alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

শেখর ভট্টাচার্য

: সোমবার, ০১ এপ্রিল ২০২৪
image

এই সুবর্ণ পলির দেশে কৃষক-শ্রমিকেরা আমাদের অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে দেয়নি

‘প্রতিটি লেখকের হৃদয়ে ভেতরে একটি কলম থাকে, অথবা তার হৃদয় যেন কলমÑ সেই কলমটি লিখে যায় অবিরাম। ‘হৃদয়’ বলতে আমরা বুকের বাঁ দিকটা দেখিয়ে থাকি, সেই বাঁ দিকে আছে হৃৎপি- যার কাজ দূষিত রক্তকে শোধন করে সমস্ত শরীরে পাঠানো।...হৃদয়ের ভেতরে যে কলমের অস্তিত্ব আমি অনুভব করি, সেই কলম আসলে আমাদের রক্তের অন্তর্গত একটি কলম, অথবা রক্তই সেই কলম। রক্ত যে কথা কয় তা কৃত্রিম কিংবা অসত্য হতে পারে না।’

সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত ‘হৃৎকলমের টানে’ যখন সংকলিত হয়ে বই আকারে বের হয় ১৯৯০ সালে। তখন সৈয়দ হক প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় হৃদয় হরণ করা এই কথাগুলো লিখেছিলেন। আমি ক্ষুদ্র মানুষ তার থেকেও ক্ষুদ্র একজন লেখক। সৈয়দ শামসুল হকের সাথে আমার পরিচয় ছিলো না, তার সাথে দেখা হয়েছিলো একবার যশোরের একটি হোটেলে। দুই হাজার সাতের কোন এক শীতের বিকালে। এই দেখাকে পরিচয় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না।

যশোর শহরের ১৫ নম্বর কেশবলাল সড়কের হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনালের লবিতে আমি তাকে থামিয়েছিলাম। তিনি দোতালা থেকে নিচে নামছিলেন। আমি বিনয়ের সাথে তার সাথে কথা বলতে চাই। তিনি থামেন এবং আমার সাথে মিনিট পনেরো কথাও বললেন। এতো সাহস কোথায় সঞ্চয় করে রেখেছিলাম? ভাবলে অবাক হই এখন। আমার নিজের লেখালেখিতে দাড়ি বা ফুলস্টপ টেনেছি। আমি যে কোন এক সময় শৈশব, কৈশোর, প্রাক-যৌবনে কিছু কিছু লেখার চেষ্টা করতাম, সে কথা বলার সাহস হয়নি।

হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বিস্ময় নিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, নন্দনতত্ত্ব নিয়ে কোন কথা আসে না মস্তকে। সৈয়দ হকের সাথে কথা হয়েছিলো, তার লেখা উপন্যাস ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীরা’ এবং সংবাদে প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত ‘হৃৎকলমের টানে’ নিয়ে। তাকে কেমন করে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসি, ‘সেই পাখির ডাক কী এখনও শুনতে পান?’ তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সেই পাখির ডাক আমৃত্যু শুনে যাবো।’ কোন পাখির ডাক?

‘হৃৎকলমের টানের’ কোন এক সপ্তাহে সৈয়দ হক তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় কী অসাধারণ কথা লিখেছিলেন। মানুষের হয়ে, প্রকৃতির হয়ে, বিবেকের হয়ে একটি পাখি তাকে ডেকে যায় নিয়ত। ক্রমাগত বলে যায়, ‘শুনছো? শুনছো? শুনছো?’, এই কথাটির উপস্থাপনা এতো শক্তিশালী ও হৃদয়েরতন্ত্রীতে ডাক পাঠানোর মতো ছিলো যে, যারা লেখাটি পড়েছেন তারাও সে ডাক যেনো শুনতে পেতেন। ১৯৮৬ সালে তিনি শুরু করেন তার এই বিখ্যাত কলাম। অবরুদ্ধ দেশে তিনি প্রতীকীভাবে মানুষকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছিলেন। হোটেলের লবিতে তিনি বলেছিলেন ‘জেগে ওঠার ডাক যে লেখক সারা জীবন শুনতে পাবে না, তার সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।’

বয়ে চলা মহাকালের ঘড়িতে পনেরো মিনিট খুব কম সময়। সেই সময়ে যদি সৈয়দ হকের মতো মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় তাহলে সময়টি প্রকৃত অর্থে হিরণ¥য় হয়ে ওঠে। তাকে কিছুই বলতে পারিনি, তার লেখার প্রতি মুগ্ধতা, প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা এসব কথা কিছুই বলা হয়নি। তার পরেও তার জেগে ওঠার ডাক আমি শুনতে পাই। আমার একটি বিশ্বাসের কথা তার সাথে আলোচনা করলে আমি তৃপ্তি পেতাম। কথাটি হলো, প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের হৃদয়ে একটি নিস্পাপ এবং কৌতূহলী শিশু বাস করে। সে শিশু সারাদিন লেখককে অবিরত প্রশ্ন করে যায়। সে প্রশ্ন যদি লেখক শুনতে না পান, স্থবিরতা তাকে পেয়ে বসবে। লেখকের শব্দের ব্যবহার, রূপকল্প, কাব্যময়তা সব কিছু এক ঘেয়ে হয়ে যাবে। তিনি সারা জীবন একই কথা লিখে লিখে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। চিন্তার বৈচিত্র্য হারিয়ে সর্বহারা লেখকে পরিণত হবেন। মনের ভেতরে শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়। সে কাজে ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত লেখক সত্তার মৃত্যু হয়। আমার এ বিশ্বাস কী সত্যি? সৈয়দ হকের সাথে যদি অন্য কোথায়, অন্য কোন খানে কিংবা মেঘের ভেলায় আকাশে দেখা হয়ে যায়,তাহলে তাকে সে প্রশ্ন করা হবে। মনে হয় ‘জেগে ওঠার ডাক দেয়া’ পাখি আর বুকের ভেতরে বসত করা শিশু আসলে এক ও অভিন্ন। এক একজনের এক একরকম উপলব্ধি। আমি জানি না, আমি জানি না! আমি যা বললাম তা কি সত্যি। সত্যি মিথ্যা, মিথ্যা সত্যি। উপলব্ধির কী সত্যি মিথ্যা আছে, তাও বলা বড় কঠিন।

তবে একটি বিষয়ে মনে হয় সকলেই ঐকমত্য পোষণ করবেন তাহলোÑ মানবিক মানুষের মনের ভেতরে একটি অদৃশ্য বিবেকের বসতি আছে। বিবেক শক্তিশালী হয় কখনো কখনো জ্ঞান দিয়ে। জ্ঞান সিক্ত বিবেকের সাথে যুক্তি ও ইতিবাচক আবেগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়ে যায়। বিবেক যখন শক্তিশালী হয় বিবেচনা বোধ তখন প্রখর হয়ে যায়। বিবেক আর বিবেচনা কিন্তু সমার্থক শব্দ নয়। সংবেদনশীল বিবেক থেকে বিবেচনার জন্ম হয়। এরকম বিবেচনা সবসময় ইতিবাচক হতে বাধ্য। বিবেককে জাগ্রত করতে হলে এর পরিচর্যা করতে হয়। আর একটি কথা বলা যায়, শুধু মাত্র জ্ঞান দ্বারাই বিবেককে পরিপুষ্ট করা যায়না। যদিও এই লেখাটিতে একবার জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে তারপরও ‘ভালোবাসা’ বিবেক বিকাশের আর একটি শক্তিশালী উপাদান। তাই শক্তিশালী বিবেকের বসতি সকল শ্রেণীর মানুষের হৃদয়ে থাকতে পারে। ওই যে বিবেকবোধ থেকে জাগ্রত বিবেচনা, এর থেকেই সকল শ্রেণীর মানুষ একাত্তরে আধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের হাতিয়ার কী ছিলো? দেশপ্রেম অবশ্যই। জনতা জেগে ওঠে কথাটির অর্থ হলো বিবেকবোধ তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়। জনতা যখন জেগে উঠে তখন নিবেদন হয় সর্বোচ্চ মাত্রায়। মাতৃভূমি রক্ষায় পিপীলিকার মতো অগ্নি স্ফুলিঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে কুণ্ঠাবোধ করে না। ভয়াবহ মারণাস্ত্র তখন তাদের কাছে খেলনা হয়ে যায়। জনতার জেগে ওঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে ভিয়েতনামে, চীন, মার্কিন বলয়ের নিষ্ঠুর রাষ্ট্র নেতারা দেখেছেন একাত্তর সালে বাংলাদেশে। আর পাকিস্তান বাহিনী লাঠি এবং সামান্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে বাঙালির সাহস দেখে বিস্মিত হয়েছে, আর বিস্মিত হয়েছে সমগ্র বিশ্ব। ওই যে কালজয়ী সেই সঙ্গীতের মতোÑ ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।’

সৈয়দ শামসুল হককে পাখি নিয়ত ডেকে যেতো, মানুষের হয়ে, প্রকৃতির হয়ে, বিবেকের হয়ে ক্রমাগত বলে যেতো- ‘শুনছো? শুনছো? শুনছো?’, সেই পাখি এখন আর আমাদের কোনভাবেই ডাক দিয়ে যায় না। পাখির ডাকে বিবেক জেগে ওঠে না তাই আমাদের বিবেচনা বোধের অস্তিত্ব কখনো কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। পাখির ডাক শুধু শুনতে পায় ক্ষেতমজুর, পোশাক শ্রমিক, গভীর সমুদ্রে যারা জীবনবাজি রেখে মাছ ধরতে যায় সেসব মানুষেরা, যাদের পুঁজি শুধু দেহ, তাদের বিবেকবোধই শুধু জাগ্রত আছে। ওই যে এতো বড় করোনা মহামারি গেলো বাজারে কখনো খাদ্যদ্রব্যের জোগান কম হয়েছে? সারা বিশ্বের মানুষ কতোটুকু হাহাকার করেছে জানি না, তবে এই সুবর্ণ পলির দেশে কৃষক-শ্রমিকেরা আমাদের অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে দেননি, তবে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা তখনো টাকা পাচার করেছে। বিশ টাকার বালিশ বিশ হাজার টাকায় কিনেছে, বিক্রি করেছে। করোনার টিকা জালিয়াতি করেছে। লুন্ঠন থেমে থাকেনি, এখনও থেমে নেই। পাখি আর মানুষের বিবেককে জেগে তুলে না। মনের ভেতরের নিষ্পাপ শিশু প্রশ্ন করে না। সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, মানুষে মানুষে বৈষম্য এসব বিষয় নিয়ে এখন আর কেউ রাজপথে কথা বলে না। ভয়াবহ এক নীরবতার সংস্কৃতি আমাদের ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে।

এক সময়ের তেরোশত নদীতে ঘেরা বাংলাদেশের নদীগুলো যেমন দখল হয়ে যাচ্ছে, অচেতন হয়ে যাচ্ছে প্রায়, জাতির অন্তরের গহীনে থাকা দেশপ্রেমও ঠিক সেভাবে চৈত্র মাসে খরা-পীড়িত নদীর স্পন্দনহীন, ঢেউহীন একধরনের চেতনায় পরিণত হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা যদি বুদ্ধি বিক্রেতা হয়ে যান, পদক-পদবি, পদের খোঁজে নিজেদের ডুবিয়ে রাখেন তাহলে জাতির বিবেক তো দিকনির্দেশনার অভাবে মৃতপ্রায় নদীর মতো হয়ে যাবে। হয়েছেও তাই। ঝলমলে পথ হয়েছে, প্রাসাদোপম বাড়ি হয়েছে কিছু মানুষের। দেশে-বিদেশে অর্থ-বিত্তের কোন অভাব নেই, তবে বিবেক-বিবেচনা মৃতবত।

পরিপূর্ণ হতাশ হওয়ার কিছু নেই, আমাদের খেটেখাওয়া মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের নীতি-নৈতিকতা দেশপ্রেমের কোন অভাব নেই। অধিকাংশ মানুষের মনের ভেতরের পাখি যখন একসাথে ডেকে ওঠবে তখন আবার নদীতে জোয়ার আসবে, খড়কুটো যারা আমদের এ অসাধারণ সুন্দর দেশটিকে এগিয়ে যেতে বাধার সৃষ্টি করছে তারাও স্রোতের তোড়ে ভেসে যাবে। আমরা আশাবাদী। আমরা বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম; দেশের সকল মানুষকে সমতালে, সমলয়ে, সমপদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

শেখর ভট্টাচার্য

image

এই সুবর্ণ পলির দেশে কৃষক-শ্রমিকেরা আমাদের অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে দেয়নি

সোমবার, ০১ এপ্রিল ২০২৪

‘প্রতিটি লেখকের হৃদয়ে ভেতরে একটি কলম থাকে, অথবা তার হৃদয় যেন কলমÑ সেই কলমটি লিখে যায় অবিরাম। ‘হৃদয়’ বলতে আমরা বুকের বাঁ দিকটা দেখিয়ে থাকি, সেই বাঁ দিকে আছে হৃৎপি- যার কাজ দূষিত রক্তকে শোধন করে সমস্ত শরীরে পাঠানো।...হৃদয়ের ভেতরে যে কলমের অস্তিত্ব আমি অনুভব করি, সেই কলম আসলে আমাদের রক্তের অন্তর্গত একটি কলম, অথবা রক্তই সেই কলম। রক্ত যে কথা কয় তা কৃত্রিম কিংবা অসত্য হতে পারে না।’

সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত ‘হৃৎকলমের টানে’ যখন সংকলিত হয়ে বই আকারে বের হয় ১৯৯০ সালে। তখন সৈয়দ হক প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় হৃদয় হরণ করা এই কথাগুলো লিখেছিলেন। আমি ক্ষুদ্র মানুষ তার থেকেও ক্ষুদ্র একজন লেখক। সৈয়দ শামসুল হকের সাথে আমার পরিচয় ছিলো না, তার সাথে দেখা হয়েছিলো একবার যশোরের একটি হোটেলে। দুই হাজার সাতের কোন এক শীতের বিকালে। এই দেখাকে পরিচয় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না।

যশোর শহরের ১৫ নম্বর কেশবলাল সড়কের হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনালের লবিতে আমি তাকে থামিয়েছিলাম। তিনি দোতালা থেকে নিচে নামছিলেন। আমি বিনয়ের সাথে তার সাথে কথা বলতে চাই। তিনি থামেন এবং আমার সাথে মিনিট পনেরো কথাও বললেন। এতো সাহস কোথায় সঞ্চয় করে রেখেছিলাম? ভাবলে অবাক হই এখন। আমার নিজের লেখালেখিতে দাড়ি বা ফুলস্টপ টেনেছি। আমি যে কোন এক সময় শৈশব, কৈশোর, প্রাক-যৌবনে কিছু কিছু লেখার চেষ্টা করতাম, সে কথা বলার সাহস হয়নি।

হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বিস্ময় নিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, নন্দনতত্ত্ব নিয়ে কোন কথা আসে না মস্তকে। সৈয়দ হকের সাথে কথা হয়েছিলো, তার লেখা উপন্যাস ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীরা’ এবং সংবাদে প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত ‘হৃৎকলমের টানে’ নিয়ে। তাকে কেমন করে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসি, ‘সেই পাখির ডাক কী এখনও শুনতে পান?’ তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সেই পাখির ডাক আমৃত্যু শুনে যাবো।’ কোন পাখির ডাক?

‘হৃৎকলমের টানের’ কোন এক সপ্তাহে সৈয়দ হক তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় কী অসাধারণ কথা লিখেছিলেন। মানুষের হয়ে, প্রকৃতির হয়ে, বিবেকের হয়ে একটি পাখি তাকে ডেকে যায় নিয়ত। ক্রমাগত বলে যায়, ‘শুনছো? শুনছো? শুনছো?’, এই কথাটির উপস্থাপনা এতো শক্তিশালী ও হৃদয়েরতন্ত্রীতে ডাক পাঠানোর মতো ছিলো যে, যারা লেখাটি পড়েছেন তারাও সে ডাক যেনো শুনতে পেতেন। ১৯৮৬ সালে তিনি শুরু করেন তার এই বিখ্যাত কলাম। অবরুদ্ধ দেশে তিনি প্রতীকীভাবে মানুষকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছিলেন। হোটেলের লবিতে তিনি বলেছিলেন ‘জেগে ওঠার ডাক যে লেখক সারা জীবন শুনতে পাবে না, তার সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।’

বয়ে চলা মহাকালের ঘড়িতে পনেরো মিনিট খুব কম সময়। সেই সময়ে যদি সৈয়দ হকের মতো মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় তাহলে সময়টি প্রকৃত অর্থে হিরণ¥য় হয়ে ওঠে। তাকে কিছুই বলতে পারিনি, তার লেখার প্রতি মুগ্ধতা, প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা এসব কথা কিছুই বলা হয়নি। তার পরেও তার জেগে ওঠার ডাক আমি শুনতে পাই। আমার একটি বিশ্বাসের কথা তার সাথে আলোচনা করলে আমি তৃপ্তি পেতাম। কথাটি হলো, প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের হৃদয়ে একটি নিস্পাপ এবং কৌতূহলী শিশু বাস করে। সে শিশু সারাদিন লেখককে অবিরত প্রশ্ন করে যায়। সে প্রশ্ন যদি লেখক শুনতে না পান, স্থবিরতা তাকে পেয়ে বসবে। লেখকের শব্দের ব্যবহার, রূপকল্প, কাব্যময়তা সব কিছু এক ঘেয়ে হয়ে যাবে। তিনি সারা জীবন একই কথা লিখে লিখে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। চিন্তার বৈচিত্র্য হারিয়ে সর্বহারা লেখকে পরিণত হবেন। মনের ভেতরে শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়। সে কাজে ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত লেখক সত্তার মৃত্যু হয়। আমার এ বিশ্বাস কী সত্যি? সৈয়দ হকের সাথে যদি অন্য কোথায়, অন্য কোন খানে কিংবা মেঘের ভেলায় আকাশে দেখা হয়ে যায়,তাহলে তাকে সে প্রশ্ন করা হবে। মনে হয় ‘জেগে ওঠার ডাক দেয়া’ পাখি আর বুকের ভেতরে বসত করা শিশু আসলে এক ও অভিন্ন। এক একজনের এক একরকম উপলব্ধি। আমি জানি না, আমি জানি না! আমি যা বললাম তা কি সত্যি। সত্যি মিথ্যা, মিথ্যা সত্যি। উপলব্ধির কী সত্যি মিথ্যা আছে, তাও বলা বড় কঠিন।

তবে একটি বিষয়ে মনে হয় সকলেই ঐকমত্য পোষণ করবেন তাহলোÑ মানবিক মানুষের মনের ভেতরে একটি অদৃশ্য বিবেকের বসতি আছে। বিবেক শক্তিশালী হয় কখনো কখনো জ্ঞান দিয়ে। জ্ঞান সিক্ত বিবেকের সাথে যুক্তি ও ইতিবাচক আবেগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়ে যায়। বিবেক যখন শক্তিশালী হয় বিবেচনা বোধ তখন প্রখর হয়ে যায়। বিবেক আর বিবেচনা কিন্তু সমার্থক শব্দ নয়। সংবেদনশীল বিবেক থেকে বিবেচনার জন্ম হয়। এরকম বিবেচনা সবসময় ইতিবাচক হতে বাধ্য। বিবেককে জাগ্রত করতে হলে এর পরিচর্যা করতে হয়। আর একটি কথা বলা যায়, শুধু মাত্র জ্ঞান দ্বারাই বিবেককে পরিপুষ্ট করা যায়না। যদিও এই লেখাটিতে একবার জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে তারপরও ‘ভালোবাসা’ বিবেক বিকাশের আর একটি শক্তিশালী উপাদান। তাই শক্তিশালী বিবেকের বসতি সকল শ্রেণীর মানুষের হৃদয়ে থাকতে পারে। ওই যে বিবেকবোধ থেকে জাগ্রত বিবেচনা, এর থেকেই সকল শ্রেণীর মানুষ একাত্তরে আধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের হাতিয়ার কী ছিলো? দেশপ্রেম অবশ্যই। জনতা জেগে ওঠে কথাটির অর্থ হলো বিবেকবোধ তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়। জনতা যখন জেগে উঠে তখন নিবেদন হয় সর্বোচ্চ মাত্রায়। মাতৃভূমি রক্ষায় পিপীলিকার মতো অগ্নি স্ফুলিঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে কুণ্ঠাবোধ করে না। ভয়াবহ মারণাস্ত্র তখন তাদের কাছে খেলনা হয়ে যায়। জনতার জেগে ওঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে ভিয়েতনামে, চীন, মার্কিন বলয়ের নিষ্ঠুর রাষ্ট্র নেতারা দেখেছেন একাত্তর সালে বাংলাদেশে। আর পাকিস্তান বাহিনী লাঠি এবং সামান্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে বাঙালির সাহস দেখে বিস্মিত হয়েছে, আর বিস্মিত হয়েছে সমগ্র বিশ্ব। ওই যে কালজয়ী সেই সঙ্গীতের মতোÑ ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।’

সৈয়দ শামসুল হককে পাখি নিয়ত ডেকে যেতো, মানুষের হয়ে, প্রকৃতির হয়ে, বিবেকের হয়ে ক্রমাগত বলে যেতো- ‘শুনছো? শুনছো? শুনছো?’, সেই পাখি এখন আর আমাদের কোনভাবেই ডাক দিয়ে যায় না। পাখির ডাকে বিবেক জেগে ওঠে না তাই আমাদের বিবেচনা বোধের অস্তিত্ব কখনো কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। পাখির ডাক শুধু শুনতে পায় ক্ষেতমজুর, পোশাক শ্রমিক, গভীর সমুদ্রে যারা জীবনবাজি রেখে মাছ ধরতে যায় সেসব মানুষেরা, যাদের পুঁজি শুধু দেহ, তাদের বিবেকবোধই শুধু জাগ্রত আছে। ওই যে এতো বড় করোনা মহামারি গেলো বাজারে কখনো খাদ্যদ্রব্যের জোগান কম হয়েছে? সারা বিশ্বের মানুষ কতোটুকু হাহাকার করেছে জানি না, তবে এই সুবর্ণ পলির দেশে কৃষক-শ্রমিকেরা আমাদের অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে দেননি, তবে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা তখনো টাকা পাচার করেছে। বিশ টাকার বালিশ বিশ হাজার টাকায় কিনেছে, বিক্রি করেছে। করোনার টিকা জালিয়াতি করেছে। লুন্ঠন থেমে থাকেনি, এখনও থেমে নেই। পাখি আর মানুষের বিবেককে জেগে তুলে না। মনের ভেতরের নিষ্পাপ শিশু প্রশ্ন করে না। সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, মানুষে মানুষে বৈষম্য এসব বিষয় নিয়ে এখন আর কেউ রাজপথে কথা বলে না। ভয়াবহ এক নীরবতার সংস্কৃতি আমাদের ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে।

এক সময়ের তেরোশত নদীতে ঘেরা বাংলাদেশের নদীগুলো যেমন দখল হয়ে যাচ্ছে, অচেতন হয়ে যাচ্ছে প্রায়, জাতির অন্তরের গহীনে থাকা দেশপ্রেমও ঠিক সেভাবে চৈত্র মাসে খরা-পীড়িত নদীর স্পন্দনহীন, ঢেউহীন একধরনের চেতনায় পরিণত হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা যদি বুদ্ধি বিক্রেতা হয়ে যান, পদক-পদবি, পদের খোঁজে নিজেদের ডুবিয়ে রাখেন তাহলে জাতির বিবেক তো দিকনির্দেশনার অভাবে মৃতপ্রায় নদীর মতো হয়ে যাবে। হয়েছেও তাই। ঝলমলে পথ হয়েছে, প্রাসাদোপম বাড়ি হয়েছে কিছু মানুষের। দেশে-বিদেশে অর্থ-বিত্তের কোন অভাব নেই, তবে বিবেক-বিবেচনা মৃতবত।

পরিপূর্ণ হতাশ হওয়ার কিছু নেই, আমাদের খেটেখাওয়া মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের নীতি-নৈতিকতা দেশপ্রেমের কোন অভাব নেই। অধিকাংশ মানুষের মনের ভেতরের পাখি যখন একসাথে ডেকে ওঠবে তখন আবার নদীতে জোয়ার আসবে, খড়কুটো যারা আমদের এ অসাধারণ সুন্দর দেশটিকে এগিয়ে যেতে বাধার সৃষ্টি করছে তারাও স্রোতের তোড়ে ভেসে যাবে। আমরা আশাবাদী। আমরা বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম; দেশের সকল মানুষকে সমতালে, সমলয়ে, সমপদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top