বাবুল দে
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর পুরো ঢাকা শহর মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল। পুরান ঢাকায় তারা বেছে বেছে হিন্দুপাড়ায় বেশি হত্যাকা- ঘটিয়েছে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের মালাকারটোলার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সবচেয়ে বেশি হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে এই মারাকারটোলার প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে হামলা করে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হিন্দু নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ধরে নিয়ে যায় ঢাকার ঐহিত্যবাহী লোহার পুলে। সেখানে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে তাদের। সেদিন পাকিস্তানিরা একলাইনে দাঁড় করিয়ে ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বেশ কয়েকজন আহত হন, কয়েকজন গুলির মধ্যেও মৃত্যুরমুখ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসেন।
২৭ মার্চের সেই মৃত্যুপুরী মালাকারটোলায় আমাদের পৈতৃক বাড়ি। সেদিনের গণহত্যার পর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আমার দুই ভাইয়ের নাম। আর আমার বাবা গুলি খেয়েও বেঁচে যান। পাকিস্তানিরা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারাদিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমরা ভয়-আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি আমাদের আশপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা বিভিন্ন এলাকার। শাখারিপট্টিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছেই সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। থানার ভিতরে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহারপুলের উপর দিয়ে যাওয়া আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে।
রাত এগারোটার দিকে একদল আর্মি এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। এভাবে হিসাব করে আমাদের বাড়িতেই আর্মি হামলা করবে আমরা ভাবতেই পারিনি। দরজা ভেঙ্গে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দুলাল দে ও বিপ্লব দে’কে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে, তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভাই বিপ্লব করুণ কণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা আমাদের তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বাবা কোন উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।
আমাদের বাড়িতে হামলা করার আগে-পরে আর্মি আরও কয়েকটি বাড়িতে হামলা করে অনেক লোককে ধরে নিয়ে যায়। রাত-দুপুরে তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে, সেখানে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিনগান উঁচিয়ে গুলি করে। গুলি খেয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরো দুই-তিনজন বেঁচে যায়। আমার বাবার হাতে ও বুকের পাশে গুলি লাগে, দুই-একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা দোলাইখালের ময়লা পানিতে মরার মতো পড়ে থাকেন। পাকিস্তান আর্মি গুলি করার পর আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন।
আহত হওয়ায় তার ওঠার শক্তি ছিল না। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর খুব ভোরে ফজর নামাজের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। উঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই। তিনি খুব মিহি কন্ঠে দুলালকে ডাকেন- এই দুলাল ওঠ, চল পালিয়ে যাই; কিন্তু একটু পরই বুঝতে পারেন দুলাল বেঁচে নেই। এরপরই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে দোলাইখালের পাড় দিয়ে হেঁটে কাছেই আমাদের পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা তাড়াতাড়ি একজন লোক দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান। সেখানে বাবা প্রায় এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে প্রথমে বিক্রমপুর গিয়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। পরে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা সবাই আগরতলায় চলে যাই।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
বাবুল দে
বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর পুরো ঢাকা শহর মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল। পুরান ঢাকায় তারা বেছে বেছে হিন্দুপাড়ায় বেশি হত্যাকা- ঘটিয়েছে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের মালাকারটোলার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সবচেয়ে বেশি হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে এই মারাকারটোলার প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে হামলা করে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হিন্দু নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ধরে নিয়ে যায় ঢাকার ঐহিত্যবাহী লোহার পুলে। সেখানে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে তাদের। সেদিন পাকিস্তানিরা একলাইনে দাঁড় করিয়ে ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বেশ কয়েকজন আহত হন, কয়েকজন গুলির মধ্যেও মৃত্যুরমুখ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসেন।
২৭ মার্চের সেই মৃত্যুপুরী মালাকারটোলায় আমাদের পৈতৃক বাড়ি। সেদিনের গণহত্যার পর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আমার দুই ভাইয়ের নাম। আর আমার বাবা গুলি খেয়েও বেঁচে যান। পাকিস্তানিরা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারাদিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমরা ভয়-আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি আমাদের আশপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা বিভিন্ন এলাকার। শাখারিপট্টিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছেই সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। থানার ভিতরে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহারপুলের উপর দিয়ে যাওয়া আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে।
রাত এগারোটার দিকে একদল আর্মি এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। এভাবে হিসাব করে আমাদের বাড়িতেই আর্মি হামলা করবে আমরা ভাবতেই পারিনি। দরজা ভেঙ্গে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দুলাল দে ও বিপ্লব দে’কে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে, তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভাই বিপ্লব করুণ কণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা আমাদের তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বাবা কোন উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।
আমাদের বাড়িতে হামলা করার আগে-পরে আর্মি আরও কয়েকটি বাড়িতে হামলা করে অনেক লোককে ধরে নিয়ে যায়। রাত-দুপুরে তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে, সেখানে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিনগান উঁচিয়ে গুলি করে। গুলি খেয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরো দুই-তিনজন বেঁচে যায়। আমার বাবার হাতে ও বুকের পাশে গুলি লাগে, দুই-একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা দোলাইখালের ময়লা পানিতে মরার মতো পড়ে থাকেন। পাকিস্তান আর্মি গুলি করার পর আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন।
আহত হওয়ায় তার ওঠার শক্তি ছিল না। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর খুব ভোরে ফজর নামাজের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। উঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই। তিনি খুব মিহি কন্ঠে দুলালকে ডাকেন- এই দুলাল ওঠ, চল পালিয়ে যাই; কিন্তু একটু পরই বুঝতে পারেন দুলাল বেঁচে নেই। এরপরই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে দোলাইখালের পাড় দিয়ে হেঁটে কাছেই আমাদের পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা তাড়াতাড়ি একজন লোক দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান। সেখানে বাবা প্রায় এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে প্রথমে বিক্রমপুর গিয়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। পরে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা সবাই আগরতলায় চলে যাই।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]