alt

উপ-সম্পাদকীয়

গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে

রেজাউল করিম খোকন

: মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

সরকার এখন গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিচ্ছে। পৃথিবীর যেকোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন অপরিহার্য। আর সব দেশেরই গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। প্রতিটি রাষ্ট্রই কৃষি উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কৃষির উন্নয়ন প্রকারান্তরে কৃষকের উন্নয়ন। কৃষিভূমির প্রতিটি ইঞ্চিতে উন্নত বীজ ও সার ব্যবহারের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যে নিবিড় চাষাবাদ করা হয় তাকে কৃষি বিপ্লব বলা হয়।

গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা শহরাঞ্চল থেকে ভিন্নতর হলেও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়াসহ প্রতিটি বাড়ির সাথে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করা গেলে তা উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের সহায়ক হয়। এর সাথে সাথে যেটি প্রয়োজন তা হলো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা।

এখন গ্রামের পথঘাট অনেক উন্নত। এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলো পাকা রাস্তার মাধ্যমে শহরের সাথে সংযুক্ত। বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীরা সৌরবিদ্যুতের বদৌলতে আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে রান্নার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের গৃহভিত্তিক প্রকল্প তিন দশকের অধিক সময় আগে যাত্রা শুরু করলেও এ ব্যাপারে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিভূমির পরিমাণ খুবই কম। কিন্তু উন্নত বীজ ও সার এবং বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে কৃষিজ প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশের কৃষকরা এক বছর যে ফসল উৎপাদন করে লাভবান হয় পরবর্তী বছর একই ফসল উৎপাদনে উদ্যোগী হয়। এভাবে একজনকে লাভবান হতে দেখে অনেকে একই ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এভাবে ফসলের বাড়তি উৎপাদনের কারণে মূল্য পড়ে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলের উৎপাদন, বিপণন ও চাহিদা বিষয়ে কৃষকের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা কমে।

এমন অনেক মসলাজাতীয় ফসল রয়েছে যেগুলোর উৎপাদন আমাদের দেশে কম অথবা দেশে একেবারেই উৎপন্ন হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এলাচি, দারুচিনি, গোলমরিচ, জিরা, জাফরান, জায়ফল, জয়ত্রী, পোস্তাদানা প্রভৃতি। এসব মসলাজাতীয় ফসল আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত এবং সার্কভুক্ত রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় প্রচুর উৎপন্ন হয়। বর্তমানে মাটির পরিচর্যার মাধ্যমে পৃথিবীর এক অঞ্চলের ফসল অন্য অঞ্চলে উৎপন্ন হয়। অর্থকরী এসব ফসলের আবাদ করলে এর মাধ্যমে যে আয় হবে তা কৃষকদের সচ্ছল জীবনযাপনে সহায়ক হবে। সুতরাং আমাদের সরকার ও কৃষি বিভাগের উচিত কৃষকদের সেই লক্ষ্যে উৎসাহী করে তোলা। আমাদের দেশে যেসব অঞ্চলে আম, লিচু, কমলা, মাল্টা, বাউকুল, আপেল কুল, আমড়া, বেল, কতবেল, কাজী পেয়ারা, আঙ্গুর প্রভৃতি উৎপন্ন হয় সেসব অঞ্চলের কৃষকরা বাড়ির আঙিনায় পুকুর ও রাস্তার ধারে আবার কৃষি জমিতে এসব গাছ লাগিয়ে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। এ সফলতা তাদের বাড়তি আয়ের পথ করে দিয়েছে।

আমাদের দেশে এখনো নগর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। যদিও আমাদের সংবিধানে এ বৈষম্য দূর করার জন্য কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সরকারি বেতনর্ভুক্ত যেসব ব্যক্তি জড়িত তাদের কর্মের প্রতি অনীহা, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততার অভাব প্রভৃতি এ বিষয়ক সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমকেই বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন উচ্চ ফলনশীল বীজ ও বিভিন্ন সারের আনুপাতিক ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় এমন সব সফলের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। এমন অনেক ফসল আছে যেগুলো মৌসুমি কিন্তু বৈজ্ঞানিক পন্থায় চাষের কারণে সেসব ফসলও এখন সারা বছর উৎপন্ন করা সম্ভব। তাছাড়া অতীতে যে ভূমিতে বার্ষিক একটি ফসল হতো এখন একই ভূমিতে বার্ষিক দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে তিনটি ফসলের চাষ করা হচ্ছে। আবার একই ভূমিতে একটি ফসলের ফাঁকে ফাঁকে আরেকটি ফসলের চাষ হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ধান ও মাছের চাষ একই ভূমিতে একসাথে করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রতিটি ফসল ও মাছ উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটালেও কৃষকপর্যায়ে পাইকারি বিক্রয়মূল্য এবং ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকায় বাড়তি উৎপাদন ও বাড়তি মূল্য কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারছে না। বর্তমানে আমাদের বেশকিছু কৃষিপণ্য বিদেশে রফতানি হয়।

এসব পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্য বিধায় রফতানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া হয়। যদিও এ প্রণোদনার একটি অংশ কৃষকের পাওয়ার কথা; কিন্তু আজ আমাদের দেশের কৃষক সে প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী প্রতিটি সরকারই গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের লক্ষ্যে বার্ষিক রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নকালে যথাযথ বরাদ্দ দিতে সচেষ্ট থেকেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বিরাট অংশ জনপ্রতিনিধি ও সরকারি ব্যক্তিরা লুণ্ঠন করায় তা কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে পারেনি। আর এ কারণেই আমাদের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব দীর্ঘদিন ধরে একটি আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষির পাশাপাশি সমভাবে কুটির শিল্প স্থাপন ও অন্যান্য শিল্প কারখানার বিকাশ সাধন করা গেলে গ্রামের মানুষ জীবিকা ও বাড়তি আয়ের অন্বেষণে শহরমুখী হবে না।

দেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হলো কৃষি। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন- কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। কৃষি এখনো দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই কৃষিভিক্তিক শিল্পে স্বল্পমাত্রার সঞ্চালনা ও প্রেষণাই আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে এবং গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষিশিল্পের উন্নয়ন জরুরি। এ খাতকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার জন্যই কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার অর্জন করেছে। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে টেকসই খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

পরিবর্তিত পরিবেশে কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিষয়গুলো হলোÑ কৃষকের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ অথবা বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক এবং জমি চাষের, ফসল কাটার ও ফসল মাড়াই কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ এবং সরবরাহ নিশ্চিত করা। সেচের অভাবে যাতে কোনো জমির ফসল নষ্ট না হয় সেজন্য সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেশের সব পতিত জমি কৃষিযোগ্য জমিতে পরিণত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ এক জমিতে চার ফসল উৎপাদন, দানাদার বিভিন্ন ফসল ছাড়াও ফলমূল, বাদাম, ডাল ও তেলজাতীয় শস্য, সবজি চাষ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন ও মাছ চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলা। নগর কৃষি ও ছাদ বাগানে ফল ও সবজি চাষের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে বাগান পরিকল্পনা ও সৃজন করা প্রয়োজন। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদের আগাম তথ্য প্রদানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

কৃষিকাজে ব্যবহৃত কৃষি উপকরণের দাম বাজারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা। কারণ উচ্চমূল্যে কৃষি উপকরণ কিনলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ হয়ে যাবে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে উৎপাদিত ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। কৃষককে কৃষিকাজে খাদ্যশস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করার ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে তাকে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকারিভাবে বেশির ভাগ ফসল ক্রয়, গুদামজাত ও বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাছাড়া অনলাইন পোর্টাল করে অথবা ফেসবুক গ্রুপ করে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এছাড়া কৃষি খাতে আধুনিকায়নে খরচ কমাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং কৃষির যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষি খাতে আরও বেশি হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন প্রয়োজন। স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশের পথে মূলধারার কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে ও তৃণমূল উদ্যোক্তা সৃষ্টির পাশাপাশি গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে

রেজাউল করিম খোকন

মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

সরকার এখন গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিচ্ছে। পৃথিবীর যেকোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন অপরিহার্য। আর সব দেশেরই গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। প্রতিটি রাষ্ট্রই কৃষি উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কৃষির উন্নয়ন প্রকারান্তরে কৃষকের উন্নয়ন। কৃষিভূমির প্রতিটি ইঞ্চিতে উন্নত বীজ ও সার ব্যবহারের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যে নিবিড় চাষাবাদ করা হয় তাকে কৃষি বিপ্লব বলা হয়।

গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা শহরাঞ্চল থেকে ভিন্নতর হলেও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়াসহ প্রতিটি বাড়ির সাথে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করা গেলে তা উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের সহায়ক হয়। এর সাথে সাথে যেটি প্রয়োজন তা হলো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা।

এখন গ্রামের পথঘাট অনেক উন্নত। এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলো পাকা রাস্তার মাধ্যমে শহরের সাথে সংযুক্ত। বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীরা সৌরবিদ্যুতের বদৌলতে আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে রান্নার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের গৃহভিত্তিক প্রকল্প তিন দশকের অধিক সময় আগে যাত্রা শুরু করলেও এ ব্যাপারে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিভূমির পরিমাণ খুবই কম। কিন্তু উন্নত বীজ ও সার এবং বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে কৃষিজ প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশের কৃষকরা এক বছর যে ফসল উৎপাদন করে লাভবান হয় পরবর্তী বছর একই ফসল উৎপাদনে উদ্যোগী হয়। এভাবে একজনকে লাভবান হতে দেখে অনেকে একই ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এভাবে ফসলের বাড়তি উৎপাদনের কারণে মূল্য পড়ে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলের উৎপাদন, বিপণন ও চাহিদা বিষয়ে কৃষকের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা কমে।

এমন অনেক মসলাজাতীয় ফসল রয়েছে যেগুলোর উৎপাদন আমাদের দেশে কম অথবা দেশে একেবারেই উৎপন্ন হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এলাচি, দারুচিনি, গোলমরিচ, জিরা, জাফরান, জায়ফল, জয়ত্রী, পোস্তাদানা প্রভৃতি। এসব মসলাজাতীয় ফসল আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত এবং সার্কভুক্ত রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় প্রচুর উৎপন্ন হয়। বর্তমানে মাটির পরিচর্যার মাধ্যমে পৃথিবীর এক অঞ্চলের ফসল অন্য অঞ্চলে উৎপন্ন হয়। অর্থকরী এসব ফসলের আবাদ করলে এর মাধ্যমে যে আয় হবে তা কৃষকদের সচ্ছল জীবনযাপনে সহায়ক হবে। সুতরাং আমাদের সরকার ও কৃষি বিভাগের উচিত কৃষকদের সেই লক্ষ্যে উৎসাহী করে তোলা। আমাদের দেশে যেসব অঞ্চলে আম, লিচু, কমলা, মাল্টা, বাউকুল, আপেল কুল, আমড়া, বেল, কতবেল, কাজী পেয়ারা, আঙ্গুর প্রভৃতি উৎপন্ন হয় সেসব অঞ্চলের কৃষকরা বাড়ির আঙিনায় পুকুর ও রাস্তার ধারে আবার কৃষি জমিতে এসব গাছ লাগিয়ে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। এ সফলতা তাদের বাড়তি আয়ের পথ করে দিয়েছে।

আমাদের দেশে এখনো নগর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। যদিও আমাদের সংবিধানে এ বৈষম্য দূর করার জন্য কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সরকারি বেতনর্ভুক্ত যেসব ব্যক্তি জড়িত তাদের কর্মের প্রতি অনীহা, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততার অভাব প্রভৃতি এ বিষয়ক সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমকেই বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন উচ্চ ফলনশীল বীজ ও বিভিন্ন সারের আনুপাতিক ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় এমন সব সফলের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। এমন অনেক ফসল আছে যেগুলো মৌসুমি কিন্তু বৈজ্ঞানিক পন্থায় চাষের কারণে সেসব ফসলও এখন সারা বছর উৎপন্ন করা সম্ভব। তাছাড়া অতীতে যে ভূমিতে বার্ষিক একটি ফসল হতো এখন একই ভূমিতে বার্ষিক দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে তিনটি ফসলের চাষ করা হচ্ছে। আবার একই ভূমিতে একটি ফসলের ফাঁকে ফাঁকে আরেকটি ফসলের চাষ হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ধান ও মাছের চাষ একই ভূমিতে একসাথে করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রতিটি ফসল ও মাছ উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটালেও কৃষকপর্যায়ে পাইকারি বিক্রয়মূল্য এবং ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকায় বাড়তি উৎপাদন ও বাড়তি মূল্য কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারছে না। বর্তমানে আমাদের বেশকিছু কৃষিপণ্য বিদেশে রফতানি হয়।

এসব পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্য বিধায় রফতানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া হয়। যদিও এ প্রণোদনার একটি অংশ কৃষকের পাওয়ার কথা; কিন্তু আজ আমাদের দেশের কৃষক সে প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী প্রতিটি সরকারই গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের লক্ষ্যে বার্ষিক রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নকালে যথাযথ বরাদ্দ দিতে সচেষ্ট থেকেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বিরাট অংশ জনপ্রতিনিধি ও সরকারি ব্যক্তিরা লুণ্ঠন করায় তা কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে পারেনি। আর এ কারণেই আমাদের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব দীর্ঘদিন ধরে একটি আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষির পাশাপাশি সমভাবে কুটির শিল্প স্থাপন ও অন্যান্য শিল্প কারখানার বিকাশ সাধন করা গেলে গ্রামের মানুষ জীবিকা ও বাড়তি আয়ের অন্বেষণে শহরমুখী হবে না।

দেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হলো কৃষি। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন- কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। কৃষি এখনো দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই কৃষিভিক্তিক শিল্পে স্বল্পমাত্রার সঞ্চালনা ও প্রেষণাই আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে এবং গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষিশিল্পের উন্নয়ন জরুরি। এ খাতকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার জন্যই কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার অর্জন করেছে। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে টেকসই খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

পরিবর্তিত পরিবেশে কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিষয়গুলো হলোÑ কৃষকের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ অথবা বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক এবং জমি চাষের, ফসল কাটার ও ফসল মাড়াই কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ এবং সরবরাহ নিশ্চিত করা। সেচের অভাবে যাতে কোনো জমির ফসল নষ্ট না হয় সেজন্য সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেশের সব পতিত জমি কৃষিযোগ্য জমিতে পরিণত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ এক জমিতে চার ফসল উৎপাদন, দানাদার বিভিন্ন ফসল ছাড়াও ফলমূল, বাদাম, ডাল ও তেলজাতীয় শস্য, সবজি চাষ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন ও মাছ চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলা। নগর কৃষি ও ছাদ বাগানে ফল ও সবজি চাষের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে বাগান পরিকল্পনা ও সৃজন করা প্রয়োজন। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদের আগাম তথ্য প্রদানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

কৃষিকাজে ব্যবহৃত কৃষি উপকরণের দাম বাজারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা। কারণ উচ্চমূল্যে কৃষি উপকরণ কিনলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ হয়ে যাবে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে উৎপাদিত ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। কৃষককে কৃষিকাজে খাদ্যশস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করার ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে তাকে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকারিভাবে বেশির ভাগ ফসল ক্রয়, গুদামজাত ও বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাছাড়া অনলাইন পোর্টাল করে অথবা ফেসবুক গ্রুপ করে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এছাড়া কৃষি খাতে আধুনিকায়নে খরচ কমাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং কৃষির যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষি খাতে আরও বেশি হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন প্রয়োজন। স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশের পথে মূলধারার কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে ও তৃণমূল উদ্যোক্তা সৃষ্টির পাশাপাশি গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top