। অথচ বর্তমানে দেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের মৌসুম চলছে। গ্রামের মাঠগুলোতে কৃষকেরা মাটির নিচ থেকে পেঁয়াজ তুলছেন। তাহলে কেন পেঁয়াজের বাজারে আগুন? তার নেপথ্যে কারা কাজ করছে তা কি দেখছেন বাজার মনিটরিং টিম? ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ফলে ভরা উৎপাদন মৌসুমে কৃষক তার পেঁয়াজের ন্যায্যদাম পাচ্ছে না। পেঁয়াজ ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তারা কোটি টাকার মালিক। বর্তমানে গ্রামের কৃষকেরা মুড়িকাটা পেঁয়াজ পাইকারদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ৫০-৬৫ টাকার দরে দাম পাচ্ছেন।

কৃষক বাধ্য হয়ে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে, কারণ পেঁয়াজ ফলানোর উৎপাদন খরচ তাকে মিটাতে হয়েছে ধারদেনা করে। বর্তমানে সরকার আলুও ভারত থেকে আমদানি করছেন বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য। ভারতীয় আলু আসার সুবাদে প্রতি কেজি আলু ২৫-৩৫ টাকা দরে স্থানভেদে কেনাবেচা হচ্ছে। এখন আলু উঠানোর সময়। কৃষকেরা মাঠ থেকে আলু উঠাচ্ছেন আর ঠিক ওই সময়ই সরকার ভারত থেকে আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের। তাহলে কৃষকের অবস্থাটা কি দাঁড়ায়। একজন প্রান্তিক কৃষক কত টাকা করে আলু বিক্রি করতে পারবেন যদি খুচরা বাজারে এ দাম হয়। কিভাবে একজন কৃষক তার উৎপাদন খরচ মেটাবেন তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন।

প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে সস্তা মূল্যে কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা আলু কিনে আবার মজুদ করবে। তারপর বাজারে আলুর সংকট সৃষ্টি হবে। এ বিষয়টি কি কথিত সুশীলরা ভেবেছেন কখনো। অবশ্যই এরা মুনাফার আশায় আলু মজুদের কাজটি করবে। এ পেঁয়াজ এই আলু আড়ৎদাররা মজুদ করে রাখবে, আর ভারতীয় ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে একটা সময় আমদানিটা বন্ধ করে দেবে আর তখন পেঁয়াজ আলুর থেকে মোটা অংকের মুনাফা হাতিয়ে নেবে। আর ওই সময়টায় কৃষকের হাতে আলু পেঁয়াজ থাকবে না, যা দিয়ে সিন্ডিকেট রোধের ব্যবস্থা করা যাবে। বাজার যারা মনিটরিং করেন তারা উৎপাদক (কৃষক) পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত কৃষিপণ্যের হাতবদলটা কিভাবে মনিটরিং করেন তারও একটি ব্যাখ্যা থাকা দরকার। আর এ ব্যাখ্যাটা গণমাধ্যমে আসা উচিত; যা সাধারণ মানুষ দেখে বুঝতে পারবে মূল সমস্যাটা কে করছে। এ ধরনের ব্যাখ্যার ব্যবস্থাটা যদি থাকে তাহলে প্রতীয়মান হয়ে যাবে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাটা আসলে কি কৃষকবান্ধব না আড়ৎদার মজুদারবান্ধব।

২০২৩ সালে বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হতো ১০৯ টাকা দরে; বর্তমানে ওই চিনি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। দেশের সিংহ ভাগ চিনি আমদানি করে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী। বিদেশের বাজারে পাইকারি দরে প্রতি কেজি চিনি কিনে কত টাকা করে বিক্রি করছেন তা কি বাজার মনিটরিং টিম তদারক করেন। নাকি বাজার মনিটরিং টিম খুচরা বিক্রেতার ওপর এসে তাফালিং করে বেড়ান। এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। চিনির দাম কিন্তু কমবে না, কাঁচামরিচ, আলু পেঁয়াজ, লেবু (যেগুলো দেশের কৃষক উৎপাদন করে) ইত্যাদির দাম কমবে। চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে অথচ দেশের সরকারি চিনিকলগুলোর কোন সংস্কার করা হয় না। এদিকে সরকারি চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি চিনিকল।

দেশের চিনিকলগুলো চালু থাকলে শ্রমিকের ও কৃষকের কর্মসংস্থান হতো। দেশের যে কয়েকটি সরকারি চিনিকল চালু আছে সেগুলোতে আখ সাপ্লাই দিয়ে কৃষক সময়মতো ন্যায্যমূল্যটাও পায় না। সার্বিকভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে প্রশ্ন আসে, সরকার কৃষকের জন্য কতটুকু করছেন? অথচ প্রতিটি রাজনৈতিক দল সেøাগান দেয়Ñ কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, বাস্তবে তার চিত্রটা পুরো উল্টো।

সুতরাং কাগজে নয় বাস্তব কর্মকা- দিয়ে প্রমাণ করুন সরকার কৃষকবান্ধব।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top