alt

উপ-সম্পাদকীয়

ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতির অন্যতম কারণ

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: বুধবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২২

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা আমলাতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। তারা চেয়েছিল উপমহাদেশে এমন এক এলিট শ্রেণী তৈরি করতে যারা দেখতে ভারতীয় কিন্তু মগজে ব্রিটিশ। মূলত ব্রিটিশদের শাসন, শোষণ ও স্বার্থ রক্ষা করা ছিল তাদের দায়িত্ব। তাদের সেভাবেই ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হতো। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের শেষ ১০০ বছরে ইংরেজদের মানুষ প্রচন্ড ঘৃণা করতে শুরু করে। তাই, তাদের দিয়েই ট্যাক্স তোলা সহজ হতো। ফলে প্রশাসনের বড় পদগুলো যেমন সচিব-অতিরিক্ত সচিব-যুগ্ম সচিব লেভেলের পদগুলোতে ইংরেজরা নিজেরাই কাজ করত আর ছোট পদগুলোতে ছিল ভারতীয় চেহারার ব্রিটিশ মগজের অফিসারগুলো। এসব ভারতীয় আমলারাই মাঠ প্রশাসনে কাজ করত। ব্রিটিশরা আমলাতন্ত্র যত আইন-কানুন নিয়মনীতি তৈরি করেছে, তার প্রায় সবই সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলা হয় জনগণের সেবক। কিন্তু বাস্তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে সেবক নামক প্রভুর হাতে নানাভাবে, নানা সময়ে। সব দপ্তরসমূহে নাগরিক সেবা সহজীকরণের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনবান্ধব হওয়ার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যেই নেয়া হয়েছে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল। এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। ২০১২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ কৌশল প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়। দেশের সাধারণ নাগরিক যেন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাছ থেকে ভালো ব্যবহার ও সময়মতো কাজ বুঝে পায় এবং কোনভাবেই যেন দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করাই এই কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য। দাপ্তরিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনার জন্যই এ পদক্ষেপ। প্রশাসনে যদি জবাবদিহিতা না থাকে, তবে অগ্রগতির সব আশাই বৃথা হতে বাধ্য। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তাই সরকারের শুদ্ধাচারের পরিকল্পনার প্রধান বিষয়ই হচ্ছে উল্লিখিত লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আর তা প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। তাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিন লালিত প্রভুসুলভ আচরণ পরিহারে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সেজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সচেতনতামূলক আন্দোলন সঞ্চারিত করা।

তথ্য অধিকার আইনের একটি শক্তিশালী বিধান হলো, সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো সর্বোচ্চ পরিমাণ তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অর্থাৎ নাগরিক বা সাংবাদিকদের চাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো নিজ নিজ দপ্তরের কাজকর্ম-সংক্রান্ত অধিকাংশ তথ্য নিজ নিজ ওয়েবসাইটে এবং অন্যান্য মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ করবে এবং নাগরিকদের তরফ থেকে যে কোনো তথ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আন্তরিকভাবে প্রস্তুত থাকবে; সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানাবে না; বরং প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক আরও তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করবে। সরকারের নীতিনির্ধারক ও জনপ্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে তথ্য অধিকার আইনের মর্মকথা সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি জাগলে তারা কখনোই তথ্যকে সরকারি সম্পত্তি মনে করতে পারতেন না। তথ্য অধিকার আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের ক্ষমতায়ন ঘটানো, সরকারের কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, দুর্নীতি প্রতিহত করা; সর্বোপরি রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি যাতে জনগণের স্বার্থে কাজ করে, তা নিশ্চিত করা। এই সবকিছুর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুকূল মানসিকতা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে সেটাই অনুপস্থিত।

তথ্যই শক্তি আর অবাধ তথ্যে প্রবেশাধিকারের মধ্য দিয়ে দাপ্তরিক কাজের স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিকে কমিয়ে আনার পাশাপাশি নাগরিক সেবার মান নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্যদিকে সংবিধানের ২১(২) মতে, প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য জনগণের সেবার চেষ্টা করা। বিশ্বব্যাপী কর্তৃপক্ষের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের সব পদক্ষেপে অবাধ তথ্য প্রবাহ ও তথ্যে অভিগম্যতার গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এটি বলা অত্যুক্তি হবে না যে দারিদ্র্য বিলোপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারী উন্নয়নে, জেন্ডার সমতা অর্জনে, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু হার কমানো ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে তথ্যের অবাধপ্রবাহ, জনগণের তথ্যে প্রবেশাধিকার তথা তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও জীবন থেকে এ কথাই বারবার উঠে এসেছে, ব্যক্তি মানুষের উন্নয়ন ও চরিত্র গঠন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চিন্তা অবান্তর। সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন ‘সোনার মানুষ’। সোনার মানুষ হচ্ছে সেই মানুষ যে চিন্তা, ভাবনা, কথা এবং কাজে শুদ্ধ। স্বাধীনতার পর একটি গান বেতার, টেলিভিশন, মঞ্চে প্রায়শ প্রচারিত হতো : “শোনো কৃষক, শোনো শ্রমিক, শোনো মজুর ভাই/ সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ব্যক্তি ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। ‘মানবতার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ’ রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘অনুপার্জিত আয়’-কে সর্বতোভাবে বারিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণের’ অঙ্গীকার করেছে। একই অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান।

বর্তমান সরকারের প্রণীত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- ‘উন্নয়ন কর্মকান্ড’। উন্নয়ন কর্মকান্ড বেশি হওয়া মানে বেশি অর্থের লেনদেন। যেখানে যত বেশি টাকা পয়সা খরচ হয়, সেখানে দুর্নীতির সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। সেজন্য উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় অগ্রসরমান বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে গত এক যুগে প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন আইনকানুন, নিয়মনীতি, পরিকল্পনা এবং কৌশল। সেগুলো বাস্তবায়নও অব্যাহত আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পদ্ধতিগত সংস্কার, তাদের কৃত্য, কৃতি ও দক্ষতার উন্নয়ন এবং সর্বোপরি একটি সমন্বিত ও সংঘবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে শুদ্ধাচারকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কি থেমে আছে দুর্নীতি? আইন প্রয়োগ করে দুর্নীতি বিস্তৃতির রাশ কিছুটা টেনে ধরা গেলেও সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিকে রুখে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গত এক যুগের বেশি সময়ে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের নেতিবাচক অবস্থানের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান, দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম ও ব্যবস্থা গ্রহণ মানুষকে আশান্বিত করছে। মানুষের এ ইতিবাচক বোধ এবং উপলব্ধিকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়।

ছোট পদগুলোতে ছিল ভারতীয় চেহারার ব্রিটিশ মগজের অফিসারগুলো। এসব ভারতীয় আমলারাই মাঠ প্রশাসনে কাজ করত

প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি বন্ধ হওয়া দরকার। দরকার মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরা। কারণ, প্রশাসনিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এবং কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দুর্নীতিবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার প্রভাব বন্ধ করতে হলে প্রশাসনের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্তন দরকার হয়। আমলাদের স্বার্থপরতা আর তোষণ নীতি সরকারের নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নষ্ট করছে। অধিকন্তু প্রশাসনিক ও নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতির অন্যতম কারণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তথ্য অধিকার আইনের স্পিরিটে নাগরিক সেবা ও সুশীল সেবা কী নিশ্চিত হচ্ছে? পাশাপাশি প্রচলিত আমলাতন্ত্রে সরকারের শুদ্ধাচার কৌশলের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। সর্বোপরি এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তথ্য অধিকার আইন ও শুদ্ধাচার কৌশলের বাস্তবায়ন ছাড়া উন্নয়ন সোনার পাথর বাটিতে পরিণত হবে। তাই আসুন সব সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করি।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতির অন্যতম কারণ

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বুধবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২২

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা আমলাতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। তারা চেয়েছিল উপমহাদেশে এমন এক এলিট শ্রেণী তৈরি করতে যারা দেখতে ভারতীয় কিন্তু মগজে ব্রিটিশ। মূলত ব্রিটিশদের শাসন, শোষণ ও স্বার্থ রক্ষা করা ছিল তাদের দায়িত্ব। তাদের সেভাবেই ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হতো। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের শেষ ১০০ বছরে ইংরেজদের মানুষ প্রচন্ড ঘৃণা করতে শুরু করে। তাই, তাদের দিয়েই ট্যাক্স তোলা সহজ হতো। ফলে প্রশাসনের বড় পদগুলো যেমন সচিব-অতিরিক্ত সচিব-যুগ্ম সচিব লেভেলের পদগুলোতে ইংরেজরা নিজেরাই কাজ করত আর ছোট পদগুলোতে ছিল ভারতীয় চেহারার ব্রিটিশ মগজের অফিসারগুলো। এসব ভারতীয় আমলারাই মাঠ প্রশাসনে কাজ করত। ব্রিটিশরা আমলাতন্ত্র যত আইন-কানুন নিয়মনীতি তৈরি করেছে, তার প্রায় সবই সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলা হয় জনগণের সেবক। কিন্তু বাস্তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে সেবক নামক প্রভুর হাতে নানাভাবে, নানা সময়ে। সব দপ্তরসমূহে নাগরিক সেবা সহজীকরণের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনবান্ধব হওয়ার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যেই নেয়া হয়েছে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল। এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। ২০১২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ কৌশল প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়। দেশের সাধারণ নাগরিক যেন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাছ থেকে ভালো ব্যবহার ও সময়মতো কাজ বুঝে পায় এবং কোনভাবেই যেন দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করাই এই কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য। দাপ্তরিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনার জন্যই এ পদক্ষেপ। প্রশাসনে যদি জবাবদিহিতা না থাকে, তবে অগ্রগতির সব আশাই বৃথা হতে বাধ্য। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তাই সরকারের শুদ্ধাচারের পরিকল্পনার প্রধান বিষয়ই হচ্ছে উল্লিখিত লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আর তা প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। তাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিন লালিত প্রভুসুলভ আচরণ পরিহারে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সেজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সচেতনতামূলক আন্দোলন সঞ্চারিত করা।

তথ্য অধিকার আইনের একটি শক্তিশালী বিধান হলো, সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো সর্বোচ্চ পরিমাণ তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অর্থাৎ নাগরিক বা সাংবাদিকদের চাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো নিজ নিজ দপ্তরের কাজকর্ম-সংক্রান্ত অধিকাংশ তথ্য নিজ নিজ ওয়েবসাইটে এবং অন্যান্য মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ করবে এবং নাগরিকদের তরফ থেকে যে কোনো তথ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আন্তরিকভাবে প্রস্তুত থাকবে; সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানাবে না; বরং প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক আরও তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করবে। সরকারের নীতিনির্ধারক ও জনপ্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে তথ্য অধিকার আইনের মর্মকথা সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি জাগলে তারা কখনোই তথ্যকে সরকারি সম্পত্তি মনে করতে পারতেন না। তথ্য অধিকার আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের ক্ষমতায়ন ঘটানো, সরকারের কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, দুর্নীতি প্রতিহত করা; সর্বোপরি রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি যাতে জনগণের স্বার্থে কাজ করে, তা নিশ্চিত করা। এই সবকিছুর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুকূল মানসিকতা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে সেটাই অনুপস্থিত।

তথ্যই শক্তি আর অবাধ তথ্যে প্রবেশাধিকারের মধ্য দিয়ে দাপ্তরিক কাজের স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিকে কমিয়ে আনার পাশাপাশি নাগরিক সেবার মান নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্যদিকে সংবিধানের ২১(২) মতে, প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য জনগণের সেবার চেষ্টা করা। বিশ্বব্যাপী কর্তৃপক্ষের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের সব পদক্ষেপে অবাধ তথ্য প্রবাহ ও তথ্যে অভিগম্যতার গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এটি বলা অত্যুক্তি হবে না যে দারিদ্র্য বিলোপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারী উন্নয়নে, জেন্ডার সমতা অর্জনে, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু হার কমানো ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে তথ্যের অবাধপ্রবাহ, জনগণের তথ্যে প্রবেশাধিকার তথা তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও জীবন থেকে এ কথাই বারবার উঠে এসেছে, ব্যক্তি মানুষের উন্নয়ন ও চরিত্র গঠন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চিন্তা অবান্তর। সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন ‘সোনার মানুষ’। সোনার মানুষ হচ্ছে সেই মানুষ যে চিন্তা, ভাবনা, কথা এবং কাজে শুদ্ধ। স্বাধীনতার পর একটি গান বেতার, টেলিভিশন, মঞ্চে প্রায়শ প্রচারিত হতো : “শোনো কৃষক, শোনো শ্রমিক, শোনো মজুর ভাই/ সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ব্যক্তি ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। ‘মানবতার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ’ রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘অনুপার্জিত আয়’-কে সর্বতোভাবে বারিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণের’ অঙ্গীকার করেছে। একই অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান।

বর্তমান সরকারের প্রণীত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- ‘উন্নয়ন কর্মকান্ড’। উন্নয়ন কর্মকান্ড বেশি হওয়া মানে বেশি অর্থের লেনদেন। যেখানে যত বেশি টাকা পয়সা খরচ হয়, সেখানে দুর্নীতির সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। সেজন্য উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় অগ্রসরমান বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে গত এক যুগে প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন আইনকানুন, নিয়মনীতি, পরিকল্পনা এবং কৌশল। সেগুলো বাস্তবায়নও অব্যাহত আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পদ্ধতিগত সংস্কার, তাদের কৃত্য, কৃতি ও দক্ষতার উন্নয়ন এবং সর্বোপরি একটি সমন্বিত ও সংঘবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে শুদ্ধাচারকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কি থেমে আছে দুর্নীতি? আইন প্রয়োগ করে দুর্নীতি বিস্তৃতির রাশ কিছুটা টেনে ধরা গেলেও সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিকে রুখে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গত এক যুগের বেশি সময়ে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের নেতিবাচক অবস্থানের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান, দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম ও ব্যবস্থা গ্রহণ মানুষকে আশান্বিত করছে। মানুষের এ ইতিবাচক বোধ এবং উপলব্ধিকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়।

ছোট পদগুলোতে ছিল ভারতীয় চেহারার ব্রিটিশ মগজের অফিসারগুলো। এসব ভারতীয় আমলারাই মাঠ প্রশাসনে কাজ করত

প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি বন্ধ হওয়া দরকার। দরকার মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরা। কারণ, প্রশাসনিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এবং কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দুর্নীতিবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার প্রভাব বন্ধ করতে হলে প্রশাসনের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্তন দরকার হয়। আমলাদের স্বার্থপরতা আর তোষণ নীতি সরকারের নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নষ্ট করছে। অধিকন্তু প্রশাসনিক ও নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতির অন্যতম কারণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তথ্য অধিকার আইনের স্পিরিটে নাগরিক সেবা ও সুশীল সেবা কী নিশ্চিত হচ্ছে? পাশাপাশি প্রচলিত আমলাতন্ত্রে সরকারের শুদ্ধাচার কৌশলের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। সর্বোপরি এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তথ্য অধিকার আইন ও শুদ্ধাচার কৌশলের বাস্তবায়ন ছাড়া উন্নয়ন সোনার পাথর বাটিতে পরিণত হবে। তাই আসুন সব সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করি।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top