alt

উপ-সম্পাদকীয়

টঙ্ক আন্দোলনের কুমুদিনী হাজং

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ৩০ মার্চ ২০২৪
image

কুমুদিনী হাজং

শনিবার, মার্চ ২৪, ২০২৪; এই দিনে ব্রিটিশ শাসনামলে সংঘটিত ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের হাজং সম্প্রদায়ের নেত্রী কুমুদিনী হাজং ১০২ বছর বয়সে তার নিজ বাড়ি নেত্রকোনায় মারা গেছেন। জমিদারের অন্যায্য খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন এই কুমুদিনী হাজং। সেই সময়ে ব্রিটিশ ও জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াকু হাজংদের মধ্যে কেবল কুমুদিনী হাজং কালের সাক্ষী হয়ে এতদিন বেঁচে ছিলেন। তিনিও আজ চলে গেলেন।

নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে বহেরাতলী গ্রামে কুমুদিনী হাজংয়ের জন্ম। বহেরাতলী গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় কুমুদিনী হাজং কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য ছিলেন এবং নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে কমরেড মণি সিংহের স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধন করেন।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। সুসং দুর্গাপুর জমিদারের প্রজা ছিল হাজং সম্প্রদায়। টঙ্ক বা ধানকাবারি খাজনা ছিল এমন একটি প্রথা যার আওতায় ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান-খাজনা জমিদারকে দিতে হতো। এই প্রথায় উৎপাদিত ফসলের পরিমাণের ওপর নয়, বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণের ভিত্তিতে খাজনা নির্ধারিত হতো; প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল মার খেলেও জোর করে খাজনা আদায় করা হতো, তাই টঙ্কা প্রথা হাজং কৃষকদের দরিদ্র ও নিঃস্ব করে তোলে। অথচ হাজংরা একসময় খাজনামুক্ত জমি চাষের সুযোগ পেয়েছিল, বিনিময়ে শুধু বন্যহাতি ধরে জমিদারকে দিয়ে দেয়া হতো। জমিদার সেই হাতি বেশি দামে অন্য জমিদারের কাছে বিক্রি করতেন।

‘গারো হিলস অ্যাক্ট, ১৮৬৯’ পাস হওয়ার পর জমির মালিকানা চলে যায় ইংরেজদের হাতে এবং এতে হাজংরা বিনা খাজনায় জমি চাষের সুযোগ হারায়। কৃষিই ছিল হাজংদের প্রধান পেশা; তাই তারা নিজেদের স্বার্থেই টঙ্ক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে সুসং দুর্গাপুর জমিদারের ভাগ্নে হচ্ছেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহ। ১৯৩৭ সালে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে সূচিত এই টঙ্ক আন্দোলন ছিল স্থানীয় জমিদারের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।

হাজংদের নিয়ন্ত্রণে রেখে একটিভিস্টদের শায়েস্তা করতে ১৯৪৬ সালে দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এই ক্যাম্প স্থাপনের পর টঙ্ক প্রথাবিরোধী হাজংরা প্রতিদিন ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর অত্যাচারের শিকার হতো। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকারের সশস্ত্র সেনারা কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বরকে ধরতে তার বাড়িতে হানা দেয়।

লংকেশ্বর হাজং ও তার ভাইদের ধরতে না পেরে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং লংকেশ্বর হাজংয়ের পরিবর্তে তার নববিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে জোর করে টেনেহিঁছড়ে দুর্গাপুর সেনাছাউনির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এই খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে টঙ্ক আন্দোলনের আরেক নেত্রী রাশিমণি হাজং শতাধিক নারী পুরুষসহ দেশীয় দা, কুড়াল, বল্লম, লাঠি, তীর, ধনুক নিয়ে কুমুদিনীকে ছাড়িয়ে আনতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

এমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে সশস্ত্র সেনারা রাশিমণি হাজং এবং সুরেন্দ্র হাজংকে গুলি করে হত্যা করে। দুই সহযোদ্ধাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে ঘটনায় উপস্থিত হাজং নারী-পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সশস্ত্র সেনাদের ওপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালায়। হাজংদের এই হামলায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর দুজন সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। হামলায় হতবুদ্ধি হয়ে সেনারা কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। কিন্তু পরদিন ব্রিটিশ সেনারা কুমুদিনী হাজং ও রাশিমণিদের বহেরাতলী গ্রামে এসে সব তছনছ করে তা-ব চালালেও একটিভিস্ট কাউকে খুঁজে পায়নি।

ঘটনার কিছুদিন পর রাশমণির স্বামী পাঞ্জি স্ত্রীর শোকে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে সংজ্ঞাহীন কুমুদিনী হাজংকে নেয়া হয় কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের পাহাড়ঘেরা গোপন আস্তানায়। ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর আগমন বার্তা পেয়ে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী ও ভাসুররা আগেই মণি সিংহের আস্তানায় এসে অবস্থান নিয়েছিল। বহেরাতলী গ্রামে হাজংদের সশস্ত্র আক্রমণে দুজন সেনা মারা যাওয়ায় সরকার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে এবং মামলায় কমরেড মণি সিংহ, কুমুদিনী হাজংসহ একটিভিস্ট সব হাজংদের আসামি করা হয়।

সেনাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে কুমুদিনী হাজং ফেরারি জীবনে ‘সরস্বতী’ নাম ধারণ করেন। নিপীডড়ত মানবতার জন্য আত্মবিসর্জন দিয়ে রাশমণি হাজং হয়ে যান হাজং সম্প্রদায়ের ‘হাজং মাতা’, আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টঙ্ক আন্দোলনের মহান নেত্রী। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হলে এই নির্মম প্রথার বিলোপ হয়।

লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে শুধু রাজা-বাদশাহর অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের কাহিনী পড়েছি, শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের আত্মত্যাগের বর্ণনা না থাকায় প্রকৃত ইতিহাস আমাদের অজ্ঞাত থেকে গেছে। এখনো যে ইতিহাস চর্চা হয় তাতে গ্রামাঞ্চলের অচ্ছ্যুত মানুষদের কথা উঠে আসে না। কুমুদিনী হাজং না মরলে তার সংগ্রামী জীবন বা রাশমণি হাজং ও সুরেন্দ্র হাজংয়ের গুলি খেয়ে মরার খবর বিস্মৃত হয়ে থেকে যেত। ক্ষমতাবান ও শক্তিধর শোষকদের শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুগে যুগে কুমুদিনী হাজংরা লড়াই করে গেছেন, তাদের বিস্মৃত হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সত্যি অসম্ভব। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের শোষণ আর উলঙ্গ সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি থেকে নিষ্কৃত পাওয়ার প্রত্যাশায়। তাই একাত্তরে আমাদের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে পূর্বসূরি রাশমণি হাজং বা কুমুদিনী হাজংয়ের আত্মত্যাগের ঋণ অস্বীকার করা যাবে না।

‘একুশে’ বা ‘স্বাধীনতা’ পদক দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই সরকার মাঝে মাঝে উপযুক্ত লোক খুঁজে বেড়ায় দাসানুদাস মনোবৃত্তির পদলেহি বিদগ্ধজনদের মধ্যে। উপযুক্ত লোকের অভাবে একই লোককে সব পদকে ভূষিত করে বর্তমানে পদকের শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসন এবং জমিদারদের অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা লড়তে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকা অপরিহার্য। সংগ্রামী নারী ফুলো মূর্মূ, ঝানো মূর্মূ, ইলা মিত্র, লীলা নাগ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস, মাজেরা, জামিলা, মাতঙ্গিনী হাজরা ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তারা এখনো নবীনদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণা।

বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে যিনি গুলি ছুঁড়েছিলেন সেই বীণা দাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর রোডে গড়ে ওঠা একটি অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন, সারা কলকাতা ঘুরে ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করেছেন। লড়াই-সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজংও তার জীবদ্দশায় একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারতেন। রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য, যারা পদক বা পুরস্কার পায় না তারা অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় চিরঞ্জীব হয়ে ওঠেন। টঙ্ক আন্দোলনের নেতা কুমুদিনী হাজংয়ের স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রইল।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

টঙ্ক আন্দোলনের কুমুদিনী হাজং

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

কুমুদিনী হাজং

শনিবার, ৩০ মার্চ ২০২৪

শনিবার, মার্চ ২৪, ২০২৪; এই দিনে ব্রিটিশ শাসনামলে সংঘটিত ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের হাজং সম্প্রদায়ের নেত্রী কুমুদিনী হাজং ১০২ বছর বয়সে তার নিজ বাড়ি নেত্রকোনায় মারা গেছেন। জমিদারের অন্যায্য খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন এই কুমুদিনী হাজং। সেই সময়ে ব্রিটিশ ও জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াকু হাজংদের মধ্যে কেবল কুমুদিনী হাজং কালের সাক্ষী হয়ে এতদিন বেঁচে ছিলেন। তিনিও আজ চলে গেলেন।

নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে বহেরাতলী গ্রামে কুমুদিনী হাজংয়ের জন্ম। বহেরাতলী গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় কুমুদিনী হাজং কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য ছিলেন এবং নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে কমরেড মণি সিংহের স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধন করেন।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। সুসং দুর্গাপুর জমিদারের প্রজা ছিল হাজং সম্প্রদায়। টঙ্ক বা ধানকাবারি খাজনা ছিল এমন একটি প্রথা যার আওতায় ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান-খাজনা জমিদারকে দিতে হতো। এই প্রথায় উৎপাদিত ফসলের পরিমাণের ওপর নয়, বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণের ভিত্তিতে খাজনা নির্ধারিত হতো; প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল মার খেলেও জোর করে খাজনা আদায় করা হতো, তাই টঙ্কা প্রথা হাজং কৃষকদের দরিদ্র ও নিঃস্ব করে তোলে। অথচ হাজংরা একসময় খাজনামুক্ত জমি চাষের সুযোগ পেয়েছিল, বিনিময়ে শুধু বন্যহাতি ধরে জমিদারকে দিয়ে দেয়া হতো। জমিদার সেই হাতি বেশি দামে অন্য জমিদারের কাছে বিক্রি করতেন।

‘গারো হিলস অ্যাক্ট, ১৮৬৯’ পাস হওয়ার পর জমির মালিকানা চলে যায় ইংরেজদের হাতে এবং এতে হাজংরা বিনা খাজনায় জমি চাষের সুযোগ হারায়। কৃষিই ছিল হাজংদের প্রধান পেশা; তাই তারা নিজেদের স্বার্থেই টঙ্ক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে সুসং দুর্গাপুর জমিদারের ভাগ্নে হচ্ছেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহ। ১৯৩৭ সালে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে সূচিত এই টঙ্ক আন্দোলন ছিল স্থানীয় জমিদারের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।

হাজংদের নিয়ন্ত্রণে রেখে একটিভিস্টদের শায়েস্তা করতে ১৯৪৬ সালে দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এই ক্যাম্প স্থাপনের পর টঙ্ক প্রথাবিরোধী হাজংরা প্রতিদিন ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর অত্যাচারের শিকার হতো। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকারের সশস্ত্র সেনারা কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বরকে ধরতে তার বাড়িতে হানা দেয়।

লংকেশ্বর হাজং ও তার ভাইদের ধরতে না পেরে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং লংকেশ্বর হাজংয়ের পরিবর্তে তার নববিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে জোর করে টেনেহিঁছড়ে দুর্গাপুর সেনাছাউনির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এই খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে টঙ্ক আন্দোলনের আরেক নেত্রী রাশিমণি হাজং শতাধিক নারী পুরুষসহ দেশীয় দা, কুড়াল, বল্লম, লাঠি, তীর, ধনুক নিয়ে কুমুদিনীকে ছাড়িয়ে আনতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

এমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে সশস্ত্র সেনারা রাশিমণি হাজং এবং সুরেন্দ্র হাজংকে গুলি করে হত্যা করে। দুই সহযোদ্ধাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে ঘটনায় উপস্থিত হাজং নারী-পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সশস্ত্র সেনাদের ওপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালায়। হাজংদের এই হামলায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর দুজন সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। হামলায় হতবুদ্ধি হয়ে সেনারা কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। কিন্তু পরদিন ব্রিটিশ সেনারা কুমুদিনী হাজং ও রাশিমণিদের বহেরাতলী গ্রামে এসে সব তছনছ করে তা-ব চালালেও একটিভিস্ট কাউকে খুঁজে পায়নি।

ঘটনার কিছুদিন পর রাশমণির স্বামী পাঞ্জি স্ত্রীর শোকে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে সংজ্ঞাহীন কুমুদিনী হাজংকে নেয়া হয় কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের পাহাড়ঘেরা গোপন আস্তানায়। ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর আগমন বার্তা পেয়ে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী ও ভাসুররা আগেই মণি সিংহের আস্তানায় এসে অবস্থান নিয়েছিল। বহেরাতলী গ্রামে হাজংদের সশস্ত্র আক্রমণে দুজন সেনা মারা যাওয়ায় সরকার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে এবং মামলায় কমরেড মণি সিংহ, কুমুদিনী হাজংসহ একটিভিস্ট সব হাজংদের আসামি করা হয়।

সেনাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে কুমুদিনী হাজং ফেরারি জীবনে ‘সরস্বতী’ নাম ধারণ করেন। নিপীডড়ত মানবতার জন্য আত্মবিসর্জন দিয়ে রাশমণি হাজং হয়ে যান হাজং সম্প্রদায়ের ‘হাজং মাতা’, আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টঙ্ক আন্দোলনের মহান নেত্রী। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হলে এই নির্মম প্রথার বিলোপ হয়।

লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে শুধু রাজা-বাদশাহর অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের কাহিনী পড়েছি, শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের আত্মত্যাগের বর্ণনা না থাকায় প্রকৃত ইতিহাস আমাদের অজ্ঞাত থেকে গেছে। এখনো যে ইতিহাস চর্চা হয় তাতে গ্রামাঞ্চলের অচ্ছ্যুত মানুষদের কথা উঠে আসে না। কুমুদিনী হাজং না মরলে তার সংগ্রামী জীবন বা রাশমণি হাজং ও সুরেন্দ্র হাজংয়ের গুলি খেয়ে মরার খবর বিস্মৃত হয়ে থেকে যেত। ক্ষমতাবান ও শক্তিধর শোষকদের শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুগে যুগে কুমুদিনী হাজংরা লড়াই করে গেছেন, তাদের বিস্মৃত হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সত্যি অসম্ভব। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের শোষণ আর উলঙ্গ সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি থেকে নিষ্কৃত পাওয়ার প্রত্যাশায়। তাই একাত্তরে আমাদের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে পূর্বসূরি রাশমণি হাজং বা কুমুদিনী হাজংয়ের আত্মত্যাগের ঋণ অস্বীকার করা যাবে না।

‘একুশে’ বা ‘স্বাধীনতা’ পদক দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই সরকার মাঝে মাঝে উপযুক্ত লোক খুঁজে বেড়ায় দাসানুদাস মনোবৃত্তির পদলেহি বিদগ্ধজনদের মধ্যে। উপযুক্ত লোকের অভাবে একই লোককে সব পদকে ভূষিত করে বর্তমানে পদকের শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসন এবং জমিদারদের অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা লড়তে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকা অপরিহার্য। সংগ্রামী নারী ফুলো মূর্মূ, ঝানো মূর্মূ, ইলা মিত্র, লীলা নাগ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস, মাজেরা, জামিলা, মাতঙ্গিনী হাজরা ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তারা এখনো নবীনদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণা।

বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে যিনি গুলি ছুঁড়েছিলেন সেই বীণা দাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর রোডে গড়ে ওঠা একটি অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন, সারা কলকাতা ঘুরে ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করেছেন। লড়াই-সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজংও তার জীবদ্দশায় একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারতেন। রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য, যারা পদক বা পুরস্কার পায় না তারা অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় চিরঞ্জীব হয়ে ওঠেন। টঙ্ক আন্দোলনের নেতা কুমুদিনী হাজংয়ের স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রইল।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের]

back to top