alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘এই হলো সরকারি চিকিৎসা সেবার হাল’

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চলছে সংস্কার। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর চলছে কঠোর নজরদারি। নিবন্ধনবিহীন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়ার জন্য মাঠে নেমেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনেকেই বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে একটা প্রশ্ন আসেÑ যারা চান নিবন্ধনবিহীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হোক, তারাই কেন টাকা দিয়ে সেখানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে যান।

প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা দরকার। কারণ যখন একটা মানুষ অসুস্থ হয়ে কাতরাতে থাকে তখন সে বাঁচার জন্য যে খড়কুটাটুকু পায় তা ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। দেশের সাধারণ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এসে কি পরিমাণে নাকানি-চুবানির শিকার হয় তা ভাবা যায় না। তার দৃশ্যটা অত্যন্ত ভয়াবহ। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ডবয় থেকে শুরু করে বড়কর্তারা কি পরিমাণ দুর্ব্যবহার করে একজন রোগীর সাথে তা অনেকেরই জানা আছে। তাই যাদের আত্মমর্যাদা আছে তারা কেউ যেতে চান না সরকারি হাসপাতালে। যারা আর্থিকভাবে দুরাবস্থায় আছেন, অন্য কোথাও টাকা দিয়ে সেবা নিতে পারছেন না, তারা বাধ্য হয়ে যান সরকারি হাসপাতালে। অনেক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি যে ভয়াবহ দুর্ব্যবহার করেন কর্মরত কর্মীরা তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কথা। বহিঃবিভাগে একজন রোগীর সাথে টিকেট কাটা থেকে শুরু হয় রোগীর প্রতি শুরু হয় অমানবিক আচরণ। রোগী টিকেট কাটার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, টিকেট প্রদানকারী কাউন্টারে বসা লোকটি পাশোর বসে থাকা সহকর্মীর সাথে কথা বলছেন। কথাগুলোর মূল উপজীব্য গল্প হলো, সকালে তিনি কি দিয়ে খেলেন ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। রোগী বিরক্ত হয়ে কিছু বললে তিনি আর ওই রোগীকে টিকেট দেন না। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ, তাদের টপকিয়ে গলায় আইডি কার্ড ঝুলানো ব্যক্তিরা চার-পাঁচটি টিকেট কেটে নেন। কেন এমন হলো জানতে চাইলে কাউন্টার থেকে বলা হয় তিনি স্টাফ তাই তার লাইনে না দাঁড়িয়ে নেয়ার অধিকার আছে।

অনেক অপমান সহ্য করে রোগী টিকেট কাটলেন, তারপর আবার সেই লাইন ডাক্তারের চেম্বারে। এখানে স্বজন প্রীতি ও স্টাফদের অগ্রাধিকার। স্টাফ নামক কিছু ব্যক্তি রোগীর কাছ থেকে বকশিশ নিয়ে লাইন টপকিয়ে কিছু রোগীকে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকিয়ে দেন। এখানে কোন রকম ডাক্তারে চেম্বারে ঢুকা হলো, দুই জায়গায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে তিন ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলো রোগী। সেখানে রোগীর বসার কোন চেয়ার নেই, রোগীকে তার রোগের বর্ণনা ডাক্তারের চেম্বারে দাঁড়িয়ে বলতে হচ্ছে। যদিও দাঁড়িয়ে থেকে বলতে সমস্যা হয় না, কারণ ডাক্তার দুই-এক মিনিটের বেশি সময় শুনেন না রোগীর কথা।

গত ২৩ মার্চের একটি ঘটনা। সকাল ১০টা থেকে দাঁড়িয়ে থেকে একজন রোগী সাড়ে বারোটায় পেলেন ডাক্তারের সাক্ষাৎকার। ডাক্তার তাকে টেস্ট করাতে বললেন। রোগী টেস্টের ফি জমা দিতে গেলেন। ততক্ষণে টেস্ট ফি নেয়ার কাউন্টার বন্ধ। জানানো হলো জোহরের নামাজের পর আবার ফি নেয়া হবে। সময় জানতে চাইলে বলা হলো ২টা ৩০ মিনিটে। জোহরের নামাজ তো দেড়টায় হয়। তবে এত আগে কেন বন্ধ করলেন ফি নেয়া, রোগী এই কথা বলায় কাউন্টারের বসা লোকটি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, তিনি বললেন রোজা রমজানের দিন এটা বুঝেন না। রোগী হতবাক হয়ে গেলেন, রোজা বলেই কি দায়িত্ব পালন করতে নেই। উপায়ন্তর না দেখে আবার ফি নেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে রইলেন অসহায় রোগীটি। দুইটার দিকে হিজাবাবৃত একজন নারী কাউন্টারে বসলেন। কাউন্টারে বসে তিনি পাশের ভদ্র লোকের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। রোগী তাকে বলল, মেডাম টাকাটা নিয়ে নেন। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, এক কথা কয়বার বলব। একবার বলছি না আড়াইটার সময় টাকা জমা নেব। আড়াইটা বাজল। এক লোক এসে বলল আপা অমুক ভাই আপনার সাথে কথা বলবেন, এই বলে লোকটা মোবাইল ধরিয়ে দিলে কাউন্টারে বসা মহিলাটিকে। কি কথা হলো বুঝা গেল না, তবে দেখা গেল লোকটার হাতের প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে টেস্টের ফি নিলেন কাউন্টারে বসা মহিলাটি।

লাইন ব্যতিরেকে কেন এই কাজ করলেন, এ কথা বলায় তিনি তো রেগে আগুন। তিনি বললেন, ফ্রি চিকিৎসা পাচ্ছেন ত তাই একটু দেরি সহ্য করতে পারেন না। রোগীটি তৎক্ষণাৎ বললেন, ফ্রি চিকিৎসা মানে, আমরাদের ট্যাক্সে চলে এই হাসপাতাল। এই কথা বলায় উক্ত কর্মী আরো রেগে গেলেন। তিনি আরও বললেন যান আপনার সরকারকে গিয়ে বলেন এসব কথা, এসব কথা রাজনীতির মাঠে বলবেন। তিনি নিলেন শুধু আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানোর ফির টাকাটা জমা নিলেন। বাকিটা পরের দিন জমা দিতে বললেন।

ফি জমা দেয়ার পর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার লাইনে দাঁড়ালো রোগীটি। ডাক্তার মহোদয় চেম্বারে নেই। কেন নেই জানতে চাইলে, চেম্বারের সামনে টুলে বসে থাকা লোকটি বলল, তা তিনি তা বলতে পারবেন না, তবে তিনি আসবেন, কখন আসবেন তা সে জানে না। তিনি আরও জানালেন এই ডাক্তার কারো কথা শুনবেন না, এমনকি পরিচালক বললেও কাজ হবে না, তিনি তার মর্জিমাফিক আসবেন আল্ট্রা করাবেন।

বেলা সোয়া ৪টায় আল্ট্রাসনোগ্রাফির ডাক্তার এলেন। রোগীটি তার আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে যখন রাস্তায় বের হলেন তখন ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বাজে। পরের দিন আবার গেলেন রক্ত ও প্রসাবের টেস্ট করাতে, লাইনে দাঁড়িয়ে ফি জমা তারপর সেম্পল দিলেন প্যাথলজিতে। প্যাথলজি থেকে জানানো হল, আগামী দিন তার টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হবে। বহিঃবিভাগে ডাক্তার দেখাতে একজন রোগীর মোট পাঁচটি কর্ম-দিবস লাগে। তারপর সহ্য করতে হয় অবর্ণনীয় অপমানজনক আচরণ। পাঁচ কর্ম-দিবসে মজুরির হিসাব করলে দেখা যায়, যদি রোগীটি দিনমজুরও হয় তাহলে তার পাঁচ কর্ম-দিবসে প্রতি কর্ম-দিবসে ৬শ টাকা হারে তিন হাজার টাকা নষ্ট হয় একবার ডাক্তার দেখাতে। এই হলো সরকারি চিকিৎসা সেবার হাল। এমন বিড়ম্বনা (বিড়ম্ববনা বললে ভুল হবে অসহনীয় মানসিক অত্যাচার সহ্য করা, এটা বলা সঠিক হবে) সহ্য করে মানুষের সরকারি চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে। তাই দেখা যায়, এরকম যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষ ছুটে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দিকে। আর এ সুযোগটা নিচ্ছে একজন দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ; সনদবিহীন চিকিৎসক হয়ে চিকিৎসার নামে করছে রমরমা ব্যবসা।

বর্তমান সরকার সরকারি হাসপাতালগুলোর ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ করেছেন; যা বিশ্বের অনেক আধুনিক হাসপাতালের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের তুলনা করা যায়। ভেতরকার সেবা প্রদানকারীরা যে কতটা বীভৎস তা অবকাঠামো দেখে বুঝা কঠিন। বিষয়টা অনেকটা উপরের ফিটফাট ভেতরে সদরঘাটের মতো। শোনা যায়, বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সরকারি হাসপাতালের কর্মীরা উৎকোচ পায়, যার জন্য তারা এই দুর্ব্যবহার করে। যাতে এই দুর্ব্যবহার সহ্য না করে রোগীরা বাধ্য হয় বেসরকারি চিকিৎসাসেবা নিতে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘এই হলো সরকারি চিকিৎসা সেবার হাল’

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চলছে সংস্কার। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর চলছে কঠোর নজরদারি। নিবন্ধনবিহীন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়ার জন্য মাঠে নেমেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনেকেই বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে একটা প্রশ্ন আসেÑ যারা চান নিবন্ধনবিহীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হোক, তারাই কেন টাকা দিয়ে সেখানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে যান।

প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা দরকার। কারণ যখন একটা মানুষ অসুস্থ হয়ে কাতরাতে থাকে তখন সে বাঁচার জন্য যে খড়কুটাটুকু পায় তা ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। দেশের সাধারণ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এসে কি পরিমাণে নাকানি-চুবানির শিকার হয় তা ভাবা যায় না। তার দৃশ্যটা অত্যন্ত ভয়াবহ। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ডবয় থেকে শুরু করে বড়কর্তারা কি পরিমাণ দুর্ব্যবহার করে একজন রোগীর সাথে তা অনেকেরই জানা আছে। তাই যাদের আত্মমর্যাদা আছে তারা কেউ যেতে চান না সরকারি হাসপাতালে। যারা আর্থিকভাবে দুরাবস্থায় আছেন, অন্য কোথাও টাকা দিয়ে সেবা নিতে পারছেন না, তারা বাধ্য হয়ে যান সরকারি হাসপাতালে। অনেক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি যে ভয়াবহ দুর্ব্যবহার করেন কর্মরত কর্মীরা তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কথা। বহিঃবিভাগে একজন রোগীর সাথে টিকেট কাটা থেকে শুরু হয় রোগীর প্রতি শুরু হয় অমানবিক আচরণ। রোগী টিকেট কাটার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, টিকেট প্রদানকারী কাউন্টারে বসা লোকটি পাশোর বসে থাকা সহকর্মীর সাথে কথা বলছেন। কথাগুলোর মূল উপজীব্য গল্প হলো, সকালে তিনি কি দিয়ে খেলেন ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। রোগী বিরক্ত হয়ে কিছু বললে তিনি আর ওই রোগীকে টিকেট দেন না। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ, তাদের টপকিয়ে গলায় আইডি কার্ড ঝুলানো ব্যক্তিরা চার-পাঁচটি টিকেট কেটে নেন। কেন এমন হলো জানতে চাইলে কাউন্টার থেকে বলা হয় তিনি স্টাফ তাই তার লাইনে না দাঁড়িয়ে নেয়ার অধিকার আছে।

অনেক অপমান সহ্য করে রোগী টিকেট কাটলেন, তারপর আবার সেই লাইন ডাক্তারের চেম্বারে। এখানে স্বজন প্রীতি ও স্টাফদের অগ্রাধিকার। স্টাফ নামক কিছু ব্যক্তি রোগীর কাছ থেকে বকশিশ নিয়ে লাইন টপকিয়ে কিছু রোগীকে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকিয়ে দেন। এখানে কোন রকম ডাক্তারে চেম্বারে ঢুকা হলো, দুই জায়গায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে তিন ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলো রোগী। সেখানে রোগীর বসার কোন চেয়ার নেই, রোগীকে তার রোগের বর্ণনা ডাক্তারের চেম্বারে দাঁড়িয়ে বলতে হচ্ছে। যদিও দাঁড়িয়ে থেকে বলতে সমস্যা হয় না, কারণ ডাক্তার দুই-এক মিনিটের বেশি সময় শুনেন না রোগীর কথা।

গত ২৩ মার্চের একটি ঘটনা। সকাল ১০টা থেকে দাঁড়িয়ে থেকে একজন রোগী সাড়ে বারোটায় পেলেন ডাক্তারের সাক্ষাৎকার। ডাক্তার তাকে টেস্ট করাতে বললেন। রোগী টেস্টের ফি জমা দিতে গেলেন। ততক্ষণে টেস্ট ফি নেয়ার কাউন্টার বন্ধ। জানানো হলো জোহরের নামাজের পর আবার ফি নেয়া হবে। সময় জানতে চাইলে বলা হলো ২টা ৩০ মিনিটে। জোহরের নামাজ তো দেড়টায় হয়। তবে এত আগে কেন বন্ধ করলেন ফি নেয়া, রোগী এই কথা বলায় কাউন্টারের বসা লোকটি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, তিনি বললেন রোজা রমজানের দিন এটা বুঝেন না। রোগী হতবাক হয়ে গেলেন, রোজা বলেই কি দায়িত্ব পালন করতে নেই। উপায়ন্তর না দেখে আবার ফি নেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে রইলেন অসহায় রোগীটি। দুইটার দিকে হিজাবাবৃত একজন নারী কাউন্টারে বসলেন। কাউন্টারে বসে তিনি পাশের ভদ্র লোকের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। রোগী তাকে বলল, মেডাম টাকাটা নিয়ে নেন। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, এক কথা কয়বার বলব। একবার বলছি না আড়াইটার সময় টাকা জমা নেব। আড়াইটা বাজল। এক লোক এসে বলল আপা অমুক ভাই আপনার সাথে কথা বলবেন, এই বলে লোকটা মোবাইল ধরিয়ে দিলে কাউন্টারে বসা মহিলাটিকে। কি কথা হলো বুঝা গেল না, তবে দেখা গেল লোকটার হাতের প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে টেস্টের ফি নিলেন কাউন্টারে বসা মহিলাটি।

লাইন ব্যতিরেকে কেন এই কাজ করলেন, এ কথা বলায় তিনি তো রেগে আগুন। তিনি বললেন, ফ্রি চিকিৎসা পাচ্ছেন ত তাই একটু দেরি সহ্য করতে পারেন না। রোগীটি তৎক্ষণাৎ বললেন, ফ্রি চিকিৎসা মানে, আমরাদের ট্যাক্সে চলে এই হাসপাতাল। এই কথা বলায় উক্ত কর্মী আরো রেগে গেলেন। তিনি আরও বললেন যান আপনার সরকারকে গিয়ে বলেন এসব কথা, এসব কথা রাজনীতির মাঠে বলবেন। তিনি নিলেন শুধু আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানোর ফির টাকাটা জমা নিলেন। বাকিটা পরের দিন জমা দিতে বললেন।

ফি জমা দেয়ার পর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার লাইনে দাঁড়ালো রোগীটি। ডাক্তার মহোদয় চেম্বারে নেই। কেন নেই জানতে চাইলে, চেম্বারের সামনে টুলে বসে থাকা লোকটি বলল, তা তিনি তা বলতে পারবেন না, তবে তিনি আসবেন, কখন আসবেন তা সে জানে না। তিনি আরও জানালেন এই ডাক্তার কারো কথা শুনবেন না, এমনকি পরিচালক বললেও কাজ হবে না, তিনি তার মর্জিমাফিক আসবেন আল্ট্রা করাবেন।

বেলা সোয়া ৪টায় আল্ট্রাসনোগ্রাফির ডাক্তার এলেন। রোগীটি তার আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে যখন রাস্তায় বের হলেন তখন ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বাজে। পরের দিন আবার গেলেন রক্ত ও প্রসাবের টেস্ট করাতে, লাইনে দাঁড়িয়ে ফি জমা তারপর সেম্পল দিলেন প্যাথলজিতে। প্যাথলজি থেকে জানানো হল, আগামী দিন তার টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হবে। বহিঃবিভাগে ডাক্তার দেখাতে একজন রোগীর মোট পাঁচটি কর্ম-দিবস লাগে। তারপর সহ্য করতে হয় অবর্ণনীয় অপমানজনক আচরণ। পাঁচ কর্ম-দিবসে মজুরির হিসাব করলে দেখা যায়, যদি রোগীটি দিনমজুরও হয় তাহলে তার পাঁচ কর্ম-দিবসে প্রতি কর্ম-দিবসে ৬শ টাকা হারে তিন হাজার টাকা নষ্ট হয় একবার ডাক্তার দেখাতে। এই হলো সরকারি চিকিৎসা সেবার হাল। এমন বিড়ম্বনা (বিড়ম্ববনা বললে ভুল হবে অসহনীয় মানসিক অত্যাচার সহ্য করা, এটা বলা সঠিক হবে) সহ্য করে মানুষের সরকারি চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে। তাই দেখা যায়, এরকম যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষ ছুটে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দিকে। আর এ সুযোগটা নিচ্ছে একজন দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ; সনদবিহীন চিকিৎসক হয়ে চিকিৎসার নামে করছে রমরমা ব্যবসা।

বর্তমান সরকার সরকারি হাসপাতালগুলোর ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ করেছেন; যা বিশ্বের অনেক আধুনিক হাসপাতালের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের তুলনা করা যায়। ভেতরকার সেবা প্রদানকারীরা যে কতটা বীভৎস তা অবকাঠামো দেখে বুঝা কঠিন। বিষয়টা অনেকটা উপরের ফিটফাট ভেতরে সদরঘাটের মতো। শোনা যায়, বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সরকারি হাসপাতালের কর্মীরা উৎকোচ পায়, যার জন্য তারা এই দুর্ব্যবহার করে। যাতে এই দুর্ব্যবহার সহ্য না করে রোগীরা বাধ্য হয় বেসরকারি চিকিৎসাসেবা নিতে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top