alt

উপ-সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘ কী করছে, রাজ্য সরকারের অবস্থানইবা কী

গৌতম রায়

: শনিবার, ১৬ মার্চ ২০২৪

আরএসএস তাদের সাংগঠনিক স্তরে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বলে না। বলে ‘বাংলা’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কিছুদিন আগে এই রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ করবার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন, সেটির পেছনে কিন্তু রাজ্য বা রাজ্যবাসীর স্বার্থের থেকেও তার কাছে সঙ্ঘের সাংগঠিক লব্জটিকে জলচল করানোর দিকেই বেশি লক্ষ্য ছিল।

বাঁকুড়া জেলার লোকপুরাতে সূফি সাধক গাজী ইসমাইলের দরগা কয়েক শতাব্দী ধরে আছে। কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র বিশ্বাসের ভিত্তিতে হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার চালায় যে, বেণুগোপালের মন্দির ধ্বংস করে লোকপুরাতে সূফি সন্ত গাজী ইসমাইলের মাজার নির্মিত হয়েছে। গোটা বাঁকুড়া জেলাতে সমন্বয়ী সংস্কৃতির ধারা প্রবাহে গাজী ইসমাইলের উদার ভাবনা একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্মের অনেক রীতিনীতির সঙ্গে বাঁকড়ার আদিবাসী সমাজের নৈকট্য তেমন একটা না থাকলেও গাজী ইসমাইলের মাজার দিয়ে যে সমন্বয়ী, মরমী সাধনার ধারা প্রবাহিত হয়, সেই প্রবাহের সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সর্বোপরি অর্থনৈতিকভাবে একটা সুসম্পর্ক সেখানকার আদিবাসী সমাজের আছে।

সমন্বয়ী সংস্কৃতি চর্চার ধারাবাহিকতা বীরভূম জেলার একটা বৈশিষ্ট্য। চন্ডীদাস-জয়দেব- কেঁদুলি-রবীন্দ্রনাথ-পাথরচাপড়ি-দাতাপীরÑ সব মিলিয়ে যে মানবরতনের জয়গান যুগ যুগ ধরে বীরভূম জেলাতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে, তার আবেশ বাংলা তথা ভারতকে অতিক্রম করে বিশ্ব মানবতার চরৈবতির ধারাকে পরিপুষ্ট করেছে।

সমন্বয়ী সাধনার অন্যতম বৈশিষ্ট্যযুক্ত মোড়গ্রাম কুদরত-ই খুদা থেকে রেজাউল করীমের মতো মনীষীদের যে ভূমি ধারণ করেছে, সেই মোড়গ্রামের সৈয়দবাবার মাজার এখন আরএসএসের লক্ষ্যবস্তু। এই পবিত্র মাজার ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের আজগুবি দাবি, মাজারটি নাকি হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসপ্রাপ্ত নানা সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয়েছে।

মাহবুব শাহ-দাতাপীর বা দাদাপীর নামে যিনি যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেনÑ এই পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা বসে এখানে দাতাপীরের দরবারে। বাউল-ফকির-মারফতির গানে গানে মানুষ রতনের সন্ধানে শুধু পাথরচাপড়িই নয়, সংলগ্ন তাতিপাড়া, রাজনগর, খয়রাডিহিসহ বক্রেশ্বর লাগোয়া প্রায় প্রতিটি গ্রামের হিন্দু-মুসলমান-তফশিলী জাতি-উপজাতি-আদিবাসী মানুষদের মধ্যে দাতাপীর, তাকে ঘিরে মেলাÑ এসব নিয়ে এক অসাধারণ সমন্বয়ী ভাবধারার এক রসপ্রবাহ বয়ে চলে। সেই রসধারা এই অঞ্চলে মানুষের সম্প্রীতির ভিতকে যুগ যুগ ধরে মজবুত করে আসছে।

১২২১ খ্রিস্টাব্দে বীরভূমে অবস্থান করতেন প্রখ্যাত সুফীসাধক মাখদুম শাহ। বাংলায় সুফীধারার ভিতর দিয়ে মানবপ্রেমের প্রচারে মধ্যকালীন ভারতে মাখদুম শাহের অবদান অবিস্মরণীয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে মাখদুম শাহের প্রেমের বাণীর কথা বহুবার উল্লেখ করেছেন। তার সমাধিস্থল, সিউয়ান দরগা, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের কাছে বিশেষ আদরের। সেই একই হাস্যকর দাবি হিন্দুত্ববাদীদের; বহু মন্দিরের সামগ্রী দিয়ে নাকি এই মাজারটি তৈরি করা হয়েছিল।

১৭০৩ সালে বর্ধমানের ইছলাবাজার মসজিদটি নির্মিত। অষ্টাদশ শতকে নির্মিত এই মসজিদটিকেও মন্দিরের সামগ্রী দিয়ে তৈরি করবার মনগড়া অভিযোগে ধ্বংসের তালিকাতে রেখেছে আরএসএস।

বর্ধমানেরই কসবার রাজা মসজিদ নাকি মন্দিরের উপকরণ দিয়ে তৈরি। কালনা মহকুমাতে শাহ মাজিল মধ্যকালীন ভারতে সুফী ভাবধারায় মরমী সাধনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। পঞ্চদশ শতকে গোটা রাঢ় বাংলায় বৈষ্ণব ধারার বিকাশে সুফীধারার প্রেমের বাণী একটা অপূর্ব সমন্বয়ী চেতনার সৃষ্টি করেছিল। এই ধারার রেশ আজও রাঢ় বাংলায় প্রবাহিত রয়েছে। ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত শাহ মাজিলের বর্ধমানের কালনা মহকুমাজুড়ে সুফীধারার এক অসামান্য প্রবাহ বইয়ে দিয়েছিলেন। তার দরগাটিও মন্দিরের জিনিসপত্র দিয়ে তৈরিÑ এমন আজগুবি অভিযোগ তুলে, সেই দরগাটিও সঙ্ঘ তাদের ধ্বংসের তালিকাতে রেখেছে।

১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল কালনার শাহি মসজিদ। গোটা রাঢ় বাংলাজুড়ে সমন্বয়ী ভাবধারার প্রসারে, বিশেষ করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবার ক্ষেত্রে এ মসজিদটির ভূমিকা ঐতিহাসিক। এটিও মন্দির ভেঙে তৈরিÑ এমন মনগড়া অভিযোগ করছে সঙ্ঘ।

বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট অঞ্চলটি হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সংস্কৃতির যে ধারার প্রচলন করেছে, সেটি বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখেছে। ১৫২৩-২৪ সালে এখানে যে জামা মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল, সেটি রাঢ় বাংলায় শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মধ্যকালীন ভারত থেকেই একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। মন্দির ভেঙে এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছে এই মনগড়া অভিযোগ করছে হিন্দুত্ববাদীরা।

রাইখা ও সেখানকার তালাবওয়ালি মসজিদ স্থানীয় স্তরে খুব জনপ্রিয় একটি মসজিদ। আরএসএস মনে করে, এই মসজিদটিও মন্দির ভেঙে নাকি তৈরি। বর্ধমানের সুয়াতায় সৈয়দ শাহ শাহীদ মুহাম্মদ বাহমানির দরগাটি আরএসএসের মতে বৌদ্ধ উপাসনালয় ভেঙে তৈরি। নীতিগতভাবে বৌদ্ধদের সংখ্যালঘু অধিকার দিতে নারাজ আরএসএসের। তাদের পরিকল্পিত অভিন্ন দেয়ানি বিধিতে বৌদ্ধদের ব্যক্তিগত আইনের অবলুপ্তির কথাই সঙ্ঘ বলে। কিন্তু মজার কথা হলো, বর্ধমানের এই দরগাটি শুধু ওই জেলাতেই নয়, গোটা রাঢ় বঙ্গে সমন্বয়ী সংস্কৃতির একটি অন্যতম কেন্দ্র, ওখানকার ওরস ঘিরে বাংলাদেশ থেকেও তীর্থযাত্রীরা আসেন, তাইই বৌদ্ধ উপাসনালয় ভেঙে এ দরগা তৈরির আজগুবি তত্ত্বের অবতারণা সঙ্ঘ করছে।

চতুর্দশ শতকে (১৩৪২) কলকাতার বেনিয়াপুকুরে একটি মসজিদ তৈরি করেছিলেন আলাউদ্দিন আলাউল হক নামক এক সুফী সন্ত। মধ্যকালীন ভারতে সমন্বয়ী ভাবধারার প্রচারে এই সুফী সন্তের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এই মসজিদটিও মন্দির ভেঙে নাকি তৈরিÑ এমন অসত্য, বিভ্রান্তিকর কথা বলে সঙ্ঘ। এ মসজিদ ঘিরে হিন্দুত্ববাদীরা যে প্রচার কলকাতায় চালাচ্ছে সেটি কি গোয়েন্দা পুলিশের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না? কেন এমন প্রচার চালিয়ে যাওয়া আরএসএস কর্মীদের সম্পর্কে একদম শীতল মনোভাব দেখিয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিয়ন্ত্রাধীন গোয়েন্দারা?

কলকাতা সন্নিহিত হাওড়া জেলার বেশ কিছু মসজিদ এবং মাজার হিন্দুত্ববাদীদের ধ্বংসের তালিকাতে রয়েছে। হাওড়া শিল্পাঞ্চল যেহেতু ভাষা এবং ধর্মের দিক থেকে মিশ্র জনজাতি পূর্ণ। এই জেলার গঙ্গাবিলাস অঞ্চলে যে পীর সাহিব কি মসজিদ, স্থানীয় মানুষদের কাছে সমন্বয়ী সংস্কৃতির একটা পরম্পরাবহন করে আসছে বহুকাল ধরে।

মালদহ জেলার বহু মসজিদ হিন্দুত্ববাদীদের টার্গেট। মালদহ জেলা নাকি তৈরিই হয়েছে হিন্দুরাজাদের রাজধানী লক্ষণাবতী ধ্বংস করে।

হিন্দুত্ববাদী শিবিরের তৎপরতার কারণে কেরালা রাজ্য সরকার সব রকমের প্রশাসনিক সতর্কতা নিয়েছেন। সিপিআই (এম) দলগতভাবে সেখানে যেভাবে সঙ্ঘের সঙ্গে প্রত্যক্ষ মোকাবিলাতে প্রতিনিয়ত রয়েছে- এটা গোটা দেশে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একটা বিশেষ সাহস জোগায়; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেভাবে সঙ্ঘের এ রাজ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে এবং সামাজিক বিভাজন তৈরি করছে তা ঘিরে কোনো প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থান আজ পর্যন্ত নেয়নি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘ কী করছে, রাজ্য সরকারের অবস্থানইবা কী

গৌতম রায়

শনিবার, ১৬ মার্চ ২০২৪

আরএসএস তাদের সাংগঠনিক স্তরে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বলে না। বলে ‘বাংলা’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কিছুদিন আগে এই রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ করবার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন, সেটির পেছনে কিন্তু রাজ্য বা রাজ্যবাসীর স্বার্থের থেকেও তার কাছে সঙ্ঘের সাংগঠিক লব্জটিকে জলচল করানোর দিকেই বেশি লক্ষ্য ছিল।

বাঁকুড়া জেলার লোকপুরাতে সূফি সাধক গাজী ইসমাইলের দরগা কয়েক শতাব্দী ধরে আছে। কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র বিশ্বাসের ভিত্তিতে হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার চালায় যে, বেণুগোপালের মন্দির ধ্বংস করে লোকপুরাতে সূফি সন্ত গাজী ইসমাইলের মাজার নির্মিত হয়েছে। গোটা বাঁকুড়া জেলাতে সমন্বয়ী সংস্কৃতির ধারা প্রবাহে গাজী ইসমাইলের উদার ভাবনা একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্মের অনেক রীতিনীতির সঙ্গে বাঁকড়ার আদিবাসী সমাজের নৈকট্য তেমন একটা না থাকলেও গাজী ইসমাইলের মাজার দিয়ে যে সমন্বয়ী, মরমী সাধনার ধারা প্রবাহিত হয়, সেই প্রবাহের সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সর্বোপরি অর্থনৈতিকভাবে একটা সুসম্পর্ক সেখানকার আদিবাসী সমাজের আছে।

সমন্বয়ী সংস্কৃতি চর্চার ধারাবাহিকতা বীরভূম জেলার একটা বৈশিষ্ট্য। চন্ডীদাস-জয়দেব- কেঁদুলি-রবীন্দ্রনাথ-পাথরচাপড়ি-দাতাপীরÑ সব মিলিয়ে যে মানবরতনের জয়গান যুগ যুগ ধরে বীরভূম জেলাতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে, তার আবেশ বাংলা তথা ভারতকে অতিক্রম করে বিশ্ব মানবতার চরৈবতির ধারাকে পরিপুষ্ট করেছে।

সমন্বয়ী সাধনার অন্যতম বৈশিষ্ট্যযুক্ত মোড়গ্রাম কুদরত-ই খুদা থেকে রেজাউল করীমের মতো মনীষীদের যে ভূমি ধারণ করেছে, সেই মোড়গ্রামের সৈয়দবাবার মাজার এখন আরএসএসের লক্ষ্যবস্তু। এই পবিত্র মাজার ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের আজগুবি দাবি, মাজারটি নাকি হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসপ্রাপ্ত নানা সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয়েছে।

মাহবুব শাহ-দাতাপীর বা দাদাপীর নামে যিনি যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেনÑ এই পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা বসে এখানে দাতাপীরের দরবারে। বাউল-ফকির-মারফতির গানে গানে মানুষ রতনের সন্ধানে শুধু পাথরচাপড়িই নয়, সংলগ্ন তাতিপাড়া, রাজনগর, খয়রাডিহিসহ বক্রেশ্বর লাগোয়া প্রায় প্রতিটি গ্রামের হিন্দু-মুসলমান-তফশিলী জাতি-উপজাতি-আদিবাসী মানুষদের মধ্যে দাতাপীর, তাকে ঘিরে মেলাÑ এসব নিয়ে এক অসাধারণ সমন্বয়ী ভাবধারার এক রসপ্রবাহ বয়ে চলে। সেই রসধারা এই অঞ্চলে মানুষের সম্প্রীতির ভিতকে যুগ যুগ ধরে মজবুত করে আসছে।

১২২১ খ্রিস্টাব্দে বীরভূমে অবস্থান করতেন প্রখ্যাত সুফীসাধক মাখদুম শাহ। বাংলায় সুফীধারার ভিতর দিয়ে মানবপ্রেমের প্রচারে মধ্যকালীন ভারতে মাখদুম শাহের অবদান অবিস্মরণীয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে মাখদুম শাহের প্রেমের বাণীর কথা বহুবার উল্লেখ করেছেন। তার সমাধিস্থল, সিউয়ান দরগা, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের কাছে বিশেষ আদরের। সেই একই হাস্যকর দাবি হিন্দুত্ববাদীদের; বহু মন্দিরের সামগ্রী দিয়ে নাকি এই মাজারটি তৈরি করা হয়েছিল।

১৭০৩ সালে বর্ধমানের ইছলাবাজার মসজিদটি নির্মিত। অষ্টাদশ শতকে নির্মিত এই মসজিদটিকেও মন্দিরের সামগ্রী দিয়ে তৈরি করবার মনগড়া অভিযোগে ধ্বংসের তালিকাতে রেখেছে আরএসএস।

বর্ধমানেরই কসবার রাজা মসজিদ নাকি মন্দিরের উপকরণ দিয়ে তৈরি। কালনা মহকুমাতে শাহ মাজিল মধ্যকালীন ভারতে সুফী ভাবধারায় মরমী সাধনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। পঞ্চদশ শতকে গোটা রাঢ় বাংলায় বৈষ্ণব ধারার বিকাশে সুফীধারার প্রেমের বাণী একটা অপূর্ব সমন্বয়ী চেতনার সৃষ্টি করেছিল। এই ধারার রেশ আজও রাঢ় বাংলায় প্রবাহিত রয়েছে। ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত শাহ মাজিলের বর্ধমানের কালনা মহকুমাজুড়ে সুফীধারার এক অসামান্য প্রবাহ বইয়ে দিয়েছিলেন। তার দরগাটিও মন্দিরের জিনিসপত্র দিয়ে তৈরিÑ এমন আজগুবি অভিযোগ তুলে, সেই দরগাটিও সঙ্ঘ তাদের ধ্বংসের তালিকাতে রেখেছে।

১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল কালনার শাহি মসজিদ। গোটা রাঢ় বাংলাজুড়ে সমন্বয়ী ভাবধারার প্রসারে, বিশেষ করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবার ক্ষেত্রে এ মসজিদটির ভূমিকা ঐতিহাসিক। এটিও মন্দির ভেঙে তৈরিÑ এমন মনগড়া অভিযোগ করছে সঙ্ঘ।

বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট অঞ্চলটি হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সংস্কৃতির যে ধারার প্রচলন করেছে, সেটি বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখেছে। ১৫২৩-২৪ সালে এখানে যে জামা মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল, সেটি রাঢ় বাংলায় শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মধ্যকালীন ভারত থেকেই একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। মন্দির ভেঙে এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছে এই মনগড়া অভিযোগ করছে হিন্দুত্ববাদীরা।

রাইখা ও সেখানকার তালাবওয়ালি মসজিদ স্থানীয় স্তরে খুব জনপ্রিয় একটি মসজিদ। আরএসএস মনে করে, এই মসজিদটিও মন্দির ভেঙে নাকি তৈরি। বর্ধমানের সুয়াতায় সৈয়দ শাহ শাহীদ মুহাম্মদ বাহমানির দরগাটি আরএসএসের মতে বৌদ্ধ উপাসনালয় ভেঙে তৈরি। নীতিগতভাবে বৌদ্ধদের সংখ্যালঘু অধিকার দিতে নারাজ আরএসএসের। তাদের পরিকল্পিত অভিন্ন দেয়ানি বিধিতে বৌদ্ধদের ব্যক্তিগত আইনের অবলুপ্তির কথাই সঙ্ঘ বলে। কিন্তু মজার কথা হলো, বর্ধমানের এই দরগাটি শুধু ওই জেলাতেই নয়, গোটা রাঢ় বঙ্গে সমন্বয়ী সংস্কৃতির একটি অন্যতম কেন্দ্র, ওখানকার ওরস ঘিরে বাংলাদেশ থেকেও তীর্থযাত্রীরা আসেন, তাইই বৌদ্ধ উপাসনালয় ভেঙে এ দরগা তৈরির আজগুবি তত্ত্বের অবতারণা সঙ্ঘ করছে।

চতুর্দশ শতকে (১৩৪২) কলকাতার বেনিয়াপুকুরে একটি মসজিদ তৈরি করেছিলেন আলাউদ্দিন আলাউল হক নামক এক সুফী সন্ত। মধ্যকালীন ভারতে সমন্বয়ী ভাবধারার প্রচারে এই সুফী সন্তের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এই মসজিদটিও মন্দির ভেঙে নাকি তৈরিÑ এমন অসত্য, বিভ্রান্তিকর কথা বলে সঙ্ঘ। এ মসজিদ ঘিরে হিন্দুত্ববাদীরা যে প্রচার কলকাতায় চালাচ্ছে সেটি কি গোয়েন্দা পুলিশের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না? কেন এমন প্রচার চালিয়ে যাওয়া আরএসএস কর্মীদের সম্পর্কে একদম শীতল মনোভাব দেখিয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিয়ন্ত্রাধীন গোয়েন্দারা?

কলকাতা সন্নিহিত হাওড়া জেলার বেশ কিছু মসজিদ এবং মাজার হিন্দুত্ববাদীদের ধ্বংসের তালিকাতে রয়েছে। হাওড়া শিল্পাঞ্চল যেহেতু ভাষা এবং ধর্মের দিক থেকে মিশ্র জনজাতি পূর্ণ। এই জেলার গঙ্গাবিলাস অঞ্চলে যে পীর সাহিব কি মসজিদ, স্থানীয় মানুষদের কাছে সমন্বয়ী সংস্কৃতির একটা পরম্পরাবহন করে আসছে বহুকাল ধরে।

মালদহ জেলার বহু মসজিদ হিন্দুত্ববাদীদের টার্গেট। মালদহ জেলা নাকি তৈরিই হয়েছে হিন্দুরাজাদের রাজধানী লক্ষণাবতী ধ্বংস করে।

হিন্দুত্ববাদী শিবিরের তৎপরতার কারণে কেরালা রাজ্য সরকার সব রকমের প্রশাসনিক সতর্কতা নিয়েছেন। সিপিআই (এম) দলগতভাবে সেখানে যেভাবে সঙ্ঘের সঙ্গে প্রত্যক্ষ মোকাবিলাতে প্রতিনিয়ত রয়েছে- এটা গোটা দেশে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একটা বিশেষ সাহস জোগায়; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেভাবে সঙ্ঘের এ রাজ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে এবং সামাজিক বিভাজন তৈরি করছে তা ঘিরে কোনো প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থান আজ পর্যন্ত নেয়নি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top