alt

উপ-সম্পাদকীয়

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের সালতামামি

শেখর ভট্টাচার্য

: মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪
image

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি চরিত্র অন্বেষণের জন্য এখন আর মিথ কিংবা তার সমসাময়িক মানুষের ধার ধারতে হয় না। এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু রচিত তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা‘ এবং ‘আমার দেখা নয়া চীন’। এখন আর অন্য কারো বক্তব্য বা লেখা থেকে সাহায্য নেয়ার দরকার নেই, শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখা থেকেই জানা যায় সমাজের অসহায়-বঞ্চিত মানুষদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কতো গভীর ছিলো। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি চরিত্রের অনিন্দ্য সুন্দর অলি গলি এখন তার এই তিনটি বই থেকে অনেকটাই জানা সম্ভব। এছাড়াও সম্প্রতি তাকে নিয়ে প্রকাশিত গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো থেকে তার দেশপ্রেম, দেশের প্রতি নিবেদনের অনেক কথা আমরা সহজেই জানতে পারি। কী আশ্চর্য! একজন মানুষের ব্যক্তি চরিত্রের অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছিলো গোয়েন্দাদেরও। যারা কিনা তার জীবনকে বিষিয়ে তোলার জন্য সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় মানবিক হৃদয়ের অপূর্ব দৃষ্টান্ত গোয়েন্দারাও এড়িয়ে যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের নৈতিক গুণের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা উপচে পড়ে যখন দেখা যায় তার বিরুদ্ধপক্ষও (গোয়েন্দারা) তার জীবনের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে যায়।

প্রান্তিক মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার ছাপ খুঁজে পাই তার লেখা তিনটি গ্রন্থ থেকে। বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণার সময়ের ঘটনাটি বারবার বলতে ইচ্ছে করে। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য কয়েক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে ধরে নিজের কুঁড়েঘরে নিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছেন, বলেছেন, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছু নেই।’

এ ঘটনা তার মনে দীর্ঘস্থায়ী দাগ ফেলে যায়। মানুষের ভালোবাসা বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের ভালোবাসাকে জীবনভর তিনি শ্রদ্ধায় গ্রহণ করে গেছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২৫৬ পৃষ্ঠায় তিনি সেই দিনের অনুভূতি তুলে ধরেছেন (২৫৬ পৃষ্ঠায়) এভাবেÑ‘নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি। তিনি বাংলার মানুষকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন সেটি তার প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। একবার এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ডযধঃ রং ুড়ঁৎ য়ঁধষরভরপধঃরড়হ? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ও ষড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব. ওই সাংবাদিক সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, ডযধঃ রং ুড়ঁৎ ফরংয়ঁধষরভরপধঃরড়হ? বঙ্গবন্ধু শান্তকণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন- ও ষড়াব ঃযবস ঃড়ড় সঁপয.

মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমরা দেখতে পাই তার শৈশব জীবন থেকে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানি, স্কুলে পড়ার সময় তিনি কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টারের সঙ্গে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠনে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রত্যেক রবিবার থলি হাতে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠাতেন। সেই চাল বিক্রি করে গরিব ছাত্রদের বই-খাতা কেনা, লেখাপড়ার খরচ চলত। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে হামিদ মাস্টার মারা গেলে এই সেবা সমিতির ভার তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। ছোটবেলায় তার গভীর মানবিক হৃদয়ের আরেকটি ঘটনা আমাদের অবাক করে। একবার তার গ্রামের চাষিদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষকদের জীবনে নেমে আসে অভাব-অনটন। অনেক বাড়িতেই দুবেলা ভাত রান্না বন্ধ হয়ে যায়। চাষিদের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা। তাদের সন্তানেরা অভুক্ত। সারা গ্রামেই প্রায়-দুর্ভিক্ষাবস্থা নিয়ে চাপা গুঞ্জন। কিশোর মুজিব এরকম পরিস্থিতিতে দুঃখ-ভারাক্রান্ত; কিন্তু কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একটা কিছু করার জন্য তিনি ছটফট করছিলেন। সেই সময় যে পথটি তার সামনে খোলা ছিল, তিনি তাই করলেন। নিজের পিতাকে তিনি তাদের গোলা থেকে বিপন্ন কৃষকদের মধ্যে ধান বিতরণের জন্য অনুরোধ জানালেন। তাদের নিজেদের ধানের মজুত কেমন- এই অনুরোধ তার বাবা রাখতে পারবেন কিনা, সেসব তিনি ভাবেননি। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার চিন্তাটিই ছিল তখন তার কাছে মুখ্য। সারাজীবন ধরেই তিনি এই প্রান্তঃজনের স্বপক্ষে লড়েছেন। অভাজনেরাই ছিল তার চিরকালের সুখ-দুঃখের সাথি। প্রাণের তাগিদেই তিনি তাদের সাথে মিশতেন। এই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা যখন ইতিহাসের দফার ভেতরে বঙ্গবন্ধুকে অন্বেষণ করি তখন ব্যক্তিজীবনের মহত্ত্বকে পাশ কেটে যাই।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অকপটে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেয়ার কারণ। তিনি লিখেছেন- পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এই ভেবে যে এই নতুন রাষ্ট্রে দরিদ্র মুসলমান ও কৃষক জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবেন। আমরা দেখতে পাই, ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনদের উদ্ধার করেছেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সময়পোযোগী। সেই কবে ৬৬-তে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা... গেয়ে হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন। সেই সম্মেলনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ২০ মার্চ পল্টন ময়দানের বক্তৃতায় বলেছিলেনÑ ‘৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে অনেকের কাছে গিয়েছি, কেউ আমাকে সমর্থন করে নাই।’ কবিগুরুর গান থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...।’ আরও বলেছিলেন- ‘আমার দলের নেতাকর্মীরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তবে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছবই।’

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট। উদেশ্য ছিল প্রাথমিকভাবে বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি তৈরি করা। জীবদ্দশায় তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সংঘবদ্ধ করার মাধ্যমে বাঙালিদের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মনে রাখতে হবেÑ হাজার বছর ধরে বাঙালিদের স্বপ্ন দেখার সীমানা ছিল ভাষা, সংস্কৃতিকে স্বাধীনভাবে চর্চা করা। আমরা বাংলার আদি যুগ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাঙালি শাসক, কবি, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নেতাকর্মীদের কাছ থেকে স্বাধীন সার্বভৌম স্বভূমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন কিংবা পরিকল্পনার কথা শুনতে পাইনি। যে মানুষটি সাতচল্লিশোত্তর পাকিস্তানে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই প্রথম বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্ন তুলেছিলেন। স্বাধিকার ছিল স্বাধীনতার প্রথম ধাপ সেটি তিনি খুব ভালো করতেন জানতেন। এ কারণেই তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক। এ’কথাটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের দোর্দ- প্রতাপশালী সামরিক শাসক আইয়ুব খান। ৬ দফার পথ ধরেই এসেছিলো ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। সত্তরের নির্বাচন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন ছিল সর্বশেষ ধাপ। তবে এখানে একটি বিষয় স্মরণ করা উচিত তাহলো- ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যে অংশটি আমরা বারবার উচ্চারণ করে থাকি তাহলোÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ প্রশ্ন হলো স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি কিন্তু মুক্তির সংগ্রামে কতটুকু এগিয়ে যেতে পেরেছি। স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পরের সালতামামি যদি আমরা করতে না পারি তাহলে জাতির প্রতি, শহীদের প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হবো আমরা। একাত্তরেরর সংঘবদ্ধ জাতির প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না।

একাত্তরে আমার কেমন দেশ চেয়েছিলাম? এর প্রথম উত্তর হলো শোষিত মানুষের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর দেয়া নানা বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেও এর সহজ উত্তর পাওয়া যায়। স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে তিনি বলেছিলেনÑ ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’

বঙ্গবন্ধু তার সমস্ত রাজনৈতিক জীবনে প্রান্তজনের সখা ছিলেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করে আমরা হীরকজয়ন্তীর পথে এগিয়ে যাচ্ছি, ৬ দফার মূল কথা ছিল জাতির মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করা। স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার হওয়া উচিত সমদৃষ্টির, সমউন্নয়নের, সমতার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। পারব কি আমরা?

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের সালতামামি

শেখর ভট্টাচার্য

image

মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি চরিত্র অন্বেষণের জন্য এখন আর মিথ কিংবা তার সমসাময়িক মানুষের ধার ধারতে হয় না। এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু রচিত তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা‘ এবং ‘আমার দেখা নয়া চীন’। এখন আর অন্য কারো বক্তব্য বা লেখা থেকে সাহায্য নেয়ার দরকার নেই, শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখা থেকেই জানা যায় সমাজের অসহায়-বঞ্চিত মানুষদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কতো গভীর ছিলো। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি চরিত্রের অনিন্দ্য সুন্দর অলি গলি এখন তার এই তিনটি বই থেকে অনেকটাই জানা সম্ভব। এছাড়াও সম্প্রতি তাকে নিয়ে প্রকাশিত গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো থেকে তার দেশপ্রেম, দেশের প্রতি নিবেদনের অনেক কথা আমরা সহজেই জানতে পারি। কী আশ্চর্য! একজন মানুষের ব্যক্তি চরিত্রের অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছিলো গোয়েন্দাদেরও। যারা কিনা তার জীবনকে বিষিয়ে তোলার জন্য সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় মানবিক হৃদয়ের অপূর্ব দৃষ্টান্ত গোয়েন্দারাও এড়িয়ে যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের নৈতিক গুণের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা উপচে পড়ে যখন দেখা যায় তার বিরুদ্ধপক্ষও (গোয়েন্দারা) তার জীবনের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে যায়।

প্রান্তিক মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার ছাপ খুঁজে পাই তার লেখা তিনটি গ্রন্থ থেকে। বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণার সময়ের ঘটনাটি বারবার বলতে ইচ্ছে করে। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য কয়েক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে ধরে নিজের কুঁড়েঘরে নিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছেন, বলেছেন, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছু নেই।’

এ ঘটনা তার মনে দীর্ঘস্থায়ী দাগ ফেলে যায়। মানুষের ভালোবাসা বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের ভালোবাসাকে জীবনভর তিনি শ্রদ্ধায় গ্রহণ করে গেছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২৫৬ পৃষ্ঠায় তিনি সেই দিনের অনুভূতি তুলে ধরেছেন (২৫৬ পৃষ্ঠায়) এভাবেÑ‘নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি। তিনি বাংলার মানুষকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন সেটি তার প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। একবার এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ডযধঃ রং ুড়ঁৎ য়ঁধষরভরপধঃরড়হ? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ও ষড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব. ওই সাংবাদিক সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, ডযধঃ রং ুড়ঁৎ ফরংয়ঁধষরভরপধঃরড়হ? বঙ্গবন্ধু শান্তকণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন- ও ষড়াব ঃযবস ঃড়ড় সঁপয.

মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমরা দেখতে পাই তার শৈশব জীবন থেকে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানি, স্কুলে পড়ার সময় তিনি কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টারের সঙ্গে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠনে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রত্যেক রবিবার থলি হাতে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠাতেন। সেই চাল বিক্রি করে গরিব ছাত্রদের বই-খাতা কেনা, লেখাপড়ার খরচ চলত। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে হামিদ মাস্টার মারা গেলে এই সেবা সমিতির ভার তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। ছোটবেলায় তার গভীর মানবিক হৃদয়ের আরেকটি ঘটনা আমাদের অবাক করে। একবার তার গ্রামের চাষিদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষকদের জীবনে নেমে আসে অভাব-অনটন। অনেক বাড়িতেই দুবেলা ভাত রান্না বন্ধ হয়ে যায়। চাষিদের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা। তাদের সন্তানেরা অভুক্ত। সারা গ্রামেই প্রায়-দুর্ভিক্ষাবস্থা নিয়ে চাপা গুঞ্জন। কিশোর মুজিব এরকম পরিস্থিতিতে দুঃখ-ভারাক্রান্ত; কিন্তু কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একটা কিছু করার জন্য তিনি ছটফট করছিলেন। সেই সময় যে পথটি তার সামনে খোলা ছিল, তিনি তাই করলেন। নিজের পিতাকে তিনি তাদের গোলা থেকে বিপন্ন কৃষকদের মধ্যে ধান বিতরণের জন্য অনুরোধ জানালেন। তাদের নিজেদের ধানের মজুত কেমন- এই অনুরোধ তার বাবা রাখতে পারবেন কিনা, সেসব তিনি ভাবেননি। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার চিন্তাটিই ছিল তখন তার কাছে মুখ্য। সারাজীবন ধরেই তিনি এই প্রান্তঃজনের স্বপক্ষে লড়েছেন। অভাজনেরাই ছিল তার চিরকালের সুখ-দুঃখের সাথি। প্রাণের তাগিদেই তিনি তাদের সাথে মিশতেন। এই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা যখন ইতিহাসের দফার ভেতরে বঙ্গবন্ধুকে অন্বেষণ করি তখন ব্যক্তিজীবনের মহত্ত্বকে পাশ কেটে যাই।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অকপটে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেয়ার কারণ। তিনি লিখেছেন- পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এই ভেবে যে এই নতুন রাষ্ট্রে দরিদ্র মুসলমান ও কৃষক জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবেন। আমরা দেখতে পাই, ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনদের উদ্ধার করেছেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সময়পোযোগী। সেই কবে ৬৬-তে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা... গেয়ে হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন। সেই সম্মেলনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ২০ মার্চ পল্টন ময়দানের বক্তৃতায় বলেছিলেনÑ ‘৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে অনেকের কাছে গিয়েছি, কেউ আমাকে সমর্থন করে নাই।’ কবিগুরুর গান থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...।’ আরও বলেছিলেন- ‘আমার দলের নেতাকর্মীরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তবে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছবই।’

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট। উদেশ্য ছিল প্রাথমিকভাবে বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি তৈরি করা। জীবদ্দশায় তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সংঘবদ্ধ করার মাধ্যমে বাঙালিদের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মনে রাখতে হবেÑ হাজার বছর ধরে বাঙালিদের স্বপ্ন দেখার সীমানা ছিল ভাষা, সংস্কৃতিকে স্বাধীনভাবে চর্চা করা। আমরা বাংলার আদি যুগ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাঙালি শাসক, কবি, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নেতাকর্মীদের কাছ থেকে স্বাধীন সার্বভৌম স্বভূমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন কিংবা পরিকল্পনার কথা শুনতে পাইনি। যে মানুষটি সাতচল্লিশোত্তর পাকিস্তানে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই প্রথম বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্ন তুলেছিলেন। স্বাধিকার ছিল স্বাধীনতার প্রথম ধাপ সেটি তিনি খুব ভালো করতেন জানতেন। এ কারণেই তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক। এ’কথাটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের দোর্দ- প্রতাপশালী সামরিক শাসক আইয়ুব খান। ৬ দফার পথ ধরেই এসেছিলো ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। সত্তরের নির্বাচন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন ছিল সর্বশেষ ধাপ। তবে এখানে একটি বিষয় স্মরণ করা উচিত তাহলো- ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যে অংশটি আমরা বারবার উচ্চারণ করে থাকি তাহলোÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ প্রশ্ন হলো স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি কিন্তু মুক্তির সংগ্রামে কতটুকু এগিয়ে যেতে পেরেছি। স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পরের সালতামামি যদি আমরা করতে না পারি তাহলে জাতির প্রতি, শহীদের প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হবো আমরা। একাত্তরেরর সংঘবদ্ধ জাতির প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না।

একাত্তরে আমার কেমন দেশ চেয়েছিলাম? এর প্রথম উত্তর হলো শোষিত মানুষের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর দেয়া নানা বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেও এর সহজ উত্তর পাওয়া যায়। স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে তিনি বলেছিলেনÑ ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’

বঙ্গবন্ধু তার সমস্ত রাজনৈতিক জীবনে প্রান্তজনের সখা ছিলেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করে আমরা হীরকজয়ন্তীর পথে এগিয়ে যাচ্ছি, ৬ দফার মূল কথা ছিল জাতির মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করা। স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার হওয়া উচিত সমদৃষ্টির, সমউন্নয়নের, সমতার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। পারব কি আমরা?

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top