alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিল্পীর অভিমান, শিল্পীর আত্মহনন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২৩ মার্চ ২০২৪
image

সাদি মহম্মদ

আমি সংগীতশিল্পী নই, কিন্তু সংগীতপ্রেমী হিসেবে গান শুনতে ভালোবাসি। সংগীতপ্রেমী হলেও সব ধরনের গান ভালো লাগে না, বিশেষ করে ব্যান্ডের গান সচরাচর শুনি না। আমি শুনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি; শুনি অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, ডিএল রায়, পুরনো দিনের আধুনিক এবং মরমিগান। তবে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আকর্ষণ বেশি। রবি ঠাকুরের বাণী সব সময় বুঝি না, কিন্তু সুরের আবেশ আমাকে মোহিত করে। সবাই যে আমার মতো হবে তা কিন্তু নয়Ñ আমার ছেলে অর্ণব কোনো দিন রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি শুনেছে বলে মনে হয় না, মেয়ে ঐশী আমার অনুরোধে রবীন্দ্রসংগীতের অনুশীলন করে।

আমাদের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নিজামউদ্দিন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষের মতে রবি ঠাকুরের সব গানের সুর একরকম, লং প্লেয়ারে কখন যে গান থেকে গানের পরিবর্তন হয় তা তিনি ধরতে পারতেন না। অন্যদিকে আমার কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমদ শুধু রবীন্দ্রসংগীত শোনার জন্য আরও বেশি দিন বাঁচতে চেয়েছিলেন। আমি প্রায় প্রতিদিন ঢাকা থেকে গাজীপুর টাকশালে গিয়ে অফিস করতাম, পথিমধ্যে দশ বছর ধরে গাড়িতে বসে বসে গান শুনেছি, অধিকাংশ গান ছিল সাদি মহম্মদের কণ্ঠে। ডিএল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ এবং রজনীকান্ত সেনের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ এই দুটি গান সাদি মহম্মদের কণ্ঠে আমার কাছে অতুলনীয় মনে হতো।

সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহ ছিলেন মূলত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। বুধবার ১৩ মার্চ, ২০২৪; সন্ধ্যায় তাদের নিজ বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় শিল্পী সাদি মহম্মদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর দিন তিনি রোজা রাখেন, ইফতারও করেন; এরপরই তিনি স্বেচ্ছায় না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। তাদের ঘনিষ্ঠতম স্বজন নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপার কথা অনুযায়ী গত বছর তার পঙ্গু মা মারা যাওয়ার পর সাদি মহম্মদ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন, মার মৃত্যুতে তার মধ্যে হতাশা ভর করে। কারণ বাবার মৃত্যুর পর এই মা কাপড় সেলাইয়ের আয় দিয়ে ১০টি সন্তানের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন।

মাকে হারিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে সংগ্রাম করে ক্লান্ত হয়ে হয়তো তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যু আত্মহননের একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। অনেকের অভিমত, সাদির অনেক আগেই পাগল হয়ে যাওয়া কথা। সাদি কেন এতদিনেও পাগল হননিÑ প্রায়ই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে সাদিকেও। এবার সেই ঘটনায় আসি। সাদির বাবা মহম্মদ সলিমুল্লাহ ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ধার্মিক, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তিনি মসজিদে আদায় করতেন। মসজিদে নামাজ পড়ার জন্যই তিনি মসজিদের পাশে বাড়ি নির্মাণ করেন।

২৬ মার্চ, ১৯৭১, শুক্রবার; জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেন মহম্মদ সলিমুল্লাহ। সাদিদের পাশের অবাঙালি বাড়ি থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। নামাজ শেষে অবাঙালি বিহারিরা এই মর্মে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিতে থাকে যে, সলিমুল্লাহদের বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে গুলি করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে বিহারিরা মহম্মদ সলিমুল্লাহর বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, সাদিদের পরিবারের সদস্যরা পাশের বাসার ছাদে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন, সাদির মার দুই পা ভেঙে যায়, ৯৬ বছর বয়সে তিনি গত বছর মৃত্যুবরণ করেন। আমৃত্যু তিনি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেছেন। সাদি এবং তার বাবা পাশের খালি বাসার আশ্রয় নেন। তাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান এয়ারফোর্সের এক পাঞ্জাবি অফিসার ঘরে ঢুকে সাদির বাবাকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে ছুরি তুলে নেয়।

সলিমুল্লাহ সাহেব আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, সাদি তার ছোট হাত দিয়ে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত চেপে ধরেন, বাবা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুই পালা’। পালানোর সময় সাদি পথিমধ্যে চাচাকে বল্লম দিয়ে হত্যা করতে দেখেন, দেখেন খালাতো ভাইকে মাটিতে শুইয়ে গরুর মতো জবাই করার দৃশ্য। এছাড়া পালানোর পথে বিহারিদের হত্যাযজ্ঞে অনেক নিরীহ মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। এতগুলো মর্মন্তুদ দৃশ্য দেখার পরও সাদি কেন পাগল হননি, সেই প্রশ্ন জাগারই কথা।

সাদি পাগল না হলেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন বলে মনে হয় না। সাদি মহম্মদের জন্ম ১৯৫৭ সালে। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু বুয়েটে লেখাপড়া শেষ না করেই তিনি ১৯৭৫ সালে চলে যান ভারতের শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেখানে তিনি শান্তিদেব ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখেন। তার ষাটটিরও বেশি গানের অ্যালবাম রয়েছে। সাদি মহম্মদ ছিলেন একাধারে শিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার।

গানের জগতে এমন প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদকের জন্য বিবেচিত হননি। রাষ্ট্রীয় পদক না পাওয়ার একটা অতৃপ্তি তার থাকতেই পারে। কারণ যারা রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন তারা সবাইই যে সাদির চেয়ে বেশি প্রতিভাবান বা জাতীয় পর্যায়ে তাদের সবার অবদান সাদির চেয়ে বেশি তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের গানের ভুবনে সাদির অবদান অপরিসীম, তার চেয়ে আরও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেও রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে, নানা পদকে ভূষিত করেছে।

স্বীকৃতি না পাওয়ার এই হতাশাকে গভীর করে তুলেছে চলতি বছরে সাদির ছোট ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদের একুশে পদকপ্রাপ্তি। ছোট ভাইয়ের কর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বড় ভাই সাদিকে আনন্দ দিলেও স্বীকৃতি প্রদানের অনুষ্ঠানে যেতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেননি। নিজের না পাওয়ার হতাশা লুকিয়ে ছোট ভাইকে বলেছেন ‘তুই পেলেই আমার পাওয়া হবে’। পদক পেতে নাকি সরকারের আপনজন হতে হয়, তদবিরের জোর থাকতে হয়। তাই বোধহয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শর্ষিণার পীর আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফরকে ১৯৮০ সালে ‘স্বাধীনতা’ পুরস্কার দেয়া হয়। একইভাবে দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত খন্দকার আব্দুল হামিদকেও ১৯৭৭ সালে সাংবাদিকতায় ‘একুশে পদক’ দেয়া হয়েছে।

এমন অনেকের গলাতেই ‘স্বাধীনতা’ পদক তুলে দেয়া হয়েছে যাদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো যোগ ছিল না। বিতর্ক আরও আছে, সব সরকারের আমলেই নিজের কাছের লোককে ‘একুশে’ এবং ‘স্বাধীনতা’ পদক তুলে দিয়ে ভাষা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা হয়েছে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় পদকের জন্য মনোনয়ন ও নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি যথাযথ বলে মনে হয় না; আবেদন করে পদক নেয়ার আগ্রহ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অনেকের থাকে না।

সাদির পরিবারে সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক খারাপ, তা কিন্তু বলা যাবে না। তাহলে সাদি কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না? স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তাদের পরিবারের অবদান কম ছিল না। সাদির বাবা ছিলেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিনেই শহীদ হন মহম্মদ সলিমুল্লাহ, কবর দেয়ার জন্য তার মৃতদেহটিও পাওয়া যায়নি। অবশ্য তার নামেই মোহাম্মদপুরে সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে সাদিদের বাড়িটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। সাদির বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শেখ কামাল। শেখ কামাল, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম জিকু, শাহজাহান সিরাজসহ বড় বড় নেতাদের প্রায়ই তাদের বাসায় আগমন হতো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আওয়ামী লীগের উল্লেখিত নেতারা সাদিদের বাসায় উপস্থিত হয়েছিলেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান সাদির বাবা মহম্মদ সলিমউল্লাহ, আর সেই পতাকা সাদির করা নক্সায় সেলাই করে দিয়েছিলেন সাদি মহাম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ। এতে প্রতিপন্ন হয়, মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারের অবদান রয়েছে এবং তারা বর্তমান সরকারের অপরিচিত কেউ নন।

গানের জগতে সাদি মহম্মদের যতটুকু অবদান রয়েছে তা দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হলে অন্তত কটু সমালোচনা হতো না, জনগণ খুশি হতো। পদক প্রদানে জীবিত মানুষের কর্ম জীবিত থাকাকালীন বিবেচনায় না এনে মৃত মানুষের কর্মহীন জীবনে কেন বিবেচিত হয় তা স্পষ্ট নয়। নোবেল পুরস্কার তাই কোন মৃত ব্যক্তিকে দেয়া হয় না। বাংলাদেশে অনেকেই একাধিক রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন, অনেকে বাংলা একাডেমি, একুশে পদক পাওয়ার পরও স্বাধীনতা পদক না পেয়ে মরতে চাননি। পেয়েছেনও।কিন্তু কেন? দেশে পদক পাওয়ার যোগ্য লোকের এত আকাল পড়ল কেন? মুক্তিযুদ্ধে কোটি কোটি লোকের অবদান রয়েছে, তাদের বিবেচনায় না নিয়ে একই ব্যক্তিকে সব পদকে ভূষিত করার এই মানসিকতা অবশ্যই পরিত্যজ্য, এতে প্রকাশ পায় জাতির দেউলিয়াত্ব।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাদির মৃত্যুর কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিমানজাত হতাশাকে উল্লেখ করায় অনেক শিল্পীর আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে; তারা বলতে চাচ্ছেন, প্রকৃত শিল্পী কখনও প্রাপ্তি, অর্জন, পদকের লোভে সাধনা করেন না। তারা আরও একটি কথা এখন উচ্চারণ করে যাচ্ছেন এবং তা হলো সাদির মৃত্যুর পর পদক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি সাদিকে ছোট করছে। আমরা আমজনতা তা মনে করি না। প্রায় সবাই সাদি মহম্মদের পক্ষে বলছেন, সাদি যে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য উপযুক্ত ছিলেন তা সবার লেখায় প্রতিফলিত হচ্ছে। যারা যথার্থ শিল্পী তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কোন করুণা নয়, কর্মের সম্মান। রাষ্ট্রকে ভুল শোধরানোর জন্য সবাইর আরও বেশি সোচ্চার হতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলেও মহান এই সংগীত সাধককে সশ্রদ্ধচিত্তে বিদায় জানিয়েছে কোটি কোটি ভক্ত। মরণোত্তর পদক দিয়ে তাকে আর যেন দ্বিতীয়বার অপমান না করা হয়। অগণিত মানুষের ভালোবাসা, দেশ-বিদেশে হাজার হাজার ভক্তের ভালোবাসায় শিল্পী সাদি মহম্মদ বেঁচে থাকবেন বহুকাল।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিল্পীর অভিমান, শিল্পীর আত্মহনন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

সাদি মহম্মদ

শনিবার, ২৩ মার্চ ২০২৪

আমি সংগীতশিল্পী নই, কিন্তু সংগীতপ্রেমী হিসেবে গান শুনতে ভালোবাসি। সংগীতপ্রেমী হলেও সব ধরনের গান ভালো লাগে না, বিশেষ করে ব্যান্ডের গান সচরাচর শুনি না। আমি শুনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি; শুনি অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, ডিএল রায়, পুরনো দিনের আধুনিক এবং মরমিগান। তবে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আকর্ষণ বেশি। রবি ঠাকুরের বাণী সব সময় বুঝি না, কিন্তু সুরের আবেশ আমাকে মোহিত করে। সবাই যে আমার মতো হবে তা কিন্তু নয়Ñ আমার ছেলে অর্ণব কোনো দিন রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি শুনেছে বলে মনে হয় না, মেয়ে ঐশী আমার অনুরোধে রবীন্দ্রসংগীতের অনুশীলন করে।

আমাদের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নিজামউদ্দিন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষের মতে রবি ঠাকুরের সব গানের সুর একরকম, লং প্লেয়ারে কখন যে গান থেকে গানের পরিবর্তন হয় তা তিনি ধরতে পারতেন না। অন্যদিকে আমার কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমদ শুধু রবীন্দ্রসংগীত শোনার জন্য আরও বেশি দিন বাঁচতে চেয়েছিলেন। আমি প্রায় প্রতিদিন ঢাকা থেকে গাজীপুর টাকশালে গিয়ে অফিস করতাম, পথিমধ্যে দশ বছর ধরে গাড়িতে বসে বসে গান শুনেছি, অধিকাংশ গান ছিল সাদি মহম্মদের কণ্ঠে। ডিএল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ এবং রজনীকান্ত সেনের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ এই দুটি গান সাদি মহম্মদের কণ্ঠে আমার কাছে অতুলনীয় মনে হতো।

সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহ ছিলেন মূলত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। বুধবার ১৩ মার্চ, ২০২৪; সন্ধ্যায় তাদের নিজ বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় শিল্পী সাদি মহম্মদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর দিন তিনি রোজা রাখেন, ইফতারও করেন; এরপরই তিনি স্বেচ্ছায় না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। তাদের ঘনিষ্ঠতম স্বজন নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপার কথা অনুযায়ী গত বছর তার পঙ্গু মা মারা যাওয়ার পর সাদি মহম্মদ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন, মার মৃত্যুতে তার মধ্যে হতাশা ভর করে। কারণ বাবার মৃত্যুর পর এই মা কাপড় সেলাইয়ের আয় দিয়ে ১০টি সন্তানের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন।

মাকে হারিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে সংগ্রাম করে ক্লান্ত হয়ে হয়তো তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যু আত্মহননের একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। অনেকের অভিমত, সাদির অনেক আগেই পাগল হয়ে যাওয়া কথা। সাদি কেন এতদিনেও পাগল হননিÑ প্রায়ই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে সাদিকেও। এবার সেই ঘটনায় আসি। সাদির বাবা মহম্মদ সলিমুল্লাহ ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ধার্মিক, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তিনি মসজিদে আদায় করতেন। মসজিদে নামাজ পড়ার জন্যই তিনি মসজিদের পাশে বাড়ি নির্মাণ করেন।

২৬ মার্চ, ১৯৭১, শুক্রবার; জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেন মহম্মদ সলিমুল্লাহ। সাদিদের পাশের অবাঙালি বাড়ি থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। নামাজ শেষে অবাঙালি বিহারিরা এই মর্মে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিতে থাকে যে, সলিমুল্লাহদের বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে গুলি করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে বিহারিরা মহম্মদ সলিমুল্লাহর বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, সাদিদের পরিবারের সদস্যরা পাশের বাসার ছাদে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন, সাদির মার দুই পা ভেঙে যায়, ৯৬ বছর বয়সে তিনি গত বছর মৃত্যুবরণ করেন। আমৃত্যু তিনি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেছেন। সাদি এবং তার বাবা পাশের খালি বাসার আশ্রয় নেন। তাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান এয়ারফোর্সের এক পাঞ্জাবি অফিসার ঘরে ঢুকে সাদির বাবাকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে ছুরি তুলে নেয়।

সলিমুল্লাহ সাহেব আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, সাদি তার ছোট হাত দিয়ে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত চেপে ধরেন, বাবা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুই পালা’। পালানোর সময় সাদি পথিমধ্যে চাচাকে বল্লম দিয়ে হত্যা করতে দেখেন, দেখেন খালাতো ভাইকে মাটিতে শুইয়ে গরুর মতো জবাই করার দৃশ্য। এছাড়া পালানোর পথে বিহারিদের হত্যাযজ্ঞে অনেক নিরীহ মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। এতগুলো মর্মন্তুদ দৃশ্য দেখার পরও সাদি কেন পাগল হননি, সেই প্রশ্ন জাগারই কথা।

সাদি পাগল না হলেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন বলে মনে হয় না। সাদি মহম্মদের জন্ম ১৯৫৭ সালে। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু বুয়েটে লেখাপড়া শেষ না করেই তিনি ১৯৭৫ সালে চলে যান ভারতের শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেখানে তিনি শান্তিদেব ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখেন। তার ষাটটিরও বেশি গানের অ্যালবাম রয়েছে। সাদি মহম্মদ ছিলেন একাধারে শিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার।

গানের জগতে এমন প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদকের জন্য বিবেচিত হননি। রাষ্ট্রীয় পদক না পাওয়ার একটা অতৃপ্তি তার থাকতেই পারে। কারণ যারা রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন তারা সবাইই যে সাদির চেয়ে বেশি প্রতিভাবান বা জাতীয় পর্যায়ে তাদের সবার অবদান সাদির চেয়ে বেশি তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের গানের ভুবনে সাদির অবদান অপরিসীম, তার চেয়ে আরও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেও রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে, নানা পদকে ভূষিত করেছে।

স্বীকৃতি না পাওয়ার এই হতাশাকে গভীর করে তুলেছে চলতি বছরে সাদির ছোট ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদের একুশে পদকপ্রাপ্তি। ছোট ভাইয়ের কর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বড় ভাই সাদিকে আনন্দ দিলেও স্বীকৃতি প্রদানের অনুষ্ঠানে যেতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেননি। নিজের না পাওয়ার হতাশা লুকিয়ে ছোট ভাইকে বলেছেন ‘তুই পেলেই আমার পাওয়া হবে’। পদক পেতে নাকি সরকারের আপনজন হতে হয়, তদবিরের জোর থাকতে হয়। তাই বোধহয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শর্ষিণার পীর আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফরকে ১৯৮০ সালে ‘স্বাধীনতা’ পুরস্কার দেয়া হয়। একইভাবে দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত খন্দকার আব্দুল হামিদকেও ১৯৭৭ সালে সাংবাদিকতায় ‘একুশে পদক’ দেয়া হয়েছে।

এমন অনেকের গলাতেই ‘স্বাধীনতা’ পদক তুলে দেয়া হয়েছে যাদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো যোগ ছিল না। বিতর্ক আরও আছে, সব সরকারের আমলেই নিজের কাছের লোককে ‘একুশে’ এবং ‘স্বাধীনতা’ পদক তুলে দিয়ে ভাষা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা হয়েছে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় পদকের জন্য মনোনয়ন ও নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি যথাযথ বলে মনে হয় না; আবেদন করে পদক নেয়ার আগ্রহ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অনেকের থাকে না।

সাদির পরিবারে সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক খারাপ, তা কিন্তু বলা যাবে না। তাহলে সাদি কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না? স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তাদের পরিবারের অবদান কম ছিল না। সাদির বাবা ছিলেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিনেই শহীদ হন মহম্মদ সলিমুল্লাহ, কবর দেয়ার জন্য তার মৃতদেহটিও পাওয়া যায়নি। অবশ্য তার নামেই মোহাম্মদপুরে সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে সাদিদের বাড়িটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। সাদির বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শেখ কামাল। শেখ কামাল, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম জিকু, শাহজাহান সিরাজসহ বড় বড় নেতাদের প্রায়ই তাদের বাসায় আগমন হতো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আওয়ামী লীগের উল্লেখিত নেতারা সাদিদের বাসায় উপস্থিত হয়েছিলেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান সাদির বাবা মহম্মদ সলিমউল্লাহ, আর সেই পতাকা সাদির করা নক্সায় সেলাই করে দিয়েছিলেন সাদি মহাম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ। এতে প্রতিপন্ন হয়, মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারের অবদান রয়েছে এবং তারা বর্তমান সরকারের অপরিচিত কেউ নন।

গানের জগতে সাদি মহম্মদের যতটুকু অবদান রয়েছে তা দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হলে অন্তত কটু সমালোচনা হতো না, জনগণ খুশি হতো। পদক প্রদানে জীবিত মানুষের কর্ম জীবিত থাকাকালীন বিবেচনায় না এনে মৃত মানুষের কর্মহীন জীবনে কেন বিবেচিত হয় তা স্পষ্ট নয়। নোবেল পুরস্কার তাই কোন মৃত ব্যক্তিকে দেয়া হয় না। বাংলাদেশে অনেকেই একাধিক রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন, অনেকে বাংলা একাডেমি, একুশে পদক পাওয়ার পরও স্বাধীনতা পদক না পেয়ে মরতে চাননি। পেয়েছেনও।কিন্তু কেন? দেশে পদক পাওয়ার যোগ্য লোকের এত আকাল পড়ল কেন? মুক্তিযুদ্ধে কোটি কোটি লোকের অবদান রয়েছে, তাদের বিবেচনায় না নিয়ে একই ব্যক্তিকে সব পদকে ভূষিত করার এই মানসিকতা অবশ্যই পরিত্যজ্য, এতে প্রকাশ পায় জাতির দেউলিয়াত্ব।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাদির মৃত্যুর কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিমানজাত হতাশাকে উল্লেখ করায় অনেক শিল্পীর আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে; তারা বলতে চাচ্ছেন, প্রকৃত শিল্পী কখনও প্রাপ্তি, অর্জন, পদকের লোভে সাধনা করেন না। তারা আরও একটি কথা এখন উচ্চারণ করে যাচ্ছেন এবং তা হলো সাদির মৃত্যুর পর পদক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি সাদিকে ছোট করছে। আমরা আমজনতা তা মনে করি না। প্রায় সবাই সাদি মহম্মদের পক্ষে বলছেন, সাদি যে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য উপযুক্ত ছিলেন তা সবার লেখায় প্রতিফলিত হচ্ছে। যারা যথার্থ শিল্পী তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কোন করুণা নয়, কর্মের সম্মান। রাষ্ট্রকে ভুল শোধরানোর জন্য সবাইর আরও বেশি সোচ্চার হতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলেও মহান এই সংগীত সাধককে সশ্রদ্ধচিত্তে বিদায় জানিয়েছে কোটি কোটি ভক্ত। মরণোত্তর পদক দিয়ে তাকে আর যেন দ্বিতীয়বার অপমান না করা হয়। অগণিত মানুষের ভালোবাসা, দেশ-বিদেশে হাজার হাজার ভক্তের ভালোবাসায় শিল্পী সাদি মহম্মদ বেঁচে থাকবেন বহুকাল।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন]

back to top