alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

অমৃত চিছাম

: রোববার, ৩১ মার্চ ২০২৪
image

পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া বেঁচে থাকার কথা চিন্তা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা প্রায় একই কথা। আমাদের দেহের প্রায় ৭০ ভাগই পানি। আমাদের রক্ত, মাংস, স্নায়ু, দাঁত, হাড় ইত্যাদি প্রতিটি অঙ্গের গঠনের জন্য পানির প্রয়োজন। একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ২-৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে বিষয়টি তা হলো পানি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা প্রত্যেকে প্রচুর পরিমাণ পানি ব্যবহার করে থাকি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে কয়েকটি বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তার মধ্যে একটি অন্যতম হলো পানি। এমনকি অনেকে ধারণা করেন ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয় তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে পানি। আর অতি আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত পানির সিংহভাগ অংশই পূরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার মাধ্যমে। বিভিন্ন কারণে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়া বিশেষ করে ফ্রেশ পানি দিন দিন কমে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে উক্ত বিষয়টি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজে প্রচুর পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করি, কিন্তু সেভাবে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ করা হয় না। এর একটি অন্যমত কারণ হলো দেশব্যাপী বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকা-। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। দেশে অভ্যন্তরে বসবাসরত এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়ে থাকে, আর চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ উৎস হতে উত্তোলন করার মাধ্যমে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে। সেই দেশগুলোর মধ্যে আমাদের প্রিয় স্বদেশের অবস্থান সপ্তম। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামলে দিন দিন হ্রাস পাবে সুপেয় পানির উৎস। আর যার প্রভাব সরাসরি কৃষি, শিল্প ও স্বাস্থ্য খাতে পরিলক্ষিত হবে। আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের। দেশে সেচব্যবস্থার প্রায় ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। উল্লেখ্য, প্রতি বছর ভূগর্ভ থেকে ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয়। আর এর সিংহভাগ অর্থাৎ ৮৬ শতাংশই ব্যবহার করা হয় সেচ কাজে। আর অপরিকল্পিতভাবে অত্যাধিক ভূর্গস্থ পানি উত্তোলনের ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা মৌসুমে গভীর ও অগভীর নলকূপগুলো পানি সংকটের মুখে পড়ছে। আর এ সমস্যার একটি সহজ ও কার্যকরী সমাধান হতে পারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও এর যথাযথ ব্যবহার। বৃষ্টির পানি ভূগর্ভের জলের সংশ্লিষ্টতা হতে পারে। দেশে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত- ২০৩ সেন্টিমিটার (২০৩০ মিলিমিটার বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৬.০১ ডিগ্রি. সে.। উত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় লালাখাল (সিলেট) ৩৮৮ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হয় লালপুর (নাটোর) ১৫৪ সেন্টিমিটার। দেশে বৃষ্টিপাতের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই সম্পন্ন হয় বর্ষাকালে। তাই যথাসম্ভব পরিবেশসম্মত উপায়ে ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা গেলে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমনÑ কৃষিকাজ, গাড়ি পরিষ্কার, কাপড় পরিষ্কার, টয়লেট ফ্লাশিং, সড়ক পরিষ্কার, সড়কের পাশে লাগানো গাছের পানির চাহিদা, আগুন নিভানো, বিনোদন কেন্দ্র, পাওয়ার স্টেশন, কলকারখানাসহ আরও হরেক রকম কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর যা আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ অনেকাংশে কমিয়ে দেবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে। বৃষ্টির পানি বহুলাংশে আমাদের মৃদু পানির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। বৃষ্টির পানি মৃদু পানির জন্য খুব ভালো একটি উৎস। এর বিভিন্ন রকম শারীরিক উপকারিতাও রয়েছে। যেমনÑ বৃষ্টির পানিতে আছে অ্যালকালাইন উপাদান, যা অ্যাসিডিটি কমায় ও হজমশক্তি বাড়ায়। এতে থাকা অ্যালকালাইন পিএইচ ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়। এই পানি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কাজ করে, যা ত্বক, চুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে। প্রতিদিন সকালে সংরক্ষণ করে রাখা বৃষ্টির পানি ২-৩ চামচ খেলে পাকস্থলীর সমস্যা দূর হয়। গরমে যাদের ত্বকে ঘামাচির সমস্যা রয়েছে তারা বৃষ্টির পানিতে গোসল করে সুফল পেতে পারেন। বৃষ্টির পানি পৃথিবীর সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য জীবন ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বৃষ্টির পানি সাধারণত নদী, হাওর, জলাশয়, গাছ, ফুল ও প্রাণী প্রদান করে যা জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়া ভূমিতে পর্যাপ্ত পানি পৌঁছানো, প্রাণীর খাবারের উৎসসমূহের ব্যাপক উন্নতি সাধন করে। এটি প্রাকৃতিক জলশংকর প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা জলচক্রে প্রাকৃতিক পুনর্বাহক হিসেবে কাজ করে। ১ হাজার বর্গফুট ছাদে ১ ইঞ্চি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে প্রায় ৬০০ গ্যালন পানি জমা হয়। তাই বর্তমানে পানি সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বৃষ্টির পানির পূর্ণ ব্যবহারের প্রতি আরও গভীর মনযোগী হতে হবে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি করে। এটি একটি সহজলভ্য নবায়নযোগ্য জলসম্পদ। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে শহুরে বন্যা অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে মাটির ক্ষয় রোধ করা সম্ভব। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পানি সংরক্ষণের খুবই সাশ্রয়ী ও কার্যকরী পদ্ধতি। রাষ্ট্রসংঘের এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, একজন মানুষের সারাদিনে খাওয়ার জন্য দরকার ৫ লিটার জল, স্যানিটেশনে ২০ লিটার, স্নানের জন্য ১৫ লিটার আর রান্নার জন্য ১০ লিটার। মোট ৫০ লিটারের মতো পানি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু ৬৭৬ বর্গমিটার বাড়ির ছাদে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারলে তা দিয়ে অন্তত ৪০ জন মানুষের সারা বছরের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও, সাধারণ জনগণ, জনপ্রতিনিধিদের আরও যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া পরিবেশ সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে যত কম ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার। অধিক পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ায় পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এছাড়া মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। এজন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, রেডিও, টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, যাতে সবাই বৃষ্টির পানি ব্যবহারের প্রতি আরও উৎসাহী হয়। যা আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ অনেকাংশে কমিয়ে দেবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে। সর্বোপরি ভূগর্ভস্থ পানির যথাযথ সংরক্ষণ ও ২০৩০ সালে ‘এসডিজি ৬’ বাস্তবায়নে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে, একইসঙ্গে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

অমৃত চিছাম

image

রোববার, ৩১ মার্চ ২০২৪

পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া বেঁচে থাকার কথা চিন্তা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা প্রায় একই কথা। আমাদের দেহের প্রায় ৭০ ভাগই পানি। আমাদের রক্ত, মাংস, স্নায়ু, দাঁত, হাড় ইত্যাদি প্রতিটি অঙ্গের গঠনের জন্য পানির প্রয়োজন। একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ২-৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে বিষয়টি তা হলো পানি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা প্রত্যেকে প্রচুর পরিমাণ পানি ব্যবহার করে থাকি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে কয়েকটি বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তার মধ্যে একটি অন্যতম হলো পানি। এমনকি অনেকে ধারণা করেন ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয় তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে পানি। আর অতি আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত পানির সিংহভাগ অংশই পূরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার মাধ্যমে। বিভিন্ন কারণে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়া বিশেষ করে ফ্রেশ পানি দিন দিন কমে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে উক্ত বিষয়টি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজে প্রচুর পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করি, কিন্তু সেভাবে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ করা হয় না। এর একটি অন্যমত কারণ হলো দেশব্যাপী বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকা-। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। দেশে অভ্যন্তরে বসবাসরত এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়ে থাকে, আর চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ উৎস হতে উত্তোলন করার মাধ্যমে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে। সেই দেশগুলোর মধ্যে আমাদের প্রিয় স্বদেশের অবস্থান সপ্তম। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামলে দিন দিন হ্রাস পাবে সুপেয় পানির উৎস। আর যার প্রভাব সরাসরি কৃষি, শিল্প ও স্বাস্থ্য খাতে পরিলক্ষিত হবে। আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের। দেশে সেচব্যবস্থার প্রায় ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। উল্লেখ্য, প্রতি বছর ভূগর্ভ থেকে ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয়। আর এর সিংহভাগ অর্থাৎ ৮৬ শতাংশই ব্যবহার করা হয় সেচ কাজে। আর অপরিকল্পিতভাবে অত্যাধিক ভূর্গস্থ পানি উত্তোলনের ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা মৌসুমে গভীর ও অগভীর নলকূপগুলো পানি সংকটের মুখে পড়ছে। আর এ সমস্যার একটি সহজ ও কার্যকরী সমাধান হতে পারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও এর যথাযথ ব্যবহার। বৃষ্টির পানি ভূগর্ভের জলের সংশ্লিষ্টতা হতে পারে। দেশে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত- ২০৩ সেন্টিমিটার (২০৩০ মিলিমিটার বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৬.০১ ডিগ্রি. সে.। উত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় লালাখাল (সিলেট) ৩৮৮ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হয় লালপুর (নাটোর) ১৫৪ সেন্টিমিটার। দেশে বৃষ্টিপাতের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই সম্পন্ন হয় বর্ষাকালে। তাই যথাসম্ভব পরিবেশসম্মত উপায়ে ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা গেলে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমনÑ কৃষিকাজ, গাড়ি পরিষ্কার, কাপড় পরিষ্কার, টয়লেট ফ্লাশিং, সড়ক পরিষ্কার, সড়কের পাশে লাগানো গাছের পানির চাহিদা, আগুন নিভানো, বিনোদন কেন্দ্র, পাওয়ার স্টেশন, কলকারখানাসহ আরও হরেক রকম কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর যা আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ অনেকাংশে কমিয়ে দেবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে। বৃষ্টির পানি বহুলাংশে আমাদের মৃদু পানির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। বৃষ্টির পানি মৃদু পানির জন্য খুব ভালো একটি উৎস। এর বিভিন্ন রকম শারীরিক উপকারিতাও রয়েছে। যেমনÑ বৃষ্টির পানিতে আছে অ্যালকালাইন উপাদান, যা অ্যাসিডিটি কমায় ও হজমশক্তি বাড়ায়। এতে থাকা অ্যালকালাইন পিএইচ ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়। এই পানি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কাজ করে, যা ত্বক, চুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে। প্রতিদিন সকালে সংরক্ষণ করে রাখা বৃষ্টির পানি ২-৩ চামচ খেলে পাকস্থলীর সমস্যা দূর হয়। গরমে যাদের ত্বকে ঘামাচির সমস্যা রয়েছে তারা বৃষ্টির পানিতে গোসল করে সুফল পেতে পারেন। বৃষ্টির পানি পৃথিবীর সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য জীবন ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বৃষ্টির পানি সাধারণত নদী, হাওর, জলাশয়, গাছ, ফুল ও প্রাণী প্রদান করে যা জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়া ভূমিতে পর্যাপ্ত পানি পৌঁছানো, প্রাণীর খাবারের উৎসসমূহের ব্যাপক উন্নতি সাধন করে। এটি প্রাকৃতিক জলশংকর প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা জলচক্রে প্রাকৃতিক পুনর্বাহক হিসেবে কাজ করে। ১ হাজার বর্গফুট ছাদে ১ ইঞ্চি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে প্রায় ৬০০ গ্যালন পানি জমা হয়। তাই বর্তমানে পানি সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বৃষ্টির পানির পূর্ণ ব্যবহারের প্রতি আরও গভীর মনযোগী হতে হবে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি করে। এটি একটি সহজলভ্য নবায়নযোগ্য জলসম্পদ। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে শহুরে বন্যা অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে মাটির ক্ষয় রোধ করা সম্ভব। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পানি সংরক্ষণের খুবই সাশ্রয়ী ও কার্যকরী পদ্ধতি। রাষ্ট্রসংঘের এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, একজন মানুষের সারাদিনে খাওয়ার জন্য দরকার ৫ লিটার জল, স্যানিটেশনে ২০ লিটার, স্নানের জন্য ১৫ লিটার আর রান্নার জন্য ১০ লিটার। মোট ৫০ লিটারের মতো পানি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু ৬৭৬ বর্গমিটার বাড়ির ছাদে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারলে তা দিয়ে অন্তত ৪০ জন মানুষের সারা বছরের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও, সাধারণ জনগণ, জনপ্রতিনিধিদের আরও যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া পরিবেশ সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে যত কম ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার। অধিক পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ায় পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এছাড়া মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। এজন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, রেডিও, টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, যাতে সবাই বৃষ্টির পানি ব্যবহারের প্রতি আরও উৎসাহী হয়। যা আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ অনেকাংশে কমিয়ে দেবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে। সর্বোপরি ভূগর্ভস্থ পানির যথাযথ সংরক্ষণ ও ২০৩০ সালে ‘এসডিজি ৬’ বাস্তবায়নে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে, একইসঙ্গে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়]

back to top