মাহতাব হোসাইন মাজেদ
যক্ষ্মা সাধারণত টিবি নামে পরিচিত একটি গুরুতর ফুসফুসের রোগ। যক্ষ্মা একটি প্রাচীন রোগ। এটি মারাত্মক রোগ হিসেবে পরিচিত সম্ভবত প্রস্তরযুগ থেকে। মিসরে তিন হাজার বছরের পুরনো মমির ফুসফুসে যক্ষ্মার ক্ষত পাওয়া গেছে। গ্রিক স্বর্ণযুগে যক্ষ্মা নামে পরিচিত ছিল। সাধারণভাবে একে ‘ক্ষয়রোগ’ বলা হতো।
আজ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। যক্ষ্মা রোগের ক্ষতিকর দিক বিশেষ করে স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই রোগটি নির্মূলে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সিসকাস সিলভিয়াস নামে নেদারল্যান্ডসের লিডেনবাসী এক ব্যক্তি মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ফুসফুসে গোটা আকৃতির ক্ষত দেখতে পেয়ে এর নাম দেন টিউবারসেল। জোহান শনলেইন ১৮৩৯ সালে এই রোগের নাম দেন টিউবারকুলোসিস।
যক্ষ্মার সঠিক চিকিৎসা না করালে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা শুরু করা হলে রোগীর কাছ থেকে খুব বেশিদিন যক্ষ্মা ছড়ায় না এবং সঠিক চিকিৎসায় সাফল্য প্রায় শতভাগ, কিন্তু কখনো কখনো টিবি ভালো হয়ে আবার আক্রমণ করতে পারে কিংবা মৃত্যু ঘটাতে পারে।
ড. রবার্ট কচ ১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ জার্মানির বার্লিনে যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার করেন। এর পরই বিসিজি টিকা, টিউবারকুলিন টেস্ট, নানা প্রকার ওষুধ, ‘ডটস পদ্ধতি’ ইত্যাদি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ড. রবার্ট কচের যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কারকে কেন্দ্র করেই প্রতি বছর ২৪ মার্চ ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
আর এটি একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ যা হাঁচি এবং কাশির মাধ্যমে সংক্রমিত ফোঁটাগুলোর মাধ্যমে একজন সংক্রামক ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
এই রোগটি একসময় খুব বিরল ছিল কিন্তু এটি ১৯৮৫ সালে এইচআইভি এইডস মামলার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে শুরু করে (এটি একটি প্রধান কারণ ছিল কারণ সংক্রমিত ব্যক্তি ইমিউনোকম্প্রোমাইজড হয়ে যায় যা টিবি-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে শরীরের লড়াই করার ক্ষমতা হ্রাস করে)।
যক্ষ্মা একটি প্রচলিত বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা রয়ে গেছে, যা বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আরও সাধারণ যেখানে স্বাস্থ্যসেবার সীমিত অ্যাক্সেস এবং দরিদ্র জীবনযাত্রার অবস্থা। যাইহোক, এটি উন্নত দেশগুলোতেও বিদ্যমান, যদিও কম হারে। অবশ্যই! এখানে যক্ষ্মা (টিবি) রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতির একটি বিশদ বিভাজন রয়েছে।
আমাদের দেহের টিবি-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে রক্ষা করার ক্ষমতা রয়েছে। আমাদের দেহের একটি ইমিউন সিস্টেম রয়েছে যা তাদের শনাক্ত করতে পারে এবং অসুস্থতা ধরা থেকে আমাদের প্রতিরোধ করতে পারে। এভাবে ডাক্তাররা যক্ষ্মা রোগের লক্ষণগুলোর ওপর নির্ভর করে টিবিকে দুটি ভাগে শ্রেণীবদ্ধ করেছেনÑ
সুপ্ত যক্ষ্মা : এই ক্ষেত্রে, ব্যক্তি টিবিতে আক্রান্ত হলেও তার কোনো উপসর্গ নেই। এই রূপটি টিবি সংক্রমণ বা নিষ্ক্রিয় টিবি নামেও পরিচিত। এটি প্রকৃতির দ্বারা সংক্রামক নয় তবে এর চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি পরবর্তী পর্যায়ে সক্রিয় টিবিতে রূপান্তরিত হতে পারে।
সক্রিয় যক্ষ্মা : এই বৈকল্পিক লাখণগুলো দেখায় এবং আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। এটি টিবি রোগ নামেও পরিচিত। এটি বাতাসের ফোঁটার মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি কয়েক সপ্তাহ পরে এবং এমনকি কয়েক বছর পরেও ব্যক্তি টিবি-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরেও হতে পারে!
আমরা প্রায়শই বুঝতে পারি না যে আমরা যখনই কথা বলি, কাশি বা হাঁচি করি তখন আমরা বাতাসে মাইক্রো ফোঁটা ছেড়ে দিই। এই মাইক্রোড্রপলেটগুলো টিবি-সৃষ্টিকারী জীবাণুর বাহক হয়ে ওঠে। সক্রিয় যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তি যখন হাসে, কথা বলে, গান গায়, কাশি বা হাঁচি দেয়, তখন সে বাতাসে মাইক্রোড্রপলেটের সঙ্গে টিবি-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ছেড়ে দেয়।
মেডিকেল ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষা : স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা আপনার চিকিৎসা ইতিহাস, উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করে এবং টিবি সংক্রমণের লক্ষণ যেমন লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া বা ফুসফুসে অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ চেক করার জন্য একটি শারীরিক পরীক্ষা করা শুরু করে।
দুর্বল ইমিউন সিস্টেম (এইচআইভি/এইডস বা অন্যান্য অবস্থার কারণে), জনাকীর্ণ পরিবেশে বসবাস বা কাজ করা, পদার্থের অপব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসেবার অপর্যাপ্ত অ্যাক্সেসসহ বেশ কয়েকটি কারণ টিবির ঝুঁকি বাড়ায়।
যক্ষ্মার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি : এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তি, ধূমপায়ী, ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত ব্যক্তি, মাদকসেবী ও ঘন ঘন বিদেশ গমনকারী ব্যক্তি। দেখা গেছে, আফ্রিকা বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকা, আফগানিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর আমেরিকা, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের যক্ষ্মা হওয়ার প্রকোপ বেশি।
একসময় প্রবাদ ছিল ‘যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা’। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নয়ন সাধন, বিশেষ করে দেশে বর্তমান সরকারের নেয়া জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বা এনটিপির কারণে এখন যক্ষ্মা নিয়ে আর কোনো ভয় নেই। বর্তমানে দেশের প্রায় সব জায়গায় বিনামূল্যে যক্ষ্মার চিকিৎসাব্যবস্থা করেছে সরকার। উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, পোশাককর্মীদের চিকিৎসা কেন্দ্র, তাছাড়া ব্র্যাক থেকে বিনামূল্যে যক্ষ্মার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিবি প্রোগ্রামের আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে যক্ষ্মার কারণে ৯০ শতাংশ মৃত্যুহার ও ৮০ শতাংশ প্রকোপ কমিয়ে আনার জন্য বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার সাহায্য ছাড়াও দেশজুড়ে বিনামূল্যে যক্ষ্মারোগ নির্ণয়, রোগী শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদানের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অঙ্গসংগঠন, মেডিকেল কলেজ, গ্রাম, উপজেলা, থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্র কাজ করে আসছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আস্তে আস্তে টিবি বা যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে, যা প্রশংসনীয়। উপমহাদেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম যা এমডিআর যক্ষ্মার দ্রুত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ সাফল্য লাভ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে, আশা করা যায় একসময় যক্ষ্মামুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে বাংলাদেশ।
তারপরও আমাদের দেশে যক্ষ্মা এখনো একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। এতে শুধু যে নিম্ন আয়ের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে তা নয়, বরং এই রোগ যে কারোরই হতে পারে। সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসাই যক্ষ্মা থেকে রক্ষা করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ছয় হাজার যক্ষ্মারোগী মারা যাচ্ছে। সারা বিশ্বে এ সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকিউলোসিস বা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা। অনিয়মিত ওষুধ সেবন, পুরো ওষুধ সেবন না করার কারণে এ রোগের ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই উপসর্গের উন্নতি ঘটলেও নির্দেশিত ওষুধের সম্পূর্ণ কোর্সটি সম্পূর্ণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অসম্পূর্ণ চিকিৎসা ওষুধ-প্রতিরোধী টিবি হতে পারে, এটি চিকিৎসা করা আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।
টিবি নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা এবং ওষুধের সঙ্গে জড়িত একটি ব্যাপক পদ্ধতির প্রয়োজন। সফল চিকিৎসার ফলাফলের জন্য এবং রোগের বিস্তার রোধ করার জন্য সময়মতো রোগ নির্ণয়, সঠিক ওষুধের আনুগত্য এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্ভুল রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার কৌশলের জন্য সর্বদা স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের কাছ থেকে নির্দেশনা নিন। তাই যক্ষ্মা সঠিক ওষুধ এবং সতর্কতার মাধ্যমে পরিচালনা করা যেতে পারে। সুরক্ষা নির্দেশিকা অনুসরণ করা এবং রোগ ছড়ানো এড়াতে বুদ্ধিমানের কাজ।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রোববার, ২৪ মার্চ ২০২৪
যক্ষ্মা সাধারণত টিবি নামে পরিচিত একটি গুরুতর ফুসফুসের রোগ। যক্ষ্মা একটি প্রাচীন রোগ। এটি মারাত্মক রোগ হিসেবে পরিচিত সম্ভবত প্রস্তরযুগ থেকে। মিসরে তিন হাজার বছরের পুরনো মমির ফুসফুসে যক্ষ্মার ক্ষত পাওয়া গেছে। গ্রিক স্বর্ণযুগে যক্ষ্মা নামে পরিচিত ছিল। সাধারণভাবে একে ‘ক্ষয়রোগ’ বলা হতো।
আজ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। যক্ষ্মা রোগের ক্ষতিকর দিক বিশেষ করে স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই রোগটি নির্মূলে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সিসকাস সিলভিয়াস নামে নেদারল্যান্ডসের লিডেনবাসী এক ব্যক্তি মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ফুসফুসে গোটা আকৃতির ক্ষত দেখতে পেয়ে এর নাম দেন টিউবারসেল। জোহান শনলেইন ১৮৩৯ সালে এই রোগের নাম দেন টিউবারকুলোসিস।
যক্ষ্মার সঠিক চিকিৎসা না করালে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা শুরু করা হলে রোগীর কাছ থেকে খুব বেশিদিন যক্ষ্মা ছড়ায় না এবং সঠিক চিকিৎসায় সাফল্য প্রায় শতভাগ, কিন্তু কখনো কখনো টিবি ভালো হয়ে আবার আক্রমণ করতে পারে কিংবা মৃত্যু ঘটাতে পারে।
ড. রবার্ট কচ ১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ জার্মানির বার্লিনে যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার করেন। এর পরই বিসিজি টিকা, টিউবারকুলিন টেস্ট, নানা প্রকার ওষুধ, ‘ডটস পদ্ধতি’ ইত্যাদি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ড. রবার্ট কচের যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কারকে কেন্দ্র করেই প্রতি বছর ২৪ মার্চ ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
আর এটি একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ যা হাঁচি এবং কাশির মাধ্যমে সংক্রমিত ফোঁটাগুলোর মাধ্যমে একজন সংক্রামক ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
এই রোগটি একসময় খুব বিরল ছিল কিন্তু এটি ১৯৮৫ সালে এইচআইভি এইডস মামলার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে শুরু করে (এটি একটি প্রধান কারণ ছিল কারণ সংক্রমিত ব্যক্তি ইমিউনোকম্প্রোমাইজড হয়ে যায় যা টিবি-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে শরীরের লড়াই করার ক্ষমতা হ্রাস করে)।
যক্ষ্মা একটি প্রচলিত বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা রয়ে গেছে, যা বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আরও সাধারণ যেখানে স্বাস্থ্যসেবার সীমিত অ্যাক্সেস এবং দরিদ্র জীবনযাত্রার অবস্থা। যাইহোক, এটি উন্নত দেশগুলোতেও বিদ্যমান, যদিও কম হারে। অবশ্যই! এখানে যক্ষ্মা (টিবি) রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতির একটি বিশদ বিভাজন রয়েছে।
আমাদের দেহের টিবি-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে রক্ষা করার ক্ষমতা রয়েছে। আমাদের দেহের একটি ইমিউন সিস্টেম রয়েছে যা তাদের শনাক্ত করতে পারে এবং অসুস্থতা ধরা থেকে আমাদের প্রতিরোধ করতে পারে। এভাবে ডাক্তাররা যক্ষ্মা রোগের লক্ষণগুলোর ওপর নির্ভর করে টিবিকে দুটি ভাগে শ্রেণীবদ্ধ করেছেনÑ
সুপ্ত যক্ষ্মা : এই ক্ষেত্রে, ব্যক্তি টিবিতে আক্রান্ত হলেও তার কোনো উপসর্গ নেই। এই রূপটি টিবি সংক্রমণ বা নিষ্ক্রিয় টিবি নামেও পরিচিত। এটি প্রকৃতির দ্বারা সংক্রামক নয় তবে এর চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি পরবর্তী পর্যায়ে সক্রিয় টিবিতে রূপান্তরিত হতে পারে।
সক্রিয় যক্ষ্মা : এই বৈকল্পিক লাখণগুলো দেখায় এবং আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। এটি টিবি রোগ নামেও পরিচিত। এটি বাতাসের ফোঁটার মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি কয়েক সপ্তাহ পরে এবং এমনকি কয়েক বছর পরেও ব্যক্তি টিবি-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরেও হতে পারে!
আমরা প্রায়শই বুঝতে পারি না যে আমরা যখনই কথা বলি, কাশি বা হাঁচি করি তখন আমরা বাতাসে মাইক্রো ফোঁটা ছেড়ে দিই। এই মাইক্রোড্রপলেটগুলো টিবি-সৃষ্টিকারী জীবাণুর বাহক হয়ে ওঠে। সক্রিয় যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তি যখন হাসে, কথা বলে, গান গায়, কাশি বা হাঁচি দেয়, তখন সে বাতাসে মাইক্রোড্রপলেটের সঙ্গে টিবি-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ছেড়ে দেয়।
মেডিকেল ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষা : স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা আপনার চিকিৎসা ইতিহাস, উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করে এবং টিবি সংক্রমণের লক্ষণ যেমন লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া বা ফুসফুসে অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ চেক করার জন্য একটি শারীরিক পরীক্ষা করা শুরু করে।
দুর্বল ইমিউন সিস্টেম (এইচআইভি/এইডস বা অন্যান্য অবস্থার কারণে), জনাকীর্ণ পরিবেশে বসবাস বা কাজ করা, পদার্থের অপব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসেবার অপর্যাপ্ত অ্যাক্সেসসহ বেশ কয়েকটি কারণ টিবির ঝুঁকি বাড়ায়।
যক্ষ্মার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি : এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তি, ধূমপায়ী, ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত ব্যক্তি, মাদকসেবী ও ঘন ঘন বিদেশ গমনকারী ব্যক্তি। দেখা গেছে, আফ্রিকা বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকা, আফগানিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর আমেরিকা, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের যক্ষ্মা হওয়ার প্রকোপ বেশি।
একসময় প্রবাদ ছিল ‘যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা’। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নয়ন সাধন, বিশেষ করে দেশে বর্তমান সরকারের নেয়া জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বা এনটিপির কারণে এখন যক্ষ্মা নিয়ে আর কোনো ভয় নেই। বর্তমানে দেশের প্রায় সব জায়গায় বিনামূল্যে যক্ষ্মার চিকিৎসাব্যবস্থা করেছে সরকার। উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, পোশাককর্মীদের চিকিৎসা কেন্দ্র, তাছাড়া ব্র্যাক থেকে বিনামূল্যে যক্ষ্মার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিবি প্রোগ্রামের আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে যক্ষ্মার কারণে ৯০ শতাংশ মৃত্যুহার ও ৮০ শতাংশ প্রকোপ কমিয়ে আনার জন্য বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার সাহায্য ছাড়াও দেশজুড়ে বিনামূল্যে যক্ষ্মারোগ নির্ণয়, রোগী শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদানের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অঙ্গসংগঠন, মেডিকেল কলেজ, গ্রাম, উপজেলা, থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্র কাজ করে আসছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আস্তে আস্তে টিবি বা যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে, যা প্রশংসনীয়। উপমহাদেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম যা এমডিআর যক্ষ্মার দ্রুত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ সাফল্য লাভ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে, আশা করা যায় একসময় যক্ষ্মামুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে বাংলাদেশ।
তারপরও আমাদের দেশে যক্ষ্মা এখনো একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। এতে শুধু যে নিম্ন আয়ের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে তা নয়, বরং এই রোগ যে কারোরই হতে পারে। সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসাই যক্ষ্মা থেকে রক্ষা করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ছয় হাজার যক্ষ্মারোগী মারা যাচ্ছে। সারা বিশ্বে এ সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকিউলোসিস বা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা। অনিয়মিত ওষুধ সেবন, পুরো ওষুধ সেবন না করার কারণে এ রোগের ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই উপসর্গের উন্নতি ঘটলেও নির্দেশিত ওষুধের সম্পূর্ণ কোর্সটি সম্পূর্ণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অসম্পূর্ণ চিকিৎসা ওষুধ-প্রতিরোধী টিবি হতে পারে, এটি চিকিৎসা করা আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।
টিবি নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা এবং ওষুধের সঙ্গে জড়িত একটি ব্যাপক পদ্ধতির প্রয়োজন। সফল চিকিৎসার ফলাফলের জন্য এবং রোগের বিস্তার রোধ করার জন্য সময়মতো রোগ নির্ণয়, সঠিক ওষুধের আনুগত্য এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্ভুল রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার কৌশলের জন্য সর্বদা স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের কাছ থেকে নির্দেশনা নিন। তাই যক্ষ্মা সঠিক ওষুধ এবং সতর্কতার মাধ্যমে পরিচালনা করা যেতে পারে। সুরক্ষা নির্দেশিকা অনুসরণ করা এবং রোগ ছড়ানো এড়াতে বুদ্ধিমানের কাজ।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]