alt

উপ-সম্পাদকীয়

সাজা কমিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা কি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে

সামসুল ইসলাম টুকু

: মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমছে না। বছর বছর জাতীয় সড়ক দিবস পালিত হয়। ‘গতিসীমা মেনে চলি, দুর্ঘটনা রোধ করি’ ‘সময়ের চেয়ে জীবন মূল্যবান’ এমন বহু স্লোগান সামনে রেখে আলোচনা সভা, সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। লিফলেট বিলি হয়, শোভাযাত্রা হয় কিন্তু দুর্ঘটনা কমে না।

সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়ন না থাকা এবং চালক কর্তৃক যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি, ট্রাফিক আইন না মানা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তারপরেও পরিবহন শ্রমিকদের অব্যাহত দাবির মুখে পরিবহন আইন সংশোধন করা হচ্ছে। আইনের ১২টি ধারায় চালক ও চালকের সহকারীদের জেল জরিমানা ও শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন সংশোধন আইন-২০২৪ এর খসড়া নীতিগত সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এই অনুমোদন দেয়া হয়। ১২টি ধারায় আর্থিক জরিমানা কমানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে ৮টিতে জরিমানা কমানো হয়েছে। এছাড়া এর আগে ৩টি ধারায় অজামিনযোগ্য ধারা থাকলেও এখন মাত্র ১টিতে অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। গত ৪ বছর ধরেই এই দর কসাকসি চালু থাকলেও পরিবহন শ্রমিকরা তদের স্বার্থেও দুর্ঘটনা কমানোর কোনো উদ্যগ গ্রহণ করেনি বরং দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির জরিপ থেকে জানা যায় ২০২৩ সালে মোট ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৯০২ জন এবং আহত হয়েছেন ১০ হাজার ৩৭২ জন। উল্লেখিত এই দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬ বছরের গড় জরিপের চেয়েও অনেক বেশি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় ওই ৬ বছরে ৩১ হাজার ৬৯৩টি দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৯৬ হাজার ৫১৭ জন আহত হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে দুর্ঘটনা ৫ হাজার ২৮২টি, মৃত্যু ৭ হাজার ৩০৯ এবং আহত ১৬ হাজার ৮৬। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নিরাপদ সড়ক করার জন্য কোনো প্রতিশ্রুতি কাজ করছে না। ২০১১-২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তার দশক ঘোষণা করে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু অনুসাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সে অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেনি। ধারাবাহিকভাবে চারবারের ক্ষমতাসীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ও সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে নিরাপদ সড়কের জনদাবি ও নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ৩০ বছরের আন্দোলন বৃথাই গেছে। পরিবহন সেক্টরের জনবিরোধী আন্দোলনের কাছে সরকার জনগন সবাই হার মেনেছে।

এদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক্টর ও ট্রলির শ্রমিক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় পতিত হয় ৩৩ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল, ভটভটি, নসিমন, অটোরিকশা সিএনজি চালানোর সময় ১৭ শতাংশ দুর্ঘটনায় পতিত হয়। অন্যদিকে এসব যানবাহনের যাত্রী হিসেবে ৪২ শতাংশ এবং পথচারী হিসেবে ৮ শতাংশ দুর্ঘটনার শিকার হন। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে মোটরযানের যাত্রী ও পথচারী ৫০ শতাংশ যেমন হতাহত হয় তেমনি মোটরযানের চালক হেল্পার কন্ডাক্টর শ্রমিক ও ৫০ শতাংশ হতাহত হয় ।

বিষয়টি চালক মাথায় রাখলেও দুর্ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু তারা এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করে সতর্ক হয় না। এজন্য দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত পঙ্গু চালকদের ছবিসহ পরিচয় প্রতিটি পরিবহন শ্রমিকদের আস্তানায় টাঙিয়ে রাখার ব্যবস্থা করলে এবং পাশাপাশি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রতিদিন সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করলে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবনতা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ হতে পারে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে ১ জাজার ৬৫৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭৫৮ জন নিহত ও ১ হাজার ১২৩ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫% এর বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর এবং ৬০% দুর্ঘটনা ঘটেছে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং উচ্চগতির মোটরসাইকেল ক্রয়, ব্যবহার, ট্রাফিক আইন না মানা ও না জানা।

দেশে এখন ৩৭ লাখ মোটরসাইকেল। এর মধ্যে ৯ লাখই ঢাকায়। ইতোমধ্যে দেশে মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা হয়েছে এবং আগামীতে মোটরসাইকেল কম দামে ও সহজে পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারও বাড়বে। সড়ক ও মহাসড়কের দুর্ঘটনায় মৃতের ৩০% মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, কার ও মাইক্রোতে সিটবেল্টের ব্যাবহার এবং মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহার করলে মৃতের হার ৩০/৪০ শতাংশ কমতে পারে। হয়তো তাই। কিন্তু ট্রাফিক আইন না মানলে নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া গাড়ি চালালে মৃতের সংখ্যা আদৌ কম হবে না। এজন্য কঠোরভাবে পরিবহন আইন প্রয়োগ জরুরি। কিন্তু তা না হয়ে যদি সে আইন প্রয়োগে শিথিলতা দেখানো হয়, সাজা লাঘব করা হয় তবে দুর্ঘটনা বাড়বে, কমবে না। পরিবহন আইন ২০১৮ তে যেসব বিষয়গুলোকে অপরাধ বিবেচনা করে শাস্তির বিধান করা হয়েছিল সেগুলোকে সরকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকের চাপে সংশোধন করে শাস্তির পরিমাণ অর্ধেকেরও কম করেছে ।

পরিবহন মালিকদের ইচ্ছায় যাত্রীদের ভাড়া গত ৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নিরীহ যাত্রীরা ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে আওয়াজ তুললেও সে আওয়াজ সরকারের কাছে পৌঁছায় না। তাই ভাড়া বাড়িয়ে মালিকদের এবং পরিবহন আইনের সাজা কমিয়ে শ্রমিকদের সুবিধা করে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেয়া ছাড়া কিছু হচ্ছে না। তারপরেও এর শুভ পরিণতি দেখার জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া জাতির কোনো উপায় নেই ।

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণের একটি অলিখিত সংস্কৃতি চালু আছে বহুকাল থেকে। তা হলোÑ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত যদি থানায় মামলা করতে পারে বা পুলিশ দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে মামলার ঝামেলা এড়াতে গাড়ির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ২০/৩০ হাজার টাকা আর পুলিশের সেলামি দিয়ে মীমাংশা করে নেয়। এই সুবিধা অনেকে পায় আবার অনেকে পায় না। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে একটি রিট আবেদনের পরপ্রেক্ষিতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে আইন অনুযায়ী তহবিল গঠনের নির্দেশ দেয়া হবে না কেন তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৫৩ ও ৫৪ ধারায় নিহত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ এবং আহত ব্যক্তির চিকিৎসার বিধান রয়েছে। তথাপি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন ও পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করাসহ দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ ইতোমধ্যে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে পঙ্গু ভিক্ষুকদের প্রায় ৮২ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার এবং তাদের মাত্র ১২ শতাংশ চিকিৎসার জন্য সামান্য সহযোগিতা পেয়েছে। তাই মানবিক দিক থেকেও তহবিল গঠন জরুরি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পৌঁছে দেয়া আবশ্যক।

[লেখক : সাংবাদিক]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সাজা কমিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা কি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে

সামসুল ইসলাম টুকু

মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমছে না। বছর বছর জাতীয় সড়ক দিবস পালিত হয়। ‘গতিসীমা মেনে চলি, দুর্ঘটনা রোধ করি’ ‘সময়ের চেয়ে জীবন মূল্যবান’ এমন বহু স্লোগান সামনে রেখে আলোচনা সভা, সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। লিফলেট বিলি হয়, শোভাযাত্রা হয় কিন্তু দুর্ঘটনা কমে না।

সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়ন না থাকা এবং চালক কর্তৃক যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি, ট্রাফিক আইন না মানা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তারপরেও পরিবহন শ্রমিকদের অব্যাহত দাবির মুখে পরিবহন আইন সংশোধন করা হচ্ছে। আইনের ১২টি ধারায় চালক ও চালকের সহকারীদের জেল জরিমানা ও শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন সংশোধন আইন-২০২৪ এর খসড়া নীতিগত সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এই অনুমোদন দেয়া হয়। ১২টি ধারায় আর্থিক জরিমানা কমানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে ৮টিতে জরিমানা কমানো হয়েছে। এছাড়া এর আগে ৩টি ধারায় অজামিনযোগ্য ধারা থাকলেও এখন মাত্র ১টিতে অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। গত ৪ বছর ধরেই এই দর কসাকসি চালু থাকলেও পরিবহন শ্রমিকরা তদের স্বার্থেও দুর্ঘটনা কমানোর কোনো উদ্যগ গ্রহণ করেনি বরং দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির জরিপ থেকে জানা যায় ২০২৩ সালে মোট ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৯০২ জন এবং আহত হয়েছেন ১০ হাজার ৩৭২ জন। উল্লেখিত এই দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬ বছরের গড় জরিপের চেয়েও অনেক বেশি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় ওই ৬ বছরে ৩১ হাজার ৬৯৩টি দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৯৬ হাজার ৫১৭ জন আহত হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে দুর্ঘটনা ৫ হাজার ২৮২টি, মৃত্যু ৭ হাজার ৩০৯ এবং আহত ১৬ হাজার ৮৬। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নিরাপদ সড়ক করার জন্য কোনো প্রতিশ্রুতি কাজ করছে না। ২০১১-২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তার দশক ঘোষণা করে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু অনুসাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সে অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেনি। ধারাবাহিকভাবে চারবারের ক্ষমতাসীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ও সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে নিরাপদ সড়কের জনদাবি ও নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ৩০ বছরের আন্দোলন বৃথাই গেছে। পরিবহন সেক্টরের জনবিরোধী আন্দোলনের কাছে সরকার জনগন সবাই হার মেনেছে।

এদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক্টর ও ট্রলির শ্রমিক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় পতিত হয় ৩৩ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল, ভটভটি, নসিমন, অটোরিকশা সিএনজি চালানোর সময় ১৭ শতাংশ দুর্ঘটনায় পতিত হয়। অন্যদিকে এসব যানবাহনের যাত্রী হিসেবে ৪২ শতাংশ এবং পথচারী হিসেবে ৮ শতাংশ দুর্ঘটনার শিকার হন। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে মোটরযানের যাত্রী ও পথচারী ৫০ শতাংশ যেমন হতাহত হয় তেমনি মোটরযানের চালক হেল্পার কন্ডাক্টর শ্রমিক ও ৫০ শতাংশ হতাহত হয় ।

বিষয়টি চালক মাথায় রাখলেও দুর্ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু তারা এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করে সতর্ক হয় না। এজন্য দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত পঙ্গু চালকদের ছবিসহ পরিচয় প্রতিটি পরিবহন শ্রমিকদের আস্তানায় টাঙিয়ে রাখার ব্যবস্থা করলে এবং পাশাপাশি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রতিদিন সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করলে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবনতা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ হতে পারে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে ১ জাজার ৬৫৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭৫৮ জন নিহত ও ১ হাজার ১২৩ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫% এর বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর এবং ৬০% দুর্ঘটনা ঘটেছে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং উচ্চগতির মোটরসাইকেল ক্রয়, ব্যবহার, ট্রাফিক আইন না মানা ও না জানা।

দেশে এখন ৩৭ লাখ মোটরসাইকেল। এর মধ্যে ৯ লাখই ঢাকায়। ইতোমধ্যে দেশে মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা হয়েছে এবং আগামীতে মোটরসাইকেল কম দামে ও সহজে পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারও বাড়বে। সড়ক ও মহাসড়কের দুর্ঘটনায় মৃতের ৩০% মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, কার ও মাইক্রোতে সিটবেল্টের ব্যাবহার এবং মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহার করলে মৃতের হার ৩০/৪০ শতাংশ কমতে পারে। হয়তো তাই। কিন্তু ট্রাফিক আইন না মানলে নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া গাড়ি চালালে মৃতের সংখ্যা আদৌ কম হবে না। এজন্য কঠোরভাবে পরিবহন আইন প্রয়োগ জরুরি। কিন্তু তা না হয়ে যদি সে আইন প্রয়োগে শিথিলতা দেখানো হয়, সাজা লাঘব করা হয় তবে দুর্ঘটনা বাড়বে, কমবে না। পরিবহন আইন ২০১৮ তে যেসব বিষয়গুলোকে অপরাধ বিবেচনা করে শাস্তির বিধান করা হয়েছিল সেগুলোকে সরকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকের চাপে সংশোধন করে শাস্তির পরিমাণ অর্ধেকেরও কম করেছে ।

পরিবহন মালিকদের ইচ্ছায় যাত্রীদের ভাড়া গত ৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নিরীহ যাত্রীরা ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে আওয়াজ তুললেও সে আওয়াজ সরকারের কাছে পৌঁছায় না। তাই ভাড়া বাড়িয়ে মালিকদের এবং পরিবহন আইনের সাজা কমিয়ে শ্রমিকদের সুবিধা করে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেয়া ছাড়া কিছু হচ্ছে না। তারপরেও এর শুভ পরিণতি দেখার জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া জাতির কোনো উপায় নেই ।

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণের একটি অলিখিত সংস্কৃতি চালু আছে বহুকাল থেকে। তা হলোÑ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত যদি থানায় মামলা করতে পারে বা পুলিশ দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে মামলার ঝামেলা এড়াতে গাড়ির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ২০/৩০ হাজার টাকা আর পুলিশের সেলামি দিয়ে মীমাংশা করে নেয়। এই সুবিধা অনেকে পায় আবার অনেকে পায় না। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে একটি রিট আবেদনের পরপ্রেক্ষিতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে আইন অনুযায়ী তহবিল গঠনের নির্দেশ দেয়া হবে না কেন তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৫৩ ও ৫৪ ধারায় নিহত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ এবং আহত ব্যক্তির চিকিৎসার বিধান রয়েছে। তথাপি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন ও পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করাসহ দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ ইতোমধ্যে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে পঙ্গু ভিক্ষুকদের প্রায় ৮২ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার এবং তাদের মাত্র ১২ শতাংশ চিকিৎসার জন্য সামান্য সহযোগিতা পেয়েছে। তাই মানবিক দিক থেকেও তহবিল গঠন জরুরি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পৌঁছে দেয়া আবশ্যক।

[লেখক : সাংবাদিক]

back to top