alt

উপ-সম্পাদকীয়

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র : মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সেক্টর

অরূপরতন চৌধুরী

: মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পর প্রবাসী সরকার কাজ শুরু করে। ১৯ এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈছকে আব্দুল মান্নানকে মন্ত্রী পদ-মর্যাদায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২৪ মে দুটি রেকর্ডার মেশিন এবং মাত্র ১টি মাইক্রোফোন দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার ২৫ মাইল দূরে ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে কোরআন তেলাওয়াত ও বক্তৃতার মাত্র ১০ মিনিটের প্রচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতারের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে সেকেন্ড প্রতি ৮৩০ কিলোসাইকেলে প্রতিধ্বনিত হয় এটি। শুরুতে কেন্দ্রটিকে বেশ সমস্যার দিয়ে যেতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অত্যধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘চরমপত্র’। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ, রণাঙ্গনের সাফল্য কাহিনী, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসরসহ আরো কিছু অনুষ্ঠান পরিধি বাড়তে বাড়তে দৈনিক ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত নিয়মিত প্রচার হতো। আর এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠসৈনিক ছিলাম আমি। যার জন্য আজ নিজেকে গর্বিত মনে করি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যতগুলো সেক্টর যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তার মধ্যে আরেকটি সেক্টর ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। কারণ এই বেতার কেন্দ্রটি যদিও কোন সেক্টরের আওতায় ছিল না তবুও কেন্দ্রটি একটি সেক্টরের মতোই কাজ করেছে। যুদ্ধ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করছে, কোন ব্রিজ বা কালভার্ট উড়িয়ে দিচ্ছে, কোন এলাকা দখল হয়েছে তার সবই জানা সম্ভব ছিল এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। শুধু যে এই সব খবর তারা পেত তা নয় একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কর্মীদের, গেরিলাদের ও আপামর জনসাধারণকে আশার আলো দেখিয়ে যাচ্ছিল এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

এই বেতার কেন্দ্রে তখন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথার্থ না থাকলেও কেন্দ্রে প্রত্যেকের উদ্যমতা ছিল। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটির দোতলার ছোট কক্ষটিতে (যেখানে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন) দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার, সীমিতসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র, কতিপয় যন্ত্রশিল্পী, চাদর টাঙানো রেকর্ডিং রুমেই চলে রেকর্ডিং কাজ। দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে প্রায় ৭০ জন রাত্রীযাপন করতাম। এই বেতার কেন্দ্রই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।’

৯ মাস সম্মুখ মুক্তিযুদ্ধে দেশের অজ¯্র বীর সন্তান জীবন অকাতরে করেছেন দান। অবিস্মরণীয় তাদের এ অবদান। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতায় জীবনকে তুচ্ছ ভেবে শত্রুর মোকাবেলায় তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। এমনও কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা অস্ত্র হাতে তুলে নেননি কিন্তু, তাদের কণ্ঠ, তাদের আওয়াজ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মুক্তি সেনানিদেরকে,আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় জনগণকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সফলতায় ভূমিকা রেখেছেন।

প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মী (দুজন বেতার কর্মী ছিলেন না), স্থানীয় নেতা, জনগণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতায়। এই বিপ্লবী বেতার কেদ্রের ১০ জন সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল মোহাম্মদ (উক্ত বেতারের তৎকালীন নিজস্ব শিল্পী), আব্দুল কাশেম সন্দ্বিপ (ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আব্দুল শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন বেতার প্রকৌশলী), আব্দুল্লাহ আল ফারুক (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুর হোসেন (তৎকালীন টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), আমিনুর রহমান (তৎকালীন টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), শারফজ্জামান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিব উদ্দিন ( ইনি বেতার কর্মী ছিলেন না) স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করেছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি যখন পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা, শোকাতুর, কামানের গোলায় পুলিশ লাইন ভস্মীভূত এবং যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ই-পি-আর-এর কিছু বঙ্গশার্দল সম্পূর্ণ অন্ধভাবে স্ব স্ব দায়িত্বে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন, অন্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রামে, ঠিক তখনই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র বহু বাঙালি অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। সে অশ্রু ছিল আনন্দের, স্বস্তির, গৌরবের। বাঙালি আবার উঠে দাঁড়াল গভীর আত্মবিশ^াসে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পেলেন শত্রুর ওপর আঘাত হানার নতুন প্রেরণা।

ইথারে ভেসে আসা শব্দ যে বুলেটের চেয়েও শক্তি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে টিক্কা-নিয়াজী- ফরমান আলীর পাক-পশুরা সেদিন বুলেট-বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে নরপশুদের বিরুদ্ধে। মুজিবনগর সরকার নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতর কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে। প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৭১ সালের ২৫ মে মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যক্রম শুরু করে, যা ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অবদানের কথা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি এই বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী কলা-কুশলীদের মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি ও যুদ্ধে তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয় ও সব পর্যায়ে সমাদৃত।

১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে মুক্তিয্দ্ধু ব্যাপক আকার ধারণ করতে শুরু করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ও প্রচার-প্রচারণাও বাড়তে থাকে দুর্বার গতিতে। এর মধ্যে কিছু কিছু অনুষ্ঠান বাঙালিদের মনে একটা জাগরণ সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নেতাদের ভাষণ ৭ কোটি বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আশার আলো সঞ্চার করেছিল। এই বেতার কেন্দ্র দীর্ঘ ৯ মাস অমিত তেজ ও তেজস্বীনি ভাষা আর দৃপ্তকণ্ঠে দুর্বার অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালির অতন্দ্রপ্রহরী ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস দিয়ে দিশেহারা মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে বিজয়ের দারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।

বস্তুতপক্ষে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটির মূল পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধু আগেই ভেবে রেখেছিলেন। কারণ ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাহকে ডেকে নেন এবং তাকে গোপনে একটি বেতার যন্ত্র তৈরী করার নির্দেশনা দেন। উদ্দেশ্য ছিল ওই বেতার যন্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা।

পরবর্তীতে সত্যি সত্যিই এইরকম বেতার যন্ত্র থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতারের সৃষ্টি হলো যা ৭ কোটি মানুষকে যুদ্ধের ৯টি মাস উৎসাহ, উদ্দীপনাই শুধু নয়, যুদ্ধকেও বেগবান করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে এর জয় সুনিশ্চিত করেছে। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস মুছে যাবে না। এর ইতিহাস সংরক্ষণ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কিভাবে একটি বেতার কেন্দ্র একটি যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, মানুষকে আশার আলো দেখিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে পারে ও জয় সুনিশ্চিত করতে পারে।

[লেখক: সাম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম ও অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ]

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র : মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সেক্টর

অরূপরতন চৌধুরী

মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পর প্রবাসী সরকার কাজ শুরু করে। ১৯ এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈছকে আব্দুল মান্নানকে মন্ত্রী পদ-মর্যাদায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২৪ মে দুটি রেকর্ডার মেশিন এবং মাত্র ১টি মাইক্রোফোন দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার ২৫ মাইল দূরে ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে কোরআন তেলাওয়াত ও বক্তৃতার মাত্র ১০ মিনিটের প্রচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতারের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে সেকেন্ড প্রতি ৮৩০ কিলোসাইকেলে প্রতিধ্বনিত হয় এটি। শুরুতে কেন্দ্রটিকে বেশ সমস্যার দিয়ে যেতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অত্যধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘চরমপত্র’। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ, রণাঙ্গনের সাফল্য কাহিনী, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসরসহ আরো কিছু অনুষ্ঠান পরিধি বাড়তে বাড়তে দৈনিক ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত নিয়মিত প্রচার হতো। আর এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠসৈনিক ছিলাম আমি। যার জন্য আজ নিজেকে গর্বিত মনে করি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যতগুলো সেক্টর যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তার মধ্যে আরেকটি সেক্টর ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। কারণ এই বেতার কেন্দ্রটি যদিও কোন সেক্টরের আওতায় ছিল না তবুও কেন্দ্রটি একটি সেক্টরের মতোই কাজ করেছে। যুদ্ধ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করছে, কোন ব্রিজ বা কালভার্ট উড়িয়ে দিচ্ছে, কোন এলাকা দখল হয়েছে তার সবই জানা সম্ভব ছিল এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। শুধু যে এই সব খবর তারা পেত তা নয় একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কর্মীদের, গেরিলাদের ও আপামর জনসাধারণকে আশার আলো দেখিয়ে যাচ্ছিল এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

এই বেতার কেন্দ্রে তখন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথার্থ না থাকলেও কেন্দ্রে প্রত্যেকের উদ্যমতা ছিল। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটির দোতলার ছোট কক্ষটিতে (যেখানে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন) দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার, সীমিতসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র, কতিপয় যন্ত্রশিল্পী, চাদর টাঙানো রেকর্ডিং রুমেই চলে রেকর্ডিং কাজ। দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে প্রায় ৭০ জন রাত্রীযাপন করতাম। এই বেতার কেন্দ্রই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।’

৯ মাস সম্মুখ মুক্তিযুদ্ধে দেশের অজ¯্র বীর সন্তান জীবন অকাতরে করেছেন দান। অবিস্মরণীয় তাদের এ অবদান। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতায় জীবনকে তুচ্ছ ভেবে শত্রুর মোকাবেলায় তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। এমনও কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা অস্ত্র হাতে তুলে নেননি কিন্তু, তাদের কণ্ঠ, তাদের আওয়াজ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মুক্তি সেনানিদেরকে,আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় জনগণকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সফলতায় ভূমিকা রেখেছেন।

প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মী (দুজন বেতার কর্মী ছিলেন না), স্থানীয় নেতা, জনগণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতায়। এই বিপ্লবী বেতার কেদ্রের ১০ জন সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল মোহাম্মদ (উক্ত বেতারের তৎকালীন নিজস্ব শিল্পী), আব্দুল কাশেম সন্দ্বিপ (ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আব্দুল শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন বেতার প্রকৌশলী), আব্দুল্লাহ আল ফারুক (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুর হোসেন (তৎকালীন টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), আমিনুর রহমান (তৎকালীন টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), শারফজ্জামান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিব উদ্দিন ( ইনি বেতার কর্মী ছিলেন না) স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করেছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি যখন পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা, শোকাতুর, কামানের গোলায় পুলিশ লাইন ভস্মীভূত এবং যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ই-পি-আর-এর কিছু বঙ্গশার্দল সম্পূর্ণ অন্ধভাবে স্ব স্ব দায়িত্বে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন, অন্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রামে, ঠিক তখনই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র বহু বাঙালি অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। সে অশ্রু ছিল আনন্দের, স্বস্তির, গৌরবের। বাঙালি আবার উঠে দাঁড়াল গভীর আত্মবিশ^াসে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পেলেন শত্রুর ওপর আঘাত হানার নতুন প্রেরণা।

ইথারে ভেসে আসা শব্দ যে বুলেটের চেয়েও শক্তি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে টিক্কা-নিয়াজী- ফরমান আলীর পাক-পশুরা সেদিন বুলেট-বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে নরপশুদের বিরুদ্ধে। মুজিবনগর সরকার নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতর কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে। প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৭১ সালের ২৫ মে মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যক্রম শুরু করে, যা ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অবদানের কথা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি এই বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী কলা-কুশলীদের মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি ও যুদ্ধে তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয় ও সব পর্যায়ে সমাদৃত।

১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে মুক্তিয্দ্ধু ব্যাপক আকার ধারণ করতে শুরু করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ও প্রচার-প্রচারণাও বাড়তে থাকে দুর্বার গতিতে। এর মধ্যে কিছু কিছু অনুষ্ঠান বাঙালিদের মনে একটা জাগরণ সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নেতাদের ভাষণ ৭ কোটি বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আশার আলো সঞ্চার করেছিল। এই বেতার কেন্দ্র দীর্ঘ ৯ মাস অমিত তেজ ও তেজস্বীনি ভাষা আর দৃপ্তকণ্ঠে দুর্বার অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালির অতন্দ্রপ্রহরী ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস দিয়ে দিশেহারা মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে বিজয়ের দারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।

বস্তুতপক্ষে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটির মূল পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধু আগেই ভেবে রেখেছিলেন। কারণ ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাহকে ডেকে নেন এবং তাকে গোপনে একটি বেতার যন্ত্র তৈরী করার নির্দেশনা দেন। উদ্দেশ্য ছিল ওই বেতার যন্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা।

পরবর্তীতে সত্যি সত্যিই এইরকম বেতার যন্ত্র থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতারের সৃষ্টি হলো যা ৭ কোটি মানুষকে যুদ্ধের ৯টি মাস উৎসাহ, উদ্দীপনাই শুধু নয়, যুদ্ধকেও বেগবান করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে এর জয় সুনিশ্চিত করেছে। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস মুছে যাবে না। এর ইতিহাস সংরক্ষণ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কিভাবে একটি বেতার কেন্দ্র একটি যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, মানুষকে আশার আলো দেখিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে পারে ও জয় সুনিশ্চিত করতে পারে।

[লেখক: সাম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম ও অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ]

back to top