রবিউল আওয়াল পারভেজ
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। দেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। ইতোমধ্যেই সারা দেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গেছে। অপেক্ষা শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার। পাকিস্তানি বাহিনী তা আঁচ করতে পেরে বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে রুখে দিতে ১৮ মার্চ বাঙালি নিধনের এক নীলনকশা প্রণয়ন করে। নাম দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নৃশংস হামলা চালানো হয় ২৫ মার্চ মধ্য রাতে। হত্যা করা হয় হাজার হাজার নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে। সে এক ভয়াল রজনী!
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে আসছিল। তবে পাকিস্তান পূর্বের সকল শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার ছাপিয়ে এই দিনেই শুরু করেছিল গণহত্যা যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত স্থায়ী হয়। ২৫ মার্চ রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ‘অপারেশন বিগ বার্ড’ পরিচালনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তিনি গ্রেপ্তারের পূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয়টি মাস ধরে চলমান সেই যুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর চালায় এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। হত্যা করে ৩০ লাখ মানুষকে। পাশবিক নির্যাতন চালায় মা-বোনদের ওপর।
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করে বলে, গণহত্যা বা জেনোসাইড হচ্ছে এমন কর্মকা- যার মূল লক্ষ্য হলো একটি জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা। তাছাড়া কোনো নির্দিষ্ট স্থানে একসঙ্গে বা অল্প সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ হত্যা করাকেও গণহত্যা বলা হয়। এটা স্পষ্ট যে বাঙালি জাতির স্বাধীনতাকামী মানুষদের সম্পূর্ণরূপে নিধনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি বাহিনী এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
তবে সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো একাত্তরের এই গণহত্যা এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়নি। তার পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানান মারপ্যাচ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই জটলায় চাপা পড়ে আলোর মুখ দেখছে না পৃথিবীর ইতিহাসের এক নির্মম গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি।
আর কতকাল এ গণহত্যার স্বীকৃতি না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হবে বাঙালিকে? মনের মাঝে চাপা যন্ত্রণা নিয়ে আর কতগুলো স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন করবে বাঙালি? এবার সময় হয়েছে বিশ্বের কাছে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর হওয়ার। এবার সময় এসেছে ২৫ মার্চকে বিশ্ব গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়ার। আন্তর্জাতিকভাবে ২৫ মার্চ ‘বিশ্ব গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষিত হলে, এই পৃথিবীর বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষ্যতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাকিস্তানিদের নির্মমতা, নৃশংসতা সম্পর্কে জানতে পারবে এবং জানতে পারবে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা, বীরত্বের কথা। সেই বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি হবে গণহত্যার বিরুদ্ধে। ১৯৫৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ৪৩টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৫ কোটি মানুষ এবং বর্তমানে গাঁজায় ইসরাইল দখলদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা চলমান। কাজেই গণহত্যার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি এখন সময়ের সময়ের দাবি।
আশার কথা হলোÑ বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে গণহত্যার স্বীকৃতি ও ২৫ মার্চকে ‘বিশ্ব গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করার জন্য দাবি উত্থাপন করছে। আশা করি, বাংলাদেশ সরকার ৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় এবং গণহত্যার কথা স্মরণ করে ২৫ মার্চকে ‘বিশ্ব গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আরো জোর তৎপরতা চালাবে। তবে পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা দেখতে পাই, মূলত কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশির উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতার মাধ্যমেই ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ানরা গণহত্যার শিকার হয়। পরবর্তীতে আর্মেনিয়ার সরকার ও আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে তারা গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। কাজেই বিষয়টি স্পষ্ট যে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভে শুধু সরকারের উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। এ দেশের সাধারণ মানুষ ও প্রবাসীদেরও স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্নে সোচ্চার হতে হবে।
বিভিন্ন দেশ (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) যখন কোন দেশে ঘটে যাওয়া হত্যাকা-কে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দেবে তখনই তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য করা হবে। আবার জাতিসংঘ যদি কোন হত্যাকা-কে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তখনও সেটাকে বলা যাবে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
সুতরাং আমাদের দেশের সরকার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তর্জাতিক ফোরামে গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে হবে এবং দেশে দেশে এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই একাত্তরের গণহত্যা এবং ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করবে।
[লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]
রবিউল আওয়াল পারভেজ
মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। দেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। ইতোমধ্যেই সারা দেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গেছে। অপেক্ষা শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার। পাকিস্তানি বাহিনী তা আঁচ করতে পেরে বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে রুখে দিতে ১৮ মার্চ বাঙালি নিধনের এক নীলনকশা প্রণয়ন করে। নাম দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নৃশংস হামলা চালানো হয় ২৫ মার্চ মধ্য রাতে। হত্যা করা হয় হাজার হাজার নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে। সে এক ভয়াল রজনী!
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে আসছিল। তবে পাকিস্তান পূর্বের সকল শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার ছাপিয়ে এই দিনেই শুরু করেছিল গণহত্যা যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত স্থায়ী হয়। ২৫ মার্চ রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ‘অপারেশন বিগ বার্ড’ পরিচালনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তিনি গ্রেপ্তারের পূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয়টি মাস ধরে চলমান সেই যুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর চালায় এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। হত্যা করে ৩০ লাখ মানুষকে। পাশবিক নির্যাতন চালায় মা-বোনদের ওপর।
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করে বলে, গণহত্যা বা জেনোসাইড হচ্ছে এমন কর্মকা- যার মূল লক্ষ্য হলো একটি জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা। তাছাড়া কোনো নির্দিষ্ট স্থানে একসঙ্গে বা অল্প সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ হত্যা করাকেও গণহত্যা বলা হয়। এটা স্পষ্ট যে বাঙালি জাতির স্বাধীনতাকামী মানুষদের সম্পূর্ণরূপে নিধনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি বাহিনী এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
তবে সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো একাত্তরের এই গণহত্যা এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়নি। তার পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানান মারপ্যাচ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই জটলায় চাপা পড়ে আলোর মুখ দেখছে না পৃথিবীর ইতিহাসের এক নির্মম গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি।
আর কতকাল এ গণহত্যার স্বীকৃতি না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হবে বাঙালিকে? মনের মাঝে চাপা যন্ত্রণা নিয়ে আর কতগুলো স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন করবে বাঙালি? এবার সময় হয়েছে বিশ্বের কাছে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর হওয়ার। এবার সময় এসেছে ২৫ মার্চকে বিশ্ব গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়ার। আন্তর্জাতিকভাবে ২৫ মার্চ ‘বিশ্ব গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষিত হলে, এই পৃথিবীর বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষ্যতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাকিস্তানিদের নির্মমতা, নৃশংসতা সম্পর্কে জানতে পারবে এবং জানতে পারবে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা, বীরত্বের কথা। সেই বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি হবে গণহত্যার বিরুদ্ধে। ১৯৫৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ৪৩টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৫ কোটি মানুষ এবং বর্তমানে গাঁজায় ইসরাইল দখলদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা চলমান। কাজেই গণহত্যার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি এখন সময়ের সময়ের দাবি।
আশার কথা হলোÑ বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে গণহত্যার স্বীকৃতি ও ২৫ মার্চকে ‘বিশ্ব গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করার জন্য দাবি উত্থাপন করছে। আশা করি, বাংলাদেশ সরকার ৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় এবং গণহত্যার কথা স্মরণ করে ২৫ মার্চকে ‘বিশ্ব গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আরো জোর তৎপরতা চালাবে। তবে পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা দেখতে পাই, মূলত কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশির উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতার মাধ্যমেই ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ানরা গণহত্যার শিকার হয়। পরবর্তীতে আর্মেনিয়ার সরকার ও আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে তারা গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। কাজেই বিষয়টি স্পষ্ট যে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভে শুধু সরকারের উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। এ দেশের সাধারণ মানুষ ও প্রবাসীদেরও স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্নে সোচ্চার হতে হবে।
বিভিন্ন দেশ (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) যখন কোন দেশে ঘটে যাওয়া হত্যাকা-কে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দেবে তখনই তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য করা হবে। আবার জাতিসংঘ যদি কোন হত্যাকা-কে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তখনও সেটাকে বলা যাবে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
সুতরাং আমাদের দেশের সরকার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তর্জাতিক ফোরামে গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে হবে এবং দেশে দেশে এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই একাত্তরের গণহত্যা এবং ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করবে।
[লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]